ভালোবাসি তারে পর্ব-১৯

0
5930

ভালোবাসি তারে

১৯.
দুপুর হবে প্রায়। সবাই মিলে এখন বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে। গাড়ির পেছনের সীটে পাশাপাশি বসেছে নিঝুম আর ঝুম। ড্রাইভিং সীটে বসে আছে স্নিগ্ধ। সবাই বারবার তাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। হাসার কারণও আছে। ঝুমের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে নিঝুম। প্রায় ১৫মিনিট হলো। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে সে। হয়তো গভীর ঘুমে আছে। অথচ, জাগ্রত ঝুমকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছে নিঝুম। অতিরিক্ত লজ্জায় ঝুম মাথা উঁচু করতে পারছে না। আস্তে আস্তে অনুভব করতে পারে, তার গাল দু’টো ভারি ভারি লাগছে। লজ্জা পাওয়ার কারণে কি? তপ্ত নিশ্বাস ফেলল ঝুম। অস্বস্তিতে ঠোঁট কামড়ে রাখলো।

ঝুমের গলির সামনে এসে থামলো গাড়ি। দুপুর হওয়ায় এলাকাটা যথেষ্ট নির্জন। নিঝুম তখনো ঝুমের কাঁধে ঘুমিয়ে। স্নিধা এবার মজা নিয়ে বলল,
— “আর কত ঘুমাবে নিঝুম ভাইয়া? ঝুম আপু? এবার তো উঠাও ভাইয়াকে!”

তীব্র অস্বস্তিতে ঝুম কিছু বলতে পারছে না। এদিকে স্নিধার কথায় সায় দিয়ে সবাই প্রায় চিৎকার করা শুরু করে দিয়েছে। চেঁচামেচি শুনে নিঝুমের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আশ্চর্যের বিষয়, ঝুমের কাঁধে নিজেকে ঘুমন্ত অবস্থায় অবিষ্কার করে নিঝুম চমকায় না। বরং স্বাভাবিক ভাবে ঠিক হয়ে বসে। ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ থম মেরে তাকিয়ে থাকে ঝুমের পানে। পরপরই এক ধমকে চুপ করিয়ে দেয় স্নেহা, স্নিগ্ধ আর স্নিধাকে। ঝুম স্বল্প কেঁপে উঠে ধমক শুনে। আমতা আমতা করে বলে,
— “আমি তাহলে এখন আসি?”

নিঝুম ফের তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ঝুমের দিকে তাক করে। তবে ক্ষণিকের জন্য। ধীরে ধীরে নিঝুমের দৃষ্টি শান্ত হয়ে আসে। শান্ত গলায় বলে,
— “আজকে নিধাকে পড়ানোর প্রয়োজন নেই ঝুম। দেখে মনে হচ্ছে টায়ার্ড তুমি। রেস্ট নাও।”

ঝুম হালকা মাথা নাড়ায়। গরমে সত্যি-ই নাজেহাল অবস্থা তার। নিঝুমের দিকে একপলক তাকিয়ে ঝুম বেড়িয়ে যায় গাড়ি থেকে। ধীর পায়ে গলির ভেতর প্রবেশ করতে শুরু করে। যতই ভেতরে যাচ্ছে, ততই বুকের দুকদুক শব্দ বেড়ে যাচ্ছে ঝুমের। মন চাইছে, আরেকবার পেছন ফিরে নিঝুমকে দেখতে। কিন্তু লজ্জায় পারছে না। যদি নিঝুম বা অন্য কেউ কিছু মনে করে? অথচ ঝুম জানেই না নিঝুম তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছে এই আশায়, যদি ঝুম একবার হলেও পেছনে ফিরে তাকায়। ক্ষণিকের জন্য হলেও!

বহু কষ্টে নিজের লজ্জা কাটিয়ে ধীরে ধীরে পেছনে ফিরে তাকায় ঝুম। অনেকটা দূরে হওয়ায় গাড়ির ভেতরের কিছু দেখতে পারছে না ঝুম। যদি দেখতো, তাহলে হয়তো নিঝুমের হাসি মাখা মুখ চোখে পরতো তার। যা তীব্র ভাবে আকর্ষিত করত তাকে। মনে শান্তি বয়ে আনতো নিমিষেই!

______________________________

বিশাল বড় ছাদের এক কোণে রেলিং এর উপর বসে আছে নিঝুম। নিস্তব্ধ রাতে খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতে নিঝুমের বেশ ভালো লাগে। তার সঙ্গে একটা সিগারেট হলে তো কথা-ই নেই। কিন্তু সিগারেট আনতে ভুলে গেছে নিঝুম। সুতরাং, নিজ মনে গুনগুন করে ছন্দ মিলাচ্ছে সে। সময়টা উপভোগ করছে।

হঠাৎ ছাদের দরজা খোলার কর্কশ কণ্ঠ কানে এলো তার। দরজা ঠেলে ছাদে প্রবেশ করছে স্নিগ্ধ। নিঝুম সেদিকে একপলক তাকায়। পরক্ষণেই দৃষ্টি আগের জায়গায় স্থির করে। স্নিগ্ধ নিঝুমের পাশে এসে দাঁড়ায়। ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “এত রাতে এখানে কি করছিস?”

নিঝুম নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দেয়,
— “আমারো তো একই প্রশ্ন। তুই এখানে কেন?”
স্নিগ্ধ থতমত খেয়ে যায়। দ্রুত বলে,
— “আমি তো তোর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।”
— “ওহ্!”

কথার উল্টো পিঠে আর কিছু বলে না স্নিগ্ধ। নিঃশব্দে নিঝুমের পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। মিনিক দশেক পর হঠাৎ নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “ভালোলাগা আর ভালোবাসা তো এক না, তাই না স্নিগ্ধ?”

স্নিগ্ধ সন্দিহান চোখে তাকায়। কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করে না।
— “হ্যাঁ। এক না।”
তারপর আবারো নিরবতা।

আকাশের পানে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে নিঝুম। স্নিগ্ধ ডাকতেই বিরক্ত হয়ে বলে,
— “ডিস্টার্ব করছিস কেন?”
— “তুই কি ঝুমকে ভালোবাসিস?”

স্নিগ্ধর এহেন কথায় চমকে যায় নিঝুম। পরক্ষণেই ভ্রু কুঞ্চিত করে বলে,
— “মানে?”

স্নিগ্ধ স্বাভাবিক ভাবে নিঝুমের কাঁধে হাত রেখে বলল,
— “আমার মনে হয় তুই ঝুমকে ভালোবাসিস।”
— “তোর এমন মনে হওয়ার কারণ?”
— “আমাদের সবারই কম বেশি এমন মনে হয়। তোর ঝুমের প্রতি যত্ন, শাসণ, ঝুমের দিকে তাকিয়ে থাকা, ঝুমকে দেখে হাসা, এসব দেখে যে কারোই মনে হবে তুই ঝুমকে ভালোবাসিস। তাছাড়া তুই-ই বল, তুই কি এখন ঝুমকে নিয়ে ভাবছিলি না?”

হ্যাঁ, নিঝুম ঝুমকে নিয়েই ভাবছিল। অদ্ভুদ ভাবে কি ভাবছিল সে নিজেও জানে না। শুধু ঝুমের কথা মনে পড়ছিল তার। তবে মুখে কিছু বলল না নিঝুম। স্নিগ্ধ নিজ থেকে বলা শুরু করল,
— “আমার মনে হয়, তুই ঝুমকে পছন্দ করিস, ভালোবাসিস। দেখ, আমারো তো গার্লফ্রেন্ড আছে। আমি বুঝি সেসব। তুই যখন ঝুমের দিকে তাকিয়ে থাকিস, আমি ঝুমের জন্য তোর চোখে ভালোবাসা দেখি। আফটার ওল, আমার ঝুমের সাথে কথা বলায়ও তোর প্রবলেম ছিল। জেলাসও হয়েছিলি। আর জেলাসিই কিন্তু ভালোবাসার প্রথম ধাপ!”

একটু থেমে স্নিগ্ধ আবার বলল,
— “আমি বলছি না যে, ঝুমকে তুই ভালোবাসিসই। আমি শুধু আমার যা মনে হয়েছে তা বলেছি। বাকিটা তুই বুঝবি। এখন আসি! গার্লফ্রেন্ডকে ফোন দিতে হবে।”

স্নিগ্ধ চলে যায়। নিঝুম নির্বাক বসে রয় মোটা আকারের রেলিংয়ের উপর। স্নিগ্ধর কথাগুলো গভীর ভাবে ভাবছে নিঝুম। ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। প্রায় সাথে সাথে ঝুমের চেহারা ভেসে উঠল নিঝুমের সামনে। মনে পড়ে গেল ঝুমের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্ত। নিঝুম অবাক হলো যেন। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করল,
— “আমি কি সত্যি ঝুমকে ভালোবাসি?”

নিঝুমের ভেতরের সত্ত্বা যেন নিঝুমকে বলছে,
— “তুই ঝুমকে ভালোবাসিস নিঝুম। শুধু বুঝতে পারছিস না।”
নিঝুম কি যেন চিন্তা করে। তারপর আনমনেই হেসে উঠে ঝুমের কথা ভেবে।

______________________________

ঝুমের শরীরটা আজকে প্রচুর খারাপ। হালকা জ্বর জ্বর লাগছে। তবুও সেসব পাত্তা দিলো না সে। কয়েকদিন পর নিধার পরীক্ষা। এসময় না যাওয়াটা ঠিক মানায় না। সুতরাং, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে জমিদার বাড়ি পৌঁছে যায় ঝুম। জ্বরের দরুণ সামান্য রোদও ঝুমের কাছে অতিরিক্ত মনে হচ্ছে। সদর দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে যায় ঝুম। ব্যাগ থেকে ছোট্ট পানির বোতল বের করে অর্ধেক পানি পান করে ফেলে নিমিষেই। তাও যেন পিপাসা মিটছে না তার। বোতলের ঢাকনা লাগাতে লাগাতে ভেতরে প্রবেশ করল ঝুম৷ মিসেস সানজিদা এবং মনোয়ারা সোফায় বসে ছিলেন। তাদের সঙ্গে স্নিগ্ধ, স্নেহা আর স্নিধাও ছিল। গল্প করছিল তারা। ঝুম সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করল। কয়েকবার আশেপাশে তাকিয়ে নিঝুমকে খোঁজার চেষ্টা করল সে। না পেয়ে, আবারো আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। স্নিগ্ধ ব্যাপারটা দেখতে পেলো। সে মুচকি হেসে ঝুমকে শুনিয়ে শুনিতে স্নিধাকে বলল,
— “বুঝছিস স্নিধা? আজকে নিঝুম হস্পিটালে না গেলে ভালো হতো। কত মানুষ যে তার দেখা পেতে চায়, কিন্তু নিঝুম তো ধরাই দেয় না।”

ঝুম চোখ বড় বড় করে তাকাল। স্নিগ্ধ যে তাকে উদ্দেশ্য করে এসব বলছে তা বুঝতে বাকি নেই তার। তবে কি স্নিগ্ধ জেনে গেছে ঝুম নিঝুমকে পছন্দ করে? হাত, পা কেঁপে কেঁপে উঠে ঝুমের। এদিক-ওদিক তাকাতে শুরু করে। মিসেস সানজিদা এবার ভ্রু কুঁচকে বলেন,
— “নিঝুম ধরা দেয় না মানে? এসব কি বলছিস?”
স্নিগ্ধ দাঁত বের করে হাসে। বলে,
— “কিছু না। তুমি তোমার কাজ করো।”
ঝুম আর দাঁড়ায় না সেখানে। সবাই কেমন যেন তাকে দেখে হাসছে। ভালো লাগছে না ঝুমের। দ্রুত পড়িয়ে এখান থেকে চলে গেলেই বাঁচে ঝুম।

আজকে হাসপাতাল থেকে একটু আগে আগেই ছুটি নিয়েছে নিঝুম। কিন্তু তবুও জমিদার বাড়ি আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেছে তার। গাড়ি পার্ক করে উঠানের দিকটায় যাচ্ছিল, হঠাৎ ঝুমের দেখা পায়। তার থেকে একটু দুরুত্বে মাটির দিকে নজর রেখে সমানে হেঁটে চলছে ঝুম। নিঝুম ডেকে উঠে,
— “ঝুমময় পিচ্চি? চলে যাচ্ছো?”

ঝুম চমকে যায়। মাথা তুলে নিঝুমকে দেখতে পেয়ে দূর্বল হাসে। ভাঙ্গা গলায় বলে,
— “কেমন আছেন ডাক্তার?”
নিঝুম উত্তর দেয় না। প্রশ্ন করে,
— “তুমি কি অসুস্থ?”

ঝুম মাথা নাড়িয়ে না জানায়। তবুও যেন বিশ্বাস হয় না নিঝুমের। কয়েক কদম এগিয়ে ঝুমের কপালে হাতের পিঠ আলতো ভাবে রাখে নিঝুম। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবে। ভ্রু কুঁচকে বলে,
— “তোমার তো জ্বর। আজকে এসেছ কেন?”
বলতে বলতেই হাত সরিয়ে নেয় নিঝুম। জবাবের আশায় ঝুমের পানে তাকিয়ে থাকে। ঝুম চুপ করে আছে। মাথা ঘুরাচ্ছে তার। কোনোমতে স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করছে। শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট জিহ্বা নিয়ে ভিঁজিয়ে নেয় ঝুম। ধীর গলায় বলে,
— “নিধার পরীক্ষা শুরু হবে। এ কয়েকদিন গ্যাপ যাওয়ায় কিছু পড়া বাকি ছিল। তাই পড়াতে এসেছিলাম।”

নিঝুমের গম্ভীর কণ্ঠ,
— “তাই বলে জ্বর নিয়ে পড়াতে আসবে? আংকেল আন্টি তোমাকে আসতে দিয়েছে কেন? সুস্থ হওয়ার আগে আসবে না এখানে।”

ঝুম নিচু স্বরে বলে,
— “স-সরি ডাক্তার…”
বলা শেষ হতে না হতেই ঝুমের মাথা ঘুরিয়ে উঠে। চোখ ছাপসা হতে শুরু করে। দূর্বল শরীর নিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে ঝুম। নিঝুম আবার ডাকে,
— “ঝুম?”

আনমনেই উত্তর দেয় ঝুম,
— “হু?”
— “ড্রাইভার চাচা তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। যাও!”
ঝুম প্রতিউত্তর দেয় না। কথাও বলে না কোনো। চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। নিঝুম জোড় গলায় আবার বলে,
— “কি হয়েছে? যাও!”

নিঝুম হঠাৎ খেয়াল করে ঝুমের শরীর কাঁপছে। নিঝুম কিছু বলার আগেই নিঝুমের বুকের ডান পাশে, একদম কোণ ঘেঁষে ঢোলে পড়ে ঝুম। নিঝুমের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ঝুমের বাহু ধরে তাকে নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায়। তবুও যেন ঝুম ঢোলে পড়ছে নিঝুমের বুকে। নিঝুম ওভাবেই কয়েকবার ডাকে ঝুমকে। ঝুম নিশ্চুপ। হয়তো জ্বরের কারণে এমন হয়েছে। নিঝুমের ইচ্ছে করে ঝুমকে কয়েকটা বকা লাগিয়ে দিতে। কি দরকার ছিল এত জ্বর নিয়ে পড়াতে আসার? এমন অদ্ভুদ কেন মেয়েটা? নিঝুমের হঠাৎ কি যেন হয়। শক্ত করে ঝুমকে জড়িয়ে ধরে সে।

_________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা