ভিনদেশি তারা পর্ব-৩১ এবং শেষ পর্ব

0
4030

#ভিনদেশি_তারা
#পর্ব-অন্তিম(৩১)
#লেখনীতে-ইশরাত জাহান ফারিয়া

৯৫.
জীবন সুন্দর তাতে সন্দেহ নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষটা আমি। প্রেগ্ন্যাসির এতগুলো দিন কেটে গেলো ভালোভাবেই, কোনো সমস্যা হলোনা। অনেকদিন পরে হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে ফোন এলো। আমি রিসিভ করতে পারিনি। বিকেলের দিকে ল্যান্ডলাইনে ফোন এলো। আমরা লনে বসে চা খাচ্ছিলাম। আমি দ্রুত এসে ফোন ধরলাম৷ ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো, ‘হ্যালো।’

‘ ইয়েস।’

‘ চিত্রা?’

‘ ইয়েস, চিত্রা স্পিকিং!’

‘ আমি নিঝুম!’

আমি অবাক হয়ে গেলাম।

‘ আপনি? এতোদিন কোথায় ছিলেন?’

‘ যেখানে এসেছি, সেখানেই!’

‘ সবাই ভালো আছে?’

‘ হুম।’

‘ তা হঠাৎ ফোন দিলেন যে?’

‘ না মানে, কেমন আছো?’

‘ ভালো।’

‘ কংগ্রাচুলেশনস।’

‘ ধন্যবাদ। মারোলাকে দেওয়া যাবে?’

‘ ও শাওয়ারে।’

‘ একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?’

‘ হুম! ‘

‘ আপনি কোনো ইনসান নন!’

নিঝুম বড্ড অবাক হয়ে বলল, ‘কীভাবে জানলে?’

‘ যেভাবেই হোক। আপনি কথাটা লুকিয়েছেন কেন?’

‘ তোমরা ভয় পাবে তাই।’

‘ এভাবে কারো বিশ্বাস নিয়ে খেলা করা ঠিক না।’

‘ এছাড়া কিছু করার ছিলোনা।’

‘ কিন্তু আপনার তো সবকিছুই জেনে যাওয়া উচিৎ ছিলো, যে আমি এখানে পালিয়ে এসেছি!’

৯৬.
নিঝুম নিঃশব্দে হাসলো। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম। বললো, ‘তোমার কি মনে হয়? এসব আমাকে কে বলেছে? আমি নিজেই খুঁজে নিয়েছি তোমাকে। কিন্তু জানতে দিইনি।’

‘ মানে?’

‘ মানে তোমাকে আমি রাস্তায়ই প্রথম দেখি। তখন আমি বেশ রাগী একজন। যা পছন্দ করি, তা আমার হতেই হবে এমন একটা ভাব। আমার সাথে অন্য যে জিনেরা ছিল তারাও তোমাকে পছন্দ করে ফেলে। কিন্তু আমি সবকিছু ভণ্ডুল করে দিই। এমনকি ঘুমের ঔষধ খাইয়ে অজ্ঞান করার সময়ও আমার কিছু হয়নি। আমি সবই জানতাম, কি করেছিলে তুমি। জানিনা আশ্চর্যজনক ভাবে আমি কেন তোমাকে সবকিছুতে ছাড় দিতে চাইছিলাম। এরপরই তো তুমি একজনকে ভালোবেসে ফেললে, আমার প্রচুর রাগ হয়েছিলো। কিন্তু কিছুই করিনি তোমাকে ভালোবাসতাম বলে। মারোকে বিয়েও তোমার কথায় করেছি।’

আমি বললাম, ‘মারোলা জানে আপনি জিন?’

‘ না। সে নাকি ভয় পায় এসব। আমি সেজন্য কিছু বলিনি।’

‘ কিন্তু আর্ফবাবু? ও?’

‘ এটা আপাতত তোলা রইলো। কোনো একদিন ওর বিষয়ে জানতে পারবে!’

আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ‘আপনি কি এখনো আমাকে ভালোবাসেন?’

‘ কিছু কিছু ভালোবাসা কখনোই ফুরোয় না। তেমনই হয়তো তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কখনোই ফুরোবেনা। ভালোবাসতাম, ভালোবাসিও। তুমি হয়তো ভালোবাসলে না, তাতে কিছু যায় আসবেনা।’

‘ আমি শুধু আহনাফকেই ভালোবেসেছি। প্রথম ও শেষ ওকে দেখেই আমার অনুভূতি জন্মায়। আমি হয়তো আমার ভাগ্যে ওকেই পেয়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তা তো আগে থেকেই সব ঠিক করে রেখেছেন।’

‘ আমি যদি একমাত্র ব্যক্তি যে দাঁড়িয়ে ছিলাম তোমার প্রতীক্ষায়। চাইলে হয়তো তুমি আমাকে বেছে নিতে পারতে। কিন্তু না,তুমি আমাকে ভালোবাসোনি। আমি হয়তো তোমার সেরা পছন্দ ছিলাম না।’

‘ হুম।’

‘ ভালো থেকো। অনাগত সন্তানের ভবিষ্যৎ সুন্দর হোক। আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ভালো রাখুক। সুখী হও।’

সেদিন এটুকুই কথা হলো। এর একসপ্তাহ পর এক রাতে আমার লেবার পেইন শুরু হয়। তখন শুভ্র তুষারে ঢেকে গিয়েছে রাস্তাঘাট। বরফ জমে একেবারে নাজেহাল অবস্থা। আপুরা শ্যানানডোয়াতে ঘুরতে গিয়েছিল। ফোন করে জানালো স্কাইলাইন ড্রাইভের অবস্থাও সেরকম। বরফ পড়ছে অবিরাম। ক্লেভ আর মম এসবের তোয়াক্কা না করে আমাকে গাড়ি করে নিয়ে গেলো হসপিটালে। মনে হচ্ছিলো পৃথিবী উল্টে যাক, ধ্বংস হয়ে যাক, আমার সন্তান যেন সুস্থ থাকে।

৯৭.
একটা ফুটফুটে শিশুর কান্নার আওয়াজ যখন আমার কানে ঢুকলো, তীরের বেগে একদলা সুখ আমার হৃদপিণ্ডে আঘাত হানলো। আমার সন্তান! ডেলিভারি নরমালই হলো। বেশি কষ্ট করতে হয়নি আমায়। ক্লেভ খুশিতে দু’রাকাত নামাজ পড়ে ফেললো। কারণ আমাদের মেয়ে হয়েছে। একদম ফর্সা গায়ের রঙ, চোখ ঘন নীল, চুলগুলো বাদামি। সারাজীবন এরকম বাচ্চা শুধু ছবিতেই দেখেছি। কিন্তু আমার ঘরে যে এরকম হুরপরী আল্লাহ তায়ালা দান করবেন আমি ভাবতেও পারিনি। শুভ্র তুষারের মতোই কোমল ওর হাত-পা। ক্লেভের সিনডারেলা, আমাদের ইলা!

‘ চিট! টুমি জানোনা অ্যামি কত্ত খুশি হয়েছি।’

আমি শুধু হাসলাম। মম আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন৷ আপুরা বাড়ি না গিয়ে সোজা হসপিটালে এলো৷ খুশিতে কান্না করে দিলো৷ বাসায় ফোন করে সবাইকে স্কাইপিতে দেখালো। রাত তখন এগারোটা। আবহাওয়া খুব খারাপ। কিন্তু আজ আমাদের আনন্দের দিন।

এভাবেই সাতদিন একটানা তুষার বর্ষণ হতে লাগলো। একদিন আহনাফ ব্যাক ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছিলো। আমি কাবার্ডে কিছু একটা খুঁজতে খুঁজতে একটা ড্রয়ার খুলে ফেললাম৷ হঠাৎ একটা লেখায় নজর গেলো। জরি দিয়ে লিখা “Chitra”। আমি নিজের নাম দেখে হাতে তুলে নিলাম জিনিসটা। দেখলাম এটা একটা অ্যালবাম। খুলতেই আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। প্রায় হাজারের উপর ছবি আমার। অনেকগুলো ছবি দেখে ” 22″ নাম্বার পেইজে এসে দেখি অনেকবছর আগের সেই তুষার দিনের ছবি। আমি উইন্ডব্রেকার পরে বরফের পুতুল বানাচ্ছি, হাসছি। মারোলাদের বাড়ির উঠোনে ছবিটা। ওদের প্রতিবেশী বাচ্চা মেয়ে দুটো আমার গাল ধরে টানছে। এমন সময় ছবিটা তোলা হয়। মনে পড়তেই আমি ক্লেভের কাছে গেলাম। ও আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ‘হোয়াট? এবাবে টাকিয়ে আছো কেন?’

‘ এটা কী?’

ও অবাক হলো অ্যালবামটা হাতে দেখে।

‘ আমার এতো ছবি কখন তুলেছো? তাও আমার পার্মিশন না নিয়ে!’

‘ স্যরি।’

‘ স্যরি মাই ফুট! তুমি বিয়ের আগে থেকেই আমার দিকে কুনজর দিতে? ছিহ!’

ক্লেভ বাক্যহারা হয়ে গেলো। তারপর দ্রুত আমার হাতদুটো মুঠোতে নিয়ে বললো, ‘মিথ্যে কথা। অ্যামি কখনোই কুনজর দিইনি। প্লিজ বিলিভ করো।’

আমি রেগে থাকার ভান করে বললাম, ‘নো।’

‘ প্লিজ চিট! এটা কৌটূহলী হয়ে টুলেছিলাম, অ্যামার বালো লাগতো টোমাকে।’

‘ ওহহ,, এখন আর ভালো লাগেনা? লাগবে কীভাবে! এখন তো আমি পুরাতন হয়ে গিয়েছি। একবাচ্চার মা হয়ে গিয়েছি। হুহ!’

ক্লেভ আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘অ্যাবোলত্যাবোল বকছো টুমি। অ্যামি টোমাকেই বালোবাসি। আর কাউকে দরকার নেই।’

‘ হুহ।’

‘ টুমি কী রেগে আছো?’

‘ না।’

‘ ইলা কোথায়?’

‘ ওর নাম ইলা না। ওর নাম এখনো ঠিক হয়নি।’

‘ নাহোক। আপাটট সিনডারেলা, অ্যামাদের ইলা।’

‘ ও ঘুমুচ্ছে।’

ক্লেভ ঘুমিয়ে থাকা মেয়েকে কপালে চুমু দিয়ে বসলো।

আমি বললাম, ‘ওর চোখগুলো আমার মতো হলোনা কেন!’

‘ আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছে।’

‘ কিন্তু সুন্দর। তোমার মতোই।’

৯৮.
‘ এখন আমার চোখ এটা যতোই সুন্দর হোকনা কেন, আমার অন্ধকার সময়ে এটা যতোই উজ্জ্বল হোকনা কেন, এই সময়টা যতোই মোহনীয় হোক না কেন,আমার কন্ঠস্বর যতোই মধুর শোনাক না কেন, শব্দগুলো যতোই সুন্দর হোকনা কেন, তুমি কী আমাকে আগের মতোই ভালোবাসবে চিট? নইলে আর আমার কাছে এসোনা, আমি দিনদিন তোমাকে আরো বেশি ভালোবেসে ফেলছি। যদি আমাকে আর না ভালোবাসো তাহলে আমি মরেই যাবো, শুধু মরে যাবো।’

আমি অবাক হয়ে বললাম,’এসব আজগুবি কথা বন্ধ করো। তোমাকে ছাড়া এতো সহজ নয়, এটা নিশ্চিত। সারাজীবন আমার সাথেই থাকতে হবে।’

ও হেসে চলে গেলো। আমি মেয়েকে আদর করতে লাগলাম। এভাবেই অনেকদিন কেটে গেলো। আমার মেয়ের প্রতিটা জন্মদিন এক একটা রাজপুত্রের রাজ্যভিষেকের মতো ধুমধামে করা হয়। যদি সে আমাদের রাজকন্যা। খুব আদরে বড় করছি ওকে। কিন্তু সমস্যা একটাই। মেয়ে আমার বাংলা বলতে পারেনা, সব ইংরেজি। একেবারে খাঁটি আমেরিকান ইংরেজি। আর খুব অদ্ভুত! প্রকৃতিকে সে খুব ভালোবাসে, এর মাঝেই ওর বাস! এখনো সে বাবার সিনডারেলা, ভালো নামটাও রাখা হয়নি।

একদিন আমার সাড়ে তিনবছরের মেয়েটা বলে উঠলো, ‘মাম, টুমি কালাকে বলো অ্যামাকে বাত বানিয়ে দিতে৷ ড্যাড বলেচে বাত কুব টেস্টি!’

মেয়ের মুখে বাংলার রফাদফা দেখে আমি কাঠ হয়ে বসে আছি৷ আপুকে বলছে কালা(খালা)। হা হা। ক্লেভ মুচকি হেসে বললো, ‘হ্যাপি চিট? ব্যাঙলা শিখাতে অনেক কষশট হয়েছে অ্যামার।’

‘ সব তোমার কারসাজি। নিজে তো পারোনা, মেয়েকেও উল্টাপাল্টা শিখাচ্ছো।’

‘ টুমি টো সেটাও শিখাও না।’

‘ হুহ।’

ক্লেভ আমার গালে চুমু দিয়ে মেয়েকে বললো, ‘এটা কী দিলাম ইলা?’

ছোট্ট মেয়ে বলে উঠলো, ‘কিসি। নো নো চুমু!’

আমি বললাম, ‘ছি ছি। কিসব শিখাচ্ছো।’

‘ চিট! একদিন দেখবে ও খুব বালো ব্যাঙলা বলতে পারছে।’

৯৯.
এভাবেই মেয়েকে নিয়ে আমাদের জীবন কাটছে। একদিন অফিস থেকে ফিরে আমাকে দরজায় জুসের গ্লাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ক্লেভ বললো, ‘আচ্ছা, অ্যামি যদি কখনোই আর না আসি। তবুও কী টুমি এবাবেই গ্লাস হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে অ্যামার অপেক্ষায়?’

আমার চোখ ভিজে উঠলো। উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়ালাম। ক্লেভ চোখের পানি মুছে দিয়ে হু হা করে হেসে বললো, ‘কুইনের চোখের পানি, কিংয়ের জীবনের চেয়েও দামী! ভালোবাসি চিট!’

এই প্রথম ক্লেভ পরিষ্কার বাংলায় “ভালোবাসি” উচ্চারণ করতে পারলো। আমি অনেক অবাক এবং খুশি হলাম। ও অদ্ভুত আচরণ করলো সারাটাবেলা। রাতে পুরো ফ্যামিলি ক্যান্ডেল লাইট ডিনার করলাম এখানকার বিখ্যাত রেস্তোরাঁয়। যেহেতু ক্লেভ এখানকার অন্যতম ধনী, আমাদের আপ্যায়নও সেভাবেই হলো। অনেকদিন পর পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা করার সুযোগ হলো।

পরেরদিনও ক্লেভ অফিস গেলোনা। আপু, মাহমুদ ভাইয়া, মম, আমি, ক্লেভ ইলাকে নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসি ঘুরে এলাম। আব্রাহাম লিংকনের বিশাল প্রতিকৃতি দেখে ইলা ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করলো। বারবার বলতে লাগলো, ‘আ’ম ইলা। টুমি এভাবে টাকিয়ে আচো কেন!!’

ওর কথা শুনে সবাই হেসে ফেললো৷ রাতে পটোম্যাক নদীর তীরে আমি আর ক্লেভ একা সময় কাটালাম। ও আজ ভীষণ খুশি, জানিনা কেন! পুরোনো স্মৃতিগুলো মনে করে দুজনেই হাসলাম।

রাতে বাড়ি ফিরে সবার সাথে কথাবার্তা বলে দুজনেই শুয়ে পড়লাম। ক্লেভের সঙ্গে অনেক মজা করলাম। ও আমাকে বললো, ‘চিট, সময়গুলো খুব ভালো কেটেছে। তাইনা?’

‘ হুম, অনেকদিন পর!’

আমি তাকিয়ে দেখি ও গভীর চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাকিয়ে আছো কেন?’

‘ দেখছি। ভালো লাগছে।’

‘ এতো দেখা ভালো নয়। চুপচাপ ঘুমাও!’

‘ আর যদি দেখতে না পাই!’

আমার বুকটা ধক করে উঠলো। তবুও মুখে হাসি ঝুলিয়ে বললাম, ‘সবসময় দেখতে পাবে।’

‘ টোমাকে আমি পরকালেও চাই চিট৷ টুমি কিন্টু অ্যামার সাথেই থেকো।’

‘ অবশ্যই। আমাকে ছাড়া কোথাও যেতেও পারবেনা তুমি। এভাবে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকবে, ঘুমাও।’

‘ টোমার দিকে হাজার বছর আমি চেয়ে থাকতে পারবো, ক্লান্ত হবোনা। মনে রেখো, বালোবাসি টোমায়।’

আমি ওর বুকে মুখ লুকোলাম। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়লাম।

সকালবেলা আমার ঘুম ভাঙলো দেরিতেই। অন্যদিন হলে ভোরবেলায়ই ক্লেভ আমাকে ডেকে তুলে। দুজন মর্নিং ওয়াকে যাই। কিন্তু আজ নয়টা বেজে গেলো ও আমাকে ডাকলোনা? নড়তে গিয়ে দেখি ওর বুকেই আমি। কি ব্যাপার! আজ এতো ঘুম কেন! আমি ওকে ঠেলে সরাতে চেয়ে পারলাম না। ও শক্ত হাতে আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। আমি অনেকবার চেষ্টা করলাম। উঠতে না পেরে আস্তে আস্তে একটু নিচু হয়ে সরে এলাম। তারপর উঠে বসে চুল বেঁধে ওকে ডাকলাম। সাড়া নেই। দ্বিতীয়বার ডাকলাম, এবারেও উঠলোনা। আমি রেগে গেলাম, মাঝেমাঝে ইচ্ছে করেই এমন করে ও। রাগে ওর কানের কাছে জোরে চিৎকার দিলাম। হেলদোল নেই! এবার আমার বুক কেঁপে উঠলো। আলতো করে ওর বুকে হাত রাখলাম, নিঃশ্বাসের উঠানামা নেই। মাথা ঘুরে উঠলো আমার। পার্লস চেক করলাম, চলছেনা।

আমি তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওকে চোখ খুলতে বলছি, কিন্তু খুলছেনা। জানতাম না ওর সেই গভীর নীল চোখজোড়া আর খোলা পাবোনা, সেই চোখজোড়া আর আমি দেখতে পারবোনা। যে চোখের প্রেমে পড়ে মানুষটাকেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম, চিরদিনের জন্য সেই চোখ বন্ধ হয়ে গেলো। টলমল পা নিয়ে বাড়ির সবাইকে চিৎকার করে ডাক দিয়ে আমি সেন্স হারিয়ে পড়ে যাই ওর বুকের উপর।

জ্ঞান ফেরার পর দেখলাম আমার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। পাশেই রাখা ক্লেভের নিথর দেহ। ফর্সা গা হলদে আভায় ছেয়ে গিয়েছে। আমি চিৎকার করে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। কিন্তু কাঁদতে পারলাম না। আমার ছোট্ট মেয়েটা দুবার বাবার গালে হাত বুলিয়ে চুমু খেয়ে জড়িয়ে ধরে পড়ে রইলো।

মম অজ্ঞান। আপু আর মাহমুদ ভাইয়া নিজেদেরই তো পারছেই না, বাড়ির কাউকেই সামলাতে পারছেন না। সবার কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। আমি পাগলের মতো ওর মুখে চুমু খেলাম, কিন্তু ও একবার নড়ে ওঠলো না। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হাসিটা উপহার দিয়ে আমাকে বললো না, ‘চিট! টুমি কিন্তু ভীষণ লুচু। অ্যামি কী খাবার জিনিস? টুমি অ্যামাকে খেয়ে ফেলছো৷ রাক্ষসী। হা হা!’

আমাকে জড়িয়েও ধরলোনা। বকাও দিলোনা। শুধু চুপচাপ ঘুমিয়ে রইলো। ইতিমধ্যেই দেশ থেকে সবার ফোন আসা শুরু হলো। স্কাইপিতে সবাইকে একনজরে দেখলাম। সবাই কাঁদছে, দাদু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন খবর শুনে। আমি একটা কথাও বললাম না। সারাক্ষণই ক্লেভের সাথে কথা বললাম। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আমার ভিনদেশি তারা আজ সত্যিই তারা হয়ে গিয়েছে। ইলা সারাক্ষণ বাবার পাশে বসে কেঁদেছে। কে এখন ওকে সিনডারেলা ডাকবে? কে বুকে নিয়ে ঘুমাবে? কে আদর করবে বাবার মতোন?

এদেশে আমাদের দূরসম্পর্কের আত্মীয় যাঁরা ছিলো তারাও এলো৷ জেনিফাররা সবাই কান্নায় ভেঙে পড়লো। মারোলা ভিডিও কলে দেখলো। কান্নায় বেচারি ভেঙে পড়েছে। খুব ভালো বন্ধু ছিলো ওরা। আর আমি! আমি স্তব্ধ, বিমূঢ়। কাল অবধি জানতাম না আমার পৃথিবী অন্ধকার হয়ে যাবে। সময় বড়ই মূল্যবান। সেকেন্ডকেও বিশ্বাস করা যায়না।

ঘুমের মাঝেই চলে যায় ওপাড়ে ও। সুস্থ-স্বাভাবিকই ছিলো। নিথর ঠোঁটের কোণে ফুটে আছে এক চিলতে হাসি, সেরা হাসি। আমি ওর মুখের দিকেই সারাক্ষণ তাকিয়ে রইলাম।

ইসলামিক রীতিনীতি মেনেই বাড়ির সাথের জঙ্গলে দাদীর কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় ওকে। তখন আমার আধো আধো জ্ঞান ছিলো হয়তো৷ শেষবার ওর কপালে চুমু দেওয়ার সময়ও আমার মনে হচ্ছিলো ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠবে, ‘ভয় পেয়েছো চিট? কেঁদোনা টুমি। কাঁদলে অ্যামার বুকে কষষ্ট হয়।’

কিন্তু বললোনা। চুপচাপ চলে গেলো। মেয়েটা আমার পাথর হয়ে গিয়েছে। কখনো সরাসরি এসব দেখেনি। ভয় পেয়ে গিয়েছে। আপুরা ওকে সামলাচ্ছে। আমার জীবন উল্টে গেলো একদিনের মধ্যেই৷ চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলো ক্লেভ ওরফে মোহাম্মদ আহনাফ নামক হাসিখুশি ব্যক্তিটি।

“এখনো সন্ধ্যারাতে
খুঁজে ফিরি সেই তারাটাকে,
যে তারাটা একলা ফেলে
চলে গেছে, ওই দূর আকাশে।
আজও ভোররাতে
আকাশ পানে চেয়ে থাকি
দূরের ওই তারাটা খুব কাছে টানে
কখনো মনে হয়, এ আমার
ভিনদেশি তারা।”

এখনো ঘরের কোণায় কোণায় ওর স্মৃতিগুলো আমাকে তাড়া দেয়। রাতেরবেলা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। ঘুমের ঘোরে হাতড়ে হাতড়ে ক্লেভকে খুঁজি, ছোঁয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু পারিনা। চোখ ভিজে বুক ফেটে কান্না আসে। তবুও মানুষটা আসেনা। কী ভীষণ নিষ্ঠুর তুমি ক্লেভ? কেন এতো ভালোবাসলে আমাকে? আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তোমাকে ছাড়া। তুমি খুব খারাপ, খুব নিষ্ঠুর! কষ্ট হয়না? আমাকে কাঁদতে দেখলে তুমি কতকিছুই না করতে, আর আজ তুমি আমার মাথায়ও হাত বুলিয়ে দাও না! অসহ্য তুমি! “কীভাবে পারো তুমি?
একলা আকাশে বাস করতে?
সেই আকাশে আছে কী
তোমার কোনো রাণী?”

১০০.
একদিন ক্লেভের নিজস্ব ডায়েরিটা আমি খুঁজে পেলাম। ও কাউকে পারমিশন দিতোনা এটাতে ধরার, ছোঁয়ার। আমি অনেকক্ষণ কাঁদলাম ওটা বুকে নিয়ে। তারপর খুলে পড়তে লাগলাম। ওর ছোটবেলার সব মজার কাহিনী। পেছনের দিকে একটা পেইজে লিখা, ‘চিট! তুমি বলেছো তুমি আমাকে ভালোবাসো। জানো আমি কত খুশি হয়েছি! তুমি যদি জানতে আমি তোমাকে কত ভালোবাসি, তাহলে নিশ্চয়ই অবাক হতে! সবসময় ভালো থেকো।’

অন্য পৃষ্ঠায় লেখা, ‘আমি ছিলাম অন্ধকারে তোমার আলোকরোজ্জ্বল তারা। আমি ছিলাম নীল রঙের ছায়া পালিতো। তুমি বলেছিলে আমাকে ভালোবাসা তোমার জন্য সহজ ছিলোনা, তাও ভালোবেসেছো। আসলে ভালোবাসা কার প্রতি কীভাবে আর কখন আসে আমরা বুঝতে পারিনা। আমার হাতে যখন তোমার হাত রাখো তখন মনে হয়, পৃথিবীটাই বুঝি আমার। তুমি যখন আমার বুকে মাথা রেখে আমাকে শোনার চেষ্টা করো তখন এটা আমার জন্য কতটা আনন্দের হয়, জানো তুমি? বারবার বলি “ভালোবাসি!” চিট! তুমি পেছনে ফিরে তাকাও, সামনে তাকাও সবখানেই আমাকে দেখতে পাবে। আমি তোমার সাথেই আছি। সবসময় পাশে থাকবো তোমার। আমি যে পৃথিবীর চেয়েও বেশি ভালোবাসি তোমাকে!’

সত্যিই আমি পেছনে ফিরে তাকালাম। আবছা অবয়ব দেখলাম। সামনে তাকালাম, ক্লেভের মায়াভরা মুখ। ডানে তাকিয়ে দেখলাম ও খাটে শুয়ে আছে। বামে তাকিয়ে ওকে আমার খুব কাছে দেখতে পাই। মুখে হাসি, চোখ চকচক করছে। আমি ওকে জড়িয়ে ধরতে গেলেই অবয়ব মুছে গেলো। বাতাসের ঝাপটা শুধু চুল ছুঁয়ে গেলো। ক্লেভ নেই! কোত্থাও নেই। ধোঁকা দিলো আবার। নিষ্ঠুর একটা!

“ভুবন ভরা
একটা আকাশের তারা তুমি।
ভাবো কী,
আমার লুকানো গল্প
কার কাছে বলি?
তোমার বুকে মুখ লুকিয়ে
গল্প বলার অভ্যেস
আজও আছে,
নেই শুধু তুমি।”

#জানিনা কেমন হয়েছে। আপনারা হয়তো রাগ করবেন স্যাড এন্ডিং দেওয়াতে।

#এরপরের কাহিনী নিয়ে আবার গল্প লিখবো ইনশাল্লাহ। নিঝুমের কাহিনী নিয়ে। তবে চিত্রার সাথে ওর মিল কোনোদিনই হবেনা। অগোছালো লিখা।

#বিরক্তিকর, বিচ্ছিরি হওয়ার জন্যও দুঃখিত। ভালো হয়নি হয়তো। ভুল ত্রুটি মাফ করবেন। লিখা/ছন্দ আমার। আর অনেকে যেভাবে বিচ্ছিরি ভাষা ব্যবহার করে , লেখার ইচ্ছেই চলে যায়। ভালো না লাগলে ইগনোর করা উচিৎ।