মেঘে ঢাকা আকাশ পর্ব-০৮

0
351

#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব-৮
#আমিনুর রহমান

হাসান আমাকে চিনতে পারল তবে খুব একটা অবাক হলো না আমাকে দেখে। হাইস্কুলের সেই বন্ধুত্বটা যে অনেক আগেই সে ভুলে গিয়েছে সেটা আর বোঝার বাকি রইল না। এসএসসি পাশ করে হাসান রাজশাহী চলে গিয়েছিল তারপর থেকে তাঁর সাথে আর কোন যোগাযোগ হয়নি। এতদিন পর যখন তাঁর সাথে দেখা তখন ভেবেছিলাম সে আমাকে জড়িয়ে ধরার জন্য দৌড়ে আসবে,আমিও দৌড়ে গিয়ে তাকে বুকে টেনে নিব। কিন্তু এমনটা হল না। হাসানের কথাবার্তার মধ্যেও কেমন জানি একটা ভাব চলে এসেছে। মানুষ যখন ভালো চাকরি করে,একটু টাকা পয়সা হয় তখন তাঁর ব্যক্তিত্বটাও কী চেঞ্চ হয়ে যায় না? হাসানকে দেখে এরকমই মনে হচ্ছে। হাসান আমার সম্পর্কে কিছুই জানে না,আমার বদনামের কথাও হয়তো জানে না। স্পৃহার কাছ থেকে অন্তত এই মিথ্যা বদনামের লজ্জাটা পেতে হবে না আমাকে এটা ভেবে ভালোই লাগছে। তবে হাসান অনেকটা বদলে গিয়েছে, তাঁর কথার মধ্যে কেমন যেন অহংকার বোধ কাজ করে,এমনটা আগে করত না।

স্পৃহা আমাকে হাসানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। হাসান যখন জানতে পারল আমরা দুজন একই ছাদের নিচে বসবাস করছি তবুও সে তেমন কোন রিঅ্যাক্ট করল না। অথচ আমি ভেবেছিলাম সে নেগেটিভ কিছু ভাববে,স্পৃহার সাথে তাঁর ঝগড়া হবে। স্পৃহাকে সে সন্দেহ করবে,স্পৃহাও রাগ করে তাঁর সাথে ব্রেকআপ করবে। এমন ভাবাটা যে কত বোকামি সেটা বুঝতে পারলাম আমি। স্পৃহা আমাদের দুজনকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার একসময় আমি নিজ থেকেই বললাম,

“আমি আপনার বয়ফ্রেন্ডকে অনেক আগে থেকেই চিনি, যদিও অনেকটা বছর আমাদের দুজনের কোন কথা হয়নি,যোগাযোগ হয়নি। তবে আমরা পাঁচটা বছর একসাথে পড়েছি।”

আমার কথার সাথে হাসান সম্মতি দিল। স্পৃহা আমাদের এতদিন পর দেখা হওয়াতে অনেকটা খুশি হল। কারণ হয়তো ওই একটাই,আমার সাথে যোগাযোগটা থেকেই যাবে। কিন্তু আমি তো তাঁর সাথে কোন যোগাযোগ রাখব না। যেদিন স্পৃহা হাসানের কাছে চলে যাবে সেদিনই আমি স্পৃহার সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে যাব অন্য কোন এক দুনিয়ায়। যেখানে স্পৃহা নামে কোন মানুষ থাকবে না। কারণ ইদানীং কেন জানি মনে হচ্ছে স্পৃহাকে ছাড়া আমার থাকা খুব কষ্ট কষ্ট হবে। এটাকে কি বলা যায় জানি না। যদি ভালোবাসা বলা যায় তবে ভালোবাসায়,না হলে অন্য কিছু। স্পৃহারও কি আমাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে? আমাকে মিস করবে অনেক? নাকি হাসানের সাথে দিব্যি কাটিয়ে দিবে নিজের সুখের দিনগুলো। এমনটা হলেও অবাক হব না। কারণ স্পৃহা আমাকে কখনোই ভালোবাসেনি,শুধু একজন বন্ধু ভেবেছে। যার কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যাবে। এর বেশি কিছু না।

অনেকক্ষণ কথা বলার পর বুঝতে পারলাম আমার এখন চলে যাওয়া উচিত। ওরা দুজন অনেকদিন পর দেখা করল। একান্তে কিছু কথা বলার থাকতে পারে ওদের, যেহেতু ওরা দুজন প্রেমিক প্রেমিকা তাই গোপনীয় অনেক কিছুই থাকতে পারে তাদের মাঝে। তাই আমি তাদেরকে একা রেখে চলে এলাম। হাসান কিংবা স্পৃহা আমার চলে আসাটা আটকালো না। কারণ তারাও একটু ব্যক্তিগত গোপনীয়তা চাচ্ছিল। আমি রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই মিলি আমাকে ফোন দেয়। সেদিনের পর মিলি আর আমাকে ফোন দেয়নি। হয়তো অভিমান করেছিল,আমি তাঁর সাথে কথা না বলে কেন ফোনটা রেখে দিয়েছি। আমিও অভিমান ভাঙানোর প্রয়োজন করিনি। তাই ফোনও দেইনি,এমনিতেও ব্রেকআপের পর মিলিকে কখনো ইচ্ছে করে ফোন দেইনি। দিতে ইচ্ছে করেনি,এই ইচ্ছে না করার কারণটাও আমি খুঁজে পাই না। হতে পারে এটার কারণ স্পৃহা কিংবা অবনি।

ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই মিলি বলল।

“তুমি কোথায় এখন? আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই ইমারজেন্সি।”

আমি তখন বললাম।

“অনেক দূরে আছি দেখা করতে পারব না। কেন দেখা করতে চাও তুমি? দেখা করার তো কোন কারণ দেখি না আমি।”

তখন মিলি বলল।

“ঢাকাতেই তো আছ? এমন তো না যে ঢাকার বাহিরে আছ। দেখা করার কারণ লাগবে কেন? এতদিন পর দেখা করতে চাইলাম আর তুমি কিনা আমাকে ইগনোর করছো। এই ছিল তোমার ভালোবাসায়? আমি কি তোমার এতটাই পর হয়ে গেছি যে একটাবার দেখা করতে পারবে না আমার সাথে? এতটাই দূরে ঠেলে দিয়েছ আমাকে?”

আমার খুব রাগ হল,এমনিতেই মন মেজাজ ভালো না, তারওপর মিলির এমন তেত কথা। আমি মিলিকে ধমক দিয়ে বললাম।

“ভালোবাসা জিনিসটার মানে তুমি আমার থেকে বেশি বুঝো। আমি কাউকে ভালোবাসতে পারি না৷ যদি পারতাম তাহলে ভালোবাসার মানুষগুলো আমাকে ছেড়ে যেত না। তুমি একটা কথা বলতে পারবা? তোমার সাথে যখন রিলেশনে ছিলাম তখন তোমার কি কখনো এক সেকেন্ডের জন্যও মনে হয়েছে আমি তোমাকে ভালোবাসি না?”

তখন মিলি বলল।

“না মনে হয়নি। তবে এখন তুমি আমাকে ইগনোর করো,আমার সাথে কথা বলতে চাও না,আমার ফোন ধরো না।”

তখন আমি মিলিকে বললাম।

“এখন আমি তোমাকে ভালোবাসি না তাই এমন করি। আর আমি এখন বিবাহিত, আমার বউ আছে।”

তখন মিলি হেসে দিয়ে বলল।

“মিথ্যা বলাও শিখে গিয়েছো দেখি। যেখানে তোমারই থাকা খাওয়ার কোন জায়গা নেই,সেখানে তুমি নাকি বিয়ে করছো। হাস্যকর।”

তখন আমি গলার স্বর নিচু করে বললাম।

“তাহলে তো জানোই আমার অবস্থা খুব শোচনীয়, আমার থাকা খাওয়ার মত জায়গা নেই। আমার জীবনে কেন আসতে চাইছো? অন্য কাউকে বেছে নিলেই তো পারো।”

তখন মিলি বলল।

“কারণ তোমাকে ভুলতে পারছি না তাই। তুমি কি আমাকে সত্যিই ভুলে গেছো?”

মিলির এমন কথা শুনে কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। আসলেই কি আমি মিলিকে ভুলে যাইনি? সবসময় তো ওই একজন মানুষকেই আমার মনে হয়। আমি জানি সে আমার না,অন্য কাউকে ভালোবাসে। তবুও কেন তাঁর জন্য আমার ভিতরটাতে হাহাকার করে? আমি মিলিকে বললাম।

“হ্যাঁ,আমি তোমাকে ভুলে গিয়েছি।”

তখন মিলি মনখারাপের সুরে বলল।

“তুমি তো বলেছিল আমি তোমাকে ভালোবাসি না তাই আমি অন্য কারো সাথে নিজেকে জড়াতে পেরেছিলাম। তাহলে আজ কেন তুমি আমাকে ভুলে গেল? তুমিও কি আমার মত অন্য কারো সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছো? তাহলে তো আমার প্রতি তোমার ভালোবাসাটা বরাবরাই মিথ্যা ছিল। অথচ তুমি আমাকে মন থেকে ভালোবাসো সেই আশায় তোমার কাছে বারবার ফিরে আসতে চেয়েছি আর তুমি কিনা অন্য কারো জন্য আমাকে ভুলে গেলে?”

বেশি কিছু বলতে ইচ্ছে করছিল না,তারপরেও বললাম।

“তুমিও তো আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে ভালোবেসেছিলে। কই আমি তো কোন অভিযোগ করিনি। তুমি তো তাঁর সাথেই নিজের জীবনটাকে রঙিন করতে চেয়েছিলে কিন্তু পারো নি। কারণ সে তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে। সে যদি চলে না যেত তাহলে তো তুমি ঠিকই আমাকে ভুলে তাঁর সাথে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করতে৷ তাহলে আমি কেন পারব না? আমার বুঝি ভালো থাকার অধিকার নেই,ভালোবাসার অধিকার নেই? আমার মনে হয় আমি তোমার সাথে ভাল থাকতে পারব না তাই তোমার সাথে আবার নতুন করে নিজেকে প্রেমের বন্ধনে বাঁধতে চাই না আমি।”

মিলির সাথে কথা বলার সময় হঠাৎ করেই মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলাম। এর আগে কখনো এমন হয়নি আমার। আমি মাথায় ব্যাথা নিয়েই বাসায় চলে গেলাম। ওষুধ খেলাম,সারাদিন শুয়ে থাকলাম তারপরেও মাথাব্যথা কমল না,শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছি বুঝতেই পারেনি। ঘুম ভাঙল বিকেল পাঁচটায়। তখনও স্পৃহা বাসায় ফিরেনি। তাহলে কি সে চিরদিনের জন্য চলে গেলো। আমাকে তো বলে যাওয়ার কথা। তাঁর সব জিনিসপত্র তো এখানেই আছে। এসব না নিয়ে তো সে যাওয়ার কথা না। সেই সকাল দশটায় আমি তাকে হাসানের কাছে রেখে এলাম। এখনও সে হাসানের সাথেই আছে। কি করছে তারা সারাটা দিন ধরে আমার খুব জানতে ইচ্ছে করল। কিন্তু চাইলেই তো আর সব জানা সম্ভব না। এটাও আমার পক্ষে জানা সম্ভব না। কি আর করবে? ভালোবাসা বিনিময় করবে এর বেশি কিছু না। আর করবেই তো, তারা প্রেমিক প্রেমিকা। এটুকু করতেই পারে। কিন্তু তাদেরকে নিয়ে এমনটা ভাবতে আমার খারাপ লাগছে কেন সেটাই বুঝলাম না।

অনেক কিছু করেও যখন মাথাব্যথাটা কোনক্রমেই কমছিল না তখন ভাবলাম একবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত। শুনেছি মানুষের যখন ব্রেইন টিউমার হয় তখন মাথায় অনেক পেইন হয়। কিন্তু আমার তো এর আগে এত পেইন হয়নি কখনো। তবুও কেন জানি ভয় হতে লাগল। আমার তো আবার এরকম কিছু হল না? ব্রেইন টিউমার হলে নাকি অপারেশনে বাঁচার সম্ভাবনা মাত্র ৫ পারসেন্ট। অপারেশন করতেও অনেক টাকা লাগে৷ হলেই বা কি? আমি মারা গেলেও তো কাঁদার মত কেউ নাই আমার। হয়তো বাবা মা জানতেই পারবে না তাদের ছেলেটা তাদের অজান্তেই তাদেরকে ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে গিয়েছে।

আমার এক বন্ধু ঢাকা মেডিক্যালে চান্স পেয়েছিল,ওর নাম রাশেদ৷ খুব ভাল স্টুডেন্ট। ধুর কি বলি আমি,ভালো না হলে কি আর ঢাকা মেডিক্যালে চান্স পায়? মাথাব্যথার সাথে সাথে কথাগুলোও কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে। রাশেদের পড়াশোনা শেষ হয়েছে। এখন ঢাকাতেই রোগী দেখে। ওর কাছে গেলে কেমন হয়? টাকাও খরচ হবে না,আমার মাথাব্যাথার কারণটাও জানতে পারব। আমার হাইস্কুল জীবনের অনেক বন্ধুরাই এখন প্রতিষ্ঠিত। আমিই শুধু কিছু করতে পারিনি। এখানেও কি আমি ব্যর্থ না? নিজের বাবা মায়ের কাছে আদর্শ সন্তান হতে পারলাম না বোনের কাছে ভালো ভাই হতে পারলাম না,ভালোবাসার মানুষের কাছে বিশ্বাস অর্জন করতে পারলাম না। সবজায়গায় কেন জানি আমি ব্যর্থ। মৃত্যুতেও কি আমি ব্যর্থ হব? না মৃত্যুর কাছে আমি সফল হব। আমার বিশ্বাস এই স্বার্থপর পৃথিবীর সবাই আমাকে নিরাশ করলেও মৃত্যু আমাকে ভালোবেসে বরণ করে নিবে।

আমার ডাক্তার বন্ধুর সাথে দেখা করলাম। পরীক্ষাও করালাম। ভয় হচ্ছে খারাপ কিছু ধরা পড়বে হয়তো আমার। এমন সময় আমার বন্ধু আমার কাছে এসে বলল।

“এত চিন্তা কিসের? তেমন কিছুুই হবে না। বেশি টেনশনে থাকিস, আর রোদের মধ্যে ছিলি সেজন্য হয়তো এমন হয়েছে। তোর সাথে কি হাসানের কথা হয়?”

হাসানের কথা শুনে আমি থমকে গেলাম। আমি গোমরা মুখে বললাম।”না,কেন বল তো?” তখন রাশেদ বলল।

“হাসান তো এখন অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে তো মেয়েদের সাথে কথায় বলতে পারত না আর এখন ওর কয়েকটা গার্লফ্রেন্ড। হাসান রাজশাহী থেকে মাঝে মাঝেই ঢাকায় আসত মিলি নামের একটা মেয়ের সাথে দেখা করতে।”

মিলি নামটা শুনে বুকের ভিতর ছ্যাত করে উঠল। আমি যেই মিলিকে চিনি সেই মিলি নয়তো?

রাশেদ আবার বলল।

“আমিও একদিন ওদের সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম। মেয়েটার বাসা ঢাকাতেই। পাঁচ ছয়মাস আগে মেয়েটা আমার এখানে এসেছিল। হাসানের সাথে ফিজিক্যালি রিলেশন করার কারণে মেয়েটার পেটে যে বাচ্চার জন্ম নিয়েছিল সেটা নষ্ট করতেই আমার কাছে এসেছিল তারা। তুই শুনলে অবাক হবি এই মেয়েটার সাথে এরকম একটা কাজ করার পরেও হাসানের এখনও দুই দুইটা গার্লফ্রেন্ড। ও মেবি ঢাকায় আসবে ট্রান্সফার হয়ে৷ আমার কাছে মেয়েটার পিকও আছে। দাঁড়া তোকে দেখাচ্ছি। ঘুরতে গিয়ে তুলেছিলাম। কথাগুলো বলেই নিজের ফোনে একটা পিক দেখালো আমাকে। ছবিটা দেখে কিছুক্ষণের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম আমি। এটাতো সেই মিলি যাকে আমি চিনতাম জানতাম,এখনও চিনি। তাহলে কি আমার ব্রেকআপের পর মিলি হাসানের সাথেই রিলেশনে জড়িয়েছিল? অথচ মিলি আমাকে অশুদ্ধ বলতো আর নিজেকে বিশুদ্ধ দাবি করতো। তাহলে কি পৃথিবীর নোংরা মানুষগুলোই নিজেকে বিশুদ্ধ দাবি করে? আসল বিশুদ্ধ মানুষগুলো নিজের বিশুদ্ধতা লুকায়িত রাখে?

চলবে………