যতনে রাখিবো পর্ব-২৯+৩০

0
57

#যতনে_রাখিবো

২৯
তাথৈ তৈরি হয়ে অভয়ের সামনে এসে দাঁড়ালে স্বামী বেচারা দিন দুনিয়া ভুলে বসে পলকহীন চোখে বউকেই দেখতে থাকলো। তাথৈও বিষয়টা লক্ষ্য করে মনে মনে হাসলো। তবে মুখে কিছু বললো না। এক বিয়ের দিন ছাড়া তাথৈকে কখনও শাড়িতে দেখেনি। বিয়ের দিন দেখলেও সেই দেখায় ভালোবাসা ছিল না। সময় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু দু’টি মানুষ যেন একে অপরের চোখের মধ্যে হারিয়ে গেছে। শেষে তাথৈই বলে উঠল,

-আমরা কি যাব? নাকি প্ল্যান বাতিল করেছেন?

তাথৈয়ের কথায় অভয়ের হুঁশ ফিরল। কী করছিল সে! নিজের কাজে লজ্জা পেয়ে অভয় বেরোনোর দ্রুততা দেখিয়ে বলল,

-এখুনি বেরুনো দরকার। চলো।

তাথৈ মুখ বাঁকিয়ে মনে মনে বলল,

-আমি চলতেই আছি। আপনিই থেমে গিয়েছিলেন।

গাড়িতে উঠতে গেলে অভয় নিজে তাথৈয়ের জন্য গাড়ির দরজা খুলে দিল। তাথৈ মনে মনে ভাবছে, আজকে এত স্পেশাল ফিল করানোর কারণ কী? নায়ক ব্যাটার নিশ্চয় কোন উদ্দেশ্য আছে। অভয় নিজে ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলে তাথৈ জিজ্ঞেস করল,

-আজ আপনি গাড়ি চালাবেন?

-হুম।

-কেন আপনার নোমান সাহেব কোথায়? উনাকে কি ছুটি দিয়ে দিয়েছেন?

গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে অভয় বলল,

-নোমান তার নিজের কাজই করছে।

তাথৈ এমনিতে নিজেকে অনেক বুদ্ধিমতী মনে করলেও আজ তার বুদ্ধি কাজে দিচ্ছে না কেন? কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না, লোকটার মনে কী চলছে। তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। ভূতের মতো ঘাপটি মেরে বসে থাকতে না পেরে তাথৈ বলল,

-গান চালাবো?

-তোমার শুনতে ইচ্ছে করলে চালাও।

-ইচ্ছে করছে মানে! আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকলে আমি ভুলেই যেতাম আমি কোন জীবিত মানুষ। নিজেকে মিশরের মমি মনে হতে শুরু করেছিল।

তাথৈ গান চালিয়ে দিয়ে আরাম করে বসে মনের সুখে গান শুনছে। চোখ বন্ধ করে সাথে নিজেও ঠোঁট মিলিয়ে গাইছে। অভয় সাধারণত গাড়ি চালানোর সময় মনোযোগ অন্য দিকে দিতে চায় না। খুব সাবধানতা অবলম্বন করে সে। কিন্তু আজ কিছুতেই মনযোগ সামনের রাস্তায় থাকছে না। ঘুরেফিরে সব মনোযোগ পাশের সিটে বসা মানুষটার উপর চলে আসছে।

গান শুনতে শুনতে দীর্ঘ যাত্রাপথও অল্পই মনে হয়েছে তাথৈয়ের কাছে। গাড়ি এখন আর চলছে না বুঝতে পেরে তাথৈ গান বন্ধ করে দিল। অভয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-এসে পড়েছি?

-হুম।

জায়গাটা কোথায় জিজ্ঞেস করার আগেই অভয় গাড়ি থেকে নেমে গেল। গাড়ির সামনে দিয়ে ঘুরে এসে তাথৈয়ের দিকের দরজার সামনে দাঁড়াল। এবারও নিজেই দরজা খুলে দিয়ে তাথৈকে বেরুতে বলল। তাথৈয়ের আজ নিজের কাছেই নিজেকে প্রিন্সেস মনে হচ্ছে। কেউ তার এভাবে কেয়ার করবে জানা ছিল না। অভয় ঝুঁকে তাথৈয়ের দিকে নিজের একটা হাত বাড়িয়ে দিল। তাথৈ মনে মনে খুশি হয়ে অভয়ের হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে এলো।

এটা কোন জঙ্গল নাকি? আশপাশ থেকে শিয়ালের ডাক শুনে এমনই তো মনে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তাকে জঙ্গলে নিয়ে এসেছে! দেশে কি সুন্দর সুন্দর জায়গায় অভাব ছিল?

-এটা কোথায় এসেছি? সব তো জঙ্গলই জঙ্গল!

তাথৈ ভয় পাচ্ছে বুঝতে পেরে অভয় ওর ভয় দূর করতে বলল,

-ভয় পেলে আমার হাত ধরে হাঁটতে পারো।

-হাঁটার তো প্রশ্নই আসে না। জঙ্গলের ভেতর কেন যাব? সাপ বিচ্ছু কামড় দিলে!

-তাথৈ, আমার উপর একটু তো বিশ্বাস রাখতে পারো।

এই কথা শুনে তাথৈয়ের আর আপত্তি করার সুযোগ থাকল না। বিশ্বাস সে করে। কিন্তু তাই বলে জঙ্গলে সাপের কামড় খেতে আসবে? খুব বেশি হাঁটতে হলো না। একটু সামনে এগিয়েই তাথৈকে দাঁড়িয়ে পড়তে হলো। এই মাঝ জঙ্গলের ভেতর এরকম সুন্দর একটা বাড়ি কে বানিয়েছে! তাথৈ বিস্মিত চোখে অভয়ের দিকে ফিরে বলল,

-এই বাড়িটা কি আপনার!

অভয় জবাব দিবার আগেই বাড়ির ভেতর থেকে নোমানকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। তাথৈয়ের বিস্ময় যেন কমছেই না। নোমানই তাহলে এসব ব্যবস্থা করেছে। ওদের কাছাকাছি এসে তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে নোমান হাসল। বলল,

-ভাবী সারপ্রাইজ কেমন লেগেছে?

-ধাক্কার মতো লেগেছে।

নোমান হেসে বলল,

-এই বাগান বাড়িটা স্যার আপনার..

নোমানকে কথা শেষ করতে না দিয়ে অভয় বলে উঠল,

-তোমার কাজ শেষ?

-জি স্যার। এখন কি আমি ফিরে যাবো?

-যাও।

নোমান কেন চলে যাচ্ছে? ওরা কি জঙ্গলে হিংস্র পশুপাখির শিকার হওয়ার জন্য একা থাকবে নাকি? যাওয়ার আগে নোমান তাথৈয়ের উদ্দেশ্যে বলে গেল।

-গুড লাক ভাবী।

দূরে কোথায় আবার অনেকগুলো শিয়াল একসাথে ডেকে উঠলে তাথৈ বলল,

-আমাদের মনে হয় এবার ভেতরে যাওয়া উচিত। এতক্ষণে হয়তো বাঘের নাকেও মানুষের ঘ্রাণ পৌঁছে গেছে। দেখছেন না শিয়াল গুলো কেমন করে ডাকছে!

তাথৈকে ভয় পেতে দেখে অভয় সামান্য একটু হেসে বলল,

-আমরা সুন্দরবন আসিনি। এখানে বাঘ পাওয়া যায় না।

-সুন্দরবন এসেছি নাকি চাঁদে এসেছি কীভাবে জানবো? আপনি তো বলে নিয়ে আসেননি।

-জায়গাটা ঢাকা থেকে একটু দূরে। রাত বলে তুমি হয়তো বুঝতে পারছো না। এটা তেমন বিশাল কোন জঙ্গল না। বাংলোটার আশেপাশেই শুধু গাছগাছালি আছে। পাশেই কিন্তু মেইন রোড। যা দিয়ে আমরা একটু আগে এলাম।

অভয়ের বোঝানোর পর তাথৈয়ের ভয় অনেকটাই কমে গেছে। এতক্ষণ বেচারি ভয়ে কলিজা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। এখন পরিবেশটা ভালো করে উপভোগ করতে পারবে।

-এটা কি আপনার নিজের বাড়ি?

প্রশ্নটা করেও তাথৈ নিজেই উত্তর দিল।

-আপনারই হবে। অন্য কারো বাংলো আপনি নিশ্চয় ভাড়া নিবেন না। তা চারপাশ এরকম অন্ধকার কেন? ইলেক্ট্রিসিটির ব্যবস্থা নেই?

তাথৈ কথা শেষ করার সাথে সাথেই চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠল। এতক্ষণ অন্ধকারই ছিল বলা যায়। হঠাৎ তীব্র আলোয় আশপাশটা দেখতে কষ্ট হচ্ছে। আলো চোখে সয়ে এলে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে তাথৈকে মুগ্ধ হতে হলো। বলাই যায় এই বাড়ির মালিকের রুচি এবং টাকা দুটোই আছে। লন সাজানো দেখে তাথৈ মনে মনে বলল,

-হায়! নায়ক ব্যাটা আমার জন্য এসব প্ল্যান করেছে?

লনেই লাইটিং করে সবকিছু অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে। তাথৈ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব দেখছে। বাস্তব জীবনে এসব বিষয়ে তার কোন অভিজ্ঞতা না থাকলেও মুভি ড্রামা প্রচুর দেখে রেখেছে। টেবিলের উপর ছোট বড় অনেক সাইজের মোমবাতি সহ খাবারও রাখা আছে।
তাথৈয়ের ফিল্মী মন বলে উঠল,

-ক্যান্ডেল লাইট ডিনার! ও মাই আল্লাহ। এটা কি আমাদের প্রথম ডিনার ডেইট!

শুধু খাবার-দাবার না। মনে হচ্ছে মুভিও দেখতে পারবে। এটা মনে হওয়ার কারণ প্রজেক্টর সেট করা দেখে বুঝেছে। ঘাসের উপর চাদর পেতে বসার জন্য জায়গা করে দেওয়া হয়েছে। বড় দুইটা কোলবালিশ সহ ছোট ছোট কয়টা বালিশও ফেলে রেখেছে।

-ডিনার ডেট, মুভি ডেট! সব দেখি একসাথে করে ফেলতে চাচ্ছে।

তাথৈ প্রতিটা জিনিস যেমন লক্ষ্য করে দেখছে তেমনি ভাবে অভয়ও তাকেই দেখে যাচ্ছে। সব আয়োজন তাথৈয়ের জন্যই। এখন তাথৈ খুশি হলেই তার চেষ্টা সফল হবে। সব দেখা শেষে অভয়ের দিকে ফিরে তাথৈ বলল,

-ভালোই। নোমান সাহেব সবকিছু খুব সুন্দর সাজিয়েছেন। ফিরে গিয়ে উনাকে একটা ধন্যবাদ দিতে হবে।

তাথৈয়ের মুখে নোমানের প্রশংসা শুনে অভয়ের মুখ লটকে গেল। সব পরিকল্পনা তার। নোমান তার কথা মতো কাজ করে সব ক্রেডিট নিয়ে গেল! এই যাত্রায় নোমানের চাকরি খেতেই হবে। ফিরে গিয়েই ব্যাটার চাকরি নট করবে। তাথৈ আড়চোখে অভয়ের চেহারার প্রতিক্রিয়া দেখে মনে মনে হাসছে।

অভয় একটা চেয়ার টেনে দিলে তাথৈ সেটাতে বসলো। সবকিছু এমন পারফেক্ট ভাবে সিনেমার সাথে মিলে যাচ্ছে কেন? অভয় হিরো হলেও সে তো হিরোইন না। সে অতি সাধারণ একটা মেয়ে।

-খাওয়া শুরু করো। নাকি ক্ষিধে পায়নি? সবকিছু কিন্তু তোমার পছন্দের।

তাথৈ দেখল সত্যিই তো খাবারের মেন্যু তার পছন্দ জেনেই রাখা হয়েছে। অভয়কে জেলাস ফিল করাতে তাথৈ যতই নোমানের প্রশংসা করুক। কিন্তু তাথৈ জানে স্যারের আদেশ ছাড়া ওই ব্যাটা নিঃশ্বাসও নেয় না।

অভয়কে দেখার চক্করে তাথৈ ঠিকঠাক খেতেও পারছে না। এই লোক সামনে থাকলে পেটে শতশত প্রজাপতি উড়ে। ক্ষিধে আপনাতেই মিটে যায়।

ডিনার ডেট শেষে এবার মুভি ডেট শুরু হবে। তাথৈ কিছুই খায়নি লক্ষ্য করে অভয় ওর সাথে একটা স্ট্রবেরির বাটি ধরিয়ে দিল। ভালোই হয়েছে। মুভি দেখতে দেখতে খাবে। পর্দায় মুভির নাম ভেসে উঠলে তাথৈ অবাক হয়ে গেল। অভয়ের সদ্য মুক্তি পাওয়া মুভি এটা। যেটা নিয়েই আজ বিকেল থেকে দেশে হৈহল্লা লেগে গেছে। তাথৈ নড়েচড়ে বসলো। শুধু শুধু মানুষটার উপর রাগ করছিল। ভেবেছিল বরের মুভিই তাকে সবার পরে দেখতে হবে। অভয় তাথৈয়ের পাশে এসে বসলে তাথৈ বলল,

-ধন্যবাদ।

-কেন?

-আজকের এই সন্ধ্যাটা আমাকে উপহার দেওয়ার জন্য।

মুভি শুরু হয়ে গেলে তাথৈ আর কোন কথা বলল না। তার সব মনোযোগ এখন পর্দায়। আসল মানুষটা বাস্তবে তার পাশে বসে আছে। কিন্তু সে পর্দার ভেতরের মানুষটাকে দেখতে বেশি আগ্রহী। দেড় ঘন্টার মুভিতে ইমোশনাল সিনে তাথৈও কেঁদেছে। ফানি মুহূর্তে হেসেছে। অ্যাকশন দৃশ্য গুলো দেখে উত্তেজিত হওয়ার সাথে ভয়ও পেয়েছে। মানুষটা কিরকম ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ছে। একসাথে দশ বারোজন গুণ্ডার সাথে মারামারি করছে। তাথৈ জানে ওসব সত্যি না। সবটাই অভিনয়। তারপরও রোমান্টিক দৃশ্য গুলো দেখে তাথৈয়ের ভাবমূর্তি পরিবর্তন হয়ে গেছে। পর্দায়ও সে অভয়কে অন্য মেয়ের সাথে দেখে জেলাস হচ্ছে। অভয় পুরোটা সময়ই তাথৈয়ের প্রতিক্রিয়াই লক্ষ্য করেছে। এক বারের জন্যও সামনে পর্দায় তাকায়নি।
মুভি শেষ হলেও তাথৈ ওরকমভাবে বসে রইল। কোন নড়াচড়া নেই। অভয় বুঝতে পারছে তাথৈ রেগে আছে। তাই সে বলল,

-তুমি এতক্ষণ যাকে দেখেছ সে আমি নই। আমি কেবল সেই চরিত্রটা নিজের মধ্যে ধারণ করেছি। তোমার সামনে যে আছে, সে বাস্তব আমি। পর্দায় তুমি ব্যক্তি অভয় খানকে খুঁজে পাবে না। যাকে দেখবে সে কেবলমাত্র একটা ক্যারেক্টার।

তাথৈয়ের রাগ পানি হতে অভয়ের এই কথাগুলোই যথেষ্ট। তবুও সে মুখ গোমড়া করে রইল। অভিনয় হলেও নায়িকাকে কোলে নেওয়া, জড়িয়ে ধরা, চুমু খাওয়া ওসব তো বাস্তবেই করেছে। সে বউ হয়েও তো আজ পর্যন্ত এসব করতে পারেনি।

তাথৈয়ের মুড এখনও ঠিক হয়নি দেখে অভয় ছোট্ট একটা একটা নিঃশ্বাস ফেললো। কী ভেবে তাথৈকে নিয়ে এসেছিল আর এখানে এসে কী ঘটলো।

তাথৈ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-আর কিছু বলবেন? নাকি আমি গাড়িতে গিয়ে বসবো?

তাথৈও ভেবেছিল অভয় হয়তো আজ তাকে প্রপোজ করবে। কিন্তু এই লোক অন্য মেয়ের সাথে নিজের রঙ তামাশা তাকে দেখাতে নিয়ে এসেছে। তাথৈ চলে যাওয়া ধরবে এমন সময় অভয় বলতে লাগল।

-আমার জীবনের সুখ দুঃখ সাফল্য ব্যর্থতা আমি তোমার সাথে ভাগ করে নিতে চাই তাথৈ। তোমার কাছে কোন কথা গোপন রাখতে চাই না। আমার জীবনে যেমন সফলতা আছে। তেমন ব্যর্থতার গল্পও আছে। যে গল্প গুলো কেউ জানে না সেগুলো তোমাকে শোনাতে চাই।

তাথৈ দাঁড়ানো থেকে আস্তে আস্তে বসে পড়ল। অভয় বলে যাচ্ছে। তাথৈ অজানা কোন ঘোরের মাঝে চলে গিয়ে ভাবছে,

-এত রোমান্টিক হতে আপনাকে কে বলেছিল? আমার মতো একটা সাধারণ মেয়েকে এত প্রাধান্য দিতে কে বলেছিল? আমার লোভী মন সারাজীবন আপনার সাথে থেকে যেতে চাইলে তখন কী করবেন? এই কথাগুলো বলে আমাকে যে আবেগী করে দিলেন এখন যদি আমি নিজের উপর কন্ট্রোল হারিয়ে আপনাকে দুই তিনটা কিস করে বসি তাহলে কি আপনি আমার নামে থানায় মামলা করবেন? আমি এখন কী করবো বলে দিন। আমার পাপী মন আপনাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিসব কথা ভেবে যাচ্ছে! আমি যদি ঘটনা গুলো ঘটিয়ে বসি এর দায়ভার কে নিবে শুনি?

চলবে
Jerin Akter Nipa

#যতনে_রাখিবো

৩০
আর কিছুটা সময় যদি লোকটা তার দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতো তাহলে তাথৈ হয়তো ঠিকই আজ লাজলজ্জা সব বিসর্জন দিতো। মনের মধ্যে পাপী চিন্তাভাবনা গুলো তো কখন থেকেই গুতাগুতি শুরু করে দিয়েছিল। ঘটনা ঘটে যেতে বেশি সময় লাগতো না যদি না অভয় তার ধ্যান ভাঙাতো।

-তাথৈ, মনে হয় তোমার ফোন বাজছে।

তাথৈ তখনও পুরোপুরি হুঁশে না ফিরে বলল,

-এটার কাজই বাজার। তাই বাজতে দিন।

-ইম্পরট্যান্ট কোন কল হতে পারে।

ধ্যাত! রোমান্টিকতার পুরো বারোটা বাজিয়ে দিল। তাথৈ মনে মনে বিরক্ত হয়ে বলল,

-ওহে সম্মানীয় গাধা নায়ক, আপনার থেকে ইম্পরট্যান্ট আমার আর কে হতে পারে? আপনি সাথে আছেন। তারপরও আমি কারো কল কেন তুলবো?

তিক্ত মেজাজ নিয়ে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখল ইম্পরট্যান্ট কলটা হাফসার থেকে এসেছে। তাথৈ মনে মনে নিজেকেই গালি দিল। কেন এই সিন্দাবাদের ভূতকে নিজের ঘাড়ে চাপিয়েছিল। সাত আটটা বছর ধরে জ্বালিয়ে খাচ্ছে। তাথৈ ফোন হাতে নিয়ে বসে আছে দেখে অভয় ইশারায় কল রিসিভ করার কথা বলল। কল রিসিভ করে হ্যালো বলার আগে ওপাশ থেকে ভেসে এলো।

-কংগ্রাচুলেশনস দোস্ত। দুলাভাইয়ের নতুন মুভি তো আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। কেমন লাগছে মিসেস অভয় খান? ফিলিংস শেয়ার করুন।

ফিলিংসের দফারফা করে দিয়ে এখন জানতে চাচ্ছে কেমন ফিল করছে সে। ফোনটা অভয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে তাথৈ বলল,

-আপনার কল। কথা বলুন।

অভয়ের ভ্রু কুঞ্চিত হলো। তাথৈয়ের ফোনে তার কল! ফোনটা হাতে নিয়ে স্ক্রিনে হাফ তারপর একটা চায়ের ইমোজি দিয়ে সেভ করা দেখে একটু দ্বিধায় পড়ল। কার সাথে কথা বলতে দিচ্ছে?

-হ্যালো।

তাথৈ হঠাৎ ছেলেদের মতো কথা বলছে শুনে হাফসা হাসতে লাগল। বলল,

-কিরে বান্ধবী, তোর কন্ঠ হঠাৎ ছেলেদের মতো হয়ে গেল কেন?

বান্ধবী বলছে! তার মানে তো এটা তাথৈয়ের কল। অভয় তাথৈকে ফোন ফিরিয়ে দিতে চাইলে তাথৈ চোখ রাঙিয়ে কথা বলতে বলল। অভয় কী কথা বলবে এটাই ভেবে পাচ্ছে না।
ওদিক দিয়ে হাফসা রেগে যাচ্ছে।

-কিরে বেডি কথা বলিস না কেন? আমার ফোনের টাকা কাটছে না? তোর জামাইয়ের মতো আমি এত বড়লোক না।

-এক মিনিট অপেক্ষা করুন আমি আপনাকে কল ব্যাক করছি।

এ তো সত্যি সত্যিই বেডাদের মতো কথা বলছে। গলার প্লাস্টিক সার্জারি করিয়ে নিলো নাকি? নিজে কথা বলছে নাকি অন্য কাউকে দিয়ে বলাচ্ছে!

-আপনি কে?

-আমি অভয় খান। আপনার বান্ধবীর বড়লোক জামাই।

কথাটা বলে অভয় হাসলেও ওপাশে সব নীরব হয়ে গেল। অনেকটা সময় পরও হাফসা কিছু বলছে না দেখে অভয় বলল,

-তোমার বান্ধবী কথা বলছে না।

তাথৈ হাই তুলে অভয়ের থেকে ফোনটা চেয়ে বলল,

-বলবেও না। হয়তো হার্ট ফেল করেছে আর নাহয় কথা বলতেই ভুলে গেছে।

অভয় তাথৈকে ফোন ফিরিয়ে দিয়ে বলল,

-তোমার ফ্রেন্ড ছিল?

-হুম।

-চিনতে পারছি না। আমার সাথে দেখা করাওনি?

-আপনি এত বড় মাপের মানুষ। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের সাথে দেখা করার সময় আছে?

-তুমি হয়তো ভুলে যাচ্ছ একটা সাধারণ মেয়েই আমার ওয়াইফ। আমার ওয়াইফের সাথে রিলেটেড সকল কিছুর জন্য আমার কাছে সময় আছে।

তাথৈ মনে মনে আবেগে বিগলিত হয়ে বলল,

-হায় আমার জামাইটা কত্ত রোমান্টিক!

——-

অভয়ের মুভির সাকসেস পার্টি রাখা হয়েছে। এ যেন পার্টি নয় পুরো তারকাদের মেলা বসেছে। এই পার্টিতে হাফসাও ইনভাইটেড ছিল। এখানে এসে বেচারির মাথা ঘুরতে শুরু করেছে। বান্ধবীকে দেখেই তো মাথা ঘুরে পড়ে যাবার দশা হয়েছিল। তাথৈকে দেখে হাসফা চাপা চিৎকার করে উঠে বলল,

-ও মাই গড! মাত্রাতিরিক্ত হট লাগছিস দোস্ত। তোর হটনেসে আমি জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছি। নায়ক সাহেব এই হটনেস কীভাবে হ্যান্ডেল করে?

এসব অশ্লীল কথা মানুষ শুনে ফেলার আগে তাথৈ হাফসার মুখ চেপে ধরলো।

-তুই কতটা অশ্লীল এটা আমি জানি। কিন্তু মানুষকে জানাতে চাচ্ছিস কেন?

হাফসা গলার ভলিউম কমিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-আমাকে অশ্লীল বলবি না। তাহলে কিন্তু সত্যি সত্যিই অশ্লীল কথাবার্তা বলতে শুরু করবো।

তাথৈ যাদেরকে চেনে তাদের সাথে হাফসারও পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। হাফসা যাদেরকে এতদিন শুধু টিভিতে দেখে এসেছে আজ তাদের সামনে থেকে দেখছে। অনেকের সাথে তো কথাও বলেছে।

-আমার দুলাভাইটা কই? জানিস আমাকে নিয়ে আসার জন্য উনি গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল।

-জানি।

হাফসা ঠোঁট কামড়ে মাথা নেড়ে বলল,

-জেন্টলম্যান!

ব্যক্তিগত ভাবে অভয়কে জানার আগে তাথৈকে কয়েকবার বলেছিল,

-তোর বরটা কি রাগী? দেখে তো মনে হয় অনেক রাগী। কেমন ভাবসাব নিয়ে চলে।

কিন্তু আজ অভয়ের আন্তরিক ব্যবহার দেখে তার এই ধারণা পাল্টে গেল। মানুষটা ভীষণ বিনয়ী।

-আমাদের আগে কথা হয়নি। দোষটা কিন্তু আমার না। পুরোটাই আপনার বান্ধবীর দোষ। কখনও পরিচয়ই করায়নি।

-বান্ধবী হয়তো ভয় পেয়েছিল। ভয় না পেয়েই বা বেচারি যাবে কোথায়? দেশের অর্ধেকের বেশি মেয়ের নজর আপনার উপর। কে কখন চুরি করে নিয়ে যায় বলা তো যায় না।

তাথৈ হাফসাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে। লোকটার সামনে এসব কথা বলে তাকে লজ্জায় ফেলছে কেন? অভয়ও আড়চোখে তাথৈয়ের দিকে দেখে হাসলো।

এরকম পার্টিতে জীবনে কখনও যায়নি। সবার মাঝে হাফসার নিজেকে ফকিন্নি লাগছে।

-দোস্ত আমাকে কেমন ফকিন্নি লাগছে না?

-ফকিন্নিকে ফকিন্নি লাগবে এটাই স্বাভাবিক।

-আমার আরও একটু মেকআপ করে আসা উচিত ছিল। তোর একটা প্রেস্টিজ আছে না।

তাথৈ আগে থেকেই জো’কে বলে রেখেছিল। তার বান্ধবীর জন্য যেন সবথেকে সুন্দর ড্রেসটা রেখে দেয়। হাফসা আফসোস করে মরছে। এদিকে জো তাথৈকে খুঁজছে।

-তোমার ফ্রেন্ড এখনও আসেনি ডল? পার্টি তো শুরু হয়ে যাবে। কখন আসবে সে?

তাথৈ হাফসাকে জো’র হাতে তুলে দিয়ে বলল,

-এইযে আসামিকে ধরে এনেছি। এখন তুমি ওর সাথে যা মন চায় করো।

হাফসা কিছুই বুঝতে পারছে না। ও কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই জো বলে উঠল,

-নো ডার্লিং, এখন আর কোন কথা নয়। পার্টি শুরু হয়ে যাবে। তুমি আমার সাথে চলো।

জো হাত ধরে টেনে হাফসাকে নিয়ে যাচ্ছে। হাফসা অসহায় চোখে তাথৈয়ের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে বলছে,

-এ কার হাতে তুই আমাকে ছেড়ে দিলি বান্ধবী!

অভয় গেস্টদের অ্যাটেন্ড করছে। পার্টিতে যেহেতু মিডিয়াও এসেছে তাই সকলের সাথেই প্রায় হেসে পোজ দিতে হচ্ছে। এখানে যারা এসেছে সবাই যে অভয়ের শুভাকাঙ্ক্ষী এমনটাও না। পার্টিতে উপস্থিত অনেকেই মনে মনে তার সাফল্যকে হিংসা করে।
লোপার সাথে দেখা হয়ে গেছে প্রতিবারের মতো এবার আর ওকে এভয়েড করলো না। কারণ অভয় জানে লোপা অনুতপ্ত। অভয়কে দেখেই একগাল হেসে লোপা বলল,

-তোমার বয়স কি দিন দিন কমছে? আগের থেকেও হ্যান্ডসাম হয়েছে।

-ধন্যবাদ।

-তোমার ওয়াইফের সাথে কিন্তু এখনও পরিচয় করাওনি। রিলেশনের মতো তাকেও কি এখনও সিক্রেট রাখবে?

অভয় আশেপাশে তাকিয়ে তাথৈকে খুঁজছে। কাছেই তাথৈকে নোমানের সাথে কথা বলতে দেখা গেল। অভয় নোমানকে ইশারা করলে নোমান তাথৈকে বলল,

-ভাবী স্যার আপনাকে ডাকছেন।

-আমাকে? কোথাও উনি?

তাথৈও অভয়কে খুঁজছে। একটা মেয়ের সাথে অভয়কে দেখলে তাথৈয়ের ভালো লাগল না।

-উনার সাথে মেয়েটা কে?

-লোপা ম্যামকে চেনেন না?

-না। আপনার স্যারের উপর রাগ করে অনেক বছর মুভি দেখা থেকে বিরত ছিলাম।

-লোপা ম্যাম কিন্তু এক সময় স্যারের জন্য পাগল ছিল। এখন কতটা পরিবর্তন হয়েছে জানি না। তবে উনার সামনে আপনাকে…

তাথৈ হাত উঁচিয়ে নোমানকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

-ওই নায়িকাকে জ্বালানোর জন্য আমাকে নিজে থেকে কিছুই করতে হবে না। আপনার স্যারকে নিয়ে মনের মধ্যে এখনও ফিলিংস থাকলে এমনিই জ্বলে যাবে।

তাথৈ ওদের দিকে এগিয়ে আসার সময় ভাবছে, উনাকে বিয়ে করে কত মেয়ের যে স্বপ্ন ভঙ্গের কারণ হয়েছি আল্লাহ মালুম। ওদের বদদোয়া থেকে আমাকে বাঁচিয়ে নিও আল্লাহ। তাথৈ পাশে এসে দাঁড়ালে অভয় আলগোছে নিজের হাত তাথৈয়ের কোমরে চালান করে দিয়ে বলল,

-মিট মাই সোলমেট, মাই বিউটিফুল ওয়াইফ তাথৈ।

তাথৈ এখনও প্রথম ধাক্কাই সামলে উঠতে পারেনি। অভয়ের হাত এখনও তার কোমরে। ঢোক গিললো বেচারি। লোপা হেসে তাথৈকে অভয়ের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে জড়িয়ে ধরে বলল,

-তোমাদের বিয়ের ইন্টারভিউতে যেমন দেখেছিলাম তার থেকেও বাস্তবে অনেক বেশি কিউট।

লোপা তাথৈকে ছেড়ে দিলে অভয় আবার তাথৈকে নিজের পাশে নিয়ে গেল। ব্যাটার মাথায় গণ্ডগোল দেখা দিয়েছে নাকি? কোমর থেকে হাতই সরাচ্ছে না। তাথৈ কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তাই সে মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে রাখল।

-তোমার বউ কিন্তু তোমার থেকে অনেক ছোট। একদম বাচ্চা বাচ্চা ফেস।

-সেজন্যই তো আরও যত্ন করে আগলে রাখতে হয়।

তাথৈ মুখে হাসি নিয়ে অভয়ের দিকে তাকালেও তার চোখে শাসন দেখা যাচ্ছে। হাসতে হাসতেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

-কী হচ্ছে শুনি?

চুল ঠিক করে দেওয়ার বাহানায় কানের কাছে মুখ নিয়ে অভয় বলল,

-কিছুই না তো।

-আপনার হাত কোথায়?

লোপা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ওদের লক্ষ্য করছে দেখে অভয় হেসে তাথৈকে আরেকটু কাছে টেনে এনে বলল,

-আসলে তাথৈকে আমার লাইফে পেয়ে আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। তাথৈ হয়তো আমার থেকেও বেটার কাউকে পেতো। কিন্তু আমি ওর মতো আর কাউকেই পেতাম না।

তাথৈ আশ্চর্য চোখে অভয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মানুষটা কি শুধুই সামনের জনকে শোনাতে কথাগুলো বলছে! সত্যিই কি তাকে পেয়ে উনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন?

চলবে
Jerin Akter Nipa