ভালোবাসি তারে পর্ব-২০

0
5684

ভালোবাসি তারে

২০.
ঝুমকে কোলে নিয়ে সদর দরজা দিয়ে ঢুকছে নিঝুম। সবার অবাক দৃষ্টি আপাতত তাদের দিকেই। নিঝুম সেসবে ভ্রুক্ষেপ না করে মিসেস সানজিদাকে ডেকে বলল,
— “মা? পানি আনো জলদি। ঝুম সেন্সলেস হয়ে গেছে।”

মিসেস সানজিদা মাথা নাড়ালেন। পরপরই মেঘলাকে নিয়ে দ্রুত পানি আনতে চলে গেলেন। নিঝুম বেশ সতর্ক ভাবে সোফায় শুইয়ে দিলো ঝুমকে। স্নিগ্ধ জিজ্ঞেস করল,
— “কি হয়েছে ওর?”
— “জ্বরে সেন্সলেস হয়ে গেছে।”

স্নিগ্ধ কি ভেবে হেসে উঠল। প্রবল আগ্রহের সঙ্গে নিঝুমকে খোঁচা দিয়ে বলল,
— “উহুম, আমার তো সেটা মনে হচ্ছে না। আচ্ছা! এমন না তো? তুই ঝুমকে প্রপোজ করেছিস আর ঝুম সেটা বিশ্বাস না করতে পেরে সেন্সলেস হয়ে গেছে?”

স্নিধা চোখ বড় বড় করে বলল,
— “মানে? নিঝুম ভাইয়া কি ঝুম আপুকে পছন্দ করে? প্রপোজ করেছে? এটাও সম্ভব?”
স্নেহাও তাল মেলালো।
— “সত্যি তো নিঝুম। তলে তলে এতদূর ট্যাম্পু চালিয়েও ফেললি আর আমাদের একবার বললিও না? আমরা না তোর ভাই-বোন?”

নিঝুম বিরক্ত হলো। ‘চ’ বলে শব্দ করে উঠল। ভ্রু কুঁচকে বলল,
— “সমস্যা কি? ও সেন্সলেস হয়ে গেছে দেখতে পারছিস না? এমনিতেই চিন্তিত আমি, তারউপর তোরা… বিরক্তিকর!”

নিঝুমের কথায় ওদের বিশেষ কিছু যায় এসেছে বলে মনে হলো না। ওরা মুচকি মুচকি হাসছে শুধু। এরই মধ্যে মিসেস সানজিদাও পানি নিয়ে এলেন ড্রইংরুমে। নিঝুম ঝুমের মুখোমুখি ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসল। পানির গ্লাসটা নিয়ে খানিকটা পানি খাইয়ে দিতে চাইলো ঝুমকে। পরপরই পানির ছিঁটে দিলো ঝুমের সারামুখে। তবুও কোনো ভাবগতি ঘটলো না ঝুমের। নিশ্বাসও ধীরে ধীরে নিচ্ছে সে। তবে স্বাভাবিক ভাবে। নিঝুম জানে ঝুমের কিছু হবে না। তবুও উত্তেজিত হয়ে উঠছে। বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। মিসেস সানজিদা নিঝুমের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
— “ওর কি বেশি খারাপ অবস্থা?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু কণ্ঠে বলল নিঝুম,
— “ঠিক আছে ও।”
— “তাহলে ওকে বাসায় দিয়ে আয়। তুই দিয়ে আসবি? নাকি ড্রাইভারকে বলব?”
— “ও আজকে এখানে থাকতে পারে না মা? নিধার সাথে!”

সবাই অবাক হয়ে তাকালো। নিঝুম ঝুমকে এখানে থাকতে বলছে? এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? মিসেস সানজিদা বিস্ময় নিয়ে নিঝুমকে জিজ্ঞেস করলেন,
— “কি বললি?”
নিঝুমের এবার একটু অস্বস্তি হয়। তবুও গম্ভীর গলায় বলে,
— “ও আজকে এখানে থাকবে। তুমি মাস্টার আংকেলকে কল করে জানিয়ে দিও যেন চিন্তা না করে।”

আর কিছু বলার বা শোনার সুযোগ দিলো না নিঝুম। ঝুমকে আবারো কোলে তুলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো। মনোয়ারা শেখ নিচে নামছিলেন তখন। নিঝুম তিন, চার সিঁড়ি উপরে উঠতেই পথ রোধ করে দাঁড়ালেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন,
— “তুই এ মেয়েকে কোলে নিয়ে আছিস কেন? কি হয়েছে এর?”
— “জ্বরে সেন্সলেস হয়ে গেছে।”

মনোরোয়া শেখ বিরক্ত হলেন যেন। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
— “তো উপরে কোথায় নিচ্ছিস? বাসায় দিয়ে আয় আপদটাকে।”

নিঝুমের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। প্রতিউত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না আর। ঝুমকে নিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল উপরে। মনোয়ারা শেখ বুঝতে পারলেন না এমন আচরণের অর্থ। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন নিঝুমের যাওয়ার দিকে।

______________________________

ঝুমের যখন জ্ঞান ফিরে তখন রাত ১২টা হবে। চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারে না সে কোথায় আছে। পরক্ষণেই পাশ ফিরে নিধাকে দেখতেই ধরফরিয়ে উঠে বসে ঝুম। চোখ বড় বড় করে তাকায় নিধার দিকে। নিধা হেসে উঠে। বলে,
— “এভাবে তাকাচ্ছেন কেন ম্যাম? আপনাকে ভূতনি লাগছে।”

ঝুম হকচকিয়ে যান। দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে বলে,
— “আমি এখানে কেন? কয়টা বাজে?”
— “আপনি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলেন ম্যাম। তাই ভাইয়ু আপনাকে আমার রুমে দিয়ে গেছে। আর এখন ১২টা বাজে।”

ঝুম আর্তনাদ করে উঠে,
— “কি? ১২টা বাজে? তো-তোমরা আমাকে বাসায় নিয়ে যাও নি কেন? আল্লাহ্! আম্মু-আব্বু আমাকে মেরে ফেলবে আজকে।”

শুনে নিধা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। বলে,
— “চিন্তা নেই ম্যাম। আম্মু আপনার প্যারেন্স এর সাথে কথা বলেছে। উনারা জানে আপনি এখানে আছেন।”

ঝুম আশ্বস্ত হলো যেন। মনে হচ্ছে, বুক থেকে বিরাট বড় পাথর নেমে গেছে। ঝুম মাত্রই শান্ত হয়ে বসেছিল আর নিধা তখনই আবার বলে উঠে,
— “জানেন ম্যাম? ভাইয়ু আপনাকে সবার সামনে কোলে করে নিয়ে এসেছে এখানে।”
ঝুম চোখ বড় বড় করে তাকায়। নিধা হাসছে। ঝুমের হাত, পা কাঁপছে। অস্বস্তি হচ্ছে। নিধাকে ধমক দিয়ে উঠল ঝুম,
— “এত পাকনা কেন তুমি? কোথায় কি বলতে হয় জানো না? চুপচাপ ঘুমাও। কয়টা বাজে খেয়াল আছে?”

নিধা কিছু বলে না। হাসি বন্ধ করে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে ঝুমের দিকে। যেন সে কিছুই বুঝে নি ঝুমের কথা। ঝুমের অস্বস্তি আরো বেড়ে যায়। শরীর থেকে কাঁথা সরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায় রুম থেকে। রুম থেকে বের হয়েই ঝুম ভাবে, সে রুম থেকে বেরিয়েছে কেন? এখানে তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তার। পরক্ষণেই ভাবে, ছাদে যেতে পারে সে। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবে ভালো লাগছিল না তাই গিয়েছে। যেই ভাবা সেই কাজ! নিঃশব্দে ছাদে চলে গেল ঝুম। খোলা আকাশের নিচে, প্রাণখোলা বাতাসের মাঝে।

ছাদের এক প্রান্তে গিয়ে দাঁড়ায় ঝুম। হঠাৎ অন্য প্রান্ত থেকে কারো আওয়াজ ভেসে উঠে। ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে যায় সে। অবাক হয়! কেউ একজন রেলিংয়ে বসে আছে। ঝুম পেছন থেকে দেখে বুঝতে পারলো সেটা নিঝুম। সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে নিঝুম ছন্দ মিলাচ্ছে,

~ ‘প্রেয়সী?
চেনো কি আমায়? আমি কে জানো?
আমি তোমার নয়নে হারিয়ে যাওয়া এক পথিক।
তোমার কাজলে রাঙা চোখের গভীর প্রেমে পড়ে পাওয়া এক প্রেমিক।
তুমি জানো কি?
আমি তোমায় কেন ভালোবাসি?

কারণ, তোমায় কারণ ছাড়াই ভালোবাসি। অথচ সেই ভালোবাসার পরিমাণটুকু আমি নিজেও জানি না।

তুমি কি জানো?
তুমি আমার নিঝুম রাতের ঝুম বৃষ্টি!
আমার হৃপিন্ডে বেজে ওঠা প্রতিটা প্রতিধ্বনি।
আমার হৃপিন্ড কি বলে জানো?
আমি ভালোবাসি তারে। আমি ভালোবাসি তোমাকে।’

ঝুম ঢোক গিলে। নিঝুম কি অন্য কাউকে ভালোবাসে? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই ভেতরটা ‘ধক’ করে উঠে ঝুমের। কাঁদতে ইচ্ছে হয়। ঝুম মনে মনে ভাবে,
— “আমি কি আমার ডাক্তারের নিঝুম রাতের ঝুম বৃষ্টি হতে পারবো না? এমন কেন হয় আমার সাথে? যা চাই তা কেন পাই না?”

ঝুমের মন খারাপ হয়ে যায় নিমিষেই। চলে যেতে নিবে তখনই নিঝুম পেছন ফিরে তাকায়। ঝুমকে দেখেই মুখে হাসি ফুটে উঠে তার। অন্ধকারের মাঝে চাঁদের হালকা আলোয় নিঝুমের সৌন্দর্য যেন আরো বেড়ে গেছে। ঝুম ভুলে যায় মন খারাপের কথা। মুগ্ধ হয়ে তাকায় সেদিকে। নিঝুম সিগারেট ফেলে দেয়। ডেকে উঠে,
— “ঝুম?”

ঝুম চমকে উঠে। মাথা নত করে ফেলে তৎক্ষণাৎ। ছোট্ট করে জবাব দেয়,
— “হু?”
— “এদিকে আসো।”

ঝুম ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় নিঝুমের দিকে। নিঝুমের একটু দূরত্বে এসে দাঁড়ায়। নিঝুম বলে,
— “এখন কেমন লাগছে? জ্বর কমেছে?”
— “মোটামোটি।”

নিঝুম হালকা শাসনের সুরে বলে,
— “মোটামোটি হলে এসেছ কেন? ঠান্ডা বাতাসে তো আবারো জ্বর আসবে। যাও! রুমে যাও!”

ঝুম যায় না। নিচের দিকে তাকিয়ে রয়। নিঝুম প্রশ্ন করে,
— “যাবে না?”
ঝুম খেয়াল করে নিঝুম কেমন তার দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে কথা বলছে। ঝুমের লজ্জা লাগছে এতে। সেই লজ্জায় রাঙা মুখ নিঝুম তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। মনে মনে শতবার উচ্চারণ করে, ‘আমার লজ্জাবতী।’

হঠাৎ ঝুম অভিমান নিয়ে বলে উঠে,
— “আপনি আমাকে মিথ্যা কেন বলেছেন?”
নিঝুমের ডান ভ্রু উঁচিয়ে তাকায়। প্রশ্ন করে,
— “কি মিথ্যা বলেছি?”
— “এই যে, আমাকে বলেছিলেন আপনি কাউকে ভালোবাসেন না। অথচ..!”

বলতে বলতে চুপ হয়ে যায় ঝুম। নিঝুম বলে,
— “অথচ কি?”
— “আপনি কার জন্য ছন্দ বানাচ্ছিলেন?”
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ঝুমের কথার ব্যাখ্যা বুঝতে পেরে হঠাৎ-ই শব্দ করে হেসে উঠে। ঝুম মুগ্ধ হয়ে দেখে সে হাসি। আনমনে বলে উঠে,
— “আপনি এত সুন্দর কেন? জানেন? আপনার চোখ দু’টো আমার ভীষণ ভালো লাগে। মনে হয়, আপনার ঠোঁটের সঙ্গে সঙ্গে আপনার নীলচে চোখজোড়াও হাসছে।”
— “তাই?”

নিঝুমের প্রশ্নে ঝুম ভড়কে যায়। স্মরণ হয়, উত্তেজনায় উল্টাপাল্টা বলে ফেলেছে সে। ঠোঁট কামড়ে বার বার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে ঝুম। ভেবে পাচ্ছে না কি বলবে। ঝুমের এহেন অবস্থা দেখে নিঝুম হাসে। স্বাভাবিক হতে বলে,
— “কিছু খাও নি নিশ্চয়ই? চলো খাবে।”
— “খেতে ইচ্ছে করছে না।”
— “ত্যাড়ামো করছো কেন?”

ঝুম মিনমিনিয়ে বলে,
— “সত্যি খেতে ইচ্ছে করছে না।”
— “না খেলে তো আরো অসুস্থ হয়ে যাবে। অপেক্ষা করো। আমি আসছি।”
বলেই এক লাফে রেলিং থেকে নেমে পড়ে নিঝুম। কিছু মুহুর্তের জন্য ছাদ থেকে চলে যায় কোথাও। মিনিট দশেক পর হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে আবার আসে। ঝুম যেখানে ছিল, সেখানেই দাঁড়ানো। নিঝুমকে আসতে দেখে চলে যেতে নিলে নিঝুম বলল,
— “কোথায় যাচ্ছো? তোমার জন্য খাবার এনেছি তো আমি।”
— “হাত ধুঁতে যাচ্ছিলাম।”
— “লাগবে না। বেঞ্চে বসো। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

ঝুম চোখ বড় বড় করে তাকায়। এটা কি আসলেই নিঝুম? কয়েক সেকেন্ডের জন্য ভাবনায় বিভোর হয়ে যায় ঝুম। নিঝুম বলে উঠে,
— “এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
ঝুম খানিকটা তোতলিয়ে বলে,
— “ন-না, মানে, এমনি!”
নিঝুম মুচকি হেসে ঝুমের হাত ধরে বসিয়ে দিলো বেঞ্চে। এবং পরমুহুর্তেই খাইয়ে দিতে লাগলো ঝুমকে। ঝুমও বিনাবাক্যে খাবার চিবুচ্ছে। এক ধরণের ঘোরের মাঝে আছে সে। বুঝতে পারছে না কিছুই!

____________________

চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা