যতনে রাখিবো পর্ব-৩১+৩২

0
211

#যতনে_রাখিবো

৩১
লোপা চলে গেলে অভয় হাত সরিয়ে নিলো। তাথৈ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে কতক্ষণ অভয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করে বলে বসলো।

-আপনার এক্স!

অভয় বুঝতে পারল না। তাকে কিছু বলেছে? তাই জিজ্ঞেস করল,

-আমাকে বললে?

-না, আপনি ছাড়াও তো আমার সামনে আপনার কাঁধের দু’জন জ্বীন আছে। তাদেরকে বলেছি।

-তোমার কথা বুঝিনি।

তাথৈ মুখ বাঁকিয়ে মনে মনে বলল, বুঝবেন কীভাবে? আপনি তো ফিডার খাওয়া শিশু। প্রকাশে বলল,

-ওই মেয়েটা আপনার এক্স?

তার বউয়ের চিন্তাভাবনা দেখে অভয় বিষম না খেয়ে পারল না।

-কে লোপা! তোমার এরকমটা মনে হলোই বা কীভাবে?

-মনে না হওয়ার কী আছে? মানুষ এক্সকে জ্বালাতেও এতটা করে না। আপনি ওই মেয়েকে জ্বালাতে যা করেছেন।

অভয় ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে তাথৈয়ের দিকে এগিয়ে এসে বলল,

-কী করেছি আমি?

-কী করেছেন জানেন না!

-উঁহু। তুমি জানিয়ে দাও। কারণ লোপাকে জেলাস ফিল করাতে আমি কোনকিছুই করিনি।

তাথৈ ঠোঁট গোল করে তীক্ষ্ণ চোখে অভয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে,

-তাহলে কি বেটা ইচ্ছে করে আমার কোমরে হাত রেখেছে! কী বদের বদ! উনার তো চরিত্রের ঠিক নেই। পার্টি চলাকালীন আর এই লোকের আশেপাশে থাকা যাবে না। মানুষের সামনে কিছু বলতে পারবো না জেনেই এই কাজ করেছে।

—-

এই তাথৈটা তাকে ফেলে কোথায় চলে গেল। এক ঘন্টার মতো জো’র অত্যাচারের শিকার হয়ে এই মাত্র ছাড়া পেলো। জো তার চুল, মুখে কী কারসাজি করছে তখন এটা ভেবে ভয় পেলেও সাজ শেষ হলে আয়নায় নিজেকে দেখে সে নিজেই চিনতে পারলো না। এই মহিলার কাজকর্ম বিরক্তিকর হলেও ইনার হাতে জাদু আছে বলতে হবে। শাড়ির কুঁচি ধরে হাফসা তাথৈকে খুঁজতে বের হয়েছে। সে দেখেই হাঁটছিল কিন্তু কানা লোকটা সামনে থেকে এসে ধাক্কা খেলো। লোকটা ইচ্ছাকৃত ভাবে ধাক্কা খেয়েছে মনে করে হাফসাও হাই হিল দিয়ে লোকটার পা মাড়িয়ে দিল। নোমান ব্যথায় শুধু উফ উফ করছে। হাফসা ওর দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসছে। মুখে বলল,

-আজব লোক তো! চোখে দেখেন না? ধাক্কা দিচ্ছেন কেন?

মেয়েটার কিছুই হয়নি। সে নিজে ব্যথা পেয়েও নোমান বলল,

-দুঃখিত। আমি আসলে দেখিনি।

-দেখেন নি! কেন দেখেননি? আমি কি পিঁপড়ার মতো ছোট কোন প্রাণী? আপনার চোখে কি সমস্যা আছে? পাঁচ ফিট চার ইঞ্চ লম্বা একটা মানুষকে কেন দেখবেন না?

পার্টিতে আমন্ত্রিত গেস্টদের লিস্ট তার মুখস্ত করা। কিন্তু ইনি কে এটাই চিনতে পারছেন না। নতুন কোন মডেল? নাকি কোন ডিরেক্টর বা হিরোর বউ বা গার্লফ্রেন্ড।

-দেখুন ম্যাম, আমি তো সরি বলেছি।

ছেলেটা তাকে ভয় পাচ্ছে দেখে হাফসার আরও মজা লাগছে। তাই সে কিছুটা কঠিন গলায় বলল,

-সরি বললেই সব দোষ মাফ হয়ে যায়? আমি আপনার মাথা ফাটিয়ে দিয়ে সরি বললে আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন? দিবেন না তো? তাহলে আমি কেন আপনাকে ক্ষমা করবো।

নোমান আমতা আমতা করে বলল,

-কিন্তু আমি তো আপনার মাথা ফাটাইনি।

হাফসা চোখ রাঙিয়ে আরও কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে তাথৈয়ের কন্ঠ শোনা গেল।

-কী হচ্ছে এখানে?

তাথৈকে দেখে নোমান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। একই সাথে হাফসা হতাশ হয়ে দম ফেলল। তাথৈটা আসার আর সময় পেলো না। সব মজা মাটি করে দিবে এখন। হলোও তাই। তাথৈ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হাফসার দিকে তাকিয়ে বলল,

-কী করছিস তুই এখানে?

হাফসা মিষ্টি হেসে বলল,

-উনার কাছে তোর কথাই জিজ্ঞেস করছিলাম।আমাকে একা ফেলে রেখে কোথায় চলে গিয়েছিলি? তোকে না পেয়ে আমি তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম।

নোমান চোখ বড় বড় করে মনে মনে বলল,

-এই মেয়ে ভয় পাওয়ার মানুষ!

বান্ধবীকে হাড়ে হাড়ে চেনা তার। ভয় না কচু। বিদেশ নিয়ে একা ছেড়ে দিলেও ভয় পাবে না এটা তো ছোটখাটো একটা পার্টি।

-কাছেই ছিলাম।

নোমানের দিকে চোখ পড়লে তাথৈ অবাক গলায় বলল,

-আপনি ঘামছেন নাকি? এসির মাঝেও আপনার গরম লাগছে?

নোমান মুখ খুলবে তার আগেই হাফসা চোখ দিয়ে শাসিয়ে নিল। তাই নোমান কাজের বাহানা দিয়ে বলল,

-জরুরি একটা কাজের কথা মনে পড়ে গেছে ভাবী। আমি আসছি।

বলেই বেচারা জীবন বাঁচিয়ে পালালো। কী সাঙ্ঘাতিক মেয়ে মানুষ বাবা! নোমান চলে যাওয়ার পর তাথৈ হাফসার হাত মুচড়ে ধরে বলল,

-মিথ্যাবাদী, আমি জানি না মনে করেছিস! ছেলেটার ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিস। কী এমন বলেছিস রে?

-আহ লাগছে। হাত ছাড় শালি। নইলে কিন্তু আমি চিৎকার করবো।

তাথৈ হাত ছেড়ে দিলো। হাফসা হাত ডলতে ডলতে বলছে,

-আরে ওইটা একটা আবাল লোক। ইচ্ছে করে এসে ধাক্কা খেলো।

-মোটেও না। নোমান ভীষণ ভদ্র একটা ছেলে। শুধু শুধু নির্দোষ ছেলেটার উপর মিথ্যা অভিযোগ লাগাচ্ছিস।

বান্ধবী তার সাথে এরকম বেইমানি করতে পারলো? তাকে বিশ্বাস না করে ওই ছেলের হয়ে কথা বলছে! কেঁদে ফেলার নাটক করে হাফসা বলল,

-এতদিনের বন্ধুত্বে এতটুকু বিশ্বাসও নেই! এই কষ্ট আমি কোথায় রাখবো? পার্টিতে ডেকে অপমান করবি জানা থাকলে এখানে আসতামই না।

-নাটক করিস না তো। তোর নাটকও আমার খুব ভালো করে জানা আছে।

—–

তাথৈ অভয়ের থেকে দূরে থাকার কথা ভাবলেও সেটা আর হলো কই। গেস্টদের সামনে লুতুপুতু কাপল হয়ে থাকতে হচ্ছে।
তাথৈ আরও একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে লোপা মেয়েটা অভয়কে এখনও পছন্দ করে। তার সাথে অভয়কে দেখে উনি মোটেও খুশি হলো। পার্টির পুরোটা সময় মুখে হাসি রেখে কথা বলতে বলতে তাথৈয়ের চাপা ব্যথা হয়ে গেছে। মুভির এই জগতটা বাইরে থেকে যতটা চাকচিক্যময় দেখা যায় বাস্তব অর্থে মোটেও তেমন না। এখানে কেউ কারো বন্ধু হয় না। কিন্তু মুখে মুখে এমন দেখায় একজন আরেকজনের জন্য জানও দিয়ে দিবে।
পার্টি শেষে সবাই চলে গেলে তাথৈ ঘরে এসে আয়নার সামনে বসে কানের দুল খুলছে। অভয় গেট পর্যন্ত কাকে যেন ছাড়তে গিয়েছিল। সে ঘরে বলে তাথৈ বলে উঠল,

-আপনার পার্টিতে আমি আর যাব না। কক্ষনো না।

তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে অভয় জানতে চাইল,

-কেন?

-সারাক্ষণ মুখে নকল হাসি ধরে রাখতে রাখতে আমার মুখই ব্যথা হয়ে গেছে। আপনাদের কোন কথাতে হাসতে হবে এটাই বুঝতে পারি না। সামান্য একটা কথা যা শুনে হাসি আসবে তো দূর বরং হাই উঠবে ওই কথাতেও হেসে গড়িয়ে পড়েন। দুনিয়ায় কত প্রকার আজব লোকজন আছে তা এসব পার্টিতে দেখা যায়।

অভয় তাথৈয়ের পেছনে এসে দাঁড়াল। মৃদু হেসে তাথৈয়ের কাঁধের উপর দিয়ে ঝুঁকে হাত থেকে খুলে রাখা ঘড়িটা ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল,

-এসবে তোমার অভ্যস্ত হয়ে যাবার কথা। কারণ না চাইলেও তোমাকে এমন আরও অনেক পার্টি আমার সাথে অ্যাটেন্ড করতে হবে।

তাথৈ ওয়াশরুম থেকে মেকআপ তুলে বের হয়ে দেখল অভয় ফোনে কথা বলছে। পার্টিতে পুরো সময় দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যথা হয়ে গেছে। তার ক্লান্ত শরীর বিছানা খুঁজছে। বালিশে মাথা লাগলে এখনই ঘুমিয়ে পড়বে। বিছানা ঠিক করে শুয়ে পড়লেও অভয়ের কথা বলা শেষ হলো না। তাথৈ মনে মনে ভাবছে,

-এই লোকের কত এনার্জি বাবা! একটুও ক্লান্তি নেই। মানুষ নাকি রোবট?

কথা বলা শেষে হয়ে গেলে তাথৈ বলল,

-আজকের এজন্য এটুকুই যথেষ্ট। কাজের অকাজের সকল ফোন কাল সকালে করবেন। এখন প্লিজ লাইটটা অফ করে দিন। ঘুরে আমার চোখ বুজে আসছে।

-রাতে খেয়েছো?

-দুপুরে খাওয়াই গলা পর্যন্ত ফুল হয়ে আছি।

-উঁহু। না খেয়ে শোয়া চলবে না। উঠে খেয়ে তারপর শোবে।

অভয়ের কথা কানেই না নিয়ে তাথৈ মুখ পর্যন্ত চাদর টেনে দিলো। অভয় জানে এই মেয়েকে ডেকেও এখন লাভ নেই। তাই আর জোড়াজুড়ি না করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। তাথৈ শক্ত করে চাদর টেনে ধরে ছিল। মনে করেছিল অভয় চাদর টেনে নিবে৷ তাকে ওঠার জন্য জোড়াজুড়ি করবে৷ কিন্তু অনেকক্ষণ পরেও অভয়ের কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে তাথৈ মুখ থেকে চাদর সরিয়ে দেখল এই লোক তো ঘরেই নেই! অকারণেই তার মন খারাপ হয়ে গেল।

-একবার বলার পর আর সাধলোও না! দ্বিতীয় বার অন্তত বলতে পারতো৷ সব রোমান্টিকতা শুধু মুভিতে হিরোইনদের সাথে করতে পারে। নিজের বউয়ের বেলায় নিরামিষ বেডা।

রাগ করে তাথৈ আবার মাথা ঘুরে শুয়ে পড়ল। সে এতটা আশাই করছে কেন? ওই লোক কি তাকে ভালোবাসে? ভালোবাসলে না কেয়ার করতো। তাথৈ তখনও ফোঁস ফোঁস করছে।

-যতনে রাখবো, আগলে রাখবো! হাহ্, এক্সকে জ্বালানোর জন্যই এসব কথা। বাস্তবে তো তেমন কিছুই করতে দেখলাম না। নাটকবাজ লোক। জীবনে আর কথাই বলবো না।
চলবে
Jerin Akter Nipa

#যতনে_রাখিবো

৩২
মাত্রই ঘুম এসে চোখে বাসা বাঁধতে চেয়েছিল এমন সময় অভয় ডেকে উঠলে তাথৈয়ের রাগ আরও বেড়ে গেল। লোকটা জ্বালিয়ে মারছে। অভয় জানে তাথৈ জেগে আছে। শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ার অভ্যাস তাথৈয়ের নেই।

-তাথৈ আমি জানি তুমি এখনও ঘুমাও নি। তাই বলছি উঠো।

তাথৈ কোন জবাব দিলো না। অভয় কোমরে হাত রেখে ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল।

-তাথৈ প্লিজ উঠো।

তাথৈ মুখ মোচড় দিলো। এখন প্লিজ বলে ঢঙ করছে। তাথৈ কতটা জেদি এটা অভয় জানে বলেই আর ডাকলো না। অভয় চুপ করে আছে দেখে ওদিকে তাথৈ ভাবছে, চলে গেল নাকি? হঠাৎ তাথৈ অনুভব করলো সে বিছানা থেকে উপরে উঠে যাচ্ছে। চাদর সহই অভয় তাথৈকে কোলে তুলে নিয়েছে। মুখের উপর চাদর থাকায় তাথৈ কোনকিছুই দেখছে না। দু-হাত হাতড়ে চাদর সরিয়ে মাটি থেকে নিজেকে তিন/চার হাতে উপরে দেখে ভয় পেয়ে অভয়ের গলা জড়িয়ে ধরে চিল্লিয়ে বলে উঠল,

-আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? রাত-বিরেতে কেন জ্বালাচ্ছেন? এখন কি শান্তিতে একটু ঘুমাতেও দিবেন না?

-তোমাকে উঠতে বলেছিলাম। তুমি আমার কথা শোননি। তাই আমারও কিছু করার ছিল না।

তাথৈকে নিয়ে অভয় দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসার সময় বলল,

-পা সাবধানে। দরজায় বাড়ি খাবে।

-কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে সেটা তো বলবেন!

-বলছি।

তাথৈ কটমট চোখে অভয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। এই লোক আগে এত শয়তান ছিল না। ইদানিং কী হয়েছে কে জানে। অভয় তাথৈকে ডাইনিংয়ে নিয়ে এসে পা দিয়ে একটা চেয়ার টেনে ওকে বসিয়ে দিল।

-চুপচাপ বসে থাকো। এখান থেকে এক পা-ও নড়বে না।

-কিন্তু আপনি আবার কোথায় চলে যাচ্ছেন?

-যাচ্ছি না। আসছি।

অভয় কিচেনে চলে গেলে তাথৈ ভাবছে, এ কী জবরদস্তি! একটু পরই খাবার হাতে অভয় ফিরে এলো। তাথৈয়ের সামনে খাবারের প্লেট রেখে বলল,

-খেয়ে নাও।

-ক্ষিধে নেই।

-ক্ষিধে না থাকলেও খেতে হবে।

-আমার পেটে ক্ষিধে না থাকলেও কি আপনি আমাকে জোর করে খাওয়াবেন! এটা কেমন জুলুম। আর তাছাড়া আমার এখন ঘুম পাচ্ছে। নিজের হাতে খেতে পারবো না।

এই কথা শুনে অভয় হাত ধুয়ে এসে তাথৈয়ের সামনে বসলো। ভাত মাখিয়ে তাথৈয়ের মুখের সামনে ধরে বলল,

-এবার খাও।

তাথৈ বেচারি সত্যিই ভাবেনি অভয় তাকে খাইয়ে দিবে। এই লোক প্রকাশ করে না কিন্তু মনে মনে তার কেয়ার ঠিকই করে। অভয়ের হাতে খেতে খেতে তাথৈয়ের চোখ ভিজে আসছে। ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছে। সৎমা ঘরে আসার পর বাবার ভালোবাসা থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। পৃথিবী আপুই শুধু তার আপন ছিল। আপুর বিয়ে পর দুলাভাই তাকে ছোট বোনের মতো স্নেহ করেছে। পৃথিবীতে এই দু’জন মানুষ ছাড়া কারো ভালোবাসা পায়নি। মনের মধ্যে গুপ্ত একটা বাসনা ছিল বিয়ের পর স্বামীর ভালোবাসা পাবে। মানুষটা তার সকল অপূর্ণতা মিটিয়ে দিবে। কিন্তু তার বিয়েটা এমন একজন মানুষের সাথে হয়েছে যে তাকে ভালোবাসে না।

——–
যারা সরকারের অধীনে কাজ করে তাদেরও হয়তো বছরে দু-তিন দিন ছুটি থাকে, কিন্তু নায়কদের মনে হয় সেটাও থাকে না। এক মুভি সুপার ডুপার হিট হয়েছে। দর্শকদের মধ্যে এটার রেশ কাটার আগেই আরেক মুভির শুটিং শুরু করে দিয়েছে। অভয় সারাদিন ব্যস্ত থাকে। কিন্তু তাথৈয়ের তো বাসায় তেমন কোন কাজই থাকে না। সে ভীষণ বোর হয়।

-এই লোককে বিয়ে করে জীবনে ভীষণ বড় একটা ভুল করে ফেলেছি। বউয়ের থেকে বেশি সময় নায়িকাদের সাথেই কাটায়।

কথায় আছে না, নেই কাজ তো খই ভাজ। তাথৈও সেরকমটাই করছে। ঘরের কোথাও এতটুকু ধুলোবালি নেই। তবুও ছোট্ট একটা কাপড় নিয়ে জিনিসপত্র মোছামুছি করছে। হঠাৎ দেয়ালে বাঁধানো অভয়ের বিশাল সাইজের একটা ছবির দিকে নজর গেলে তীক্ষ্ণ চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল।
যে জায়গায় যায় ওই জায়গায়ই এই লোকটাকে দেখতে হয়। টিভি খুললে লোকটার মুভি। চ্যানেল ঘুরালে উনার ইন্টারভিউ। রাগে দুঃখে যে বাংলা কয়টা নাটক দেখবে এর মাঝেও উনার অ্যাড আসতে হবে? কেন? বাড়ি থেকে বের হলে দেয়ালে দেয়ালে, খাম্বায় খাম্বায় উনার ছবির পোস্টার। শহর জুড়ে লোকটার এত বড় বড় ব্যানার। বাড়ি বসেও শান্তি নেই। এখানেও প্রতিটা ঘরে নিজের ছবি ঝুলিয়ে রেখেছে। এখন এই রুমটা তাথৈয়েরও। এটা মনে হওয়ার জন্য তাকে কিছু করতে হবে। তাথৈয়ের মাথায় একটা বুদ্ধি এলো। সে সাথে সাথে ফোন হাতে নিয়ে নায়ক সাহেবের ম্যানেজারের কাছে কল করল। অভয় মাঝে মাঝে কল তুলতে লেট করলেও নোমান এক সেকেন্ডে লেট করে না।

-আসসালামু আলাইকুম ভাবী। স্যার তো শটে আছেন।

-ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আপনার স্যারের জন্য তো আমি কল দিইনি। আমার আপনার সাথে জরুরি কাজ আছে।

-আমার সাথে! জরুরি কাজ?

-জি৷ এখন মন নিয়ে আমার কথা শুনুন। আর আপনার স্যারকে কিছু জানাবেন না। বুঝেছেন?

-স্যারকে জানাব না!

-না। কিছুটা সময় ধরে সিক্রেট রাখবেন। কারণ আমি আপনার স্যারকে সারপ্রাইজ দিতে চাই।

-ঠিক আছে ভাবী। আমাকে কী করতে হবে বলুন।

নোমানকে এখন যা যা করতে হবে তা বলে দিয়ে কল কেটে তাথৈ ভিলেন মার্কা হাসি দিলো।

-সারপ্রাইজের জন্য তৈরি হোন মিস্টার নায়ক।

—-
তিনটা দিন ভীষণ ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে কেটেছে। লেট নাইট শুট করে ফিরে অভয় রুমে যাবার আগেই ক্লান্ত হয়ে হলরুমে সোফায় বসে পড়লো। তাথৈ পাশে এসে দাঁড়িয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলল,

-আমি জব করবো।

অভয় পানি নেওয়ার আগে তাথৈয়ের দিকে তাকাল। তাথৈয়ের মেজাজ আগে থেকেই চড়ে ছিল। সে ঝাঁঝিয়ে উঠে বলল,

-এভাবে তাকাচ্ছেন কেন?

অভয় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,

-কীভাবে তাকালাম!

-আমি জব করবো এটাই ফাইনাল।

তাথৈয়ের হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে সহজ গলায় অভয় বলল,

-ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছ। তুমি জব করতে চাইলে আমার দিক থেকে কোন প্রকার বাধা বা আপত্তি আসবে না।

তাথৈ ভেবেছিল এই বিষয়টা নিয়ে একটু ঝগড়া করবে। সে জব করবে এটা মূল কথা ছিল না। অভয় যদি বলত, জব করে কী করবে তাহলেই ঝগড়াটা বাঁধত। বলতে পারত আপনি সারাদিন বাড়ির বাইরে কাজের মধ্যে থাকেন। আমি কেন একা একা বাড়িতে পঁচে মরবো। কিন্তু এই লোক তাকে ঝগড়া করার কোন সুযোগই দিলো না।

-কী ধরবেন জব করতে চাও ভেবেছো কিছু?

তাথৈ রাগ দেখিয়ে বলল,

-চুপ থাকুন তো আপনি। কথা বলবেন না।

অভয় বুঝতে পারছে তাথৈ তার উপর কেন রেগে আছে। রেগে থাকাটাই স্বাভাবিক। তাথৈকে যতটুকু সময় দেওয়া দরকার তা সে দিতে পারছে না। তবে অভয় ভেবে নিয়েছে এখন থেকে বছরে একটা মুভি করবে। এতদিন তার জীবনে তাথৈ ছিল না। তাই কাজটাকেই একমাত্র সঙ্গী বানিয়ে নিয়েছিল। এখন অনেক কিছুই পাল্টেছে।

—–
আজ অনেকদিন পর তাথৈয়ের কাছে আবার সেই রং নাম্বার থেকে কল এসেছে। তাথৈ বিরক্ত হতে গিয়েও হলো না। বরং আজ এটা ভেবে আশ্চর্য হচ্ছে এই পাগলের সাথে সে যা-তা ব্যবহার করে। তুইতোকারি থেকে শুরু করে গালিগালাজও করেছে। তবুও এই ছেলে হাল ছাড়ছে না। যখন শুনলো ছেলেটা এতদিন হাসপাতালে ছিল। বড়সড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। একটু সুস্থ হওয়ার পরই তাকে কল করেছে। এই কথা শুনে তাথৈ আজ আর খারাপ ব্যবহার করলো না। ভালো করে বুঝিয়ে বলল,

-দেখুন আপনার বয়স কত আমি জানি না। হয়তো আমার বড় হবেন। আবার ছোটও হতে পারেন। আমার পেছনে শুধু শুধু সময় নষ্ট করছেন। আমার বিয়ে হয়ে গেছে।

তার এসব কথা ছেলেটা যেন জানেই নিলো না। উত্তরে এটা বলল,

-কতদিন পর তোমার কন্ঠ শুনছি। তোমার কন্ঠ আমার ভাঙাচোরা শরীরে হাই পাওয়ারের এন্টিবায়োটিকের মতো কাজ করছে।

তাথৈ নিরাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই ছেলের পাগলামি চলতেই থাকবে। একে শত বোঝালেও কাজ হবে না। তবে সে কখনোই এই ছেলের পাগলামি প্রশ্রয় দিবে না।

-আপনি অসুস্থ বলে আজকে কঠিন কোন কথা বলছি না। কিন্তু আজকের পর আর কখনও আমাকে কল দিবেন না।

-কেন? আমার সাথে কথা বলো এটা তোমার স্বামী জানতে পারলে ঝামেলা করবে?

-উনি এসব ফালতু বিষয় নিয়ে ঝামেলা করার লোক না।

-তাহলে আর সমস্যা কোথায়? তোমার স্বামী এত ভালো মানুষ হলে তুমি আমার সাথে কথা বলতেই পারো।

তাথৈ ঠোঁট কামড়ে রাগ নিয়ন্ত্রণ করলো। কত বড় বেয়াদব হলে এমন কথা বলতে পারে!

-আমার স্বামী ভীষণ সৎ মানুষ বলেই উনার অজান্তে আপনার সাথে কথা বলে নিজের কাছেই অপরাধী হয়ে থাকতে চাই না। এতদিন কিছু বলিনি। কিন্তু এর পরেও আমাকে বিরক্ত করলে পুলিশের আশ্রয় নিতে বাধ্য হবো।

—-
শুটিংয়ের কাজে অভয়কে কক্সবাজার যেতে হবে। যদিও সেখানে গিয়ে বেশিদিন থাকবে না। পাঁচ ছয় দিনেরই কাজ। কিন্তু অভয়ের সাথে ওই লোপা মেয়েটা যাবে শুনেই তাথৈয়ের মনে অশান্তির শেষ রইল না। সেদিন পার্টিতে এতটুকু বুঝেছে লোপা অভয়কে এখনও পেতে চায়। অভয়ও লোপাকে জেলাস ফিল করাতেই সারাটা সময় তার কাছাকাছি ছিল। অল্পতেই বেশি ভেবে ফেলা তাথৈয়ের অবুঝ মন এটা ভাবছে, আচ্ছা ওদের মধ্যে কি সত্যিই কোন সম্পর্ক ছিল? সম্পর্কটা কি তার জন্যই ভেঙেছে। তাকে জড়িয়ে অভয়কে নিয়ে মিডিয়ায় এত জাল ঘোলা না হলে অভয় তাকে কোনদিন বিয়ে করত না। হয়তো লোপাও ভুল বুঝেছিল। ইমেজ বাঁচাতে সাথে লোপাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই তাকে বিয়ে করেছে। তাথৈই পাগল। বিয়েটাকে সত্যি ভেবে নিয়ে লোকটাকে ভালোবেসে বসে আছে। অভয় হয়তো এখনও লোপাকে ভুলতে পারেনি।

অভয়ের কক্সবাজার যাবার দিন তাথৈ ভোঁতা মুখে অভয়ের সামনে এসে দাঁড়াল। সব রেডি। নোমান গাড়ি নিয়ে এলেই অভয় বেরোবে। এর মাঝে তাথৈ তার মাথামুণ্ডু হীন ভুলভাল ধারণা গুলো থেকে অভয়কে যা বলল তা শোনার পর অভয়ের কী বলা উচিত সে জানে না।

-গার্লফ্রেন্ডের সাথে যাচ্ছেন?

ছোট্ট একটা হার্টবিট মিস হয়ে গেছে। বিস্ময় নিয়ে তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে অভয় বলল,

-কার গার্লফ্রেন্ড!

-আপনার।

-স্ত্রী হয়ে স্বামীর নামে এমন অপবাদ দিতে পারছো! তোমার থেকে তো ওই সাংবাদিক গুলো ভালো। তাদের নিউজে ওয়ান পার্সেন্ট সত্যতা তো থাকে।

তাথৈ মুখ মোচড়াল। অভয় হতাশ নয়নে তাথৈকে দেখছে। এই মেয়ের চিন্তাভাবনার কোন হাতপা নেই। যা মন চায় ভেবে বসে থাকে।

-অপবাদ কী? গার্লফ্রেন্ড না হলেও এক্স তো।

-তুমি কিন্তু আমার এক্সের সংখ্যা বাড়িয়ে দিচ্ছ।

নোমান চলে এসেছে। অভয়কে এখন বেরোতে হবে। যাবার আগে সে অপ্রত্যাশিত একটা কাজ করে ফেলল। তাথৈকে বাই বলে হুট করেই ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে ফেলল। হতভম্ব তাথৈ তখনও বুঝে উঠতে পারেনি এটা কী হলো তার সাথে। অভয় বেরিয়ে যাবার আগে বলল,

-এ কয়দিনে মনের মধ্যে যত খুশি ভুল ধারণা পোষণ করতে পারো। এবার ফিরে এসে তোমার সব ভুল ধারণা ভেঙে দেব প্রমিজ।

চলবে