রঙ বেরঙের অনুভূতি পর্ব-১০

0
221

#রঙ_বেরঙের_অনুভূতি
#লেখনীতেঃতানজিলা_খাতুন_তানু

(১০)

সুহানি আগের তুলনায় একটু সুস্থ মনের ভিতরে অনেকগুলো প্রশ্ন জমা হয়ে আছে। সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত কিছুই করতে পারবে না।‌সমস্ত কিছু ওকে জানতেই হবে।

সুহানি নিজের ভাবনার মাঝেই ছাড়লো,তখন নোহা এসে ওকে ডাক দিলোঃ কি হয়েছে কি ভাবছো।

সুহানি মুখে হাসি ফুটিয়ে বললোঃ না দিদিয়া কিছুই না।

নোহাঃ শরীর কেমন এখন।

সুহানিঃ আগের থেকে অনেক ভালো।

নোহাঃ‌খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে চিন্তা করো না।

সুহানিঃ আচ্ছা দিদিয়া একটা কথা জিজ্ঞেস করবো।

নোহাঃ‌বলো।

সুহানিঃ দিয়ার খু’ন টার কোনো তদন্ত হয়নি।

নোহা মাথা নাড়িয়ে বললোঃ না। নোহান করাই নি।

সুহানিঃ কেন?

নোহাঃ জানি না আমি অনেক বার বলেছিলাম কিন্তু ওহ শোনেনি। কারনটা আমিও বুঝে উঠতে পারিনি।

সুহানিঃ‌ আর ওদের বিয়ের কথাটা।

নোহাঃ সেটা তো দিয়া চাইনি তাই।

সুহানিঃ ওহ।

নোহাঃ তুমি আর পুরানো কথা টেনে মন খারাপ করো না।‌নতুন করে সবকিছু শুরু করো নোহানকে নিয়ে সংসার করো।

নোহা চলে যায়, সুহানি তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। নতুন করে শুরু করবো,জীবনটাই যে নতুন মোড় নিয়েছে আবার কিভাবে নতুন করে শুরু করবে আর সংসার।‌যেই বিয়েটা একটা মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত,একটা প্রতিশোধের নেশায় করা সেটা দিয়ে আর যাই হোক সংসার করা যায় না। খুব তাড়াতাড়ি এই সত্যিটা বের করে নোহানকে মুক্তি দিয়ে দেবে।তারপর সারাজীবনের জন্য এই শহর থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে যাবে, যেখানে এই অতীতের কোনো ছায়াও থাকবে না।

পরেরদিন…

নোহা,নোহান কেউই বাড়িতে নেয়। সুহানি বসে বসে অঙ্ক মেলাতে চেষ্টা করছে। ডিজাইনের স্টুডেন্ট অঙ্ক কি আর সহজে মেটাতে পারে। সবটা খালি উল্টো পাল্টা হয়ে যাচ্ছে। অনেক গুলো গোলকধাঁধা তৈরি হয়েছে।

*সেইদিন কি এমন হয়েছিলো,দিয়া অফিসে না গিয়ে ফার্ম হাউসে গেলো।
*কার কি এমন শত্রুতা ছিলো,যে দিয়াকে প্রানে মে’রে দিলো।
* আর কেনই বা দিয়া শেষ কথাটা “সুহা” নিয়েছিলো কি কারন।

এই সবকিছুর মাঝে সুহানির নামটা চলেই আসছে। অদ্ভুত। এসবের কোনো কিছুই ওহ জানে না তবুও ওর নামটা জড়িয়ে যাচ্ছে।‌মানে এমন কিছু আছে যেটার জন্য সুহানির নামটা এখানে এসে যাচ্ছে কিন্তু কি?

রাত্রিবেলা…

নোহান‌ সুহানির রুমে এসেছে। সুহানি উশখুশ করতে কিছু একটা বলবে বলে।

নোহানঃ বলো কি বলবে।

সুহানি আমতা আমতা করে বলল ঃ আমি কি কয়েকদিনের জন্য আমার বাড়িতে যেতে পারি।

নোহান সুহানির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে বললোঃ আচ্ছা কালকে ড্রাইভারকে বলবো তোমাকে দিয়ে আসবে।

সুহানি খুশি হয়ে যায়। নোহান সুহানির হাসি মুখটার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলো নিজের রুমে।

পরেরদিন সকালে….

সুহানি ওর বাড়িতে চলে যায়। ওকে দেখেই ওর মা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করে দেয়।‌আদরে্য মেয়েকে এতদিন না দেখে না কথা বলে ওনারা কিভাবে ছিলেন সেটা ওনারাই ভালো জানেন।

সুহানিঃ মা তোমার মেয়ে ম’রে যায়নে যে এইভাবে কান্না করতে হবে।

সুহানির মা রাগী চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললোঃ মার খাবি তুই।

সুহানিঃ মা বাপি আর ভাই কোথায়।

সুহানির মাঃ তোর বাপি অফিসে আর তোর ভাই স্কুলে গেছে।ভেতরে আয়।

সুহানিকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসিয়ে দিয়ে বললোঃ মারে তুই কতটা রোগা হয়ে গেছিস।

সুহানি চোখ মুখ শক্ত করে বললোঃ আমাকে রোগা মনে হচ্ছে তোমার।‌আগের থেকে ওয়েট বেড়ে গেছে।

মাঃ মায়ের সাথে ফাজলামি।

সুহানি ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বললোঃ মা তোমার হাতে অনেকদিন রান্না খাইনি। খাওয়াবে না।

মা চোখ মুছতে মুছতে মুছতে বললেনঃ তুই বস আমি রান্নার ব্যবস্থা করছি।

মা রান্নাঘরে চলে গেলো। সুহানি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।‌মা বাপিকে কতটা কস্ট দিয়েছে ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। মা এমনি যতই রাগ করে থাকুক না কেন। সন্তানকে কাছে পেয়ে আর নিজেদের সামলে রাখতে পারেন না।‌সমস্ত কিছু ভুলে বুকে টেনে নেয়।

মা রান্নাঘরে রান্না করছিলো আর সুহানি একটা করে কথা বলছিলো। মা রান্না করে সুহানিকে নিজের হাতে খাইয়ে দিলো।

বিকালে…

কলিং বেলের শব্দ শুনে সুহানি দরজা খুলে দেখলো তার আদরের একমাত্র ছোট ভাইটা দাঁড়িয়ে আছে। সুহান তার দিদিকে এতদিন পর দেখে নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলো না জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।

সুহান ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে বললোঃ দিদিভাই এতদিন কোথায় ছিলি জানিস তুই আমার একটুও ভালো লাগছিলো না।‌দিদিভাই আমি আর তোর সাথে ঝগড়া করবো না তূই প্লিজ আর আমাকে ছেড়ে যাবি না। আমি তোর সব কথা শুনবো।‌আমি ভালো ছেলে হয়ে থাকবো।দুস্টুমি করবো না প্লিজ তুই আর কোথাও যাবি না।

সুহানিঃ‌আচ্ছা যাবো না এবার তো থাম।

সুহানি সুহানকে ভেতরে নিয়ে এসে বসালো। এতবড়ো ছেলেটা বাচ্চাদের মতো কান্না করেছে তাও আবার দিদির জন্য যার সাথে প্রতিদিন ঝগড়া করতো তার জন্য। সুহানি তার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল ভাই বোনের সম্পর্ক গুলোই এরকম দুষ্টু মিষ্টি।

সুহান সুহানিকে ছেড়ে একটুও যাচ্ছে না হাতটাকে শক্ত করে ধরে আছে। মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই চলে যাবে। সুহানি ওর ভাইকে খাইয়ে দিল।সুহান ওহ চুপচাপ খেয়ে নিলো।‌ওদের মা ওদের কাজকর্ম গুলো দেখে আড়ালে চোখের পানি মুছলেন।‌সুহান সেটা খেয়াল না করলেও সুহানি করেছে। সুহানি ভাবতে থাকে মেয়েদের ভাগ্যটা এরকম কেন। এক বাড়িতে জন্মাতে হয় আর এক বাড়িতে ম’র’তে হয়। আর ওর ভাগ্যটা আরোই খারাপ।

সন্ধ্যাবেলা, পরিবেশটা একদম থমথমে। সুহানির বাবা মুখটা গম্ভীর করে বসে আছেন।‌কোনো কথা বলছেন না সুহানির একটু ভয় লাগছে এখনোই তার বাবা কে এতটা গম্ভীর লাগে নাই।

মাঃ‌কি হলো তুমি চুপ করে আছো কেন?

বাবাঃ তোমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করো।‌কি এমন কারন যার জন্য সে নিজের বান্ধবির বরকে বিয়ে করলো।

সুহানি অশ্রুসিক্ত নয়নে বললোঃ বাপি দিয়া মার বেঁ’চে নেয়। আর নোহান মনে করে আমি ওই সবকিছুর জন্য দায়ী তাই আমাকে বিয়ে করেছে।

বাবা মা দুজনেই চমকে উঠলো।

বাবাঃ কি বলছিস এসব।

সুহানি সবটা বললো।বাবা সুহানিকে জড়িয়ে ধরলো। সুহানি কান্না করছে। মায়ের চোখেও পানি।

বাবাঃ মা রে এতটা কষ্টের মাঝে তুই ছিলি সেটা আমি কখনোই বুঝতে পারিনি।আমাকে মাফ করে দে, আমি তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি।

সুহানিঃ বাপি এখানে তোমার কোনো দোষ নেয়,, সমস্ত দোষটাই আমার ভাগ্যের।

বাবাঃ একটা কথা জিজ্ঞেস করছি।

সুহানিঃ হ্যা বাপি বলো।

বাবাঃ‌ এই সম্পর্কের বেড়াজাল থেকে কি তুই বের হতে চাস।

সুহানি তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললঃ আমার চাওয়া আর না চাওয়াতে কখনোই কিছু যায় আসে নি।‌তবে একটা কথাই বলবো যে সম্পর্ক টা প্রতিশোধের নেশায় তৈরি সেটা আর যাই হোক কোনো সম্পর্ক নয়।

বাবাঃ যেই সিদ্ধান্তটাই নিস ভেবে চিন্তে নিস। তুই না চাইলেও নোহান তোর স্বামী।‌আর এই সত্যটা তোকে মানতেই হবে।

সুহানিঃ অপেক্ষা করো বাপি, সত্যিটা বের করে এনে আমি এই সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসবো।

বাবাঃ পারবি তো।

সুহানি অবাক হয়ে তার বাবার দিকে তাকালো।

সুহানিঃ বাপি এসব কি বলছো।

বাবাঃ মারে বিয়ে একটা পবিত্র সম্পর্ক।‌এই বাঁধনে আবদ্ধ দুই মানুষ সবসময়ই অপর মানুষের প্রতি দূর্বল হয়ে যায়।

সুহানি কিছুই বললো না।কি বলবে,নোহান ওর স্বামী সেটাও যে ওর মানতে বড্ড কষ্ট হয়, আর ভালোবাসা, অনুভূতি গুলো তো কারোর নিজেদের হাতে থাকে না। সবটাই হয়ে যায় না চাইলেও। সুহানি ও কি নোহানের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়বে নাকি কোনো অদৃশ্য কিছু বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে ওদের পথে। সবটাই সময়ের খেলা,সময় তার নিজস্ব গতিতে চলবে আর আমাদেরও চালিয়ে নিয়ে যাবে এটাই জীবন।

রাত গভীর…

নিকোটিনের নেশায় পেতে উঠেছে নোহান শিকদার। বুকের ভেতর অসহ্য দহন হচ্ছে।দহন কিসের জন্য সেটা নোহান ভালো করেই জানে, ছোটো বেলা থেকে ওর সব প্রিয় জিনিস গুলোই ওর জীবন থেকে হারিয়ে যায়, আর যাকে আঁকড়ে ধরে নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলো সেই দিয়াই জীবন থেকে চলে গেলো।‌আবারো জীবনটাকে অগোছালো করে দিলো। রঙহীন একটা মানুষের পরিনত হয়েছে নোহান যার জীবনে নেয় কোন অনুভূতি।

আবারো একটা নতুন দিন, কিন্তু দিনটা কি নতুন কিছুর সূচনা করবে নাকি আবারো কোনো অদৃশ্য যুদ্ধে মেতে উঠবে সবাই।

#চলবে…

বিঃ দ্রঃ-ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

হ্যাপি রিডিং।