ভালোবাসি তারে পর্ব-১৭

0
6193

ভালোবাসি তারে

১৭.
অনবরত দুকদুক করতে থাকা হৃদপিন্ড নিয়ে এক পা, এক পা করে নিধার পিছু পিছু এগোচ্ছে ঝুম। নিঝুমকে দেখতে পাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষায় শেষ হয়ে যাচ্ছে সে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি নিঝুমের মুখোমুখি হয়ে চমকে যাবে। কিন্তু আফসোস! ড্রইংরুমে নিঝুম বাদে প্রায় সবাই-ই ছিলেন। এমন কি করিম চাচাও। সম্ভবত মেঘলা এবং আকাশের বিয়ে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। ঝুমকে দেখে সবাই থেমে গেলেন। ডান পাশে বসে থাকা একজন মহিলা বেশ সূক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলেন ঝুমকে। হঠাৎ-ই বলে উঠলেন,
— “এটা কে সানজিদা?”

মিসেস সানজিদা দ্রুত বললেন,
— “ও ঝুম। নিধার টিউটর। আর ঝুম? উনি হচ্ছেন নিধার ছোট ফুফি।”
মহিলার চাহনিতে ঝুমের অস্বস্তি হচ্ছে প্রচুর। কোনোমতে হালকা হেসে সালাম দিলো নিধার ফুফিকে। মনোয়ারা শেখ সালামের উত্তর বেশ শক্ত গলায় দিলেন। ঝুম আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না সেখানে। নিধাকে নিয়ে উপরে চলে গেল।

নিধা আগে আগে দৌঁড়ে চলে যায় পড়ার রুমে। ঝুম আস্তে,ধীরে হাঁটছে। নিঝুমের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো ঝুম। মনে সাহস সঞ্চয় করে দু,তিনবার নক করলো দরজায়। ওপাশ থেকে সারাশব্দ এলো না কোনো। তবে কি নিঝুম রুমে নেই? ভাবতেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠল তার। মৃদু ভাবে দরজা ধাক্কা দিতেই দরজা হালকা খুলে গেল। ঝুম উঁকি দিয়ে রুমের ভেতর ঝাঁকলো। সম্পূর্ণ রুম খালি। বারান্দার দিকে উঁকি দিবে তার আগেই বাথরুমের দরজা খোলার আওয়াজ এলো কানে। মাথা মুছতে মুছতে বাথরুম থেকে বেড়িয়ে আসছে নিঝুম। থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট পড়লেও, উদম শরীর তার। ঝুম থমকে যায়। চোখ আপনা-আপনি বড় হয়ে যায় তার। দ্রুত দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়। বুকে হাত দিয়ে জোড়ে জোড়ে নিশ্বাস নেয়। এ কেমন অনুভূতি? অসহনীয়। আরেকবার দরজার দিকে তাকিয়ে দ্রুত পড়ার রুমের দিকে এগিয়ে যায় ঝুম।

______________________________

নিধার পড়ার রুমের দরজা হাঠ করে খোলা। নিঝুম দরজার ফাঁক দিয়ে ঝুম আর নিধাকে দেখছে। ঝুম বেশ সহজভাবে নিধাকে অংক বুঝিয়ে দিচ্ছে আর নিধাও বুঝে নিচ্ছে সেটা। নিঝুম একটু কেঁশে দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে পরল। আওয়াজ শুনে ঝুম আর নিধা দু’জনেই তাকাল দরজার দিকে। নিঝুমকে দেখে একটু আগের ঘটনা মনে পড়ে গেল ঝুমের। লজ্জায় মাথা নত করে ফেলল সে। নিধা প্রশ্ন করল,
— “কিছু কি দরকার ভাইয়ু? এখানে এসেছো যে?”

নিঝুম নিজেও জানে না সে কেন এসেছে। তবে আসতে ইচ্ছে করছিল তার। আমতা আমতা করে নিঝুম বলল,
— “ত-তোর পড়া দেখতে এসেছিলাম। কি পড়ছিস?”
— “অংক করছি।”
— “ওহ্!”

নিঝুম চুপ হয়ে গেল। কথা খুঁজে পাচ্ছে না সে। লজ্জা, সংশয় ভুলে ঝুমও এবার নিঝুমের দিকে তাকালো। ঝুম বুঝতে পারছে না, নিঝুম এখানে কেন এসেছে? আগে তো কখনো আসে নি। তবে ভালোই হয়েছে। অনেকদিন পর নিঝুমকে সামনা সামনি দেখতে পারছে ঝুম। এতটুকুই তার জন্য যথেষ্ট!

অদ্ভুদ ভাবে নিঝুমের এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না। থাকতে ভালো লাগছে। নিঝুম কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে কথা গুঁজিয়ে নিলো। তারপর বলল,
— “নিধা? তোকে একটা বই রাখতে দিয়েছিলাম আমি। সেটা কোথায়?”
নিধা বলল,
— “আমার ব্যাগে আছে ভাইয়ু। দাঁড়াও দিচ্ছি।”

নিধা ব্যাগ থেকে বই বের করতে লাগলো। ঝুম ঠোঁট কামড়ে নিধার খাতার দিকে তাকিয়ে আছে। নিঝুমের স্থির দৃষ্টি ঝুমের দিকেই। তবে সেটা ঝুমের অগোচড়ে।

নিধা বই বের করে এগিয়ে দিলো নিঝুমের দিকে। নিঝুম বই হাতে নেওয়ার পরমুহুর্তেই কোত্থেকে স্নিগ্ধ,স্নিধা আর স্নেহা এসে হাজির হলো পড়ার রুমে। স্নিগ্ধ এসেই নিঝুমের কাঁধে হাত রেখে বলল,
— “আমরা তোকে সারা দুনিয়া খুঁজে বেড়াচ্ছি আর তুই এখানে? কি করছিস এখানে?”

নিঝুম শান্ত মেজাজে শীতল গলায় বলল,
— “বই নিতে এসেছিলাম।”
স্নিধা বলল,
— “ওহ্! নিয়েছো? নিলে চলো এখন। আমাদের সাথে গল্প করবে।”
স্নেহা বলল,
— “তুমিও চলো ঝুম। মজা হবে।”

নিঝুম জবাবের আশায় ঝুমের দিকে তাকালো। তার মনে হচ্ছে, কিছু একটা ভালো হচ্ছে না। মনে প্রাণে চাইছে, ঝুম যেন মানা করে দেয়। সবার আগ্রহের অপেক্ষা কমিয়ে ঝুম বিনয়ের সঙ্গে হেসে বলল,

— “আপু, মাইন্ড করবেন না প্লীজ। এটা আমার টিউশন টাইম। এ সময় নিধাকে না পড়িয়ে অন্যকিছুতে সময় নষ্ট করা ঠিক মানাবে না। তাই আমি.. আমি অন্যকোনো সময় আপনাদের সঙ্গে গল্প করব।”

নিঝুমের মুখে অস্পষ্ট হাসির রেখা ফুটে উঠল। মনে মনে ভীষণ খুশি হলো সে। স্নেহা মন খারাপ করল একটু। তবুও হাসি মুখে বলল,
— “আচ্ছা, ঠিকাছে। কিন্তু প্লীজ, আপু বলে আমাকে বুড়ি বানিয়ে দিও না। স্নেহা নামটা তো সুন্দর তাই না?”

স্নেহা এমন ভাবে কথাটা বলল যে ঝুম হেসে দিল। স্নিগ্ধ এবার বলল,
— “এখন যেহেতু তুমি ফ্রি না, নিধাকে পড়ানোর পর আমাদের সঙ্গে আড্ডা দাও। এতে তো কোনো আপত্তি নেই নিশ্চয়ই?”

ঝুম আমতা আমতা করতে থাকে। একবার ভাবে, হ্যাঁ বলে দিবে। তাহলে নিঝুমের সঙ্গে কিছু অতিরিক্ত সময় কাটাতে পারবে সে। ‘হ্যাঁ’ বলার জন্য মুখ খুলবে, তখনই নিঝুমের শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠ শোনা গেল,
— “ওর সময় নেই স্নিগ্ধ। নিধাকে পড়ানোর পর তোদের সাথে গল্প করতে গেলে রাত হয়ে যাবে। আর ঝুম রাত-বিরেতে কারো বাসায় থাকে না।”

সম্পূর্ণ কথাটা ঝুমের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল নিঝুম। ঝুম একরাশ বিস্ময় নিয়ে তাকালো। নিঝুমের হঠাৎ কি হলো? এমনভাবে কথা বলছে কেন? ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে স্নিগ্ধ বলল,
— “এটা কেমন কথা? একটু রাত হলে তো সমস্যা নেই। তাছাড়া আমাদের গাড়ি দিয়েও তো ঝুমকে পৌঁছে দেওয়া যাবে, তাই না? ইনফেক্ট আমি নিজে পৌঁছে দিবো।”

স্নিগ্ধর সাথে তাল মিলিয়ে স্নিধা বলল,
— “হ্যাঁ ভাই। আর ঝুম যদি নিধাকে একটু পড়িয়ে ছুটি দিয়ে দেয়, তাহলে তো সন্ধ্যা হওয়ার পরই এখান থেকে ওর বাসায় যেতে পারবে। ব্যাস! সমস্যা শেষ!”

নিঝুম কিছু বলল না। চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। আপাতত কিছু ভালো লাগছে না তার। স্নিগ্ধ প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করল,
— “ঝুম? তুমি কি চাও?”

আচমকা প্রশ্নে ঝুম হকচকিয়ে যায়। কি বলবে ভেবে পায় না। পরক্ষণেই নিঝুমের দিকে তাকায়। নিঝুমের গম্ভীর মুখখানায় কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। ভাবে, নিঝুম যেহেতু চায় না সে এখানে থাকুক, সেহেতু না থাকাটাই শ্রেয় হবে। এদিকে স্নিগ্ধ তাকিয়ে আছে ঝুমের দিকে। অনেকটা অস্বস্তি নিয়ে ঝুম বলল,
— “আমার আসলে বাসায় একটু কাজ ছিল ভাইয়া। আমি বরং কাল তাড়াতাড়ি আসব। তখন গল্প করব।”

নিঝুম এটাই শুনতে চেয়েছিল যেন। এ মুহুর্তে আর এখানে থাকার প্রয়োজন নেই তার। সুতরাং, কিছু না বলে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ল নিঝুম। হুটহাট নিজের অদ্ভুদ আচরণে নিজেই অবাক হয় নিঝুম। হঠাৎ রেগে যাওয়া, পরক্ষণেই শান্ত হয়ে যাওয়া, সব কিছু কেমন ঘোলাটে তার কাছে। প্রবলভাবে অস্পষ্ট!

_______________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা