ভুলিনি তোমায় পর্ব-৩৫

0
3511

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim _Nishi
#পর্ব_৩৫

খুব বুঝেছি উনি ভয়ংকর রেগে গিয়েছেন।কারন রেগে গেলে মানুষের হুশ থাকে না যে সে কোথায় কী বলতেছে।আমি আর কিছু বললাম না চুপ করে রইলাম।কারন আমি নিজেও চায় উনি যেনো আমি ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের দিকে না তাকায়। কিন্তু কথাটা বলেছিলাম এ ভেবে,,যদি উনার বাবা উনাকে আরেকটা বিয়ে করতে বলে বা উনি আরেকটা বিয়ে করে তাহলে তো আমার আর কোনো মূল্য থাকবে না,হয়তো নতুন বউয়ের কথায় আমাকে বের করে দিবে কিন্তুু আমি যদি আগেই উনাকে বিয়ের কথা বলি তাহলে হয়তো একটু খুশি হয়ে আমাকে উনাদের সাথে রাখবে।
অথচ বিষয়টা পুরো উল্টো,উনি আমাকে ছাড়া আর কোনো মেয়ের দিকে তাকাবেও না।বিষয়টাতে অদ্ভুদ এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করতে লাগলো। মনটা অনেক হালকা হালকা লাগছে। সবসময় নাহয় একটা টেনশন থাকতো,এই বুঝি উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিবে। এখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলতে পারবো। না হলে অজানা ভয় আমাকে কুড়ে কুড়ে শেষ করে দিতো। আচ্ছা খুব কী কষ্ট হতো যদি সবকিছু নরমাল হতো?

সেদিন রাতে আর আমাদের মধ্যে আর কোনো কথাবার্তা হয় নি। উনি রেগে রুম থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন।আমি উনার যাওয়ার দিকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। এ মানুষটা আমাকে কতটা ভালোবাসে খুব ভালো করেই বুঝে গিয়েছি আমি। গভীর রাত পর্যন্ত উনার অপেক্ষায় বসে রইলাম,কিন্তুু না উনার আসার কোনো চিহ্ন দেখলাম না। আমার খুব কান্না পাচ্ছিলো,রাগ লাগছে কেনো যে ওসব বলেছি,এমনিতেই উনার মন-মানসিকতা ভালো ছিলে না। আবার আমি এসব বললাম নিশ্চিত, আমার উপর রাগ করে বের হয়ে গিয়েছেন।কথাটা ভাবতেই কেঁদে দিলাম।রাত যত বাড়তে লাগলো আমার কান্নার বেগ ততই বাড়তে লাগলো।

প্রায় শেষ রাতের দিকে উনি আসলেন।উনাকে দেখা মাত্রই আমি টলমলে পায়ে গিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরলাম।

উনি ব্যস্তভঙ্গিতে আমাকে বলতে লাগলেন,,”কী হয়েছে?তুমি কান্না করছো কেনো?ভয় পেয়েছো?”

আমি মাথা নাড়ালাম।দূর্বল গলায় বললাম,,”আ আপনি কোথায় গিয়েছেন?”

–“কোথায় যাবো?আমি একটু বাহিরে গিয়েছিলাম।”

আমি কিছু বললাম না,উনাকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে রইলাম।এ লোকটাকে কবে আমি এতটা ভালোবেসে ফেলেছি? উনি ছাড়া একেক টা সেকেন্ড দম বন্ধকর লাগছে।মনে হচ্ছে দম আটকে মারা যাবো।

উনার বুকে মাথা রেখে অস্ফুটসুরে বলে উঠলাম,,”আমি আপনাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”

উনার বেশ খানিকটা সময় লেগে যায় আমার কথাটা বুঝতে।কথাটা বুঝতেই উনি হেসে দিলেন,হেসে হেসেই বললেন,,”মাত্র কয়েকঘন্টা আমাকে ছাড়া থাকতে পারছো না আবার বলছো বিয়ে করে নিতে।”

উনি আমার কোনো জবাব না পেয়ে আমার দিকে তাকাতেই দেখলেন ইতোমধ্যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। আমার মাথাটা তুলে মুখের সামনে পড়া চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলেন। অতঃপর যত্নসহকারে আমাকে বিছানায় শুয়ে দিলেন। আমিও জুবুথুবু হয়ে উনার বুকের সাথে মিশে রইলাম। অনেক ঝর-তুফানের পর এক শান্তির ঘুম ঘুমাতে লাগলাম।’স্বামীর বুকেই বোধ হয় স্ত্রীর স্বর্গীয় সুখ।’

ভোরের মিষ্টি আলো চোখে পড়তেই ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো।চেখের পাপড়িগুলো একবার ভাজ করতে লাগলাম তো আবার খুলতে লাগলাম।অনেক্ষন পর চোখ কচলাতে কচলাতে চোখদুটো মেললাম। চোখ খুলতেই দেখলাম এহসান এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।চোখে মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে আছে। উনার চিন্তার মূল কারন যে আমি তা বুঝতে বেশ বেগ পেতে হলো না।

—“কখন উঠেছেন?”

—“ঘুমোলে না উঠবো।”

–“আপনি সারা রাত জেগে ছিলেন?”

–“হু”

–“আপনি পাগল?সারারাত না ঘুমিয়ে কেনো ছিলেন,এখন শরীর খারাপ করবে তো।”

উনি কিছু বললেন না শুধু মিষ্টি হাসি দিলেন।আমি ধ্যাত বলে উঠে গেলাম। পিছন থেকে উনার হাসির ঝংকার কানে বাজতে লাগলো,বুঝলাম উনি হাসছেন।অবশেষে উনি একটু হেসেছেন ভেবে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম। কবে যে সব স্বাভাবিক হবে?কখন আমরা একটু শান্তিতে থাকবো?জীবনটা এমন কেনো?এত জটিলতায় ভরপুর যা কাটাতে কাটাতে অর্ধেক সময় পার হয়ে যায়।ইশশ সবকিছু যদি পানির মতো হতো!

.

খাবার টেবিলে বসে আছি আমি বাবা,আর শাশুড়ি মা।এহসান রুমে শুয়ে আছেন, সৌরভ কই জানি না। ওই কথাগুলো বলার পর আর ওকে দেখি নি,আমিও আর কাউকে ওর কথা জিজ্ঞেস করি নি। তখনই হুট করে এহসান এসে বাবাকে স্ট্রিক্টলি বলতে লাগলেন,,,

‘বাবা আমি আজই ঢাকা যাবো।’

আচমকা এমন ককথা শুনে বাবা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই উনি স্বাভাবিকভাবে বললেন,,”তুমি তো জানই কালকে ওর রেজাল্ট দিয়েছে।আমার আশা ওকে ঢাবিতে পড়াবো।ওকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন আশা করি আমার স্বপ্নের পথে বাধা দিবে না।আর তাছাড়া আমি একটা জবের জন্য এপ্লাই করেছিলাম সেটা কনফার্ম হয়ে গিয়েছে দুইদিন আগে। আমি আজকেই যাবো।”

উনার কন্ঠে স্পষ্ট জেদ প্রকাশ পেয়েছে,,আমি কিছুই বুঝলাম না উনি হঠাৎ এমন কেনো করছেন।

বাবা মুখ খুলেও বন্ধ করে নিলেন।কিছুক্ষন ভেবে উনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,,”সিদ্ধান্ত তো নিয়েই নিয়েছো,আমাকে আর বলার কী প্রয়োজন ছিলো?”

উনি বাবার পাশে বসে,বাবার হাত মুঠোয় পুরে বলতে লাগলেন,,

—“বাবা,একটু বুঝার চেষ্টা করো।তাছাড়া আমরা তো আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকবো।তুমিও গিয়ে দেখে আসবে আমাদের।সমস্যা কই?প্লিজ বাবা,,!!”

উনার কথার জবাবে বাবা কয়েক মুহুূর্ত নিরবতা পালন করে বললেন,,”আচ্ছা,ঠিক আছে। ”

বাবার জবাব পেয়ে উনি বিশ্ব জয়ের হাসি দিলেন। খুশিতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললেন,,”থ্যাংকইউ বাবা।”

বাবাও মুচকি হাসি দিলেন।এদিকে আমরা সবাই আহাম্মকের মতো উনাদের কর্মকান্ড দেখতে লাগলাম।উনি এসব কী বলছেন?উনি তো কোনোদিনও আমাকে বলেন নি যে আমাকে ঢাবিতে পড়াতে চান,আর না উনি চাকরী করবেন।তাহলে এসব কেনো বললো?উনাকে কী আমি কখনই বুঝতে পারবো না?একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাওয়ার দিকে মনোযোগ দিলাম।

.

রুমে আসতে না আসতেই উনি তাড়া দিতে লাগলেন সবকিছু গুছিয়ে নিতে। আমি বেকুবের মতো উনার দিকে তাকিয়ে আছি,কারন উনি ইতোমধ্যে সব গুছিয়ে নিয়েছেন।

—“আপনি তো কেনোদিন বলেন নি আমাকে ঢাবিতে পড়াতে চান। আর না আপনার চাকরীর কথা।আমার জানামতে চাকরীর মেসেজ আরো বিশ পঁচিশ দিন আগে আসছে। তাহলে আপনি এখন কেনো যেতে চাচ্ছেন?”

—“এত প্রশ্ন কেনো করো?আমি এত কিছু বলতে পারবো না, তাড়াতাড়ি তৈরী হও আজকেই যাবো।কালকে চাকরী তে জয়েন হওয়ার লাস্ট ডেইট না হলে আর জয়েন হতে পারবো না।”

আমি আর কোনো প্রশ্ন করলাম না।চুপচাপ উনার কথামতো সব করতে লাগলাম।উনার মন-মেজাজ যে বেশ ভালো না তা ভালোই টের পাচ্ছি।চুপচাপ তৈরী হয়ে নিলাম।

বাসায় এসে পৌঁছালাম ঘন্টাখানেক আগে।আসতে আসতে অনেক রাত হয়ে গেলো,অতিরিক্ত ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় এসেই শুয়ে পড়লাম।আমার মনটা আগের থেকেও খারাপ হয়ে আছে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে আসার সময় খুব কেঁদেছিলাম। মা ও কেঁদেছিলেন, উনি তো বারবার না যাওয়ার জন্য বলেছেন।সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম মায়ের সেই আকস্মিক কথায়।উনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,,”পরেরবার আসার সময় নাতি-নাতনি নিয়ে এসো।”
উনার কথা শুনে আমার লজ্জা পাওয়ার কথা ছিলো অথচ আমি মুখ কালো করে ফেলেছিলাম। বুকটা হু করে উঠেছিলো।আমি কোনোরকম কথাটা হজম করে নিয়েছিলাম। এহসান হয়তো বিষয়টা টের পেয়েছিলেন তাই উনি তখনই তাড়া দিতে লাগলেন। সবার সাথে দেখা হলেও সৌরভের দেখা পেলাম না। সেই কথা বলার পর ওকে আমার সামনে একবারের জন্যও দেখি নি। পুরো পথে আমি আর উনার সাথে তেমন কথা বললাম না। মাথায় শুধু মায়ের বলা কথাটা ঘুরপাক করতেছিলো।

.
সকাল সাত টা বাজে,উনি আমাকে টেনে তুলে বসিয়ে দিয়েছেন।আমি বসে বসে ঝিমাচ্ছি এদিকে উনি আমাকে বারবার তাড়া দিতেছেন। আমি নিজেও জানি না, কেনো এত সকাল সকাল তৈরী হতে বলছে। উনি তো একদম ফুল তৈরী হয়ে আছেন। আমি অনেক কষ্টে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসলাম।উনি নিজেই ওয়ারড্রপ থেকে আমার জামা বের করে দিলেন তৈরী হতে।আমি কোনোরকম তৈরী হতেই উনি এসে আমাকে ব্রেকফাস্ট করাতে লাগলেন। অনেকক্ষন পর আমরা বের হলাম অজানা উদ্দেশ্যে। আমি বারবার উনাকে প্রশ্ন করেও যখন জানতে পারলাম না তখন নিজ থেকেই চুপ করে গেলাম।

কিছুক্ষনের মধ্যেই আমরা ঢাকা পি.জি হাসপাতালের সামনে এসে পৌঁছে গেলাম। হাসপাতাল দেখে আমার মাথায় হাজারো উদ্ভট চিন্ত এসে ভিড় জমালো।উনি হাসপাতালে কেনো এসেছেন?

গাড়ী থেকে নেমেই আমি উনাকে প্রশ্ন করলাম,, “আমরা এখানে কেনো এসেছি?”

উনি হাটতে হাটতে বললেন,,”গেলেই দেখতে পাবা।”

–“আজব এখন বললে কী সমস্যা?”

–“আমি আমার ভার্সিটির এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছি,উনি এখানের ডাক্তার। হয়েছে,এবার চুপচাপ আমার সাথে চলো।”

আমি কিন্তু বলে প্রশ্ন করার আগেই উনি হাত দিয়ে থামিয়ে দিলেন। আমিও রাগ দেখিয়ে উনার পিছন পিছন যেতে লাগলাম। হাসপাতালে প্রবেশ করতেই উনি আমার হাত ছেড়ে গেইটের সামনে ডাক্তারি পোশাক পরে দাড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি জড়িয়ে ধরে আলাপ করতে লাগলেন।এহসান, উনার সাথে বেশ কিছুক্ষন কথা বলার পর উনি সহ আমাকে নিয়ে উনার কেবিনে গেলেন। আমি চুপচাপ বসে ছিলাম তখন এহসান আমার সেদিনের রিপোর্ট বের করে ছেলেটিকে দিলেন। ছেলেটি কিছুক্ষন রিপোর্ট উলটপালট করে বললেন,,”হুম,উনি যা বলেছেন তা ঠিক। তবে তোমার ওয়াইফের যদি রেগুলার টির্টমেন্ট করাও তাহলে ও সুস্থ হয়ে যাবে। এবং খুব দ্রুতই বেবী নিতে পারবে তবে এতে তোমার ওয়াইফের জন্য রিস্ক হয়ে যেতে পারে।উনার বয়স টা এত বেশি না, যার কারনে অনেক সমস্যা হতে পারে। ”

ডাক্তার এমন আরো নানান কথা বলতে লাগলেন। আমি শুধু চুপচাপ এহসানের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তার মানে আমাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য উনি এত বাহানা দিয়ে চলে এসেছেন! উনাদের আলাপ-আলেচনা দেখে বুঝলাম যে কালকেই এ বিষয় নিয়ে উনার সাথে আলোচনা হয়েছে। ওহ,তো রাতে যখন উনি বের হয়েছিলেন,তখন ডাক্তারের সাথে কথা বলেছিলেন!উনি এমন কেনো?কখনো কেনো আমাকে সব বলে না,সবকিছু কেনো আমি যেনো না বুঝি তেমনভাবে করে?উনার পরিবর্তে অন্য কেউ হলে হয়তো পরিবারের সবাইকে আমার অক্ষমতার কথা জানাতেন,তারপর ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসার জন্যও কত নাটক করতো। অথচ উনি এমনভাবে সব করলেন যে কেউ একটুও টেরও পেলো না।আমার মমনে হচ্ছে আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী। কাউকে এত ভালোবাসে কীভাবে?উনি কী জানেন যে উনি,বারবার উনি উনার গভীর প্রেমে জড়িয়ে নিচ্ছেন আমায়।

—“আচ্ছা আপনি কী আমাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য এত কাহিনী করে নিয়ে এসেছেন?”

হসপিটাল থেকে সব ঝামেলা মিটিয়ে বের হতেই আমি উনাকে প্রশ্ন করলাম। আমার প্রশ্ন শুনে উনি হেসে বললেন,,

–“কেনো?তোমার এমন কেনো মনে হলো?”

—“কথাটা না পেঁচিয়ে, উত্তর দেন।”

.
.
.
চলবে?