ভুলে যেতে ভালোবাসিনি পর্ব-১৯

0
3720

ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-১৯
রোকসানা আক্তার

নাতাশা চমকে উঠে।অপ্রস্তুত বোধ নিয়ে তড়িঘড়ি চোখের পাতা নিচু করে আনে।নীর মুখে হাসি এঁটে বিছানার উপর বসে।বসার দূরত্ব ৫ ফুট হবে বৈ-কি। নাতাশা চোখতুলে না তাকালেও মনে মনে অবাক হয় অনেক।নীর কোনো রকম এক্সকিউজ না বলে,কোনোরকম সম্মতি না নিয়ে নিজ মনে বিড়ালের মতো বসে পড়ে।
নাতাশা নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায়।নীর খানিক টুকু গলা ঝেঁড়ে নাতাশার দিকে ক্ষীণ চোখে তাকিয়ে ছোটস্বর টেনে বলে,
-খুব শীত পড়ছে!আসার সময় মনে করে সুয়েটারটাও সঙ্গে নিয়ে আসিনি।
নাতাশা চুপ হয়ে থাকে।নীর শান্ত গলায় আবার বলে,
-নাতাশা তোমাকে আমার কিছু কথা বলার আছে, যদি সম্মতি পাই।

নাতাশা ভড়কে উঠে।আর মনে মনে কিলবিল করে বলে,
-বসার সম্মতি চায়নি,আবার বলার সম্মতি চাচ্ছে।যত্তসব ন্যাঁকা!
-আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছ, নাতাশা?
নাতাশা আবার চমকে উঠে!নিজেকে স্বাভাবিক করে কঠিন স্বরে বলে,
-জ্বী,বলুন!
নীর খানিক টুকু নিঃশ্বাস ছেড়ে জানলার দিকে এক পলক দৃষ্টি এঁটে।তারপর মুখে একটা প্রস্তুতি ভাব এনে বলে,
-তুমি যে ডিসিশন নিয়েছ তাতেই হ্যাপী?
নীরের কথায় নাতাশা অবাক চোখে তাঁকায়।প্রশ্নের উওর তোলে নি।নীর নাতাশার থেকে জবাব না পেয়ে
বেখেয়োলি হাসি মুখে এঁটে বলে,
-আমি অন্যায় করেছি।আমি তা জানি।আমি হয়তো তোমাকে ভালোভাবে চেনতে পারিনি এটাই আমার ব্যর্থতা।তবে, কী জানো?মানুষ ভুল থেকে শেখে।
নাতাশা এবার শক্ত হয়ে বলে,
-তো আমার কী করতে হবে?
নাতাশার শক্ত কথায় নীর নাতাশার দিকে দৃষ্টি এঁটে।চোখাচোখি পড়তেই নাতাশা তার দৃষ্টি অন্যদিক করে নেয় ।নীর শান্তধীরে বলে,
-নাথিং, নাতাশা!তবে এটুকুই বলবো আমি যে অন্যায় করেছি তার দ্বিগুণ শাস্তি মনের অতলে অনুভব করছি।হয়তো তা কাউকে দেখাতে পারছি না,বুঝাতে পারছি।যদি বুকটা ছেঁড়ে দেখানো যেত!.

নাতাশা মনে তাচ্ছিল্য একটা হাসি দেয়।সে ভাবে এসবটাই নীরের ড্রামা।আর এধরণের ছেলেরা ড্রামাতে যে তেলবাজি তা নাতাশা হাড়ে হাড়ে বুঝে।
নাতাশার সাড়াশব্দ না পেয়ে নীর গলায় খেচকি টানে।গুড়িগুড়ি করে বলে,
-বুঝলে আমার কথা?
নাতাশা দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে।সে নিঃশ্বাসের আওয়াজ নীরের কান অব্দি পৌঁছায়।নাতাশা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে,
-“আমি জানি মানুষ একসময় ভুল করে,আবার শুধলে যায়।আবার কিছু কিছু মানুষ আছে ভুল করেও শুধলায় না।আর তারা আজন্ম সেই নরপিশাচই থেকে যায়।”
অবশ্য, কথাগুলো আমি বলছি না লেখকদের উক্তি থেকে পাওয়া।

নীর চোখের দৃষ্টি নামিয়ে ফেলে।সে বুঝতে পারে নাতাশা এসব তাকেই বলছে।তারপরও নীর নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করে।কারণ,নীর অফিসে অয়নের সামনে প্রতি জ্ঞা করে এসছে সে নাতাশার সাথে কোনোমতে তর্কে জড়াবে না।
নীর হাই তুলতে তুলতে বলে,
-তোমার শেষ ডিসিশন তাহলে কি?
-আই ডোন্ট নো!

নীর কিছুটি আর না বলে দ্রুতপায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।নাতাশা মলীন চেহারায় নীরের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। নাতাশার চোখমুখ কুঁচকে আসে।আর সাথে দু’ফোঁটা কান্নার পানি।
আজ কেন জানি নীরের প্রতি ভীষণ রকম মায়া হচ্ছে নাতাশার ।যে মায়ার অনুভূতি বলাও কঠিন,আবার মেনে নেওয়াটাও কষ্টের!নীরকে এভাবে ফিরিয়ে দেওয়াটা যেন কলিজায় টান লাগার মতো।নাতাশা জানে নীরকে ছাড়া তার চলবে না।কেননা,লাভ এট ফাস্ট সাইড টু নীর!

আবার মেনে নিতেও পারে না।কারণ,নীরের সেই হেয় কথা,ধমক দেওয়া,ছোট করা ইত্যাদি নাতাশার মনকে ভীষণ রকম কষ্ট দিয়েছে।ভাবতেই নাতাশার চোখ পানিতে ভিঁজে আসে।
নিজেকে সংযত রেখে চুপ হয়ে যায়।সে দোটানায় ভাবুক।নিজেই জানে না তরী কূলের সন্ধান পাবে কি না!।।
অনেকক্ষণ পর,
কারো কথার শব্দ কানের অভ্যন্তরে পৌঁছাতে নাতাশার টনক নাড়ে।তাকিয়ে দেখে সামনে তার মা দাড়িয়ে আছে।মুখে কিঞ্চিৎ রাগের আভা।কোনোকিছু নিয়ে ভীষণ রকম ফুঁপে আছেন তা চেহারা দেখেই বুঝা যাচ্ছে।নাতাশা হাল চোখে বলে,
-কিছু হয়েছে, মা?
নাতাশার মা কড়া চোখে নাতাশার দিকে তাকায়।আর খরখর গলায় বলেন,
-তুই নীরের সাথে কি খারাপ ব্যবহার করেছিস?
-নাহ ত।কেন বলোতো?
-নীর চলে গেছে!
-কি!এতরাতে!
-হ্যাঁ।আর তুই কাল তোর শ্বশুর বাড়ি চলে যাবি।তোর বাবা তোকে স্টেশনে পৌঁছে দেবেন।আর তোর যাওয়ার ব্যাপারে মাএ তোর শাশুড়ির সাথে কথা বললাম!উনি রাজি হয়েছেন।
-মা তুমি এসব কি বলতেছ!হুটহাট ওই বাড়ি যাবো মানে?আর আমি তো কিছুই বুঝতেছি না।
-তোর কিছু বোঝা লাগবে না।যা বুঝার আমি বুঝেছি।
কথা শেষ করেই নাতাশার মা চলে যান।

নাতাশা বিছানার উপর থ হয়ে বসে পড়ে।মুখ দিয়ে নাতাশার কোনোরকম কথা আসছে না।নীর যে এতরাতে চলে গেছে তা কোনোমতে মানতেই পারেনি।
গড়গড়িয়ে অশ্রু বেয়ে পড়তে থাকে নাতাশার।নাতাশার বাবা গলা খেচকি দেন।নাতাশা চোখের পানি মুছে নেয়।গলা ছেড়ে দরজার দিলে তাকিয়ে বলে,
-বাবা,ভেতরে আসো।
নাতাশার বাবা মলীন মুখে ভেতরে ঢোকে।নাতাশার পাশে বসে। নাতাশার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
-মা তুই কাদছিস?কাদিস না।নীরের সাথে কি খুব ঝগড়া হয়েছে?
নাতাশা অবাক চোখে তার বাবার দিকে তাকায়।নাতাশা হা করে কিছু বলতে গেলেই তার বাবা বলে উঠে,
– তোর উচিত হয়নি জামাই বাবাজীর সাথে ঝগড়া করা।স্বামী যা বলে তা সহ্য করতে হয় মা।তাও জামাই বাবাজী আমাদের বাড়ির নতুন।এইযে এতরাতে রাগ করে চলে গেল!ব্যাপারটা কেমন দেখায়।ভাবতো একবার!

নাতাশা এখন ক্লিয়ার তার মা তার উপর কেন রেগেছে।উনারা ভেবেছেন নাতাশা নীরের সাথে ঝগড়া করেছে,সেকারণে নীর রাগ হয়ে অয়নকে নিয়ে এতরাতে চলে গেছে।তাই স্বামীর রাগ সামলাতে কালই নাতাশাকে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দিবেন।
-যাইহোক নাতাশা,রাতের মধ্যে জামাকাপড় গুছিয়ে নিস। কাল সকালে আমরা রওনা করবো।
বলেই নাতাশার বাবা বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ান।
হাই তুলতে তুলতে আবার বলেন,
-গেলাম আমি।ঘুমিয়ে পড়িস।

নাতাশার বাবা ঘর থেকে বেরুবার পর নাতাশা দরজা বন্ধ করে আড়ি পেতে বিছানার উপর বসে।কাল ঢাকা যাবে ভাবতেই সারা গাঁ ছমছম করে উঠে নাতাশার।কারণ,আর মাএ ২ সপ্তাহ পর পরিক্ষা তার।এখন এসময় ঢাকায় ব্যাক করা মানেই পড়ালেখা গোল্লায় যাওয়া।

সকাল হয়।নাতাশার মা নাতাশার দরজায় সজোরে করাঘাত করতে থাকেন।নাতাশা ঘুম ঘুম চোখে দরজা খুলে।নাতাশার মা স্বাভাবিক গলায় বলে উঠেন,
-ঘুম থেকে এত দেরী করে উঠলে ওই বাড়ি যাবি কখন,মা?
নাতাশা ছোট বাচ্চাদের মতো চোখদুটো কচলাতে থাকে।কচলাতে কচলাতে বলে,
-আমার ক’দিন পরতো পরিক্ষা।
-রাখ এখন পরিক্ষা।আগে যেয়ে স্বামীর ভুল ভাঙ্গা।পরিক্ষা থেকেও তোর স্বামী বড়।দেরী করিস না।তাড়াতাড়ি গিয়ে রেডি হ।আমি রান্না করতে গেলাম।

নাতাশার মা পাকঘরের দিকে চলে যায়।নাতাশা সং হয়ে দাড়িয়ে থাকে।সে জানে এখন শত চেষ্টাতেও মাকে সে সামলাতে পারবে না।কারণ,গ্রামের মহিলারা স্বামীর ভক্তি একটু বেশিই।স্বামী যদি খানিক টুকু নিয়ে মন খারাপ করে ,তবে সে কি গো আদর,সে কি গো সোহাগ,সে কি গো যত্ন।সর্বোচ্চ দিয়ে স্বামীর মন জয় করতে তাদের প্রতিযোগীতা শুরু হয়ে যায়।

নাতাশা একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে পেছনে ঘুরে টেবিলের কাছে যায়।টেবিলের উপর রাখা ব্যাগ থেকে ব্রাশ এবং টুথপেষ্ট বের নেয়।তারপর কলে যায় হাত-মুখ ধুতে।

নাতাশার মা রান্নাবান্নার কাজটা খুব তড়িঘড়িই করছেন।মেয়ে চলে যাবে।তাকে কিছু খাবার প্যাক করে দিবেন সেকারণে।
রান্না শেষ হয়ে আসলে একটি প্লেটে একটা ডিম ভাজি এবং দু’টো রুটি বেড়ে নেন।আর নাতাশার রুমে দিয়ে আসেন।তাগাদা দিয়ে বলেন,
-তাড়াতাড়ি খেয়ে নে নাতাশা। দেরী করিস না।
বলেই চলে যান।নাতাশা মনেে জেদ চেপে বসে থাকে।

চলবে….