ভুলে যেতে ভালোবাসিনি পর্ব-২২(বোনাস পর্ব)

0
4317

ভুলে যেতে ভালোবাসিনি
পর্ব-২২(বোনাস পর্ব)
রোকসানা আক্তার

সকালের ঝলমল রোদ জানলার গ্লাস ভেদ করে সারা রুমে ছড়িয়ে পড়ে।নীর উবু হয়ে শুয়ে নাক ঢেকে অতলে ঘুমচ্ছে।আর নীরের বামহাতটা নাতাশার গলার উপর পড়ে আছে।নাতাশার চোখের ভাজ ফাঁক হয়ে আসে।আস্তে আস্তে চোখের পাতা মেলে দৃষ্টি এটে নীরের দিকে।নীরের খাড়া খাড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে।শ্বাস-প্রশ্বাসে নীরের ধবধবে সাদা পিঠের হৃৎস্পন্দন উঠানাম করছে।তা দেখে নাতাশা মুঁচকি হাসে।নাতাশা চোখদুটোতে আর একটু টানটান ভাব এনে কপালের ভ্রু কুঁচকায়।তা হলো নীরের মসৃণ পিঠ দেখে।পিঠের গঠন আঁটসাঁট সুঠাম আকৃতির,দেখেই বুঝা যায় জিম করা।
নাতাশা ক্ষীণ স্বর ফেলে।আলতোভাবে নীরের হাতটা গলা থেকে সরায়।শোয়া থেকে উঠতে গেলেই পেছন থেকে টান পড়ে। নাতাশা মাথা ঘুরে তাকায়।তাকিয়ে দেখে শাড়ির আঁচলটা নীরের বুকের নিচে চাপা পড়েছে।নাতাশার বুক ধুকপুক করতে থাকে।নাতাশা চোখবুঁজে ধীরে ধীরে শাড়ির আঁচল টেনে নিয়ে আসতেই নীর চোখমুখ কুঁচকে নড়চড় করে উঠে।নাতাশা ঢোক গিলে।নাতাশা চায় না নীর তাকে এই অবস্থায় দেখে ফেলুক।কারণ নাতাশার শাড়ির অর্ধকাংশ নীরের কবলে।এমনকি সামান্য কাপড় টেনেও যে বুক ঢাকবে সেই জো টুকু পর্যন্ত নেই।
নাতাশা জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে ইয়া মাবুদ বলতে থাকে।আর দোয়া দুরুদ বিশ বার টোটস্ত।

তারপর এক চোখ কানিয়ে নীরের দিকে আবার দৃষ্টি দেয়।নাতাশার চোখ দু’টো এবার সত্যি সত্যি খাড়া হয়ে আসে।কারণ,নীর এখন শোয়া অবস্থায় নাতাশার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে মিটিমিটি হাসছে। নাতাশা কাবু হয়ে যায় লজ্জায়।মন চায় এখুনি কম্বলের মধ্যে ঢুকে পড়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখতে।এই বদভ্যাসটা ভান করে এতক্ষণ তার সব সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে।নাতাশা আর উপায়ন্তর না পেয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
-প্লিজজ একটু উঠুন।আমার যেতে হবে,মা আমায় বোধহয় ডাকছেন!
নীর টানা টানা চোখে নাতাশার দিকে তাকায়।আর ভ্রু নাচিয়ে বলে,
-লজ্জা পাওয়ার কিছুটি নেই।আমি অবশ্য কিছু দেখছি না।।।
বলেই মুখ চেপে হাসে নীর।
নাতাশা থতমত হয়ে মাথাটা নিচু করে ফেলে।মুহূর্তে দু’চোখ বুঁজে আনে।নীর তা লক্ষ করে নাতাশা আবার বলে,
-আমি সরে যাব,তবে শর্তে।
-ক-কি শর্ত ব-ব-লুন!?
-আমার দিকে স্বাভাবিক হয়ে বসে সুন্দরভাবে আমায় সরতে বলবে।পারবে?

নাতাশা নীরের চাটুকারিতা বুঝে যায়।নাতাশা মনে মনে লজ্জায় এমনিতেই শেষ আর এ আসছে উল্টো লজ্জার ক্ষতে লবণ ছিটাতে।এ কি কখনোই মানুষ হবে না?
নীর তূরী বাজায়।বলে,
-কি হলো নাতু?আমার শর্তে রাজি তো?
-দ-দেখুন সবকিছু নিয়ে ফান মোটেও ডোন্ট লাইক।আমার আঁচল ছেড়ে দিন।দেখতেই ত পারছেন অনেক বেলা হয়ে গেছে।তাছাড়া আপনার অফিসে যেতে হবে।
নীর নাতাশার কথা শুনে খিলখিল হেসে দেয়।আর জোড় গলায় বলে,
-আচ্ছা তোমার এইজ কত?
-অনার্স কম্প্লিট হওয়া মেয়ের এইজ কত হতে পারে তা জানারই কথা।আবার জিজ্ঞেস করা লাগে?
-এই তোমার এখন ও কি অনার্স কম্প্লিট হয়েছে?!
-হয়নি,হবে ত।
-আগে হয়ে নিক।বায় দ্য ওয়ে আমি এইজ ব্যাপারে আনাড়ি। কারণ,আমি এইজ গণনায় একেক ক্লাসের স্টুডেন্টকে অন্য ক্লাসের ভাবি।একবার হয়েছে কি জানো?আমাদের ভার্সিটির একটা মেয়ের উপর ক্রাশ খেয়েছিলাম।সে ছিল খুবই সুন্দরী, চিকনা-পাতলা,লম্বা।বলতে গেলে যে কারো চোখ ধাঁধানোর মতে ছিল।পরে আমি উনাকে প্রপোজ করবো, প্রপোজ করবো এই মেয়েকেই আমার চাই।এসব বলে পুরো ক্যাম্পাস বাজিয়ে দিয়েছি।দ্যান, জানতে পারলাম উনি আমার টু ইয়ারের সিনিয়র!সো, আই’ম কনফিউজড এ্যাবাউট এইজ।তাই তোমায় বলতে বললাম।
নাতাশার রাগ উঠে যায়।মনে মনে ফুঁপে উঠে বলে,
-এই লোকটির কি লজ্জা-সরম বলতে কিছুই নেই।একটা মেয়েকে এইভাবে অর্ধ অনাবৃত রেখে সে তার লেকচার ছেড়েছে!উফস!
-নাতাশা শুনতেছ?
নাতাশা বুঝতে পারছে এর জবাব না দেওয়া ছাড়া ছাড় নেই।কাজেই উওর করে কেটে পড়া উচিত।বিরক্তি নিয়ে থম গলায় বলে
-২৪
-গুড।তবে আমার কি মনে হয়েছে জানো?
-কি!
-৫৪।হিহিহিহি।
-হোয়াট?!
নাতাশা এবার হতভম্ব হয়ে নীরের দিকে মনের অজান্তে ঘুরে তাকায়।সে ভুলেই গেছে নীর যে তার দিকে তাকিয়ে আছে।নীর হো হো হো করে হাসে।আর বলে,
-যাক অবশেষে হোপ পূর্ণ হলো।তোমার এই তিলটা দেখার জন্যে কতই না বাহান করলাম।সরে যাচ্ছি।নিয়ে নাও তোমার আঁচল।
নাতাশার সারা শরীর ঝিমঝিমাতে থাকে!নাতাশার বুক বরাবর কালো কুচকুচে একটি তিল আছে যেটার চমক প্রদক খুবই মনকাড়ার মতো।তার সেই তিলটা দেখার জন্যেই নীর এতটা বাহানা ধরেছে।নাতাশা তড়িঘড়ি আঁচলটা বুকে এটে নেয়।আর আল্লাহ আল্লাহ বলে বাথরুমে ঢুকে পড়ে।দরজা বন্ধ করেই হাঁপাতে থাকে নাতাশা।মনে মনে বলে
-এটা এখন আমার সাথে কি হয়ে গেল?ইয়া মাবুদ এখন আমি উনার সামনে যাবোটা কি করে!?ইস,এতদিনই ভালো ছিলাম।দূরত্ব, ঝগড়াঝাঁটি, খুনসুটি ভালোই কেটেছে দিনগুলো।অন্তত উনার চোখের নিচু নজর থেকে ত রেহাই পোলম!আর এখন?

নাতাশা এ বলে মাথায় একটা ঝাঁকুনি দেয়।তারপর এককোষ পানি হাতে নিয়ে সারামুখে ছড়িয়ে দেয়।হালকা হালকা বোধ অনুভব করতেই স্বাভাবিক চোখে আয়নার সামনে সরু হয়ে দাড়ায় আর নিজেকে দেখতে থাকে।অনেকক্ষণ অব্দি নিজেই নিজের দিকে তাকাতে থাকে।মনের যত সন্দেহতীত কথাগুলো আকুপাকু খায়।স্থির মগ্নে ভাবে,
-নীর কি সত্যিই আমায় ভালোবাসে?আচ্ছা সত্যিই কি আমি তার এখন মনে জায়গা করে নিতে পেরেছি?নাকি এ এক কল্পনা।আচ্ছা,ও কি আমার সাথে ছলনা করতেছে নাতো?এইতো কিছুদিন আগেই ত আমাকে দু’চোখেও দেখতে পেত না যেন গলা টিপে মেরে ফেলার মতো।আজ সে সত্যিই নিজ হাতে আমায় স্পর্শ করে ভালোবাসার চন্দন এঁকে দিয়েছে!বিধাতা তুমিই বলো নীর কি সত্যিই আমায় ভালোবাসে?আমার কেনজানি বিশ্বাস হচ্ছে না।কিভাবে বিশ্বাস হবে বলো?কি এমন পরিক্ষা ওর থেকে নিব?

দরজায় নীরের করাঘাত পড়তেই নাতাশা ভাবনা থেকে ফিরে আসে।নীর ওপাশ থেকে বলে উঠে,
-আরেহ বাবা তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হও।আমার অফিসের লেট হয়ে যাচ্ছে।
-এই ত। আর মাএ কয়েক সেকেন্ড।একটু অপেক্ষা করুন।
বলেই নাতাশা তড়িঘড়ি দাঁত ব্রাশ করতে থাকে।কোনোমতে মুখে পানিটানি দিয়ে বাথরুমের দরজা খুলে।নীর বাথরুমের দরজার সামনেই ছিল।সে নাতাশাকে দেখেই ভ্রু নাচায়।নাতাশা চোখের দৃষ্টি নিচু করে ঘনঘন পলক পেলে।নীর গলা ছেড়ে বলে,
-আজ খুব তাড়াতাড়িই অফিস থেকে চলে আসবো।পারলে একটু রেডি হয়ে থেকো।আমরা আজ দুজনে বাহিরে বের হবো।
বলেই নীর নাতাশাকে সাইড কেটে ভেতরে ঢুকে যায়।নাতাশা পা বাড়িয়ে বাহিরের দিকে চলে আসে।তারপর রুম থেকে বের হয়ে কোহিনুর বেগমের কাছে যায়।গিয়েই কোহিনুর বেগমের হাত থেকে চিনির বয়াম,ময়দার বয়াম নিয়ে নেয়।কোহিনুর বেগম তা দেখে হা হয়ে তাকিয়ে আছেন।বাতাশা ফস করে চুলায় আগুন জালিয়ে তাগাদা দিয়ে বলে,
-মা?রুটি,ভাজি আমিই ছড়াচ্ছি। আপনি পারলে সোফায় গিয়ে বসুন।আর তেল,হলুদের গুড়ার বয়াম,মরিচের গুড়ার বয়াম কোথায় রাখা প্লিজজ আমায় একটু বলে দিন।তাছাড়া রান্নার সব উপকরণগুলো রাখার স্থানটা আমায় দেখিয়ে দিবেন।
কোহিনুর বেগম আলবোলা হয়ে বলেন,
-নাতাশা?তোমার রান্না করতে হবে না মা।আর ত ক’দিন পর তোমার পরিক্ষা।
-আমার কথাই যদি সবসময় ভাবেন,তাহলে আমায় কেন আপনার কথা ভাবতে দেন না!
-ন-না মান ইয়ে
-প্লিজজ মা আর কিছু শুনতে চাচ্ছি না।আরেহ,আমি গ্রামের মেয়ে!রান্নাবান্না এসব আমার কাছে কিছুই না।ধোঁয়ার কণা সয়ে সয়ে রান্না করতে শিখেছি আর সে যদি এত সৌখিনতা পাওয়ার পরও রান্নাটুকু না করতে পারে তাহলে ত অল্প পানির মাছ বেশি পানিতে গিয়ে থৈ থৈ করার মতো অবস্থা আমার।

কোহিনুর বেগমের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে।নাতাশা নিজকে নিজেই হেয় করেছে তা কোহিনুর বেগম মোটেও মানতে পারছেন না।
-নাতাশা?এসব বলতে আর যেন কখনোই না শুনি।
-ওকে বলবো না।তবে,আমার কাজে বাঁধা প্রদান না করলে।
কোহিনুর বেগম মায়াবী দৃষ্টি দিয়ে নাতাশার দিকে তাকায়।মনের অজান্তেই চোখ বেয়ে টলটলে অশ্রু ঝরতে থাকে।নাতাশা তা বুঝতে পেরেই কোহিনুর বেগমের কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখে।বলে,
-আরেহ মা আপনি কাদছেন কেন?প্লিজ কাদবেন না।
উনি কান্নাটাকল থামিয়ে মলীন মুখ করে বলে,
-দুটো ছেলে আমার।মেয়ে নেই।লোকে বলে মেয়েরা ঘরের লক্ষী।তারা সংসারে থাকলে মায়ের কষ্ট ভাগাভাগি হয়।ছেলেরা স্বার্থপরতা করলেও মেয়েরা মাকে বুকে জড়িয়ে আগলে রাখে।আর আমার এখন মনে হয় আমার মেয়ে না থেকেও একটা মেয়ে আমার আছে।

নাতাশা বুঝতে পারে কোহিনূর বেগম তাকেই এসব বলছে।নাতাশা দীর্ঘ শ্বাস টেনে কাঁধে চেপে বলে,
-হয়েছে।আর কাদবেন না।আর আপনার চোখের পানি আমার মোটেও সহ্য হয়না।
নাতাশা কোহিনুর বেগমের চোখের পানি নিজ হাতে মুছে দেয়।ডাইনিং থেকে নিহানের কন্ঠস্বর আসতেই কোহিনূর বেগম ওদিকে যান।আর নাডাশাু রান্নায় মনোযোগ দেয়।পাশে দাড়িয়ে আছে রহিমা খাতুন।

চলবে।