মহাপ্রস্থান পর্ব-১১+১২

0
248

#মহাপ্রস্থান
#পর্ব_১১
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
_________________
‘অসহায়’ নামে একটা প্রদেশ থাকা জরুরী ছিল। শুধু জরুরী বললে ভুল হবে। বলা দরকার ভীষণ, অসম্ভব দরকার ছিল। তাহলে পৃথুলা এক্ষুণী তল্পিতল্পা গুছিয়ে ‘অসহায়’ নামক প্রদেশে চলে যেত। এই দেশে সে অসহায় হয়ে থাকতে পারছে না আর। অসহায় ব্যক্তিদের অসহায় নামক দেশেই থাকা উচিত। কিন্তু বিধিবাম! সৃষ্টিকর্তা এমন কোনো প্রদেশ তৈরি করেননি। অগত্যা অসহায় বেশে তাকে এখানেই থাকতে হবে। মনে মনে সে আরশানের পিণ্ডি চটকালেও মুখে লেগে আছে তার অমায়িক হাসি; যার সম্পূর্ণটাই অভিনয়।

আশিকসহ উপস্থিত সবাই উৎসুক হয়ে পৃথুলার মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে গান শুনবে বলে। এবার আশিকের সঙ্গে তাল মেলাল শিমুল নিজেও। সে খিচুড়ির প্লেটে লেবু চিপড়ে রস বের করতে করতে বলল,

“একটা গান গেয়ে শুনিয়ে দেন না ভাবি!”

পৃথুলার মাথার র-ক্ত গরম পানির মতো টগবগ করে ফুটছে। এই গরমে শিমুল ব্যাটাকে চুবাতে পারলে কিঞ্চিৎ পরিমাণ হলেও পৃথুলা স্বস্তি পেত। সে মনে মনে স্বগতোক্তি করে। দাঁতমুখ খিঁচে বলে,

“কেন রে হতচ্ছাড়া, তোর স্যার কি কম ছিল? সে তো এক বাঁশ দিয়েছেই মিথ্যা বলে। উপরন্তু এমন সুন্দর সুন্দর ছেলে-মেয়েগুলো সেই মিথ্যাকে বিশ্বাস করে অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে আমার গান শোনার জন্য। আমার গান শুনলে ওরা এখানে টিকতে পারবে রে? তার ওপর তুই আসছিস তাল মেলাতে? কেন রে এত বাঁশ কে দিতে বলেছে তোদের? আমাকে শেষমেশ বাঁশবাগানের মালিক বানানোর ধান্দা! হতচ্ছাড়া, খুব শখ আমার গান শোনার? শোনাচ্ছি। তোর ভাবি তোকে এমন নাকানিচুবানি খাওয়াবে এবার তুই ভাবতেও পারবি না।”

“কী হলো আপু? গান গাইবেন না?”

পৃথুলার মনে মনে বকাঝকায় ভাঁটা পড়ল। সে সকালের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ভাবছিলাম। গান তো অনেকদিন গাওয়া হয় না। গলার অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। গান গাইতে গেলে গলায় ব্যথা লাগে।”

অর্ষা বলল,

“তাহলে আপু থাক। কষ্ট করে গান গাইতে হবে না।”

সবাই অর্ষাকে সমর্থন করলেও আশিক কিছুটা হতাশ হলো। সে হতাশসুরে বলল,

“অনেক আশা নিয়ে বসে ছিলাম।”

পৃথুলা আড়চোখে আরশান এবং শিমুলের দিকে তাকাল। খুব আয়েশ করে খাচ্ছে দুজন। সে মুচকি হেসে বলল,

“তবে আপনি চাইলে, আমি ছোটোবেলার একটা ছড়া শোনাতে পারি সুর দিয়ে। ছোটোবেলায় খেলার সময় ছড়াটা বলতাম আমরা। বলব এখন?”

আশিক উৎসাহিত হয়ে বলল,

“শিওর। এত বড়ো একজন গায়িকা আমাদের জন্য হলেও যে ছোটোবেলার একটা ছড়া শোনাবে এটাও আমাদের জন্য অনেক।”

পৃথুলা হাসল। গলা পরিষ্কার করে ছড়া বলা শুরু করল,

“টুনটুনি গো পাখি
নাচো তো দেখি,
না বাবা নাচব না;
পড়ে গেলে বাঁচব না…”

ছড়া সম্পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই শিমুলের নাক-মুখ দিয়ে খাবার উঠে যায়। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে নড়েচড়ে বসে আরশান। পৃথুলা নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে শিমুলের কাছে গেল। পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

“আহারে ভাইয়া! কী হলো হঠাৎ? টুনটুনি পাখির কথা মনে পড়ে গেল বুঝি?”

শিমুল পানি পান করে কাশতে কাশতে বলল,

“আমি ঠিক আছি। আপনি নিজের জায়গায় বসে খাওয়াটা শেষ করুন প্লিজ!”

পৃথুলা ক্রুর হেসে নিজের জায়গায় গিয়ে বসল। প্রসঙ্গ হঠাৎ বদলে গেল। খাওয়ার মাঝেই হুট করে মুন বলল,

“ছেলেরা কি বিয়ের পর মোটা হয়ে যায়?”

মুনের হঠাৎ এমন প্রশ্নে হতচকিত হয়ে তাকায় আরশান, আহনাফ এবং আদিব। সবার মধ্যে এই তিন বেচারাই বিবাহিত পুরুষ কিনা! আরশান মুন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। তাই সে বুঝতে না পেরে বলল,

“এরকম মনে হওয়ার কারণ?”

মুন এক লোকমা খিচুড়ি মুখে তুলে বলল,

“বিয়ের আগে আদিব মানে আমার হাজবেন্ড বেশ স্লিম ছিল। অথচ এখন দেখেন…দেখলে মনে হবে ছোটখাটো একটা হাতি। অন্যদিকে আমাদের দুলাভাই আহনাফ। উনিও কিন্তু বিয়ের আগে স্লিমই ছিলেন। এখন মনে হয় পান্ডা। আমি যদি ভুল না হই, তাহলে আপনিও স্লিম ছিলেন তাই না? পৃথুলা আপু তুমিই বলো আরশান ভাইয়া আগে স্লিম ছিল কিনা?”

পৃথুলা ফ্যাকাশে হাসল। শব্দ করে হাসতে পারলে ভালো লাগত। যার সাথে বিয়েই হয়নি তার আবার বিয়ের আগে-পরে কী কথা? তবুও সে অভিনয়টা চালিয়ে যেতে মৃদু হেসে বলল,

“হ্যাঁ, কিছুটা।”

মুন টেবিলের ওপর চাপড় দিয়ে বলল,

“এর কারণ কি জানিস তোরা?”

সবাই সমস্বরে জানতে চাইল,

“কী?”

“এর কারণ হচ্ছে বউয়ের হাতে রান্না। বউ সুস্বাদু রান্নাবান্না করে আর বর-রা খেয়ে-দেয়ে মোটা হয়।”

হাসিব ইনিয়েবিনিয়ে বলে,

“বলছিলাম যে, আমিও তো মনে হয় স্লিম। একটু মোটা হওয়া উচিত না মুন আপু? তোমার বান্ধবীকে বোঝাও না একটু।”

মুন লামিয়ার দিকে তাকাতেই লামিয়া কাঁটাচামচ তুলে বলল,

“খবরদার! আমার দিকে তাকাবি না। তাহলে তোর আর সাথে বিড়াল কমিটির এই চেয়ারম্যানেরও চোখ গেলে দেবো।”

আদিব মুনের যুক্তিকে নাকচ করে দিয়ে বলল,

“আমার লক্ষী বউ, তোমার সাথে আমি একমত হতে পারছি না। আমি বিয়ের আগেও যেমন ছিলাম আর এখনও ঠিক তেমনই আছি। এমনকি আহনাফ ভাইয়াকেও বিয়ের আগে যেমন দেখেছি, এখনও তিনি তেমনই আছেন। বাকি রইল আরশান ভাইয়া। উনাকে আমি আগে কখনো না দেখলেও ১০০% গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি, সে ভীষণ স্বাস্থ্য সচেতন লোক। আর এরকম লোক কখনো গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে না। সূতরাং আমরা কেউই তোমাদের রান্নাবান্না খেয়ে ফুলে যাইনি। তুমি যেটাকে মোটা বলছ, শব্দটা একচুয়ালি মোটা হবে না। ফিট হবে ফিট।”

আশিক তাল মিলিয়ে বলল,

“জি ভাইয়া। এবার মারেন ওর মাথায় একটা ইট।”

মুন কটমট করে তাকায় আদিবের দিকে। বলে,

“তুমি কি সারাজীবন এখানেই থাকবে? বাড়িতে যাবে না? ফডেং ফডেং করে কথা বলা পরে বুঝাব।”

আশিক প্রশ্ন করল,

“ফডেং ফডেং আবার কী কথা দোস্ত?”

“আপনি বেশি কথা বইলেন না কবি সাহেব। ফডেং ফডেং পরে জাইনেন, আগে আপনেরে করব আমি আলু পোস্ত।”
.
খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে সবার ঘুমের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছেলেদের জন্য আলাদা রুম এবং মেয়েদের জন্য আলাদা রুম। আহনাফের ঘুম আসছিল না। সে অর্ষার ফোনে টেক্সট করে,

“একটু ছাদে আসো প্লিজ!”

আরশান এবং হানিফ বসে আছে ড্রয়িংরুমে। ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আরশান রাগে গজগজ করছে। এই ছড়া মেয়েটাকে কে বলতে বলেছিল? দুনিয়াতে কি ছড়ার অভাব? সবচেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে এই যুগে গান জানে না কে?

শিমুলের ঘুমে চোখ লেগে আসছিল। সে হাই তুলতে তুলতে বলল,

“স্যার ঘুমাবেন না? অনেক রাত হলো তো।”

আরশান ল্যাপটপ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল,

“মেজাজ ভীষণ খারাপ। পৃথুলাকে বাইরে আসতে বলো তো।”

“এখন?”

“হ্যাঁ, এখন। লনে যেতে বলো। আমি আসছি।”

“আচ্ছা।”

আরশান ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য নিজের রুমে চলে গেল।

আহনাফ ছাদে এসে দেখে ছাদ একদম ময়দান। কোথাও কেউ নেই। চারদিকে শুধু বড়ো বড়ো গাছপালা দেখা যাচ্ছে। অর্ষা এখনো আসলো না কেন? সে অপেক্ষা করার জন্য রেলিঙের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারা ট্যুরে ঘুরতে এসেছে আজ তিনদিন হবে। তার মধ্যে দু’দিন চলে গেছে অর্ষার রাগ ভাঙাতে। সকালে রাগ ভাঙল আর আজ তারা ভবঘুরে হয়ে জঙ্গলে রাত্রিযাপন করছে তাও আবার বউ ছাড়া। দুঃখে তার দুর্দশা জীবন। হঠাৎ দৃষ্টি নিচে যেতেই দেখতে পেল লনে অর্ষা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা একটু বেশিই ঘাড়ত্যাড়া। আসতে বলেছিল ছাদে অথচ দাঁড়িয়ে আছে লনে গিয়ে। সে সময় বিলম্ব না করে গটগট করে নিচে নেমে বাইরে এলো।

লনে গিয়ে দেখল অন্য এক ঘটনা। এ তো অর্ষা নয়। সকাল। আহনাফকে দেখে সকাল কিছুটা চমকে যায়।

“তুমি এত রাতে বাইরে কী করছ?”

সকাল কী বলবে বুঝতে পারছে না। আহিল এত করে দেখা করার কথা বলল যে সে আর না করতে পারেনি। তাই তো ভয়কে উপেক্ষা করে লুকিয়ে বাইরে এসেছে। তার চোখ যায় আহনাফের পেছনে। আহিল এসেছে। তবে সে আহনাফকে এখানে দেখেই তৎক্ষণাৎ গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে।

“সকাল!”

আহনাফের ভারী কণ্ঠ শুনে সকাল আমতা-আমতা করে বলে,

“ভীষণ গরম লাগছিল তাই আরকি…”

আহনাফ সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায়। সকালের সাহস সম্পর্কে তার জানা আছে। নিশ্চয়ই আহিলের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। এখন লুকিয়ে যাচ্ছে বিষয়টা।
.
আরশান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখে শিমুল দাঁড়িয়ে আছে। সে পরপর দু’বার হাই তুলে বলল,

“পৃথুলা লনে যেতে পারবে না। ছাদে যেতে বলেছে আপনাকে।”

আরশানের রাগ হলেও সে এই প্রসঙ্গে কিছু বলল না। শুধু শিমুলকে বলল,

“ঠিক আছে। ওকে ছাদ থেকে ড্রয়িংরুমে আসতে বলো।”

“আচ্ছা।”

শিমু্ল ঘুম ভাঙাতে হনহন করে ছাদে গিয়ে মাঝখানে দাঁড়ায়। পৃথুলার পেছনে দাঁড়িয়ে মিনমিনে স্বরে বলে,

“স্যার, আপনাকে ড্রয়িংরুমে যেতে বলেছে।”

“আপনার সমস্যা কী? পেছন থেকে যে ডাকি শোনেন না? আপনার স্যার আসেনি?”

শিমুল পেছন থেকে পৃথুলার কণ্ঠ শুনে আঁৎকে উঠে। এই মেয়ে পৃথুলা হলে সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে কে? একবার পেছনে এবং একবার সামনে তাকিয়ে শিমুল চিৎকার করে বলে উঠে,

“আল্লাহ্! আল্লাহ্ গো! স্যার গো। বাঁচান গো। ভুউউউত…”

সে চোখ বন্ধ করে দোয়া-দরুদ পড়ছে,

“লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লাহ্-বিল্লাহ্।”

এদিকে শিমুলের অবস্থা দেখে পৃথুলা এবং অর্ষা হাসবে নাকি তার ভয় দূর করবে বুঝতে পারছে না।

চলবে…
[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।

#মহাপ্রস্থান
#পর্ব_১২
#মুন্নি_আক্তার_প্রিয়া
______________
শিমুলের জ্বর তরতর করে বাড়ছে। তার মাথার কাছে বসে পানি দিয়ে দিচ্ছে পৃথুলা। বাকিরা সবাই রুমে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়টা অত্যাধিক পর্যায়ের ছিল সেটা শিমুলের এহেন অবস্থা দেখেই আন্দাজ করা যাচ্ছে।

আরশান নির্বাক ভঙ্গিতে বসে আছে। শিমুলের এত অবনতি তার সহ্য হচ্ছে না। সামান্য একটা বিষয়ে এতটা ভয় পেয়ে গেল যে, ডিরেক্ট জ্বর এসে পড়েছে? ভেতরে ভেতরে সে রাগে ফেটে পড়লেও সামনা-সামনি ছিল স্থির। সে আহনাফ-অর্ষা এবং বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলল,

“অনেক রাত হয়ে গেছে। আপনারা প্লিজ গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমাদের জন্য অযথাই আপনাদের কত সময় নষ্ট হলো।”

অর্ষা বলল,

“সমস্যা নেই ভাইয়া। এই অবস্থায়…”

“আমরা আছি এখানে। আপনারা যান প্লিজ! এভাবে জেগে দাঁড়িয়ে থাকলে আমার নিজের খুব খারাপ লাগবে।”

আরশানের খারাপ লাগাটা যেমন চোখে লাগছিল, তেমনই আবার তাদের সবার চোখেই ছিল ঘুম। তাই আর কেউ দ্বিমত করেনি। যার যার মতো ঘুমাতে চলে গেছে। ঘর ফাঁকা হতেই আরশান পৃথুলার ওপর ক্ষিপ্ত হলো। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,

“কাজটা কী ঠিক করেছেন? এভাবে ভয় না দেখালেও পারতেন।”

পৃথুলা ভ্রুঁ কুঞ্চন করে বলল,

“আমার কী দোষ? আপনি আমাকে কেন বকছেন?”

“কাজই তো করেছেন বকার মতো। মাথায় তুলে নিচে একটা আ-ছা-ড় মারতে পারলে শান্তি হতো।”

“ঢং দেখলে আর বাঁচি না। এত দরদ কেন আপনার তার প্রতি? আমি ইচ্ছে করে তাকে ভয় দেখাইনি।”

“ইচ্ছে করে ভয় দেখাননি তাতেই জ্বর চলে এসেছে। আর ইচ্ছে করে যদি দেখান তাহলে তো ওকে হসপিটালে ভর্তি করতে হবে।”

“এখানে আমার কী দোষ বলুন? এমন দুর্বল হার্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট সাথে রাখেন কেন?”

“শিমুল এমন ছিল না। আপনার সঙ্গ পেয়ে এমন হয়েছে।”

“আমি ভীতু?”

“উত্তরটা আপনার ভালো করেই জানার কথা।”

“এত রাতে আপনার সঙ্গে আমার তর্ক করতে ইচ্ছে করছে না। আমি ঘুমাব।”

“আটকে কে রেখেছে? যান।”

“কোন রুমে ঘুমাব? আমার রুমে তো ওরা আছে।”

“আমার রুমে।”

“ছি, ছি মুখে মুখে কবুল বলেছি বলে কি সত্যি সত্যিই বউ ভাবা শুরু করে দিয়েছেন? আমি কিছুতেই আপনার সঙ্গে থাকতে পারব না।”

আরশানের চক্ষু চড়কগাছ। মেজাজ ক্ষিপ্ত। সে দাঁতে দাঁত পিষে বলে,

“আমি আপনার সাথে থাকব কে বলল? আপনি একা থাকবেন। মেয়েরা এক লাইন বেশি বোঝে জানতাম। আপনি তো ১০০ লাইন বেশি বোঝেন। কোন ধাতু দিয়ে তৈরি আপনি?”

“মাটি দিয়ে বানানো হয়েছে আমাকে।”

“এই আসুন তো আমার সাথে।”

বিরক্ত হয়ে বলল আরশান। পৃথুলাকে নিজের রুমে রেখে বাইরে থেকে লক করে দিলো। কোনো রকম রিস্ক সে নিতে চায় না। আপাতত আজ রাতটা সে শিমুলের ঘরে থাকবে বলেই মনস্থির করে।
.
অর্ষা ওপাশ হয়ে শুয়ে আছে। সে ঘুমে মত্ত। আহনাফ শুয়ে আছে আকাশমুখী হয়ে। তার দু’চোখে ঘুম নেই। শ্যালক এবং শালিকারা মিলে দুজনকে একসাথে থাকার ব্যবস্থা করে দিল অথচ মহারানী ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে। আহনাফের খুব করে ইচ্ছে করছে অর্ষার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিতে। একটু দুষ্টুমি করার বাসনা মনে। সে অর্ষার কাঁধ ধরে নিজের দিকে ঘুরাল। নিজে হাতের ওপর মাথা ভর দিয়ে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে ঘুমন্ত অর্ষার দিকে। মুচকি হেসে আহনাফ অর্ষার নাকে একটা চুমু খেল। গালে আলতো করে স্লাইড করতে করতে বিড়বিড় করে বলল,

“সাইজে ছোট্ট একটা মেয়ে, অথচ রাগ তার থেকেও দ্বিগুণ!”

অর্ষা ঘুমের ঘোরেই আবার অন্যপাশ হতে গেলে আহনাফ তাকে টেনে বুকের মাঝে নিয়ে আসে। মাথাটা তুলে নিজের হাতের ওপর রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অর্ষা ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,

“গরম লাগে!”

আহনাফ বাঁধন হালকা করল। অর্ষার ঠোঁটে চুমু খেয়ে অর্ষাকে কপি করে বলে,

“গরম লাগে!”
.
দরজায় ঠকঠক শব্দ হচ্ছে। আরশান শিমুলের রুম থেকে সেই শব্দ স্পষ্টই শুনতে পাচ্ছে। শব্দটা আসছে তারই ঘর থেকে। সে শিমুলের ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গেল। পৃথুলাকে আর কী বকাঝকা করবে; পৃথুলা নিজেই রেগেমেগে বো-ম হয়ে আছে। সে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলে,

“কতক্ষণ ধরে ডাকছি, কানে শোনেন না?”

“আস্তে কথা বলুন। কী হয়েছে?”

“কী আবার হবে? বিয়েই তো হলো না এখনো।”

“বাজে কথা না বলে কেন ডেকেছেন বলেন।”

“আমার ঘুম আসছে না।”

“তো?”

“তো আবার কী?”

“আপনার ঘুম আসছে না তো আমি কী করব?”

“আমাকে সঙ্গ দেবেন।”

“মানে!”

“চোখ দুটে ওমন বড়ো বড়ো করেছেন কেন? সঙ্গ বলতে আপনি কী বুঝলেন?”

আরশান গোপনে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল,

“কিছুই বুঝিনি। বুঝিয়ে বলুন।”

“চলেন চাঁদ দেখি।”

“কোথায়?”

“ছাদে?”

“না। এত রাতে ছাদে যাওয়া যাবে না।”

“তাহলে বারান্দায় আসেন।”

আরশান কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,

“পারব না। ঘুম না আসলে চুপচাপ শুয়ে গিয়ে শুয়ে থাকেন।”

“আপনি আমার সঙ্গে চাঁদ দেখবেন না?”

“না।”

“তাহলে আমি এখনই সবাইকে ডেকে বলব আপনি আমাকে কি’ড’ন্যা’প করে এখানে আটকে রেখেছেন। ডাকব?”

“ব্ল্যাকমেইল করছেন আমাকে?”

“না, হোয়াইটমেইল করছি। আপনি নিষ্ঠুর,পাষাণ। আপনার কথা তো আমি শুনেছি। বউ না হয়েও বউ হওয়ার অভিনয় করেছি। আর আপনি…”

আরশান পৃথুলার ননস্টপ বকবকানি থামাতে বলল,

“চুপ! থামুন। আর কিছু বলতে হবে না। আপনি বারান্দায় যান। আমি শিমুলের ঘরের দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে আসছি।”

“দেরি হয় না যেন।”

শিমুলের ঘরের দরজা চাপিয়ে নিঃশব্দে আরশান নিজের রুমে প্রবেশ করল। পৃথুলা বারান্দার দোলনায় বসে আছে। গুনগুনও করছে সম্ভবত। আরশানকে দেখা মাত্রই তার ঠোঁট নাড়ানো থামল। একটা টুল হাত দিয়ে ঠেলে সামনে দিয়ে বলল,

“বসুন।”

বিনাবাক্যে বসল আরশান।

পৃথুলা দোলনায় বসে দুলতে দুলতে বলল,

“আপনার রুমে এত সুন্দর বারান্দা আছে। অথচ আমি আগে দেখিইনি!”

“দেখলে কী হতো?”

“আমি নিয়ে যেতাম। অবশ্য সমস্যা নেই। সকালে শিমুল তুলাকে বলব দোলনাটা যেন আমার রুমে দিয়ে আসে।”

“আপনি কি এখানে সারাজীবন থাকার প্ল্যান করছেন নাকি?”

“থাকতে পারলে মন্দ হতো না। ফ্রিতে খাওয়া-দাওয়া, থাকা কার না ভালো লাগে?”

আরশান স্মিত হাসল। পৃথুলা নিজের হাসিটা চওড়া করে বলল,

“হাসলে আপনাকে কত সুন্দর লাগে! হাসেন না কেন?”

আরশান উত্তর দিল না। কয়েক সেকেন্ড মৌনতা পালন করে পৃথুলা নিজেই বলল,

“আচ্ছা আপনি কি ওয়েটারের কাজ করেন?”

প্রশ্ন শুনে আরশানের মুখ হা হয়ে যায়। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“মানে? এতদিনে আপনার এটাই মনে হলো যে, আমি ওয়েটারের জব করি?”

”মানে কী আবার? আরবীতে তো কিছু বলিনি। চাইনিজ ভাষায়ও কিছু বলিনি। তাহলে বুঝলেন না কেন?”

”আমি ওয়েটারের চাকরী কেন করতে যাব? আপনার কি আমার সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে?”

”না,নেই তো। আচ্ছা বুঝলাম আপনি ওয়েটারের চাকরী করেন না। তাই বলে কি আপনার আর কোনো জামা-কাপড়ও নেই! সেই এক সাদা শার্ট,কালো প্যান্ট পরেন অলওয়েজ।”

এ কথার জবাব না দিয়ে আরশান ওকে ঘরের ভেতর নিয়ে এলো। আলমারি খুলে বলল,

“আমি এক পোশাক প্রতিদিন পরি না বরং এক কালারের পোশাক পরি।”

পৃথুলা হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। অনেকগুলো সাদা শার্ট আর কালো প্যান্ট আলমারির কেবিনেটে রাখা। বোঝাই যাচ্ছে মানুষটা ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট লাভার। একটু মিনমিন করা গলায় সে বলে,

”অন্য কালারেও আপনাকে দারুণ মানাবে। ট্রাই করে দেখতে পারেন।”

আরশান এ কথারও কোনো জবাব দিল না। ফোনের স্ক্রিনে সময় দেখে বলল,

“রাত কিন্তু অনেক হয়ে গেছে। ঘুমাতে হবে।”

“আপনার ঘুম পেয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

“ঠিক আছে! ঘুমান তাহলে।” মন খারাপ করে বলল পৃথুলা।

আরশান পৃথুলার মন খারাপকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শিমুলের রুমে চলে গেল। অগত্যা বাধ্য হয়ে পৃথুলাকেও ঘুমানোর চেষ্টা করতে হলো।
____
সকাল সাতটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে সবার জন্য নাস্তা টেবিলে সাজায় পৃথুলা। তাকে সাহায্য করেছে শিমুল। জ্বর আর এখন নেই। ভোরের দিকেই সে বাজারে গিয়ে সবার জন্য নাস্তা নিয়ে এসেছে।

নাস্তা শেষ হলে আহনাফ-অর্ষা এবং গ্যাঞ্জাম পার্টিরা যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। খুবই বিনয়ের সঙ্গে পৃথুলা, আরশানকে তাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে গেছে আহনাফ এবং অর্ষা। ওদেরকে এগিয়ে দিতে গিয়েছে শিমুল।

পৃথুলা নিজের রুমে যাচ্ছিল। আরশান তখন পেছন থেকে বলে,

“রেডি হয়ে নিন।”

পৃথুলা অবাক হয়ে বলে,

“কেন? আজ আবার কোথায় নিয়ে যাবেন?”

“আপনার ঠিকানায়।”

“আমার ঠিকানায় বলতে? আমাকে একেবারে দিয়ে আসবেন বলতে চাইছেন?”

“হ্যাঁ।”

এমন কথা শুনে পৃথুলার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু সে খুশি তো হতেই পারছে না; উলটো ভেতরটা ভেঙেচূড়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আরশান তাড়া দিয়ে বলল,

“সময় নেই। জলদি করুন।”

পৃথুলা আলতো মাথা নাড়িয়ে ঘরে গিয়ে তৈরি হয়ে এলো। আজও আরশান একটা কালো কাপড় দিয়ে পৃথুলার চোখ বেঁধে দেয়। চোখ বাঁধার সময় আলতো করে আরশানের হাত স্পর্শ করে সে। কী নিদারুণ এক যন্ত্রণা বুকের মাঝে উথালপাতাল ঢেউ তুলছে। জঙ্গলের পথটুকু কেউ কোনো কথা বলল না।সারাদিন ননস্টপ কথা বলা পৃথুলাও যেন আজ মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। গাড়িতে বসে শুধু জিজ্ঞেস করে,

“শিমুল তুলার সঙ্গে দেখা হবে না?”

“না।” আরশানের উত্তর।

পৃথুলাকে যেখান থেকে কি’ড’ন্যা’প করা হয়েছিল সেখানে এসেই গাড়ি থামায় আরশান। পৃথুলার চোখের বাঁধন খুলে দিয়ে বলল,

“চলে এসেছি।”

পৃথুলা নিশ্চুপ হয়ে বসে রইল। আরশান তার ফোনটা ফেরত দিয়ে বলল,

“কয়েকদিন একটু সাবধানে চলাফেরা করবেন। আর পারলে মাস্ক ক্যারি করবেন।”

ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে পৃথুলা। আরশান জানতে চায়,

“কিছু বলবেন?”

পৃথুলা দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল। আরশান জানালা দিয়ে মাথা বের করে বলে,

“ভালো থাকবেন।”

পৃথুলা নিরুত্তর। একরাশ অদৃশ্য অভিমানের ছায়া তার চোখে-মুখে। আরশান গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পৃথুলা ব্যস্ত হয়ে বলে,

“শুনুন, শুনুন।”

আরশান জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। পৃথুলা বলে,

“আমাদের কি আর কখনো দেখা হবে না?”

আরশান কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থেকে বলল,

“আমার সাথে দেখা না হওয়াটাই আপনার জন্য মঙ্গলজনক পৃথু।”

এরপর আর এক মুহূর্তও দেরি না করে আরশান চলে যায়। পথহারা পথিকের ন্যায় নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে পৃথুলা।

চলবে…

[কার্টেসী ছাড়া কপি করা নিষেধ।