#মিহুর_সংসার
#পর্বঃ৭ (শেষ পর্ব)
মা’কে ফোন দিয়ে যখন জিজ্ঞেস করি তুলি খেয়েছে কিনা তখন তিনি বলেন,
“আমি তো বলে আসলাম খেতে।”
কখনও মা নিজেই মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছেন।
কখনও বাবা ধমক দিয়ে খেতে বলছেন।কিন্তু সে আগের মতোই জীবনযাপন করছে।
তুলিকে দেখে কোনোভাবেই সিরিয়াস মনে হচ্ছে না, অথচ এই সময়টাতে মেয়েদের সবচেয়ে বেশি সতর্কতা অবলম্বন করে চলতে হয়।
প্রতিদিন অফিস থেকে আসার পর একই কথা শুনতে হয়,
” সারাদিনে মাত্র একবার খাবার খেয়েছে তুলি।”
কিছু বললে জবাব দেয়,
“কিছুই ভালো লাগে না।”
আজকে অফিস থেকে আসার পর দেখলাম বাসায় নতুন এক যন্ত্রনার আমদানি হয়েছে।তুলি বাসায় একটা বিড়াল পোষা শুরু করে দিয়েছে।
রুমে ঢুকে দেখি তুলি নিজে খাবার না খেয়ে বিড়ালকে খাওয়াচ্ছে।
আমি পাশে গিয়ে বললাম,
– এখন কি এসব বিড়াল পোষার সময়?
বিড়াল তো পরেও পোষা যাবে।এই সব বিড়ালের যত্ন না নিয়ে নিজের যত্ন নাও।
আমার কথা শুনে তুলি উত্তেজিত হয়ে বলল,
– আপনি এটাকে বিড়াল কেন বললেন?
আমি আবার বিড়ালটার দিকে ভালো করে তাকালাম।কোনোভাবেই তো এটাকে বিড়াল ছাড়া অন্য কিছু মনে হচ্ছে না।
– কেনো?
এটা কি বিড়াল না?
– আপনি কি মানুষ না?
– অবশ্যই আমি মানুষ।
– তাই বলে কি আপনাকে মানুষ বলে কেউ ডাকে?
কখনও কি কেউ আপনাকে ডেকেছে যে,
“এই মানুষ এদিকে আসেন?”
– না।তুমি এতো উত্তেজিত হচ্ছো কেনো, এই সামান্য বিষয়ে।এখন থেকে কথা কম বলার চেষ্টা করবে।
– সারাদিন তো একা একাই শুয়ে থাকি,এভাবে কতক্ষণ থাকা যায়।আগের মতো টিভি দেখতেও ভালো লাগে না,কাঁদতেও ভালো লাগে না, খেতেও ভালো লাগে না।মোটকথা কিছুই ভালো লাগে না।
আসল কথা বলতেই তো ভুলে গেলাম।
– কি কথা?
– আপনার যেমন একটা নাম আছে তেমনি তারও একটা নাম রেখেছি। আপনার নাম মিহাদ হোসেন।আদর করে সবাই মিহু ডাকে।
আপনার নামের সাথে মিল রেখে ওর নাম রেখেছি।
ওর নাম কি জানেন?
– না।
– ওর নাম মিনু।খুব সুন্দর না?
এত আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো যে সুন্দর কিনা এখন যদি সুন্দর ছাড়া অন্য কিছু বলি,
মূহুর্তের মধ্যেই মন খারাপ করে বসে থাকবে।
অবশ্য মিনু নামটাও খুব সুন্দর।
আমি বললাম,
– বাহ! খুব সুন্দর।নামের সাথে বিড়ালটার চেহারার অনেক মিল আছে।
তুলি চোখ বড় বড় করে আবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
– আবার বিড়াল ডাকলেন তাকে?
– আর ডাকবো না।
– এরপর থেকে তাকে বিড়াল ডাকলে আপনাকেও ছাগল ডাকবো।অবশ্য আপনি এমনিতেও ছাগল স্বভাবের।একদিন তো কাঁঠাল পাতা আর ঘাস চেয়েছিলেন খাওয়ার জন্য, আমি তখন চা দিয়ে চলে গিয়েছিলাম।এরপর একে বিড়াল ডেকে চা চাইলেও আমি আপনাকে ঘাস, লতাপাতা দিয়ে চলে যাবো।
আমি তার সাথে আর তর্কে জড়ালাম না।চুপচাপ খাটের একপাশে শুয়ে রইলাম।
তুলি এখন নিজের থেকে বিড়ালটার খেয়াল বেশি রাখছে।নিজে না খেলেও বিড়ালটাকে আদর করে তিনবেলা খাওয়াচ্ছে।নিজে অপরিস্কার থাকলেও বিড়ালটাকে পরিস্কার রাখে।
বিড়ালটাও কয়েকদিনে বেশ ভালো মোটাতাজা হয়েছে।
আজকে তুলি আমাকে ফোন করে বলল,
আসার সময় যেন বার্গার, স্যান্ডউইচ নিয়ে আসি।
আমি ভাবলাম,
মেয়েটার বোধহয় মুখে এখন রুচি এসেছে।অনেকদিন ধরেই তো মুখে রুচি নেই।
বাসায় গিয়ে যখন তার হাতে বার্গার আর স্যান্ডউইচ দুইটা দিলাম সে সাথে সাথেই আমার চোখের সামনে প্যাকেট খুলে বিড়ালটাকে দিয়ে দিলো।
বিড়ালটা খাচ্ছে আর তুলি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
এই দৃশ্য দেখে এখন আমাকে নিজের কাছে নিজেকেই ছাগল মনে হচ্ছে।আগে জানলে কখনও এগুলো আনতাম না।
আমি বললাম,
– তুমি কিছু খাবে না?
– না, আমার এগুলো খেলে বমি আসে।মুখে নিতে পারি না।
– নিজে তো না খেয়ে থাকতে পারো কিন্তু শরীরের ভিতর যে একজন বড় হচ্ছে সেদিকে কি খেয়াল রাখতে হবে না?
সে তো পুরোপুরি তোমার উপর নির্ভলশীল।ওর তো ক্ষুধা লাগে।
তুলি আমার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলল,
– আমার যেহেতু না খেয়ে থাকলে সমস্যা হয় না, তারও নিশ্চয়ই হচ্ছে না।সে তো আমারই মেয়ে।
– তার সমস্যা হচ্ছে।সে মনে মনে কি বলছে জানো?
-কি?
– আমার মা’টা খুব নিষ্ঠুর।সে কি জানে না, সে না খেলে আমি সঠিকভাবে বেড়ে উঠতে পারবো না?
– এমন কথা তো কখনও বলে নি।আমার সাথে তো ওর নিয়মিত কথা হয়।সে খুব ভালো আছে।
– আমার কথা কিছু বলে না?
– বলে তো।কালকেও বলল, আমার বাবাটা এতো বোকা কেন?
আমি পৃথিবীতে আসলে তাকে চালাক বানাবো।
– তাহলে এখনই মা-মেয়ে দুজনে মিলে আমার নামে বদনাম দেওয়া শুরু করে দিয়েছো।
এবার তুলি কোনো কথা না বলে বিড়ালটার মাথায় আবার আদর করতে লাগলো।
পরের দিন অফিস থেকে আসার সময় আবার দুইটা বার্গার আর স্যান্ডউইচ নিয়ে আসলাম।
তুলি কে দিয়ে বললাম,
– মিনুর জন্য খাবার এনেছি।কিন্তু শর্ত আছে।
– কি শর্ত?
– সে যতটুকু খাবে তোমাকেও ততটুকু খেতে হবে।শর্তে রাজি থাকলে দিবো।
– মিনুটা আজকে সারাদিন কিছু খায় নি।আমার কাছে দেন দেখি কিছু খাওয়াতে পারি কিনা?
– তুমি মিনুকে খাওয়াও আর আমি তোমাকে খাওয়া-ই।
প্রথমে খেতে না চাইলেও পরে মিনুর জন্য কষ্ট করে হলেও খাওয়া শুরু করলো তুলি।
খেতে খেতে বলল,
– আমি মিনুকে বাসায় এনেছি কেন জানেন?
– না।
– আগে কখনও কাউকে তো সেবাযত্ন করি নি।কিন্তু এখন তো আমাদের একটা মেয়ে হবে। তাই মিনুর সেবাযত্ন করে নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছি।মিনুও নিষ্পাপ আমাদের মেয়েও নিষ্পাপ।
আমি তুলির মুখে খাবার দিয়ে বললাম,
– তুমি তো খুব চালাক মেয়ে।আমি তো এভাবে কখনও ভাবি নি।
– কিন্তু আমাদের মেয়ের নাম কি রাখবো বুঝে উঠতে পারছি না।আপনি কি নাম নিয়ে কিছু ভেবেছেন?
– নাম নিয়ে পরেও ভাবা যাবে।আগে সে সুস্থ ভাবে পৃথিবীতে আসুক।এরপর যত ইচ্ছা নাম রাখবো, যখন যেটা ডাকতে ইচ্ছে করবে তখন সেটাই ডাকবো।
– আমার তো একেক সময় একেক নাম ভালো লাগে।যখন মিনা কার্টুন দেখি তখন মনে হয়ে আমাদের মেয়ে মিনার মতো হবে।ওর নাম মিনা রাখবো।যখন অন্য কোনো কার্টুন ভালো লাগে তখন মনে হয় সেটাই রাখি।নিজেকে স্থির রাখতে পারছি না।
– নাম নিয়ে এতো অস্থির হতে হবে না।তুমি আগে খাওয়া শেষ করো।
এরমধ্যে একদিন অফিসের কাজে আমি খুব ব্যস্ত।
তুলি ফোন দিয়ে বলল,
– ডাকনাম রেখে ফেলেছি, আমাদের মেয়ের।
– কি নাম রাখলে শুনি?
– মিলি। মিহু থেকে মি আর তুলি থেকে লি।দুইটা মিলে মিলি।
তার যুক্তি শুনে আমি কিছুক্ষণ হাসলাম।নাম নিয়ে সারাদিন চিন্তা করতে করতে এখন পাগল হয়ে যাওয়া শুধু বাকি এই মেয়ের।
শেষ কয়েকটা দিন তুলির খুব কষ্ট হলো।তার যন্ত্রনায় কাতরানো দেখে আমার নিজের চোখেই পানি চলে আসে মাঝেমধ্যে।কয়েকদিন ধরে রাতে ঘুমাতেও পারে না।মাঝেমধ্যে যন্ত্রনা সহ্য করতে না পেরে কান্না শুরু করে।এখন কান্নার মধ্যে আর ন্যাকামো ভাব নেই।
আমি শুধু ভাবি,
” যেই মেয়ে কাল্পনিক মুভি দেখে সারাদিন কাঁদতো এখন এই নিজের যন্ত্রনাগুলো কীভাবে সহ্য করছে?
কোনো সন্তান যদি তার মায়ের প্রসব বেদনার কান্না শুনতে পেতো তাহলে সে কখনও তার মায়ের সাথে উচু গলায় কথা বলতো না।”
আমি ছেলে হয়ে এই বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারলাম আজ যখন নিজে সন্তানের বাবা হলাম।তুলিকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো।
কয়েকদিন ধরে তার মুখের দিকে তাকাতেই পারছিলাম না।এত যন্ত্রনা সহ্য করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা শুধু মেয়েদেরই দিয়েছেন।
এরপর ডাক্তার এসে যখন জানালো,
মা-মেয়ে দুজনেই সুস্থ আছেন তখন অনেকটা দুশ্চিন্তা মুক্ত হলাম।তবুও নিজের চোখে না দেখা পর্যন্ত মনের মধ্যে শান্তি পাচ্ছিলাম না।
কিছুক্ষণ পর আম্মা মেয়েটিকে নিয়ে আমার হাতে দিয়ে বলল,
” তোর মেয়ে,কোলে তুলে নে।”
আমি মেয়েটিকে কোলে নিয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলাম,
– তুলি কেমন আছে মা?
– সেও ভালো আছে।
মেয়েকে কোলে নিয়ে নিজের মধ্যে অদ্ভুত এক অনুভূতি হচ্ছে।এর আগেও অনেক বাচ্চা কোলে নিয়েছি কিন্তু এমন অনুভূতি হয়নি।
তুলির জ্ঞান ফিরলে তার পাশে মেয়েটিকে রাখা হলো।কিছুক্ষণ আগেও সে যন্ত্রনাই কাতরাচ্ছিল কিন্তু এখন মেয়ের সাথে শুয়ে খেলছে,মাথা হাতিয়ে দিচ্ছে।এখনও তার শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ না, শরীরে অনেক কাটাছেঁড়া করা হয়েছে।কিন্তু এসব যন্ত্রনা তার কাছে কিছুই মনে হচ্ছে না।
আমি শুধু দূর থেকে তাকিয়ে মা-মেয়ের খুঁনসুটি উপভোগ করে চলেছি।
এরপর নার্স এসে আমাকে বলল,
বার্থ সার্টিফিকেট এর জন্য কিছু তথ্য লাগবে।
আপনি সন্তানের কে হোন?
-বাবা।
মায়ের নাম কি?
– তুলি।
-বাবার নাম
– মিহাদ হোসেন।
– মেয়ের কোনো নাম ঠিক করে রেখেছেন?
– জি। মেয়ের নাম মিলি।
মিলির যখন এক বছর বয়স তখন বুঝতে পারলাম এই মেয়ে তার মায়ের মতো হয়েছে।
মা সারাদিন কার্টুন দেখে, সাথে মেয়েও।মা যখন কার্টুন দেখে হাসে মিলিও তখন হিহি করে হাসে, মায়ের মন খারাপ থাকলে মিলিরও মন খারাপ।কিন্তু মিলির মন ভালো রাখার জন্য বাসায় আরেক জন তো আছেই, তার নাম মিনু। মিলির মন খারাপ থাকলেই সে তার সাথে খেলা শুরু করে দেয়।
মিলি এখন শব্দ করে ডাকতে শিখে গেছে।সুন্দর করে মা আর মিনু ডাকতে পারে।বাবা ডাকার আশে-পাশেও নেই সে।তবে ইদানীং মায়ের সাথে কার্টুন দেখে হালুম, শিকু, গোপাল, মিনা ডাকার চেষ্টা করে।
দুই বছর পর খেয়াল করলাম মিলিকে একটু ধমক দিয়ে কথা বললে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে আবার বাসায় ফকির আসলে হাতের কাছে যা পায় তাই দেওয়া শুরু করে দেয়।ফকিরের পায়ে জুতা না থাকলে বাসার সবার জুতা দান করে দেয়।
এখন আমি এগুলো দেখে আর বিরক্ত বোধ করি না।কারন বিয়ের পর তুলির এসব কান্ড দেখে দেখে এখন আমার অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে।
কিন্তু মেয়ের এসব কান্ড দেখে তুলি এখন সহ্য করতে পারে না।
মাঝেমধ্যে যখন মিলিকে ধমক দিতে আসে তখন আমি বলি,
” খবরদার আমার মেয়েকে ধমক দিবে না।আগে তোমার এসব যন্ত্রনা আমি চোখ,মুখ বুজে সহ্য করেছি।তোমাকেও এখন এসব সহ্য করতে হবে।
বিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন বলেছেন,
” প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া আছে।”
তুলি আমার কথা শুনে শুধু বলে,
” জীবনে সুখ বলতে জিনিসটার ছোঁয়া আমি কখনও পেলাম না।আগে একজন যন্ত্রনা দিতো এখন তার সাথে আরেক জন যুক্ত হয়েছে।”
আমি কেবল হাসি আর মনে মনে ভাবি,
” তুলি এখন সংসারের দায়িত্ব ঠিকই নিয়েছে কিন্তু মিলি তার মায়ের আগের রূপে ফিরে এসেছে।মেয়ের সারাদিনের কর্মকান্ড দেখে আমি বুঝতে পারি ছোট সময় তুলি কেমন ছিল সেই সাথে বড় হয়ে মিলি কেমন হবে সেটাও এখন আমি জেনে গেছি।”
(সমাপ্ত)
© খাদেমুল আলম মিঠুন