ভুলিনি তোমায় পর্ব-৩৬ এবং শেষ পর্ব

0
4888

#ভুলিনি_তোমায়?
#Nishat_Tasnim
#পর্ব :৩৬(শেষ)

—“আচ্ছা আপনি কী আমাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য এত কাহিনী করে নিয়ে এসেছেন?”

হসপিটাল থেকে সব ঝামেলা মিটিয়ে বের হতেই আমি উনাকে প্রশ্ন করলাম। আমার প্রশ্ন শুনে উনি হেসে বললেন,,

–“কেনো?তোমার এমন কেনো মনে হলো?”

—“কথাটা না পেঁচিয়ে, উত্তর দেন।”

উনি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বলে নিশ্চুপভাবে হাটতে লাগলেন। আমিও আর কোনো প্রশ্ন করলাম না।কী করবো?
__________________________

যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,
আমি বাইব না, আমি বাইব না মোর খেয়ারতরী এই ঘাটে,
চুকিয়ে দেব বেচা কেনা,
মিটিয়ে দেব গো, মিটিয়ে দেব লেনা দেনা,
বন্ধ হবে আনাগোনা এই হাটে-
তখন আমায় নাইবা মনে রাখলে,
তারার পানে চেয়ে চেয়ে
নাই বা আমায় ডাকলে ।

গানটি গুনগুন করে গেয়ে চলছে আমি।
দেখতে দেখতে কয়েকগুলো মাস কেটে গিয়েছে।তবে দিনগুলো বেশ ভালেই চলছে।বেশ ভালো না খুব ভালো চলছে।প্রতিদিন ভার্সিটিতে যাওয়া আসা, উনাকে অফিসের জন্য তৈরি করে দেওয়া তারউপর গতকাল আমার প্রেগনেন্সি রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। এটা নিয়ে আমি কত টা খুশি হয়েছি তা বলে বোঝাতে পারবো না।

গ্রাম থেকে আসার পর থেকে আমি বাচ্চা নিয়ে অনেক বেশি পজেসিভ হয়ে গিয়েছিলাম।প্রত্যেক মাসেই আমি প্রেগনেন্সি কিট দিয়ে টেস্ট করতাম। আর প্রতিবারই রেজাল্ট নেগেটিভ আসতো,তখন খুব কষ্ট হতো,বুক ফেটে কান্না আসতো। কাল যখন পজেটিভ রিপোর্ট এসেছে আমি একদম বাকরুদ্ধ হয়ে যাই।খুব কষ্ট হচ্ছিলো বিশ্বাস করতে। খুশিতে চোখের কোনে পানি চিকচিক করে উঠেছিলো।বিষয়টা নিয়ে আমি এতটাই বিভোর ছিলাম যে উনাকে কীভাবে বলবো ভেবেই পাচ্ছিলাম না। সারাদিন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। ভার্সিটিতেও যায় নি। উনি এসবের কিছুই জানেন না, উনি মনে করেন যে আমি বাচ্চার কথা ভাবি না। কারন সেদিন উনি হাসপাতাল থেকে আসার পর রাত দিন আমাকে এটাই বুঝিয়েছেন যে উনি বাচ্চা পছন্দ করেন না।কিন্তুু উনি যে কথাটা আমাকে শান্তনা দেওয়ার জন্য বলেছিলেন তা খুব ভালো করে বুঝেছিলাম।আমি বুঝেও না বুঝার ভান করেছিলাম। উনি তখন ভেবেছেন আমি মনে হয় বাচ্চার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি। পড়ালেখা নিয়ে আমাকে পজেসিভ দেখে উনার এমন ধারনা হয়েছে। আমি ইচ্ছা করেই উনার সামনে পড়ালেখা নিয়ে পড়ে থাকতাম। আর উনিও নতুন চাকরী নিয়ে প্রচুর ব্যস্ত থাকতেন তাই আমার প্রতি ভালোভাবে খেয়ালই করেন নি।

সকাল থেকে রান্নাঘরে পড়ে আছি। আজকে নানান প্রকার ভেজনের ব্যবস্থা করতেছি, স্পেশালি উনার জন্য।সব উনার পছন্দের খাবার,।মাথা অদ্ভুদ ধরনের বুদ্ধি ঘুরঘুর করতেছে। অনেক ভেবচিন্তে ঠিক করেছি যে আমি আজকে সবকিছু তৈরী করে ভালোমতো রুমটা ডেকোরেট করে, নিজেও ভালো পোশাক পরে তৈরী হয়ে উনাকে সারপ্রাইজ দিবো। সারপ্রাইজ নামক বস্তুটা আমার কাছে কেমন অড লাগে,কিন্তু সারপ্রাইজ উনার অনেক পছন্দ তাই এ ব্যবস্থা। জানি না আদৌ উনার পছন্দ হবে কী না,প্রথমবার উনার জন্য সারপ্রাইজ প্লান করতেছি,খুবই নার্ভাস।

“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন

এক হাতে সবকিছু সামলাতে বেশ হিমশিম খেতে হয়েছে।দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে পড়েছে আমার সবকিছু রেডী করতে। সন্ধ্যার পরপরই উনি অফিস থেকে আসবেন তাই উনি আসার আগে রেডী হওয়ার জন্য গেলাম। সবকিছু পরিপাটি করে নিজেও পরিপাটি হয়ে নিলাম। আজ এই প্রথম আমি উনার জন্য শাড়ি পড়তেছি,লাস্ট সৌরভের জন্য সেদিন শাড়ি পরেছিলাম।এরপর আর কখন এই শাড়ি ছুয়েও দেখি নি। আর উনিও কখনও আবদার করেন নি, তাই আর ভাবা হয় নি। বিয়ের দিন ফুফি একটা নরমাল ডিজাইনের শাড়ী দিয়েছিলেন,আলমারী থেকে বের করে সেটাই পড়ে নিলাম। কাপড় টা নীল রঙ্গের জামদানী। আমি সুন্দর করে কাপড় টা পড়ে নিলাম,হাত ভর্তি চুড়ি, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক,সাথে চুলগুলো খোপা করে নিলাম। কি যেনো মনে করে ওয়ারড্রব থেকে উনার দেওয়া রুপার পায়েল জোড়া বের করে পরে নিলাম।
সবকিছু একদম ঠিকঠাক করে রেডী হয়ে বিছানায় পা দুলিয়ে বসে রইলাম উনার অপেক্ষায়। এত সুখ কপালে সইবে তো?

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে উনি দরজায় কড়া লাড়লেন। আমি লজ্জামাখা মুখ নিয়ে গেলাম দরজা খুলতে,কিন্তুু তখন আমার ভেতর কেমন লজ্জা, ভয় মিশ্রিত অনুভূতি কাজ করতে লাগলো। তাই আমি দরজার সামনে থেকে ঘুরে গিয়ে ডাইনিং এর লাইট টা নিভিয়ে দিলাম। তারপর অতি সাবধানে দরজাটা খুলে সরে আসলাম। আমার কেমন যেনো শরম শরম লাগছিলো।

ঘরে প্রবেশ করেই উনি অস্থির হয়ে বললেন,,
–“নায়লা,নায়লা তুমি কেথায়?ঠিক আছো তো?আর লাইট এর কি হয়েছে?”

আমি হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে রুমের দিকে হাটা ধরলাম। খেয়াল করলাম উনিও দাড়াও,দাড়াও বলে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে আমার পিছন পিছন চলে আসতেছেন আমাকে ধরার জন্য। প্রথমে আমি বুঝলাম না যে উনি আমার পিছন পিছন কীভাবে আসতেছেন,পরে ঠিকই বুঝলাম যে চুড়ির টুংটাং আর পায়েলের ওই একটা গুঙ্গুরের শব্দে উনি আমার পিছন আসতেছেন। আমি কোনোরকম রুমে ঢুকতেই উনি পিছন থেকে আমার হাত ধরে ফেললেন।আমাকে টান মারতেই উনার বুকের উপর এসে পড়লাম সাথে সাথে চুলগুলো খুলে গেলো। উনি আমাকে ভালো করে দেখতে লাগলেন,যদিও চাদের আলোয় আমাকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো। কয়েক সেকেন্ড ভালো করে চোখ বুলিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন।

—“ওহ,তুমি।জানো, আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।পুরো ঘর এমন অন্ধকার করে রেখেছো কেনো?এই তুমি কি চুড়ি পরেছো?আর লাইট বন্ধ করেছো কেনো,দাড়াও আমি লাইট জ্বালাচ্ছি।”

বলেই উনি লাইটের সুইচের দিকে এগুতে লাগলেন,আমি চুপ করে রইলাম। আসলে কথা বলতে কেমন সংকোচ লাগছে। উনি লাইট জ্বালিয়ে দিতেই আমি চোখ বন্ধ করে সোজা হয়ে দাড়িয়ে গেলাম। প্রায় অনেক্ষন উনার কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। আমি ধীরে ধীরে চোখ খুলতেই দেখলাম উনি যেখানে ছিলেন সেখানেই আমার দিকে থম মেরে তাকিয়ে দাড়িয়ে রইলেন। উনার এমন তাকানো দেখে আমার অস্বস্তি হতে লাগলো,আমি শাড়ির আচল হাতে নিয়ে মুচড়ামুচড়ি করতে লাগলাম। এক হাত দিয়ে সামনে পড়া চুলগুলো কানের পিঠে গুজতে গুজতে বললাম,,

—“ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি সব রেডী করে রেখেছি।”

উনি কয়েক মুহূর্ত নিষ্পলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলেন। আমি বড় বড় নিশ্বাস ছাড়লাম,বিয়ের এত দিন পরেও কোথা থেকে যে লজ্জা আসছে আমি নিজেও বুঝতেছি না। ২ মিনিট পর উনি এসেই দেখলেন আমি খাবার-দাবার সাজিয়ে বসে আছি।

উনি একটা চেয়ার টেনে বের করে বসতে বসতে বললেন,,

—“কী ব্যাপার, আজকে স্পেশাল কোনো ডে নাকি?”

আমি লজ্জিতভাব নিয়ে মাথা নাড়িয়ে বললাম,,হুম।

–“ওহ্,,তো কী এমন স্পেশাল ডে,আমি যতটুকু জানি আজকে তো ১৪ ফেব্রুয়ারি নয়।”

–“১৪ ফেব্রুয়ারি ছাড়া কি আর কোনো স্পেশাল দিন নেই?”

–“আছে তো। তুমি হঠাৎ এত কিছু করেছো দেখে ১৪ ফেব্রুয়ারি মনে হচ্ছে। আচ্ছা,তুমি কী লজ্জা পাচ্ছো,না মানে আমার কেমন যেনো এটাই মনে হচ্ছে।”

আমি লজ্জামাখা কন্ঠে বললাম,,
—“আপনি বেশি কথা বলেন। খাবারগুলো কেমন হয়েছে?”

–“ওরে বাবারে,তার মানে আমার বউ সত্যি লজ্জা পাচ্ছে। আচ্ছা কই দেখাও কী রান্না করেছো।”

আমি খাবারের উপর থেকে ঢাকনা সরিয়ে উনাকে এক এক করে সব দেখাতে লাগলাম। উনি প্রচন্ড অবাক হয়ে খাবারের দিকে তাকিয়ে বললেন,,”এসব তুমি রান্না করেছো?”

আমি নাক ফুলিয়ে বললাম,,,

—“না,আপনার আরেকটা বউ আছে না ও রান্না করেছো।”

উনি হেসে হেসে বললেন,,

–“হুম, আমিও সেটাই ভেবেছি।তুমি যে রান্না করো নি আমি তো সেটা ভালো করেই জানি।”

–??

উনি এবার একটু জোরেই হেসে দিলেন। হাসিমুখেই বললেন,,”ওয়াও,,বিরিয়ানী,পোলাও,মুরগীর মাংস,ডিম আবার চিংড়ি মাছও।”

উনি কিছুক্ষন খাবারগুলোর দিকে ভ্রু কুচকে তাকালেন, তারপর ব্যস্ত সুরে বললেন,,”এই,তোমার হাত দেখাও তো।”

আমি অবাক হয়ে বললাম,,”কেনো?”

—“আরে,দেখবো না কোথায় কেথায় হাত পুড়িয়েছো?”

–“এবার কিন্তুু বেশি হয়ে যাচ্ছে।”

উনি হেসে দিয়ে বললেন,,”আচ্ছা সরি। তাছাড়া খাওয়া যাবে তো?না গেলোও সমস্যা নেই আমার বউ রান্না করেছো সেটা তো খেতেই হবে। ”

কথাটা শেষ করেই উনি খাওয়া শুরু করলেন।আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছি, কেমন হয়েছে তা জানার জন্য।উনি মুখে দিয়েই থম মেরে গেলেন। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম,না জানি খারাপ হয়েছে কী না?

–“খুব বেশি খারাপ হয়েছে?”

উনি কিছু না বলে উনার প্লেট থেকে এক লেকমা নিয়ে আমার মুখে পুরে দিলেন। আমি মুখে নিতেই দেখলাম সব কিছুই ঠিক আছে।তাহলে উনি এভাবে রিয়েক্ট করছেন কেনো?

—“সব তো ঠিকঠাক লাগছে তাহলে আপনি এমন করছেন কেনো?”

—“আরে সব ঠিক আছে দেখেই তো আমি এমন রিয়েক্ট করেছি।”

–“মানে?”

—“এতো পারফেক্ট কীভাবে বানিয়েছো?জাস্ট ওয়াও। আমি ভেবেছি হয়তো ওটা -এটা কম বেশি হয়ে যাবে বাট এত মজা করে তুমি কীভাবে বানালে তাই শকড!”

—“যেভাবে বলছেন মনে হয় রেস্টুরেন্ট থেকেও বেস্ট হয়েছে। এতটাও মজা হয় নি।”

—“আমার কাছে রেস্টুরেন্ট কেনো সবকিছু থেকে বেস্ট লেগেছে।কারন আমার বউ ভালোবেসে আমার জন্য রান্না করেছে।এটা তে কয়েক কেজি মরিচ দেওয়া থাকলেও আমার কাছে মজা লাগতো।বুঝেছো?”

–“হু, হু,,বুঝেছি। এত তেল দেওয়া লাগবো না। সব শেষ করেন।”

উনি মুচকি হেসে খেতে লাগলেন,খাওয়ার ফাকে ফাকে আমাকেও খাওয়াতে লাগলেন। খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ হতেই আমি বললাম,,”আমাকে কেমন লাগছে বললেন না তো?”

–“হুম,বলবো তো।আগে বলো এত কিছু কেনো?”

আমি চুপচাপ নিচের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম।উনাকে কীভাবে বলবো সেটাই ভেবে পাচ্ছিলাম না। ধীর পায়ে উঠে গিয়ে উনার পাশ ঘেষে দাড়িয়ে উনার কানে কানে বললাম,,”আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন।” কথাটা বলেই আমি লজ্জা পেয়ে সরে আসতে নিলেই উনি আমার হাত ধরে ফেললেন। উনি আমার দিকে তাকিয়ে চোখ দিয়ে প্রশ্ন করলেন,,”সত্যি?”
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম হ্যা। সাথে সাথে উনার চোখের কোনে পানি দেখা দিলো। উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে দিলেন। আমিও উনাকে জড়িয়ে ধরলাম।

সে রাত টা অনেক টা স্বপ্নের মতো কেটেছে। আমি উনাকে এত খুশি হতে এর আগে দেখি নি, দুজনে অনেকগুলো সুন্দর মুহূর্ত কাটিয়েছিলাম।সারারাত বারান্দায় বসে সব কল্পনা-জল্পনা করতে লাগলাম। উনি তো বাচ্চার ভবিষ্যৎ পর্যন্ত চলে গিয়েছিলেন। আমি তখন বলেছিলাম,আপনি না বাচ্চা পছন্দ করেন না তাহলে এখন কেনো এসব বলছেন?
উনি আমার কোলে মাথা রেখে বললেন,,”সেটা তো তোমাকে খুশি করার জন্য বলেছিলাম।”
আমি বললাম,আমি আগেই জানতাম যে আপনি এজন্য বলেছেন।

সেদিনের পর আরো দুইদিন কেটে গিয়েছে। হঠাৎ করেই উনি সকাল সকাল বললেন,,”আজকে একবার ডাক্তারের কাছে চেকআপ করাবো,,!”
আমি আর কোনো কথা বললাম না।চুপচাপ উনার সাথে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিলাম।

ডাক্তারের সামনে বসে আছি অনেকক্ষণ হয়েছে। এ পর্যন্ত দুবার টেস্ট করিয়েছেন আর বারবারই রিপোর্ট গুলো দেখছেন। ডাক্তারের রিয়েকশন দেখে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।

–“এর আগে আপনারা কোথায় টেস্ট করিয়েছেন?সেটার রিপোর্ট টা কি দেখতে পারি?”

–“আসলে ম্যাম,এর আগে অন্য কোনো হাসপাতালে টেস্ট করি নি।প্রেগনেন্সি কিট দিয়ে টেস্ট করেছিলো।”

–“ওহ,,আমিও তাই তো বলি। আচ্ছা আপনি কী ভালো করেই দেখেছেন যে পজেটিভ ছিলো।”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,,”হ্যা।”

–“সরি বাট আপনি হয়তো ভুল দেখেচেন বা ভুল বুঝেছেন।রিপোর্ট অনুযায়ী আপনি প্রেগন্যান্ট নন। আমি দুবার টেস্ট করিয়েছি, আমার রিপোর্ট তো আর ভুল না।”

ডাক্তারের কথাটা শেষ হতেই প্রচন্ড শক খেলাম। নিশ্বাস আটকে আসছিলো,কলিজা কেপে কেপে উঠতেছে। আমার এতদিনের সব আশা মুহূর্তেই ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেলো। কষ্টে বুকটা ফেটে আসছিলো।চোখ দুটো ভীষন জ্বালা করছে,আস্তে আস্তে সব ঝাপসা হতে লাগলো।বুঝতে পারলাম আমি সেন্সলেস হচ্ছি। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না ঢলে পড়লাম উনার বুকে।

সেদিন আমার সাথে উনিও আশাহত হলেন। এই প্রথম উনাকে এতটা অসহায় হতে দেখেছি,উনি একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলেন। কথাটা আমাদের প্রচুর ডিপ্রেশনে ফেলে দিয়েছিলো। এতটা কষ্ট বোধহয় আর কখনো লাগে নি।জানি না, তবে প্রতিবারই একথা মনে হয় যে এটাই বোধ হয় সবচেয়ে বড় কষ্ট। দুদিন অনেকটা শকের মধ্যে ছিলাম। দুজনেই কেমন যেনো হয়ে গিয়েছিলাম। দিনদিন আমি পাংসুটে হয়ে যাচ্ছিলাম,চোখের নিচে কালি পড়ে নিচে নেমে গিয়েছে। উনি নিজেকে দুদিনেই সামলিয়ে নিয়েছিলেন কিন্তুু আমি পারি নি কারন এবার আমার অনেক আশা-আকাঙ্খা,, অনেক স্বপ্ন ছিলো। আমার অবস্থা দেখে, উনি নিজেকে একদম বাহিরে থেকে সামলিয়ে নিয়েছেন। আমকেও সমলানোর অনেক চেষ্টা করতেছেন,কিন্তুু কিছুতেও বাচ্চার কথা মাথা থেকে বের করতে পারছে না।আমাকে সামলাতে গিয়ে মাঝে মাঝে উনি নিজেও কেঁদে দিতেন। জীবন এত ট্রেজেডি কেনো?এত কষ্ট, দুঃখ কেনো? সবার জীবন টা কেনো স্বপ্নের মতো হয় না?

আমার ব্যবহারগুলো কেমন অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছিলো। সবসময় কেমন যেনো একটা ঘোরের মধ্যে থাকি।আসলে নিজের প্রতিই তিক্ততা চলে এসেছে।

সকালবেলা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। চোখ খুলতেই একটা ফুটফুটে বাচ্চাকে শুয়ে থাকতে দেখে লাফ মেরে উঠে বসলাম। আমার কাছে বাচ্চাটাকে স্বপ্নের মতো লাগছে। আমি সামনে তাকিয়ে দেখি এহসান হেসে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি কাপা কাপা গলায় বললাম,,”ও কে?”

এহসান বাচ্চাটাকে আমার কোলে দিয়ে বললো,,”ও আমাদের ছেলে।”

আমি অবাক হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে বললাম,,”মানে?”

—“মানে হলো,ও আমাদের বাচ্চা। আমাদের ছেলে।”

এহসানের কথা শুনে খুশিতে চোখ দুটো চিকচিক করে উঠলো। আমি উৎফুল্ল হয়ে বললাম,,”ও আমার বেবী?”

উনি মাথা নাড়িয়ে বললেন হ্যা। তখন আমার খুশি দেখে কে!

উনি নিজে নিজেই বলতে লাগলেন,,

—“নিজের সাথে যখন নিজের জীবন নিয়ে অভিযোগ করছিলাম তখন আমি দেখলাম আমার বর্তামান কষ্ট হচ্ছে আমার বউ মা হতে পারবে কী না তার সম্ভাবনা নেই। তখন আমি ভাবলাম যে পৃথিবীতে এখানে সেখানে হাজারো বাচ্চা আছে এবং তারা সবাই চায় গ্রহনযোগ্যতা। সো কাঁদার কোনো কারন নেই,যা এবং যেকোনো বাচ্চা এডপ্ট করে নেও। এন্ড এটাই আমি করেছি।”

উনার কথা শুনে উনার প্রতি সম্মান আরো বেড়ে গেলো। আমি খুশি হয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরে বললাম,,”থ্যাংকইউ।”

—“তুমি খুশি তো?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,,”হ্যা, খুব খুশি।
সেদিন থেকে আমার জীবন একদম বদলে যায়। বাচ্চা, সংসার নিয়ে আমি একদম সুখী।কখনো মনেই হয় না যে এ বাচ্চা টাকে আমি জন্ম দেই নি। আমার জীবনের অপ্রাপ্ত সুখগুলো বাচ্চাটি পূরন করে দিলো। উনি ওর নাম শখ করে রেখেছেন, আফরাহিম ফায়াত নেহাল। ওকে নেহাল বলেই ডাকি। আমার শশুড়-শাশুড়ি কাল যখন এসে দেখলেন আমাদের কাছে ৩ মাসের বাচ্চা।তখন উনার প্রচন্ড অবাক হয়েছিলেন,,আমি কিছু বললাম না চুপ করে ছিলাম। এহসান উনাদের দুজনকেই আলাদা রুমে গিয়ে কী কী যেনো বুঝিয়েছিলেন,তারপর আর উনারা আমাকে কোনো প্রকার প্রশ্ন করেন নি।উনারাও নেহালকে নাতির মতো আদর যত্ন করেছেন। আমাদের বাড়ী থেকে যেতেই শাশুড়ী মা সৌরভকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন,কিন্তু সৌরভ নাকি কিছুতেই মানে নি। অতঃপর উনি সৌরভকে কসম দিয়ে বিয়ের আসরে বসিয়ে ছিলেন। বিয়েতে আমি যাই নি, আমি অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে বারন করেছিলাম।আমি যাই নি বলে এহসানও যায় নি। এ নিয়ে শাশুড়ী মা রাগ করে আমাদের সাথে কতদিন কথা বলেন নি। মায়ের রাগ ভাঙ্গানোর জন্য আমি, নেহাল আর উনি বেড়াতে গেলাম।তারপর কত কাহিনী করে মায়ের রাগ ভাঙ্গালাম। শাশুড়ি মা আমাকে বললেন সৌরভের বউকে দেখতে যাওয়ার জন্য,আমি নেহালকে উনার কাছে দিয়ে সৌরভের রুমে গেলাম। রুমে ডুকতেই দেখলাম এক অতিব সুন্দরী মেয়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে।আমাকে দেখেই ও সালাম দিলো,আমি ভদ্রতার খাতিরে সালামের জবাব নিলাম। মেয়েটা বেশ মিশুক,অনেকক্ষণ ওর সাথে কথা বললাম।কথার মধ্যেই আমি হুট করে বললাম,,”তোমাদের মধ্যে সব ঠিক আছে তো?”

মেয়েটা সাথে সাথে চুপ করে গেলো।ওকে চুপ থাকতে দেখে আমি বললাম,,”দেখো আমি তোমার বড় ভাবী,আমাকে আপন বোনও ভাবতে পারো।আমাকে বললে হয়তো কোনো হেল্প করতে পারবো।”

মেয়েটা এবার ফুফিয়ে কেঁদে বলে উঠলো,,”উনি আমার দিকে ফিরেও তাকান না। আমার সাথে কোনো কথাই বলেন না।বাসর রাতে বলেছেন যে উনি নাকি কাউকে ভালোবাসেন আর তার জায়গা আমাকে দিতে পারবে না। ”

আমি মেয়েটাকে শান্তনা দিতে লাগলাম। সৌরভের সম্পর্কে আমার ধারনা আছে,ও যে এমন করবে আগেই জানতাম। এরপর আমি নিধি অর্থাৎ সৌরভের বউকে কিছু কথা বললাম যে কীভাবে সৌরভের সাথে স্বাভাবিক হতে পারবে। আমার ককথা শুনে মেয়েটা বললো,,”আপনি এত কিছু জানেন কীভাবে?”

আমি মুচকি হেসে বললাম সিকরেট,আমার জামাই থেকে শিখেছি। কয়েক মাস পর শুনলাম সৌরভের বউ নিধি কনসিভ করেছে। কথাটা শুনে ভাবলাম যাক তাহলে আইডিয়াগুলো কাজে এসেছে।

২৬ বছর পর,,
নায়লাদের বাড়ীতে আজ বিয়ের উৎসব চলছে।সবাই সাজুগুজু করতে ব্যস্ত।কারন আজ সেই ছোট্ট নেহালের বিয়ে।নেহাল রেডী হয়ে অপেক্ষা করছে সেই ঘন্টাখানেক আগ থেকে।কিছুক্ষন পর এহসান সিড়ি দিয়ে নামছিলো তখন,

বিয়ের শেরওয়ানি পরে সিড়ির নিচে দাড়িয়ে নেহাল তার বাবাকে বললো,,,

–“বাবা, দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।আজকের দিনেও দেরী?”

নেহালের বাবা এক হাত দিয়ে কানে ধরে বললো,,,

—“সরি,বাবা। তোমার মা, বোন আর চাচীর জন্য দেরী হয়েছে।”

—“আমার মনে হয় আর বিয়ে করা হবে না।চাচ্চু এক ঘন্টা আগে থেকে গাড়ীতে বসে আছে,,এই মহিলাদের সাজুগুজু কী কখনও শেষ হবে না?”

তখনই পিছন থেকে তিনজন একসাথে বলে উঠলো,,”আমাদের সাজুগুজু নিয়ে কার সমস্যা হচ্ছে?কালকে থেকে দেখবো তো বউকে কীভাবে সাজুগুজু করতে দেয়?”

–“আমার বউ কোনো এত আটা-ময়দা লাগায় না।হু হু,,!!”

–“তাই নাকি,, তাহলে সকাল ৬টা বাজে পার্লারে কেনো পাঠিয়েছো?”

নেহাল আমতা আমতা করে বললো,,”বিয়ের দিন একটু-আধটু সাজা লাগে।এখন চলো,চলো লেইট হয়ে যাচ্ছে।”

সাথে সাথে সবাই মুখ টিপে হেসে পাড়ি দিলো বিয়ের উদ্দেশ্যে।শুরু হলো এক নতুন অধ্যায় নতুন জীবন,নতুন চলার পথ।

সমাপ্ত
_____________________________________