যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0
608

যে শহরে প্রেমে পড়া বারণ
~মিহি

শেষ পর্ব .
শান্তিনীড়ের আঙ্গিনাটাতে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ফুলের সমারোহ চারিদিকে। সন্ধি চেয়েছিল এখান থেকেই যেন তার বিদায়টা হয়। মাহিদও আপত্তি করেনি। সাধারণ সাজপোশাকেই বিবাহ আসরে বসেছে সন্ধি। মনে জমানো খচখচানি কিছুতেই দূর হচ্ছে না তার। বিয়ে নামক বস্তুটার প্রতি তার ভয় সৃষ্টি হয়েছে। মাহিদের সাথে কথা বলতে পারলে ভালো হত কিন্তু বিয়ে শেষ হওয়ার আগে সে সুযোগ নেই। কাজী সাহেব এসেছেন একটু আগেই। মাহিদ বাইরে বসা আর সন্ধি আশ্রমের ঘরে। ইতিমধ্যে মাহিদ নাকি তড়িৎ গতিতে কবুল বলে দিয়েছে। কাজী সাহেব সন্ধির কাছে এসেছেন এখন। বারংবার সন্ধিকে কবুল বলতে বলার পরও সন্ধি চুপ। আশেপাশে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। সন্ধি বিয়ের আসর থেকে উঠে দাঁড়ালো। শ্রাবণী শিকদার তা দেখলেন কিন্তু প্রতিবাদ করলেন না। সন্ধি সোজা গেল মাহিদের কাছে।

– ‘আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।’

– ‘এখন?’

– ‘এই মুহূর্তে। আমার সাথে সাইডে আসুন।’

মাহিদ আর কথা বাড়ালো না। বিয়ের আসর ছেড়ে সন্ধির পিছু পিছু গেল। আশ্রমের পেছনের অংশে বাগান করা হয়েছে। সেখানে এসেই দাঁড়িয়েছে সন্ধি। মাহিদও এসে দাঁড়ালো সেখানে।

– ‘কী হয়েছে সন্ধি? কোন সমস্যা?’

– ‘আপনি পারবেন এই বিয়েটা টিকিয়ে রাখতে? বাবা-মায়ের পর নিজের জীবনে যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি তাতে বিয়ে নামক বন্ধন থেকে আমার বিশ্বাস উঠে গেছে। সত্যি বলতে গেলে আমি ভয় পাচ্ছি। আদৌ এ সম্পর্ক আপনার আত্মীয়-স্বজন, এ সমাজ মানতে পারবে? আপনি একজন বিধবাকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন।’

– ‘দেখো সন্ধি, বিধবাকে বিয়ে করা কোনো অপরাধ নয় তা আমি আগেই বলেছি তোমাকে। তোমার ভয়টা এ জায়গায় নয় আমি জানি। তুমি ভয়ে আছো আমাকে নিয়ে। তুমি ভাবছো আমাকে বিয়ে করলে যদি নয়নের মতো অবস্থা আমারো হয়। তোমার একটা বদ্ধমূল ধারণা জন্মেছে যে তোমার কারণেই বোধহয় নয়ন মারা গেছে। তুমিই অপয়া। আসলে এমনটা না। ওর ভাগ্যে যা ছিল, তাই হয়েছে। এতে তোমার কোনো দোষ ছিল না।’

সন্ধি মাথা নিচু করে ফেলল। আসলেই সে এ ভয়টাই পাচ্ছিল। মাহিদ তার মনের কথা বুঝতে পেরেছে। এখন আর সন্দেহ নেই সন্ধির মনে। মাহিদকেই বিয়ে করবে সে। একবার আলতো করে মাহিদের হাত স্পর্শ করে কাঁধে মাথা রাখতে ইচ্ছে হলো সন্ধির কিন্তু আপাতত তা করল না। এই ইচ্ছে পূরণের জন্য আগে কবুল বলাটা জরুরি। আবারো একছুটে কাজী সাহেবের নিকট ফিরলো সে। আশেপাশে সবাই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে সন্ধির দিকে। তাকানোটাই স্বাভাবিক। বিয়ের কনে আসর ছেড়ে হঠাৎ বরের সাথে চলে গেল, আবার চলেও এলো। কাজী সাহেব সন্ধিকে কবুল বলতে বললেন। মুহূর্তেই তিনবার কবুল বলে ফেলল সে। আশ্রমজুড়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ শব্দ শোনা গেল। সন্ধির মনটা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। তার এই আনন্দের দিনে সকলে শরিক হতে পেরেছে ভেবেই সন্ধির আনন্দ লাগছে। এত বড় একটা পরিবার পেয়েছে সে। এখন নতুন পরিবারে পা রাখার পালা। নতুন একটা পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে সন্ধির।

____________________________

রাতের প্রথম প্রহর। মাহিদের ঘরটা সাজানো হয়েছে রজনীগন্ধা আর গোলাপ দিয়ে। বিছানার চারধারে গাঁদাফুল লাগানো।সারা ঘর ফুলের গন্ধে মুখরিত। সন্ধি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সময় কত দ্রুত চলে যায়। কতই বা বছর গেল? এত তাড়াতাড়ি সে এত সুন্দর একটা জীবনের আশা করেনি। খুব অদ্ভুতভাবে যেন সব পেয়ে গেল। মাহিদের কাজিন আর বন্ধুরা বাইরে তাকে আটকেছে আরো আধ ঘণ্টা আগে। দরজার এপাশ থেকেই সন্ধি শুনতে পারছে ওদের কথা। টাকা চেয়েছে ত্রিশ হাজার কিন্তু মাহিদ কিছুতেই এত টাকা দিতে রাজি না। মূলকথা মাহিদ একটু দামদর করতে চাচ্ছে। শেষে আর না পেরে পুরো টাকাটা ওদের ধরিয়ে দিতেই মাহিদ খেয়াল করলো ইতিমধ্যে ওয়ালেটে থাকা দশ হাজার টাকাও মেরে নেওয়া হয়ে গেছে। অসহায় দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো মাহিদ। মাহিদকে প্রবেশ করতে দেখে সন্ধি একবার সেদিকে তাকালো। আজকের রাতে নাকি মেয়েরা লজ্জায় লাল হয়ে যায় অথচ সন্ধির একটুও লজ্জা লাগছে না। উল্টো কথা বলার জন্য উশখুশ করছে সে। মুখের ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে কিছু একটা বলতে চায় সে। মাহিদ মোহরানার টাকাটা সন্ধির হাতে তুলে দিল।

– ‘কিছু বলবে?’

– ‘হুম। তার আগে একসাথে নামাজটা পড়ে নিই। ফ্রেশ হয়ে ওযু করে আসেন।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

দুই রাকআত নফল নামাজ শেষ করে মোনাজাত করল সন্ধি, ‘হে আল্লাহ! আমার জীবনে এত সুখ আপনি লিখেছেন। আলহামদুলিল্লাহ। আমি যেন সারাজীবন আমার স্বামীর সাথে সুখে সংসার করতে পারি, তার পরিবারকে নিজের পরিবার ভেবে আগলে রাখতে পারি, মামণির স্বপ্নগুলো আরো উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারি। আমিন।’ মোনাজাত শেষ করে মাহিদের কোলে মাথা রাখল সন্ধি। সচরাচর ছেলেরা করে এই কাজটা তবুও সন্ধির ইচ্ছে করছে মাহিদের কোলে শুয়ে থাকতে। মাহিদ আলতো করে সন্ধির কপালে হাত রাখলো।

– ‘জানেন মাহিদ, আমি আজ খুব খুশি।’

– ‘কৃতার্থ হলাম আপনার মুখে নিজের নামটা শুনে। ধন্য আমি।’

– ‘হুশ! ঢঙ রাখেন। আপনি এতগুলো বছর অপেক্ষা করলেন কী করে? আমার কথা মনে পড়েনি?’

– ‘মনে পড়েনি আবার? তোমাকে দেখার জন্য একদিন বোরকা পড়ে আশ্রমের কাছে গিয়েছিলাম। তোমার মামণি কী চালাক! তার কাছে ধরা খেয়ে আর ওসব মতলব আঁটিনি।’

– ‘বোরকা পড়ে মেয়ে সেজে? আপনি আসলেই একটা রামছাগল। এখন শোনেন, এই যে ঘরটা সাজানো। এই সাজটা আমার দারুণ লাগছে। এটা নষ্ট করার কোনো মানে হয়না। আজকে দুজন মেঝেতে ঘুমাবো।’

– ‘পাগল তুমি? ঠাণ্ডা লেগে যাবে। তাছাড়া ফুলগুলো সরিয়ে শুয়ে পড়লে সাজের আহামরি কোনো পরিবর্তন হবে না।’

– ‘তাহলে ঘুমানোর চিন্তাই বাদ। চলেন বাইরে থেকে ঘুরে আসি।’

– ‘এই ঘরে ঢুকতে আমার কত টাকা গেছে জানো? চল্লিশ হাজার! আর এখন কিনা বাইরে যাবো। তাছাড়া এখন কেবল রাতের ন’টা। বাইরে আড্ডা দিচ্ছে সবাই।’

– ‘আমরাও দিব চলেন।’

– ‘পাগলী বউ রে। আড্ডা রাখো। আমি তোমার পাশে আছি না? এখন সময়টা একান্ত আমাদের।’

– ‘হুহ! স্বার্থপর।’

– ‘তোমার জন্য একটা উপহার আছে।’

– ‘আপনার জন্যেও আছে।’

– ‘দেখাও।’

– ‘আগে আপনি।’

মাহিদ পাঞ্জাবির পকেট থেকে একটা আংটির বক্স বের করলো। সন্ধির হাতে তা পড়িয়ে দিল। সন্ধি মুচকি মুচকি হাসছে।

– ‘এবার তোমার পালা।’

– ‘চোখ বন্ধ করেন।’

– ‘আচ্ছা করছি।’

সন্ধি বিরাট মোটা একটা ইংরেজির বই মাহিদের মাথার উপর রাখলো। বইয়ের ভারে মাথা নাড়াতেই বইটা ধপ করে মেঝেতে পড়লো। বিরক্তি দৃষ্টিতে একবার বই আর একবার সন্ধির দিকে তাকাচ্ছে সে। এতটা বিরক্ত সে এই বিষয়টা নিয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েও হয়নি যতটা না সন্ধি তাকে পচিয়ে বিরক্ত করছে।

– ‘বইয়ের ‘249’ নম্বর পৃষ্ঠা খুলুন।’

– ‘কী আছে?’

– ‘এত প্রশ্ন করেন কেন? খোলেন আগে।’

মাহিদ বইটা হাতে নিয়ে পৃষ্ঠাটা বের করে। বইয়ের ভাঁজে একটা চিরকুট, ‘আপনার স্ত্রীর হাতটা ধরে তাকে বারান্দায় নিয়ে চলুন।’ মাহিদ ভ্রু কুঁচকে সন্ধির দিকে তাকাল। সন্ধিকে অবাক করে দিয়ে তাকে কোলে করে বারান্দায় নিয়ে আসলো। বারান্দার ঝুলন্ত দোলনাটার একপাশে সন্ধিকে বসিয়ে অপর পাশে সে বসলো। পূর্ণিমার আলোতে আজকের রাত আলোকিত। সন্ধির হাতে জড়ানো মাহিদের হাত। আচমকা মাহিদ খেয়াল করলো সন্ধি তার হাতে কিছু রাখলো। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো মাউথ অর্গ্যান। মৃদু হাসলো সে। পূর্ণিমার চাঁদনী রাতে সন্ধি আলতো করে মাথা রাখলো তার কাঁধে। মাউথ অর্গ্যানে সুর বাজতে লাগলো,

‘এখন অনেক রাত
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস,
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়!

ছুঁয়ে দিলে হাত
আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়!

এখন অনেক রাত
তোমার কাঁধে আমার নিঃশ্বাস,
আমি বেঁচে আছি তোমার ভালোবাসায়!

ছুঁয়ে দিলে হাত
আমার বৃদ্ধ বুকে তোমার মাথা চেপে ধরে টলছি কেমন নেশায়!’

সমাপ্ত।