ভালোবাসি তারে
২১.
সকাল থেকেই ঝুমের মাথা ব্যথা করছে। হয়তো জ্বরের কারণে। রাতে নিঝুম এক পাতা প্যারাসিটামল দিয়েছিল তাকে। সেখান থেকে একটা ট্যাবলেট নিয়ে খেয়ে নিলো ঝুম। ঠিক তখনই হুড়মুড় করে রুমের ভেতর ঢুকল স্নিধা আর স্নেহা। ঝুম চমকে উঠল। বড় বড় চোখে ওদের দিকে তাকালো। স্নেহা ঝুমের কাছে এসে বলল,
— “তুমি এখনো কি করছ রুমে? চলো নাস্তা করবে।”
ঝুম ধীর গলায় বলল,
— “মাথা ব্যথা করছিলো একটু। তাই দেড়ি হলো। সরি!”
স্নিধা বলল,
— “এখন ঠিক আছো?”
— “হ্যাঁ। অনেকটাই।”
— “তাহলে চলো। সবাই অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”
ঝুম আর কিছু বলল না। স্নেহা আর স্নিধার পিছু পিছু ডাইনিংরুমে চলে গেলো।
সবাই আগে থেকেই ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছিল। ঝুম নিঝুমের সামনাসামনি একটা চেয়ারে বসল। মিসেস সানজিদা তখন জিজ্ঞেস করলেন,
— “এখন কেমন লাগছে? জ্বর কমেছে তোর?”
ঝুম মুচকি হেসে বলল,
— “জ্বী, আন্টি। এখন ঠিক আছি।”
বলেই ওমলেটের একটা টুকরো মুখে দিতে যাবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নিঝুমের প্রশ্ন,
— “প্যারাসিটামল খেয়েছিলে?”
ঝুম চমকে উঠে নিঝুমের দিকে তাকায়। হালকা আওয়াজে বলে,
— “জ্বী।”
— “ভালো, ভালো।”
ঝুম খেয়াল করে নিঝুম নিচের দিকে তাকিয়ে শুধু শুধুই হাসছে। নিঃশব্দে অথচ এমন ভাবে হাসছে যে ঝুমের চেয়েই থাকতে ইচ্ছে করছে। ঝুম বড় একটা নিশ্বাস ফেলল। সে দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছে। নিঝুমকে নিয়ে মস্তিষ্কে কেমন কেমন চিন্তা আসে তার। একদম হাঁড় কাঁপানো! সারাদিন নিঝুমের ভাবনায় মগ্ন থাকতে ইচ্ছে করে। এ মারাত্ত্বক অসুখের কোনো ঔষধ আছে কি? থাকলে সেটা ঝুমের প্রবল ভাবে প্রয়োজন। আর কয়েকদিন গেলেই ঝুম পাগল হয়ে যাবে নিশ্চিত। আরেক দফা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ঝুম। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল নিঝুমের ছোট ফুফি কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ঝুমের দিকে। কিছু যেন পর্যবেক্ষণ করছেন। ঝুমের অস্বস্তি হতে লাগল। মাথা নিচু করে একমনে খাবার খেতে শুরু করল ঝুম। তবুও অস্বস্তি কমছে না। মনোয়ারা শেখ তার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? ঝুম কি কোনো ভুল করেছে? মনে পরছে না তো!
______________________________
বাসায় যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছে ঝুম। উঠানের দিকটায় হাঁটছিল তখনই পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠে তাকে। ঝুম দাঁড়িয়ে যায়। পেছনে ফিরে নিঝুমকে দেখতে পায়। নিঝুম দ্রুত পায়ে ঝুমের পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। এসেই আচমকা ঝুমের কপালে হাতের উল্টো পিঠ রেখে কিছুক্ষণ ভাবে কিছু একটা। পরক্ষণেই হাত নামিয়ে বলে,
— “জ্বর তো ভেনিস হয়ে গেছে। খারাপ লাগছে?”
ঝুম তখনো ঘোরের মাঝে ছিল। তার চোখ বড় বড় হয়ে চেয়ে আছে নিঝুমের দিকে। তা দেখে নিঝুম চওড়া হাসে। ঝুম সম্বিৎ ফিরে পেয়ে তৎক্ষণাৎ মাথা নিচু করে ফেলে। আমতা আমতা করে বলে,
— “একটু।”
নিঝুম বিশেষ কিছু ভাবার মতো করে বলল,
— “তাহলে কি করা যায় ঝুম?”
— “আপনি ডাক্তার, আপনি বলুন।”
নিঝুম হেসে উঠে। বলে,
— “ঠিক বলেছো। ডাক্তার হিসেবে তোমাকে একগাদা ঔষধ খেতে দেওয়া উচিত আমার।”
ঝুম নাক কুঁচকে বলল,
— “ঔষধ পঁচা। খাবো না একগাদা ঔষধ!”
নিঝুম এবার শব্দ করে হেসে উঠে। ঝুম তাকিয়ে দেখে সে হাসি। নিঝুমের হাসছে আর সেটা বুঝি ঝুম চেয়ে দেখবে না? অসম্ভব! ঝুমের প্রিয় দৃশ্য নিঝুমের হাসি। প্রিয় জিনিস! একদম সব কিছু!
হঠাৎ নিঝুম বলে উঠে,
— “চলো। তোমায় বাসায় পৌঁছে দেই।”
— “আমি যেতে পারবো।”
— “আমি জিজ্ঞেস করি নি ঝুম। বলছি!”
নিঝুমের প্রখত দৃষ্টি এবং নির্লিপ্ত ভাব। ঝুম ভড়কে যায়। বোকা বোকা চাহনি নিয়ে নিঝুমের দিকে তাকায়। নিঝুম ঝুমের চুলে হাত বুলিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দেয় নিমিষেই। ঝুম ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই কঠিন ভাব নিয়ে বলে,
— “চলো, দেড়ি হচ্ছে।”
ঝুমও বিনাবাক্যে নিঝুমের সাথে, সাথে হাঁটতে শুরু করে। কিছু দূর যেতে না যেতেই হঠাৎ নিঝুমের ফোন বেজে উঠে। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে স্ক্রিনের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে নিঝুম। পরক্ষণেই ফোন কানে রেখে বলে,
— “হ্যাঁ?”
ওপাশ থেকে কিছু বলতেই নিঝুম ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল,
— “আসছি আমি।”
ফোনটা আবারো পকেটে ঢুকিয়ে ঝুমের দিকে তাকালো নিঝুম। ঝুম নিঝুমের দিকেই তাকিয়ে ছিল। নিঝুম তাকাতেই প্রশ্ন করে,
— “কি হয়েছে?”
ঝুমের উৎসুক দৃষ্টি।
নিঝুম কয়েকপলক চেয়ে থাকে সেদিকে। কি মনে করে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে ঝুমকে। ঝুম যেন সেখানেই জমে যায়। আশেপাশের সব ধোঁয়াশা হয়ে উঠে। বুক মাত্রারিক্ত দুকদুক করা শুরু করে তার। নিঝুম চোখ বন্ধ করে অধর ছোঁয়ায় ঝুমের কপালে। প্রবল অনুভূতির সঙ্গে। যা স্পষ্ট টের পায় ঝুম। নিঝুম তৎক্ষণাৎ সরে আসে। ঝুম বড় বড় চোখে মাটির দিকে তাকিয়ে। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে শান্ত রাখার প্রয়াস করছে মাত্র। নিঝুম অপ্রস্তুত হেসে বলে,
— “আমার ইমারজেন্সি এসে পড়েছে ঝুম। আমি ড্রাইভারকে বলছি। উনি তোমাকে দিয়ে আসবে। ঠিকাছে?”
ঝুম আনমনেই মাথা উপর-নিচ ঝাঁকায়। নিঝুমের শান্ত দৃষ্টি ঝুমের মুখ পানেই।
______________________________
ঝুম বাসার ভেতর ঢুকতেই কোত্থেকে নিলয় এসে জড়িয়ে ধরে ঝুমকে। ঝুমও মুচকি হেসে হাত বুলিয়ে দেয় তার মাথায়। নিলয় মাথা তুলে তাকায়। ফিসফিসিয়ে বলে,
— “আপা? আস্তে আস্তে রুমে যাবি বুঝলি? আম্মা কিন্তু রেগে আছে তোর উপর।”
ঝুমও ফিসফিসিয়ে বলে,
— “আম্মা এখন কোথায়?”
— “রান্নাঘরে।”
একটু থেমে আবার বলে,
— “এ সুযোগে রুমে গিয়ে দরজা আটকে বসে থাক আপা। তোকে দেখলে আম্মা পিটাবে।”
ঝুম মৃদু হাসে। পায়ের পাতায় হালকা ভর দিয়ে নিজের রুমে আগাতে থাকে। রান্নাঘর পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সময় আচমকা মিসেস শ্রেয়া বেরিয়ে আসেন রান্নাঘর থেকে। ঝুমকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠেন,
— “বাসায় এসেছিস কেন? বাইরে ছিলি বাইরে থাকতি। এই! বাইর হো বাসা থেকে। বাসায় জায়গা নেই তোর। কি বলেছি শুনেছিস?”
বলেই তেড়ে আসতে লাগলেন ঝুমের দিকে। ঝুম তড়িৎ গতিতে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল। দরজার সাথে মাথা ঠেশ দিয়ে বসে লম্বা লম্বা নিশ্বাস নিতে লাগলো। ওপাশ থেকে মিসেস শ্রেয়ার বকাবকি কানে আসছে তার। ঝুম বুঝে না তার মা এত বকতে পারে কিভাবে? ক্লান্ত হয় না? ঝুম উঠে দাঁড়ালো। ব্যাগ রেখে ঢুকে পরল বাথরুমে। প্রায় কয়েক মিনিট পর একেবারে গোসল করে বেরুলো বাথরুম থেকে। আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল মুছছিল হঠাৎ-ই ‘টুংটাং’ শব্দ বেজে উঠল ফোনে। ফোনের স্ক্রিনে নিঝুমের নামটা ভেসে উঠছে। মেসেজ পাঠিয়েছে নিঝুম। মেসেজে শুধু এতটুকুই লিখা, ‘পৌঁছেছো?’
ঝুমের মুখে হাসি ফুটে উঠে। দীর্ঘ হাসি। মনে মনে আওড়ায়,
— “ডাক্তার? আমি আপনার নিঝুম রাতের ঝুম বৃষ্টি হতে চাই। সে সুযোগটা আমাকে দিবেন আপনি?”
___________________
চলবে…
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা