ভিনদেশি তারা পর্ব-১১

0
2456

#ভিনদেশি_তারা
#পর্ব-১১
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

৩১.
ভার্সিটিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস শেষ করে ল্যাবে গেলাম। সেখানে প্রফেসর রিচার্ড আমাদের স্পেশাল ক্লাস নিবেন। আমি আর জেনিফার একসাথে এসেছি, বাকিরা আসেনি। ওরা ক্লাস করবেনা, শত জোড়াজুড়ি করেও আনতে পারিনি। প্রফেসর রিচার্ড রাগী মানুষ, ওনার ধমক শুনলেই অন্তরাত্মার ইন্না-লিল্লাহ ঘটে যায়। যদিও সচরাচর রাগেন না। ওনি আমাদেরকে একঘন্টা যাবৎ ল্যাবে রিসার্চ দেখালেন। ওখান থেকে ফেরার পথে ভার্সিটির ক্যান্টিনের কাছাকাছি পৌঁছতেই দেখতে পেলাম এলক্লেভ আমাদের দিকে আসছে। আমি মনটাকে শক্ত করে জেনিফারের হাত ধরে চলে আসতে নিলেই ক্লেভ এসে আমার হাত টেনে ধরলো। তারপর রাগী গলায় জেনিফারকে সেখান থেকে চলে যেতে বললো। জেনিফারও ভয় পেয়ে আমতাআমতা করতে করতে চলে গেলো। ক্লেভ আমার হাত ধরে টানতে টানতে কোথাও নিয়ে যেতে লাগলো।

আমি বিরক্ত হয়ে চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম,
‘কি হলো ক্লেভ? আমাকে এভাবে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? আমি তোমার সাথে কোথাও যাবোনা।’

মাঠ পেরিয়ে ততক্ষণে আমরা রাস্তায় এসে পড়েছি। ক্লেভ আমার হাত ছেড়ে দিয়ে রাগী চোখে তাকালো আমার দিকে। বললো, ‘ তুমি সেদিন আমাকে না বলে চলে এসেছিলে কেন? তারপর দেখাও করোনি। তোমাকে আমি সারপ্রাইজ দিবো বলেছিলাম।’

‘ লাগবেনা আমার সারপ্রাইজ।’ বলে চলে আসতে নিলেই ও আমার হাত ধরে ফেললো। আমি যতোই ছাড়ানোর চেষ্টা করছি ও তত শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরছে। একপর্যায়ে জোর করে আমাকে ওর গাড়িতে তুলে, নিজেও উঠে দরজা লক করে দিলো। রাগে আমার সারাশরীর কাঁপছে। ইচ্ছেমতো ওর বুকে কিল-ঘুষি দিতে লাগলাম। অভিমান জমে আছে খুব, তাও কাঁটা গায়ে নুনের ছিঁটা দিতে এসেছে দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারলাম না। ওর হাতে কামড় বসিয়ে দিলাম। তবুও ক্লেভ আমাকে ছাড়লো না।

একসময় ক্লান্ত হয়ে ওকে ছেড়ে দিলাম। ক্লেভ গম্ভীর গলায় বললো, ‘ হয়েছে? নাকি আরও কামড়াবে?’

আমি তখনো রেগে, কিছুতেই কন্ট্রোল করতে পারছিনা। বললাম, ‘আরো কামড়াবো। কামড়িয়ে তোমাকে খেয়ে ফেলবো।’

ক্লেভ বললো, ‘ সিরিয়াসলি? তুমি কি কুকুর? কুকুরের মতো বিহেভ করছো কেন?’

এবার আগুনে ঘি ঢালার মতো হলো। কুকুর বলাতে ফুঁসে উঠলাম। এত রাগে ইংরেজি ভুলে খাঁটি বাংলায় বলতে লাগলাম, ‘ এই সাদা চামড়ার কালো বাঁদর, তুই আমাকে কুকুর বললি? তুই জানিস আমি কে? আমি চিত্রা, আমার পেছনে পোলাপান রেলগাড়ির মতো ঘুরে আর তুই আমাকে কুকুর বলিস? আরে কুকুর তো তুই রে বারোভাতারি। আমাকে কি সারপ্রাইজ দিবি, তোর এই বা* সারপ্রাইজ আমার লাগতো না। বুঝলি? তোর ডানাকাটা পরী ডোনা বেপ্পিকে গিয়ে সারপ্রাইজ দে, ওই ডাইনির ফর্সা পিঠ দেইখাই তুই পাগল হইছিস। শালা হারামি!’

ক্লেভ বোকার মতো মাথা চুলকে বললো, ‘ আমি বুঝতে পারছি না তুমি কি বলছো। তুমি কি গান গাইছো?’

শুনো ছেমড়ার কথা। এতকিছু বললাম আর বলে কিনা আমি গান গাইছি? হোয়াট দ্যা হেল! মাথার রগ দপদপ করতে লাগলো। নিজেকে কন্ট্রোল করে বললাম, ‘ হুম। গান গাইছিলাম।’

ক্লেভ বললো, ‘ গানটা কেমন যেনো। এটা কি মানুষের হাত কামড়ে কামড়ে গাইতে হয়?’

আমি অবাক হলাম। এ কেমন কথা? রাগ মেটানোর জন্য যাকে উদ্দেশ্য করে দুনিয়ার গালাগালি দিলাম সে ভাবছে এটা গান। উল্টো আমার রাগ তো মিটলোই না আরো রাগ হচ্ছে।
বুঝলাম একে এসব বলে লাভ নেই, আমারই মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আমি একবার রাগী চোখে ওর দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলাম।

৩২.
গাড়ি স্টার্ট করলো ক্লেভ। নিরবে এগুচ্ছে, কেউ কোনো কথা বললাম না। শেষ বিকেলের রোদেরা গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে। পাখিরা ঘরে ফিরে যাচ্ছে। শীত আসবে ক’দিন পর বোঝা যাচ্ছে। স্নো-ফল হয় মাঝেমধ্যে ভয়ংকর ভাবে। তখন বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, গাছপালা তুষারে ঢেকে যায়। দিনরাত বিরামহীনভাবে সাদা তুলোর তুষারে ঢাকা পড়ে প্রকৃতির সতেজতা। যেদিন রোদ ওঠবে সেদিন বরফের দিকে আর তাকানো যায়না, কাচের মতো চকচক করে ফলে তাকালেই ছুরির মতো আঘাত হানে। যাইহোক, ক্লেভ চুপচাপ গাড়ি থামালো। একটা রেস্টুরেন্ট সামনে। গাড়ির দরজা খুলে আমাকেও নামতে ইশারা করলো। আমি বাধ্য হয়ে নামলাম।

পরণের স্কার্ফ আটকে গেলো গাড়ির লকে। টানাটানি করেও খুলতে পারলামনা, ক্লেভ খুলে দিলো যত্ন করে। আমি একটা কথাও বললাম না। ভেতরে গিয়ে বসলাম দুজন। কেউ নেই রেস্তোরাঁতে। ছোট ছোট চোখ আর বড় বড় কানের একটা নিগ্রো ওয়েটার এসে অর্ডার নিলো। ক্লেভ সী-ফুড অর্ডার করলো। আমি বললাম, ‘ এখানে কেন নিয়ে এসেছো?’

‘ খাবার অর্ডার করেছি, বুঝতেই তো পারছো।’

‘ সিরিয়াসলি ক্লেভ? তুমি খাওয়ার জন্য আমাকে জোর করে নিয়ে এলে?’

‘ হুম। একা একা ভালো লাগবেনা, তাই তোমাকে নিয়ে এলাম।’

‘ জেনিফারও ছিলো সেখানে, ওকে নিয়ে এলেই পারতে!’

‘ উহু। তুমি আমার স্পেশাল বন্ধু সো স্পেশাল টাইমটা আমি তোমার সাথেই কাটাবো।’

আমি ধারালো গলায় বললাম, ‘ ডোনা? সেতো তোমার ফ্রেন্ড, এক্কেবারে জটিল ফ্রেন্ড। ও এলো না কেন?’

ক্লেভ বললো, ‘ ডোনা? ওকে কেন নিয়ে আসবো?’

‘ বিকজ ডোনাও তোমার ফ্রেন্ড, বেস্টফ্রেন্ড। ও খুশি হতো।’

‘ ওকে খুশি করে আমার কি হবে?’

‘ ও তোমার ফিয়..!’ এতটুকু বলে চুপ করে গেলাম। কারণ ক্লেভ নিজেও এখনও বলেনি ডোনা ওর ফিয়ন্সে। তাহলে আমি আগ বাড়িয়ে বলতে যাবো কেন? চুপ থাকাটাই শ্রেয়। ওয়েটার খাবারগুলো সাজিয়ে দিয়ে গেলো। ক্লেভ আমাকে খেতে বললো, আমি খাচ্ছি আর মনেমনে কল্পনা করছি ডোনা আর ক্লেভের বিবাহ। “ক্লেভ সুন্দর কালো ব্লেজার পরে মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে ডোনার আগমন দেখছে। ডোনা সাদা রঙের ইয়া বড় প্রিন্সেস ড্রেস পরে হাতে একগুচ্ছ কালো গোলাপ নিয়ে এগিয়ে আসছে ক্লেভের দিকে। ওর জামাটা মাটি ছুঁইছুঁই, মাথায় ক্রাউন পাতলা ঘোমটার সাথে আটকানো, তবে ওর মোমের মতো মুখটা দেখা যাচ্ছে। ক্লেভ এগিয়ে এসে ডোনার হাতের পিঠে চুমু খেলো। আমার দু’চোখ ভিজে উঠলো। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলধারা।”

৩৩.
গালে ঠান্ডা হাতের পরশ পেতেই আমার ঘোর কাটলো। ক্লেভ আমার চোখের পানি মুছতে মুছতে অবাক হয়ে বললো, ‘এনিথিং রং?’

‘ নাথিং।’

‘ কাঁদছো কেন?’

‘ ইচ্ছে।’

‘ এ আবার কেমন ইচ্ছে?’

‘ অদ্ভুত ইচ্ছে। আমার এখন ইচ্ছে করছে হাত-পা ছুঁড়াছুঁড়ি করে কাঁদতে। সব খাবার তোমার গায়ে ছুঁড়ে ফেলতে, রেস্টুরেন্টের সব গ্লাস ভেঙে তোমার উপর দোষ চাপাতে ইচ্ছা করছে। আর ওই তোমার ফ্রেন্ড ডো..!’

বজ্জাতির নাম নিতেই বজ্জাতি হাজির। কাচের দরজা ঠেলে সুন্দর রঙেচঙে একটা হাঁটুসমান হাতাকাটা টপ পরনে ডোনাকে খুবই সুন্দর দেখাচ্ছে। আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে ক্লেভও ডোনাকে দেখলো। ডোনা আমাদের এতক্ষণে খেয়াল করলো এবং আমার সাথে ক্লেভকে দেখেই রক্তবর্ণ চোখে তাকালো।

হুড়মুড়িয়ে এসে অবাক হয়ে ক্লেভকে বললো, ‘তুমি? এখানে কেন? তাও আবার এই মেয়ের সাথে?’

‘ ভালো লাগছিলো না, তাই। তুমি এখানে?’

‘ আমি অফিস থেকে ফিরছি। ভাবলাম কিছু নিয়ে যাই সেজন্য আসা। তুমি কিন্তু আমাকে বলতে পারতে, আমি আসতাম।’

‘ তোমাকে ডিস্টার্ব করতে চাইনি।’

‘ এটা কেমন কথা। আমি কি বলেছি আমি ডিস্টার্ব ফিল করবো? সবকিছু একদিকে আর তুমি একদিকে বুঝলে? তাও তুমি এই আনস্মার্ট মেয়েটাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলে। আবার পাশে বসে খাওয়াচ্ছো।’

অপমানে আমার চোখ জ্বালা করতে লাগলো। দু’ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। মাথা নিচু করে কাঠ হয়ে বসে রইলাম।

ক্লেভ রাগী গলায় বললো, ‘ডোনা তুমি কিন্তু ওকে ইনসাল্ট করছো।’

‘ বেশ করছি। তোমার আজকাল কি হয়েছে ক্লেভ? তুমি যত্তসব থার্ডক্লাস মানুষদের সঙ্গে মিশছো।’

‘ হোয়াট দ্যা হেল ডোনা? তুমি এসব কি বলছো? চিট আমার ফ্রেন্ড। ওকে? তুমি ওকে সম্মান দিয়ে কথা বলো।’

ডোনা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠলো, ‘ও সম্মান পাওয়ার যোগ্য নাকি? কোথাকার ডাস্ট থেকে উঠে এসেছে গড জানে। আর ও তোমার সঙ্গে চিপকে আছে।’

ক্লেভ ফুঁসে উঠে বললো, ‘আই সেইড স্টপ ইট ডোনা। তুমি অনেক বলে ফেলেছো। এই মুহূর্তে তুমি ওকে স্যরি বলবে।’

‘ তুমি ওর জন্য আমার উপর চিৎকার করছো? আ’ম স্পিচলেস এডওয়ার্ড।’

‘ তোমার আর একটা কথাও আমি শুনতে চাইনা। তুমি চিট..কে স্যরি বলো। রাইট নাও।’

‘ এডওয়ার্ড.. প্লিজ! শোনো তুমি..!’

‘ যা বলার বলে দিয়েছি। বারবার বলবোনা। তুমি সেই তখন থেকে বাজে কথা বলছো।’

‘ তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছো কেন?’

ক্লেভ কঠোর গলায় বললো, ‘ আমার উচিৎ তোমার সাথে আরও খারাপ বিহেভ করা। তুমি আমার বন্ধুদেরকে রেসপেক্ট করোনা আমি জানি, তাই বলে চিটের সাথে এরকম করবে তা আমি টলারেট করবোনা। সো ওকে স্যরি বলতেই হবে। গট ইট।’

আমি এতোক্ষণ চুপচাপ মাথা নিচু করে ওদের ঝগড়া শুনছিলাম। আসলেই তো কোনো মেয়ে তার ফিয়ন্সের সাথে অন্য মেয়েকে দেখলে ফুঁসে উঠবে এটাই তো স্বাভাবিক। তাতে এরকম অদ্ভুত ব্যবহারও বেশিকিছু না। আমি নিজে হলেও এর চেয়ে বেশিকিছু করতাম হয়তো। এক্ষেত্রে ডোনাই ঠিক। আমি এবার দুজনকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘ তোমরা প্লিজ চুপ করো। আমি চলে যাচ্ছি।’

ক্লেভ অবাক হয়ে বললো, ‘কোথায় যাবে? কোথাও যেতে পারবেনা। আমি তোমাকে ড্রপ করে দিবো।’

‘ প্লিজ ক্লেভ! আমাকে একা ছেড়ে দাও। আমি বাড়ি যেতে চাই, রাত হয়ে গিয়েছে।’

ক্লেভ ধমকে বললো, ‘ আমি নিয়ে যাবো বললাম একবার।’

‘ দরকার নেই।’ তারপর ডোনার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘স্যরি। আমার জন্য তোমাদের মাঝে ঝামেলা হলো। আমি চলে যাচ্ছি তোমরা এনজয় করো! রাতটা তোমাদের!’

কথাগুলো নিজের কানেই ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। আমি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে এলাম। পেছন থেকে ক্লেভ ডাকছে চিৎকার করে, আমি তাকালামও না। গাড়িতে উঠে দু’চোখের বাঁধ ভেঙে এলো। এতো অপমানিত কখনোই হইনি আমি। জানি ক্লেভ ডোনার, তাও বেহায়া নির্লজ্জের মতো আমি সাথে একসাথে খেতে বসলাম? ছিঃ। শেম অন ইউ চিত্রা, শেম অন ইউ!

বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে বসে রইলাম। বাইরে অন্ধকার রাত, ঘরও অন্ধকার। দক্ষিণা বাতাসে শিরশির অনুভূতি ছুঁইয়ে যাচ্ছে চিবুকে, গালে। বালিশ চেপে পরে রইলাম। জানালা দিয়ে মস্ত বড়ো আকাশটার দিকে তাকিয়ে দেখি অসংখ্য তারায় ভরা। কালচে-নীল মেঘমেদুর আকাশে পরিপূর্ণ থালার মতো চাঁদ। আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছে পৃথিবী। দূর আকাশের সবচেয়ে বড় তারা দুটো দিকের তাকিয়ে রইলাম।

“আমার মনের প্রতিটা কোণ
তোমার স্পর্শে গড়া।
তোমার হৃদয়ে আমি,
এক তুমিবিহীন তারা।
আমার জীবনে তুমি,
এক ভিনদেশি তারা!”

চলবে…ইনশাআল্লাহ! আন-এডিটেড পর্ব, ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। ছন্দ আমার লিখা।