#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :২৯(দ্বিতীয় অংশ)
আমি অনেক্ষণ চুপ করে রইলাম,তারপর হুট করে বলে দিলাম সৌরভের কথা।কথাটা বলেই আমি গাপটি মেরে উনার বুকের ভেতর মাথা গুজে রইলাম।আমার ভয় হচ্ছে এটা ভেবে যে, উনি কী করবেন? মাথা তুলে আর তাকানোর সাহস হলো না। অনেক্ষন এভাবে থাকার পর উনার কোনো নড়চড় না দেখে আমি একটু একটু করে মাথা তুলে তাকালাম।উনার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি ভাবলেশহীনভাবে বসে আছেন। উনার এমন রিয়েকশন দেখে আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম। উনি এত স্বাভাবিক কেনো? উনার চোখের দিককে তাকাতেই উনি চোখ দিয়ে প্রশ্ন করলেন কী?
আমি অবাক হয়ে গেলাম।ভাবলাম হয়তো উনি বিষয়টি বুঝেন নি।তাই বললাম,,”আমি কী বলেছি আপনি বুঝছেন তো?
উনি স্বাভাবিকভাবেই বললেন,,”হ্যা, বুঝেছি। তোমার হাব-ভাব দেখে বিষয়টা আন্দাজ করতে পেরেছি।”
–“তো আপনি কিছু বলবেন না?”
—“আমি কী বলবো?জানো,আমাদের ভাগ্য টাই পুরো ট্রায়াঙ্গলের মতো। কার ভাগ্যে কী আছে কেউ জানে না। আমার ভাই যদি তোমার এক্স হয়,তাহলে আমার কী করার আছে বলো তো? অতীত ছাড়া চলা যায় না,,এই যে দেখো ঘুরে ঘুরে তোমার অতীত তোমার সামনে চলে আসতেছে। আবার অতীত নিয়েও চলা যায় না, আজ যদি তুমি অতীতের জেদ নিয়ে বসে থাকতে তাহলে তুমি বেঁচে থাকতে পারতে না। আমি জানি না ভবিষ্যৎ এ কী হবে,তবে এটুকু বলবো ভবিষ্যৎ এ যে সিদ্ধান্ত নিবে তা ভেবে চিন্তে নিও। তোমার উপর অনেকের জীবন নির্ভর করে। তবে হ্যা,তুমি যে সিদ্ধান্তই নেও না কেনো আমি তোমার পাশে থাকবো। ”
কথাটা বলে উনি আমাকে নামিয়ে দিয়ে বাহিরে চলে গেলেন।
.
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি আমি,ট্রেনটি সবুজ মাঠের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। গাছপালা আর বাড়ীগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে পিছনের দিকে দৌড়াচ্ছে। গ্রাম-বাংলার দৃশ্যগুলো মনমুগ্ধকর লাগছে,অনেকদিন পর এসব দৃশ্য দেখে আমার মন উৎফুল্লু হয়ে গিয়েছে। প্রায় ঘন্টাখানেক আগেই রওনা দিয়েছি আমরা। প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর বাতাসের সাথে আমার মনের খারাপ লাগা গুলো উড়ে চলে গেলো। নিজেকে অনেক হালকা লাগছে,এতক্ষন টেনশনে দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। বাহিরে থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে উনার দিকে নিক্ষেপ করলাম। উনি আমার পাশের সিটের সাথে গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। আমি জানি উনি অনেক টেনশনে আছেন।আমি আড়চোখে একপলক চারপাশ তাকিয়ে উনার ঘাড়ে মাথা রাখলাম। উনি হয়তো ভেবেছেন আমি ঘুমিয়ে পড়েছি তাই উনি এক হাত দিয়ে আমার পিছন দিয়ে নিয়ে আমাকে জড়িয়ে ভালো করে মাথাটা ঠিক করে উনার কাঁধে রাখলেন।আমি চোখ বন্ধ অবস্থায় মুচকি হাসলাম। এই লোকটা আমাকে ভীষণ ভালোবাসে, কিন্তুু কখনও তা অন্যদের মতো বলে বলে প্রকাশ করে না।উনার বিহেভিয়ার দেখলে যে কেউ মিনিটেই বুঝে ফেলবে। আমি জানি উনার মত কেউ আমাকে কখনও ভালোবাসতে পারবে না।কথাগুলো ভাবতেই মনের মধ্যে আনন্দের শিহরন বয়ে যেতে লাগলো।
.
দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা জার্নির পর আমরা এসে পৌঁছালাম সেই চিরচেনা গ্রামে।যেখানে একসময় হাসতে-কাঁদতে কাটিয়েছিলাম আমার ছোটবেলা। উনাদের বাড়ী পৌঁছানোর পূর্ব পর্যন্ত দু চোখ ভরে চারপাশ দেখলাম। প্রত্যেক টা জায়গা দেখে নানানরকম স্মৃতিচারণ হয়েছিলো। উনিও আমার মতো চারপাশ দেখতে ব্যস্ত ছিলেন।
বাড়ী পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক রাত হয়ে গেলো। উনাদের বাড়ী টা দেখে আমি বেশ অবাক হলাম।অনেক বড় বিল্ডিং,,কী সুন্দর কালার করা।ঘরের ভেতর ঢুকার সময় আমার হাত-পা কাঁপতেছিলো। উনি শক্ত করে আমার হাত ধরে গেটের ভেতরে নিয়ে গেলেন,গেট খোলা ই ছিলো। অনেক রাত হওয়াতেই সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। উনি দুবার কড়া নাড়তেই এক মধ্যবয়সী শ্যামবর্ণা মহিলা এসে দরজা খুলে দিলেন। আমার ধারনা যদি ভুল না হয় তাহলে হয়তো মহিলাটি উনার মা।
মহিলা টি আমাদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বললেন,,,”কাকে চাই?”
উনি মহিলাটির দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে বললেন,,”আমি এহসান..!!”
ব্যাস উনার একটা কথা যেনো তীরের মতো কাজ করলো।মহিলা টি আমাদের সাদরে গ্রহন করলেন।আমিও মহিলাটিকে সালাম দিয়ে উনার পিছন পিছন যেতে লাগলাম,কারন উনি আগেই প্রবেশ করেছেন। ভেতরে যেতেই আন্টি টি আমাদের নাস্তা-পানি দিলেন। উনি শুধু এক গ্লাস পানি খেয়েছেন। মহিলা টি আমাকে জুশ এগিয়ে দিয়ে বললেন,,”আসতে বেশি কষ্ট হয় নি তো?”
আমি জোরপূর্বক হেসে বললাম,,”না না।”
এহসান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,”বাবা কোথায়?”
উনার এমন বিহেভ দেখে আমি কিছুটা অবাক হলাম।কারন সাধারনত উনি সবার সাথে খুব সুন্দর করে কথা বলে কিন্তুু আন্টি টির সাথে এভাবে আই মিন আন্টিকে না বলে আমাকে কেনো বললো? আন্টির দিকে তাকিয়ে ভাবলাম আন্টির হয়তো খারাপ লেগেছে। আন্টি একটু হেসে বললেন,,”তোমার বাবা ঘুমাচ্ছেন।”
আন্টির কথা শুনে আমার ভ্রু কুচকে এলো,,কারন শশুরবাবার তো এখন হাসপাতালে থাকার কথা।
–“বাবা বাসায় মানে?উনাকে এত দ্রুত রিলিজ দেওয়া হয়ে গিয়েছে কীভাবে?
উনার কথা শুনে আন্টির মুখ চুপসে গেলো। আন্টি আমতা আমতা করে কিছু বলতে নিচ্ছিলেন তার আগেই উনি বললেন,,”সোজাসুজি বলাটা আপনার জন্য বেটার হবে।” আন্টি সাথে সাথে চুপ করে গেলেন এদিক ওদিক তাকিয়ে ইতস্ত হয়ে বললেন,,”আসলে তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে আসার জন্য এমন করতে বলেছিলো।উনার কিছু হয়নি,উনি সুস্থই আছেন।সকালে না হয় এ বিষয় নিয়ে কথা বলো,ওই রুম টা আমি তোমাদের জন্য ঠিক করেছি।তোমরা হাত মুখ ধুয়ে আসো আমি খাবার রেডী করছি।”
আন্টির কথা পুরো শুনার আগেই উনি গটগট করে হেটে রুমে চলে গেলেন। আমি অবাকের উপর অবাক হচ্ছি উনার কান্ড দেখে। উনি এত রুড কবে হলেন?
.
ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি আন্টি খাবার সাজিয়ে বসে আছেন।আমি মিষ্টি হেসে বললাম,,”আন্টি উনি কই?”
আন্টি মুখটা একটু কালো করে বললেন,,”বাহিরে যেতে দেখলাম,মনে হয় ওর মায়ের কবরের কাছে গিয়েছে।বাড়ীর পাশেই তো কবরস্থান। ”
আমি ছোট্ট করে বললাম,,”ওহ্”
উনি মুখ কালো করেই বললেন,,”যদি তোমার সমস্যা না থাকে তাহলে আন্টি না বলে মা ডাকো।না মানে বললে একটু খুশি হতাম।”
–“না,না। সমস্যা কেনো থাকবে?আসলে আমি আপনাকে ঠিক চিনতে পারি নি।”
উনি কিছু বললেন না শুধু হাসলেন।আমাকে বসে থাকতে দেখে বললেন,,”কী হলো খাচ্ছো না কেনো?খাবার ভালো হয় নি?”
–“কী বলেন, দেখে তো মনে হচ্ছে ভালো হয়েছে।আসলে উনার জন্য অপেক্ষা করছি।আপনি বসুন না আপনিও আমাদের সাথে খেয়ে নিবেন।”
–“না,তোমরা খাও।আমি পরে খাবো,আসলে সৌরভ এখনো আসে নি তো।আমি প্রতিদিন ওর সাথেই খাই।”
সৌরভের কথা শুনে আমি হকচকিয়ে গেলাম। তারমানে সৌরভ বাসায় নেই।কথাটা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম। কেনো যেনো সৌরভকে ফেস করতে চাচ্ছি না। আচ্ছা সৌরভকে দেখার জন্য আমার মধ্যে কোনো উৎফুল্লতা কাজ করছে না কেনো? আমার পরিবর্তে অন্য কেউ হলে নিশ্চই দেখার জন্য উশখুশ করতো।অথচ সৌরভ কোথায় সেটা জানারও বিন্দু মাত্র আগ্রহ আমার হচ্ছে না।
খাবার নাড়াচাড়া করছিলাম আর এসব ভাবছিলাম তখনই উনি দমকা হাওয়ার মতে ঘরে প্রবেশ করলেন।আমি একটু চমকে উনার দিকে তাকতেই উনি বললেন,,”তাড়াতাড়ি খেয়ে রুমে আসো।”
আমি কপাল কুচকে বললাম,,”আপনি খাবেন না?”
উনি না বলে চলে গেলেন।আমি অসহায় দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তাকালাম,উনার চোখের কেনে পানি চিকচিক করছে।উনি হেসে বললেন,,”এভাবে তাকানোর কিছু নেই।তুমি খেয়ে নেও।”
উনি খাবেন না শুনে আমারও খেতে ইচ্ছে করছে না।কিন্তু এখন উনাকে এ কথা বললে নিশ্চই কষ্ট পাবে।তাই আমি এক প্লেট খাবার সাজিয়ে নিয়ে মাকে বললাম,,”আমি খাবার রুমে নিয়ে যাচ্ছি,আমরা দুজনেই খাবো।”
উনি মিষ্টি হেসে বললেন,,”আচ্ছা।”
.
–“কী সমস্যা?খাবেন না কেনো সেটা তো বলবেন?”
উনি আমার কথা যেনো শুনেও শুনলেন না।আমার রাগ যেনো মাথায় চড়ে গেলো।খাবার নিয়ে ঠুস করে উনার মুখে দিয়ে দিলাম। উনি একদম অবাক হয়ে গেলেন।খাবারগুলো মুখ থেকে বের করতেই আমি বললাম,,”এখন যদি ফেলে দেন তাহলে আমিও খাবো না।আর আমি আপনার কারনে খাবো না অবশ্যই আপনি এটা চাইবেন না।”
উনি ফোসফোস করে খাবার খেতে লাগলেন।আমিও মুচকি হেসে খেয়ে নিলাম। খাওয়া শেষে আমি প্লেট-বাটি খাবার রুমের টেবিলে নিয়ে রেখে আসলাম।আসার সময় ইশারায় আন্টিকে বললাম,,”খেয়েছে।” আন্টির মুখে এক চিলতি হাসি ফুটে ওঠলো। আমিও হেসে চলে আসলাম।
রুমে এসে দেখি সাহেব বিছানা রেডী করে বসে আছে।আমি আস্তে করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে মশারী তুলে ভেতরে ঢুকলাম। উনি মুখ ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ করে শুয়ে পড়লেন।আমি শুধু হাসলাম।
–“উফফ,মশারী দিয়েছেন কেনো?”
–“যাতে মশা তোমাকে আর আমাকে বয়ে না নিয়ে যেতে পারে।”
উনার ত্যাড়া কথা শুনে আমার রাগ লাগলো। আসল কথা আমার এখন উনাকে খোঁচাতে মন চাচ্ছে।তাই আবারো প্রশ্ন করলাম,,”আচ্ছা আপনি বলেছেন যে সৌরভের সাথে আপনার আট বছরের পার্থক্য, সেটা কী সত্যি?”
–“না,মিথ্যা।”
–“আরে রেগে যাচ্ছেন কেনো?আমি তো আপনাকে প্রশ্ন করেছিলাম এ জন্য যে সৌরভের সাথে যদি আপনার আট বছরের পার্থক্য হয় তাহলে না জানি আমার কত বছরের হবে!”
–“হঠাৎ বয়স নিয়ে প্রশ্ন কেনো?আমি বুড়ো হলে কী সমস্যা হবে?”
–“আরে আপনি এভাবে বলছেন কেনো?আমি সেটা বলতে চাই নি। আমি জাস্ট কিউরিসিটর জন্য বলেছিলাম।”
–“না,তখন কথার টানে বলে ফেলেছিলাম।৬ বছরের পার্থক্য।”
–“ওহ্,তারমানে আপনি আমার দশ বছরের বড়!”
–“হ্যা,তো দশ এত টেনে বলার কী আছে?”
–“আপনি কথায় কথায় এত রেগে যাচ্ছেন কেনো? আমি তো স্বাভাবিকভাবেই বলেছি আপনার কাছেই এমন লেগেছে।আমি আপনার সাথে কথাই বলবো না।কার না কার রাগ আমার উপর ঝাড়তেছে।”
.
.
.
চলবে?