মেঘকন্যা পর্ব-১৮

0
2814

#মেঘকন্যা☁️
#Part_18
#Writer_NOVA

নিজের রুমে রাগে ফুঁসছি। ফ্লোরে বিশাল বড় একটা হালকা বাঙ্গি কালার গাউন এলোমেলো হয়ে পরে আছে। গতকাল বিকালে আয়িশেকে মানা করার পরও শোনেনি। আজ নাকি ওর সাথে আমাকে কোথায় যেতে হবে? আমার সারা শরীর রাগে ফাটছে।আমি নিজেও জানি না আমার এমন হচ্ছে কেন?আমি নিজের মনের ওপর কন্ট্রোল করতে কেন পারছি না।আমি তো মনে প্রাণে আয়িশকে নিজের স্বামী হিসেবে চাইতাম।তাহলে এখন আয়িশ আমার স্বামী এটা জানার পর আমার এমন হচ্ছে কেন?তখনি আম্মি আমাকে ডাকতে ডাকতে রুমে ঢুকলো।

আম্মিঃ মেঘা তুই এখনো তৈরি হোস নি কেন?আয়িশ চলে আসবে তো।এসে যদি তোকে তৈরি হতে না দেখে তাহলে রেগে যাবে।

আমিঃ আমি কোথাও যাবো না। (কঠিন গলায়)

আম্মিঃ তোর কি হয়েছে বলতো?দুদিন ধরে খেয়াল করছি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিস।রুমে ঘাপটি মেরে বসে থাকিস।কারো সাথে ভালো করে কথা বলিস না।তুই কি কোন বিষয় নিয়ে আপসেট? কোন বিষয় নিয়ে আপসেট হলে আমাকে বল।আমি তোকে সাহায্য করবো।তোর মন খারাপ দেখে আয়িশও সবসময় মন খারাপ করে রাখে।তাই তো আজ তোকে নিয়ে রাতের ডিনারে বের হতে চাইছে।

আমিঃ আমার ভালো লাগছে না। আমি এখন যাবো না।তুমি রুমের থেকে যাও তো। আমাকে একা থাকতে দেও।আমার এখন কিছু ভালো লাগে না।

আম্মিঃ ভালো লাগার জন্যই তো আমি বলছি আয়িশের সাথে ঘুরে আয়। ভালো লাগবে।জলদী আমার কাছে আয়তো।আমি তোকে তৈরি করে দেই।চোখ মুখের অবস্থা কি করেছিস সেটা কি আয়নায় দেখেছিস।

আমিঃ অন্য একটা ছেলের সাথে রাত করে পাঠাতে তোমার কোন চিন্তা হচ্ছে না আম্মি?বরং তুমি যেচে আমাকে পাঠাতে চাইছো। তুমি তো আমাকে কোন ছেলের সাথে মিশতে দিতে না।হঠাৎ কি হলো তোমার? আজ নিজে আমাকে তৈরি করে দিবে বলছো।তাও অন্য একটা ছেলের জন্য। বিষয়টা আমার কাছে বেশ রহস্যজনক লাগছে।

আমি আম্মির মুখ থেকে কথা বের করার জন্য কথাগুলো বললাম।স্বপ্নটা না দেখলে আমি হয়তো এই বিয়ের বিষয় কিছুই জানতাম না।আমার প্রশ্ন শুনে আম্মি কাচুমাচু করতে লাগলো।আমতা আমতা করে বললো।

আম্মিঃ আয়িশকে সেই কবের থেকে জানি,চিনি।ছেলেটা ভীষণ ভালো। আজকাল ওর মতো ছেলে দুটো পাওয়া যাবে না।এরকম ছেলের সাথে মেয়ে থাকলে যেকোন মা নিশ্চিন্তে থাকবে।তুই এখন বেশি কথা বলিস না তো।আমায় তোকে তৈরি করতে দে।আয়িশের আসার সময় হয়ে গেছে।

আমিঃ তুমি এমন আমতা আমতা করছো কেন?কিছু কি লুকাচ্ছো আমার থেকে?কিন্তু কেন?আম্মি আমার যথেষ্ট বোঝার বয়স হয়েছে। এখন আমার কাছ থেকে কথা লুকানোর কোন মানেই হয় না।তারপরেও কেন লুকাচ্ছো তা একমাত্র তোমরা ও আল্লাহ ভালো জানো।তবে এতে ভালো না হয়ে মন্দও হতে পারে। আমি কি কখনো তোমার ও আব্বির কথার অবাধ্য হয়েছি।আমাকে জানিয়ে সব ঠিক করতে।

আম্মি আমার কথা শুনে দমে গেল।কিছু একটা ভাবছে।আমি জানি কি ভাবছে।কারণ তার মনের কথা আমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি।সে এখন নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করছে।

আম্মিঃ আমরা কি বিয়ের বিষয়টা মেঘার থেকে লুকিয়ে ঠিক করলাম?ওকে সব জানিয়ে নিলে হয়তো কোন ভুল হতো না। এখন কি আমরা যে ভয় পাচ্ছি তাই হচ্ছে। মেঘা নিজেকে কেন গুটিয়ে নিয়েছে?সেদিনের কথা কি শুনে নিয়েছিল মেঘা?যার কারণে ছেলেটার সাথে এমন খারাপ ব্যবহার করছে।

আমিঃ আম্মি, আম্মি।কি ভাবছো এত মনোযোগ দিয়ে।কি ব্যাপার কথা বলছো না কেন?

আমি আম্মির মুখের সামনে তুড়ি বাজাতেই আম্মির হুশ ফিরলো।সে এতক্ষণ এক ধ্যানে কত কিছু ভেবে ফেললো।তবে এটা সত্যি আমি নিজের মনের বিরুদ্ধে কিছু করছি না।আমার মন যা বলছে তাই শুনছি।আমি জানি এটা ভুল তারপরেও আমি সেটাই করছি।তাহলে কি সত্যি আমার মনের কোন নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই।

আমিঃ তুমি এখন যেতে পারো।আমি আয়িশের সাথে যাবো না।আমার ওকে কেন জানি দুদিন ধরে সহ্য হচ্ছে না।আমাকে একদম জোর করবে না।

আম্মিঃ এটা কেমন কথা মেঘা?তোকে তো বললাম, তোর ভালো লাগছে না বলেই আয়িশ তোকে বাইরে থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে।ছেলেটা সারাদিন কষ্ট করে তোর জন্য একটা সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করেছে। আর তুই না গেলে ওর মনটা খারাপ হয়ে যাবে।মর্জি না করে আমার কাছে আয়।আমি তোকে তৈরি হতে সাহায্য করছি।

আমার আর কোন কথা না শুনে, আম্মি জোর করে আমাকে তৈরি করে দিতে লাগলো।আমি বিরক্তির সাথে নিজেকে সাজাতে লাগলাম।

🌨️🌨️🌨️

অন্যদিকে…….

আয়িশ আজ মেঘার জন্য অনেক সুন্দর করে ডেকোরেশন করছে।চারিদিকে লাল গোলাপ।পুরো সারপ্রাইজ প্ল্যানিং-টা মাটির নিচে করা হয়েছে। ভেতরটা বিভিন্ন রঙের লাইটে আলোকিত হয়ে আছে।বিশাল জায়গা জুড়ে নানা ফেইরি লাইট।কোণার দিকে ছোট একটা টেবিল।সেখানে পুরোটা গোলাপের পাপড়ির ছড়াছড়ি। দুটো গ্লাস উপুর করে রাখা।মাটির ওপর থেকে কয়েকটা সিড়ি নিচে নেমে এসেছে সিঁড়ি টা লাল গলিচা বিছানো।অন্য দিকে বেশ কিছু সারপ্রাইজ প্ল্যানিং করা।পূর্ব দিকে লাল গোলাপ পাপড়ি একটার ওপর একটা আটকে কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে।সেটা হলো মেঘা ও আয়িশের বিয়ের একটা ছবি।যেখানে মেঘা রেজিস্ট্রী পেপারে সই করছে আর আয়িশ এক হাতে মুখের ফুলের লম্বা ফুলের মালাগুলো সরিয়ে মুগ্ধ চোখে মেঘার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই ছবির ওপর থাকা পাপড়িগুলো মেঘা আলতো করে ছুঁয়ে দিলেই ঝরে পরে ছবিটি দৃশ্যমান হবে।

উত্তরের দিকে একটা দরজা।দরজাটাও পুরো গোলাপে সাজানো।সেটা খুলে বাইরে গেলে দেখা যাবে একটা ছোট লাল দোলনা।দোলনার পুরোটা লাল গোলাপে মোড়ানো। সামনে ছোট একটা ঝিল।ঝিলের মধ্যে কতগুলো রাজহাঁস মনের সুখে সাঁতার কাটছে।দূরের কোণার দিকে একটা ছোট বাক্স থেকে হালকা সবুজ আলো ঠিকরে বের হচ্ছে। আসলে বক্সটার মধ্যে জোনাকি পোকা আটকানো।মেঘাকে যখন এখানে নিয়ে আসবে তখন চারিদিকে অন্ধকার করে জোনাকি পোকা ছেড়ে দিবে।দোলনার পাশে বিশাল বড় একটা লাভশেইপ আকা। তাও গোলাপের পাপড়ি দিয়ে। সেখানে অগণিত মোমবাতি জ্বালানো।মোট কথা সব কিছু আজ মেঘার পছন্দের লাল গোলাপে সাজানো।

সারা ডেকোরেশন আয়িশ সকাল থেকে একা একা করেছে।আজ আয়িশ মেঘাকে প্রপোজ করবে।যদিও মেঘা ওর স্ত্রী। তারপরও মেঘার মন ভালো করতে এই সারপ্রাইজের আয়োজন করেছে।আজ সবকিছু বলে দিবে।আয়িশ জানে মেঘা সবকিছু জেনে গেছে। তাও বলবে।

আয়িশ হালকা ছাই কালার কোর্ট প্যান্ট পরেছে।সাথে সেই রঙের কোটি।শেষ বারের মতো পুরো ডেকোরেশনে চোখ বুলালো।সবকিছু ঠিক দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছারলো।

আয়িশঃ আমার জানি তুমি জেনে গেছে আমি তোমার স্বামী। আমি জানি এটাই সত্যি।জানি এই সারপ্রাইজে হিতের বিপরীত হতে পারে। তবুও আমি তোমার মুখের হাসির জন্য সারাদিন খেটে এই কাজ করলাম।আমি চাইলে শক্তি ব্যবহার করে এক নিমিষেই সব করতে পারতাম।কিন্তু সেটা করতে মন সায় দিলো না।নিজ হাতে সবকিছু করে তোমায় উপহার দিতে মন চাইলো।আমি খুশি মনে সারাদিন কষ্ট করেছি।শুধু তোমার এক চিলতে মুখের হাসির জন্য। আসলে
কষ্টে করে কিছু উপার্জন করলে তার মর্মটা উপলব্ধি করা যায়।কিন্তু বিনা কষ্টে কোন কিছু পেলে তার মর্মটা আমরা বুঝি না।

আয়িশের মনটা কু ডাকছে। মনে হচ্ছে সামনে খুব খারাপ কিছু হতে চলছে।আয়িশ মেঘাকে বিয়ের কথাটা জানাতে চায়নি এবং এটাও জানতে চাইনি ও মেঘার স্বামী। কারণ তাহলে মেঘা ওকে ভুল বুঝে দূরে চলে যাবে।আয়িশকে নিজের আশেপাশে ভিড়তে দিবে না।যাতে মেঘা একা হয়ে যাবে।আর ইশাল এই সুযোগ ব্যবহার করে খুব সহজে ওর ক্ষতি করতে পারবে।

মেঘা যখন জানবে আয়িশ ওর স্বামী তখন থেকে নিজের মনকে কন্ট্রোল করতে পারবে না। নিজের মাথা ও মনকে প্রচুর প্রেসার দিবে।যাতে সে নিজের মনের ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলবে।মাথা কাজ করবে না।সে যা চাইবে না তাই করতে বাধ্য হবে।
আয়িশকে ওর দুচোখের বিষ মনে হবে।কিছুতেই ওকে সহ্য করতে পারবে না।কারণটা হলো মেঘা নিজের শক্তির বিষয় অজ্ঞ।আয়িশ ওর সাথে থাকলে কেউ ওর কোন বিপদে ফেলতে পারবে না।যতক্ষণ না মেঘা নিজ থেকে কোন শক্তি ব্যবহার করবে ততক্ষণ পর্যন্ত আয়িশ ওর কাছে বিরক্তিকর একজন মানুষ। যার কারণে কেউ মেঘাকে বিষয়টা জানায়নি।সবাই এর জন্য ভয়ে ভয়ে ছিলো। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এখন সেটাই হচ্ছে। মেঘা আয়িশকে সহ্য করতে পারছে না।আয়িশ চায়নি মেঘাকে না জানিয়ে বিয়ে করতে।কিন্তু পরিস্থিতি তখন এতটাই খারাপ ছিলো যে ওকে জানানোর মতো সময় হাতে ছিলো না। শুধু ওর বাবা-মা কে জানাতে পেরেছে। মেঘার আম্মি-আব্বি জানে মেঘা ও আয়িশ যে মেঘরাজ্যের কন্যা ও পুত্র ।

আমি এখন আমার পরনের বিশাল গাউন ধরে দাঁড়িয়ে আছি বিরান এক মাঠের মাঝখানে। নিজেকে আহামরি করে সাজাইনি।চুলগুলো খোঁপা করে সামনের বেবি চুলগুলো ছেড়ে রেখেছি।কানের দিকে দুটো পাথরের ক্লিপ আটকানো।গলায় হালকা পাতলার মধ্যে একটা চেইন।মুখে কোন মেকআপ নেই। চোখে কাজল, ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক।এক হাতে গাউন ধরে রাখতে রাখতে বিরক্ত লাগছে।আমি হিজাব পরতে চেয়েছিলাম।কিন্তু আম্মি পরতে দেয়নি।রাতের বেলা কেউ দেখতে পাবে না তাই পরাও হয়নি।অনেক রাত হয়ে গেছে। আয়িশ খুব স্প্রিডে বাইক চালিয়ে এই বিরান মাঠে এসে থামলো।

আমার ডান হাতটা শক্ত করে আয়িশ ধরে আছে। আমি বুঝতে পারছি না ডিনারের কথা বলে আমাকে কোথায় নিয়ে এলো।বিশাল বড় একটা ম্যানহোলের ঢাকনার মতো দেখতে পাচ্ছি।উপরে কতগুলো ছোট ছোট চাকা। আয়িশ কয়েকটা চাকা ঘুরতেই ঢাকনাটা খুলে গেল। ভেতরে যাওয়ার জন্য একটা প্রকান্ড সিঁড়ি দৃশ্যমান হলো।আয়িশ আমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। সিঁড়ি শেষ প্রান্তে এসে ঘন অন্ধকার ছাড়া অন্য কিছু দেখলাম না।হঠাৎ আমার পাশে আয়িশের অস্তিত্ব টের পেলাম না।আমি ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওকে ডাকলাম।ভেতরটা এখন ঘুটঘুটে অন্ধকার।

আমিঃ আয়িশ, আয়িশ।কোথায় তুই?

আমি ডাকার সাথে সাথে পুরো জায়গা আলো জ্বলে উঠলো। চারপাশ খুব সুন্দর করে সাজানো।
চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যের ভরপুর। আমার প্রিয় লাল গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো ছিটানো। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে সামনে তাকাতে দেখতে পেলাম আয়িশ সিঁড়ির লাল গলিচায় এক হাঁটু মুড়ে বসে আমার দিকে একটা লাল বক্স এগিয়ে দিয়েছে।চোখে তার করুন চাহনি।
বক্সের মধ্যে হিরের আংটি জ্বলজ্বল করছে।অন্য সময় হলে আমি খুব খুশি হতাম। কিন্তু এখন আমার এটা দেখে অনেক রাগ উঠে গেল।কারণ _______

#চলবে