লাভ গেম পর্ব-৩৬

0
777

#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন

৩৬.

আদ্রিশ শানের দিকে রিভলবার তাক করে বলল,
“অনেক খেল দেখিয়েছিস নিজের বোন আর আমার সাথে। এইবার তোর খেলা শেষ। সময় হয়ে গেছে পুরো পৃথিবীর কাছে তোর মুখোশ উন্মোচন করার। সময় হয়ে গেছে তোর পাপের শাস্তি পাওয়ার। যে সম্পত্তি আর ক্ষমতার জন্য নিজের আপন বড় ভাইকে খুন করেছিস সে সম্পত্তি জেলে বসে ভোগ করিস। চল।”
রুশা আদ্রিশের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। শান আড়চোখে ডানে-বামে তাকাচ্ছে। এখন যদি নিজেকে ধরা দেয় তাহলে আর বাঁচতে পারবে না। তাই যেভাবেই হোক পালাতে হবে। শান আদ্রিশের কথামতো ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দুই পা এগিয়ে সামনের কাচের টি-টেবিলটা ধাক্কা মেরে আদ্রিশের দিকে ফেলে দিল। আদ্রিশের পায়ের উপর পড়াতে আদ্রিশ আলতো ভাবে ঝুঁকে পড়ে আর ওর হাত থেকে রিভলবার পড়ে যায়। রুশাও আদ্রিশের সাথে ধাক্কা খেয়ে পেছনে পড়ে যায়। এই সুযোগে শান দৌড়ে উপরে উঠে যায়। আদ্রিশ রুশাকে হাত ধরে তুলে, মেঝে থেকে রিভলবার তুলে শানের পেছনে গেল। রুশাও ওর পেছনে পেছনে যাচ্ছে। হঠাৎ করে আদ্রিশ থেমে গেল।

রুশা আদ্রিশকে থেমে যেতে দেখে প্রশ্ন করল,
“কি হলো দাঁড়িয়ে গেলে কেন?”

“তুমি এখানেই থাকো। শান কিছু একটা প্লান করছে। নয়তো উপরে যাবে কেন? ওর পালানোর হলে দরজা দিয়ে পালাবে।”
রুশাও তাই ভাবছে কিন্তু আদ্রিশের সাথে যাবে এই বায়না করে আছে।

অতঃপর ওরা দুজন ধীরে ধীরে উপরে যাচ্ছে।রুশা, শানের রুম দেখাল। ওর রুমের দরজা বন্ধ। আদ্রিশ রিভলবার পজিশন মতো রেখে দরজা খোলার চেষ্টা করল। কিন্তু দরজা খুলছে না।

আদ্রিশ রুশার দিকে চেয়ে বলল,
“ভেতরে থেকে লক করা। লক করে ভেতরে কী করছে?”

রুশা কপাল কুঁচকে ঠোঁট কামড়ে কিছু ভেবে বলল,
“দরজাটা ভেঙে ফেলো।”

আদ্রিশ কয়েকবার দরজায় আঘাত করল। রুশা হঠাৎ করে বলল,
“বারান্দা দিয়ে পালায়নি তো?”

আদ্রিশ ওর কথা শুনে শেষবারের মতো জোরে দরজায় আঘাত করল। দরজা খুলে গেল। আদ্রিশ অতি সাবধানে ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকল। তারপর রুশা। ভেতরে কেউ নেই। আলমারি হাট করে খোলা। এলোমেলো ভাবে জামাকাপড় পড়ে আছে। রুশা খেয়াল করল বেডসাইড ড্রয়ারও খোলা। ওরা গাড়ির শব্দ পেয়ে দৌড়ে বারান্দায় গেল। একটা গাড়ি বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল।

রুশা উৎকন্ঠিত হয়ে বলল,
“ভাইয়া পালিয়েছে। ঘরে থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়েছে। ওর পেছনে যেতে হবে।”

রুশা আর আদ্রিশ যত দ্রুত সম্ভব উপর থেকে নামল। ওরা গাড়ি ছুটিয়ে শানের গাড়ি খুঁজতে লাগল। আদ্রিশ ফুল স্পিডে গাড়ি চালাচ্ছে।
“রুশা, সেজানকে কল করে লাউডস্পিকার দেও। ওর সাহায্য প্রয়োজন।”

“ওকে, দিচ্ছি।”
রুশা দ্রুত সেজানকে কল করল। রিসিভ করতেই লাউডস্পিকার দিল। আদ্রিশ ওর প্রয়োজনীয় কথা সেড়ে আবারও গাড়ি চালানোতে মনোযোগ দিল।

দীর্ঘ দুই ঘন্টা পর ওরা শানের লোকেশন জানতে পারল। শান একটা জঙ্গলে গা-ঢাকা দিয়েছে। ওর প্লান রাত হলে এই শহর ছাড়বে তারপর খুব দ্রুত দেশ ছাড়বে। শান গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওর বিরক্ত লাগছে এই জঙ্গলের মধ্যে। সন্ধ্যা নেমে আসছে। পাখি, পোকামাকড় ডাকছে। মশাও কামড় দিচ্ছে। এখন এখানে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। আরেকটু অন্ধকার নামলেই এখান থেকে বের হওয়া যাবে। শান কাউকে কল করছে।
হঠাৎ গাড়ি আসার শব্দে সাবধান হয়ে যায়। যেদিক থেকে গাড়ি আসছে সেদিকে কান পেতে রাখল। তারপর আর গাড়ির শব্দ পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে। এর মানে হলো যারা এসেছে তারা গাড়ি থেকে নেমে গেছে। শানকে সাবধান হতে হবে। শান গাড়ির সামনে থেকে সরে গেল।

আদ্রিশ রুশাকে গাড়ি থেকে নামতে দিল না। এই জঙ্গলের মধ্যে ও সেভ নয়। শান নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে। ওর স্বার্থের জন্য সব করতে পারে। রুশাকেও গুলি করে দিতে পারে। আদ্রিশ রুশার জীবনের রিক্স নিতে পারবে না। রুশা নামার জন্য জোরাজোরি করলে আদ্রিশ গাড়ির দরজা লক করে দিল। রুশা রাগে ফোঁসফোঁস করছে।

আদ্রিশ দুই তিনজন গার্ড নিয়ে আদ্রিশকে খুঁজছে সাথে সেজানও আছে। রুশার পাহারায় একজনকে রেখে এসেছে৷ ওরা জঙ্গলে ঢুকে শানকে খুঁজছে। ওর গাড়ি পেয়ে গেলেও শানকে কোথাও পায়নি। ওরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গাড়ির আশেপাশে খুঁজতে লাগল। কিন্তু শানকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না। আদ্রিশের ডানপাশে জঙ্গলের ছোট ছোট গাছগুলো নড়ে ওঠে আর কারো পায়ের শব্দ পায়। আদ্রিশ সেদিকে ঘুরে কাউকে না পেয়ে গুলি মারে। রুশা গুলির শব্দ শুনে আরো ছটফট শুরু করে দিয়েছে বের হওয়ার জন্য।
আদ্রিশ সেদিকে ছুটে শানকে পেছন থেকে দেখে ওর পেছনে পেছনে ছুটতে লাগল আর চেঁচিয়ে বলতে লাগল,
“শান দাঁড়া বলছি। দাঁড়া নয়তো গুলি করব।”
আদ্রিশের কন্ঠ শুনে সেজানও সেদিকে গেল।

রুশা গাড়ির দরজা অনবরত ধাক্কাচ্ছে, লাথি মারছে। হঠাৎ করে দরজা খুলে গেল। রুশা গাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। গার্ড রুশাকে বাঁধা দিচ্ছে কিন্তু রুশা ওকে ধাক্কা মেরে চলে গেল। জঙ্গলে দিকবিদিকশুন্য হয়ে দৌড়াচ্ছে। হঠাৎ করে কারো আসার শব্দে রুশা দাঁড়িয়ে যায়। মনে হচ্ছে কয়েকজন দৌড়ে আসছে। হঠাৎ শানকে দৌড়ে আসতে দেখল, পেছনে আদ্রিশ। কিছু বোঝার আগে শান এসে ওর মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। শান হাপাচ্ছে, জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। রুশা ভয় পেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। আদ্রিশও থেমে গেল। রুশার উপর রাগ হচ্ছে, বারবার নিষেধ করেছিল বের হতে। আদ্রিশ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“ও তোর বোন। ওকে ছেড়ে দে।”

“আরে কিসের বোন? ও যদি আমার সঙ্গ দিতো তবে ছেড়ে দিতাম কিন্তু ও সাজ্জাদ চৌধুরীর মতো। তার আদর্শে বড় হয়েছে। বড়বড় নীতি কথা ঝারছে। যেখানে বাবার মতো বড় ভাইকে ছাড়িনি সেখানে ও কে? আমি আমার লাইফে কোন বাঁধা চাইনি। নিজের ইচ্ছে মতো লাইফ লিড করতে চেয়েছি, পুরো সম্পত্তির মালিক হতে চেয়েছি। সাজ্জাদ ভাই নাকি কখনো বিয়ে করবে না তাই এই রাজত্বের একচ্ছত্র রাজা ভেবে এসেছি নিজেকে। কিন্তু বিয়ে করে নিল। আবার বাচ্চাও। সহ্য হলো না আমার। তাই সাজ্জাদ চৌধুরীকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছি। সাথে তার অনাগত সন্তান। পুরো রাস্তা ক্লিয়ার। রকির সাথে পিউর বিয়ে কনফার্ম করে ফেললাম। ভাইয়াকে কেউ মেরেছে সে ভূত ওর মাথায় চেপে বসল। ও রাগে পাগল হয়ে যাচ্ছিল। তারপর বুদ্ধি করে তোকে ফাঁসিয়ে দিলাম। তোর জন্য সাজ্জাদ চৌধুরী আমাকে ভরা মজলিসের মধ্যে অপমান করেছে। তার শোধ নিতে চেয়েছি। পিউও প্রতিজ্ঞা করল ভাইয়ের খুনিকে নিজের হাতে মারবে। ওকে খুব ভালো করে জানতাম। ও ওর প্রতিজ্ঞা পূরণ করবে। তাই করছিল কিন্তু মাঝখান থেকে সব বিগড়ে দিল। তাই আজ ওকেও রাস্তা থেকে সরিয়ে দেব আর তোকেও। আমার জন্য কেউ বাঁধা সৃষ্টি করতে পারবে না। তোদের দুজনকে কেউ আমার হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। কেউ না। কেউ জানতে পারবে না সাজ্জাদ চৌধুরীর রহস্য, কেউ জানতে পারবে না তোদের রহস্য।”
রুশার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। কত সহজে নিজের আপন ভাইকে মারার ঘটনা বলছে। কত সহজে নিজের বোনকে মেরে ফেলার কথা বলছে। ওর মরে যেতে ইচ্ছে করছে।

কেউ সজোরে শানের মাথায় মোটা লাঠি দিয়ে আঘাত করে। শানের হাত থেকে রিভলবার পড়ে যায়। লুটিয়ে পড়ে মাটিতে। রুশা ছাড়া পেয়েও সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেজান সামনে এসে দাঁড়ায়। আর সেই লোক যে শানের মাথায় আঘাত করেছে।
আদ্রিশ সেজানের দিকে চেয়ে বলল,
“রেকর্ডিং কমপ্লিট?”

“ইয়েস ডান।”
শান হাত বাড়িয়ে রিভলবার ধরার চেষ্টা করছে। আদ্রিশ চিৎকার করে রুশাকে ডাকল।
“রুশা, শানকে আটকাও।”
রুশা শানের দিকে ঘুরে চেয়ে দেখে ও হাত বাড়িয়ে রিভলবার ধরার চেষ্টা করছে। রুশা এক পা আগাতেই শান রিভলবার ধরে ফেলে। আদ্রিশ কোন উপায় না পেয়ে ওর হাতে গুলি করল। হাত থেকে রিভলবার ছিটকে সরে যায় আর শান চেঁচিয়ে উঠে ব্যথায়। রুশা পা দিয়ে রিভলবার দূরে সরিয়ে দেয়। রুশা আদ্রিশকে গুলি করতে না করল। রুশা দৌড়ে গিয়ে আদ্রিশের হাত থেকে রিভলবার কেড়ে নেয়।
আদ্রিশ কিছুই বুঝতে পারছে না রুশা কি চাইছে। রাগ হচ্ছে ওর রুশার প্রতি।

শান রক্তেমাখা হাত চেপে ধরে আকুতি মিনতি করছে।
“পিউ, আমি তোর ভাই। আমি ছাড়া তোর আর কেউ নেই। এই আদ্রিশ তোকে ছাড়বে না। মেরে ফেলবে। তারচেয়ে আমার সঙ্গ দে। আমাকে ওর হাত থেকে বাঁচিয়ে নে। দুই ভাইবোন মিলে বিদেশে চলে যাব। সেখানে নতুন করে জীবন শুরু করব। আদ্রিশকে মেরে ফেল।”

রুশা লাল টকটকে চোখে তাকাল। ওর চোখ লাল হওয়ার সাথে সাথে ছলছল করছে। ওকে ভয়ংকর লাগছে। খোলা চুলগুলো উড়ছে। মনে হচ্ছে ভয়ানক প্রতিশোধ নিতে উদ্বত হয়েছে। রুদ্রাণী রুপ নিয়ে রিভলবার উঁচু করে শানের দিকে ধরল।
তারপর শক্ত কন্ঠে বলল,
“বলেছিলাম না সাজ্জাদ ভাই আমার প্রান ছিল। বলেছিলাম না তার জন্য আমি সব করতে পারি? বলেছিলাম না তার খুনিকে আমি ছাড়ব না? বলেছিলাম না নিজ হাতে তাকে হত্যা করব? প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আর তুমি তো জানো আমি প্রতিজ্ঞা পূরণ করি যেকোনো মূল্যে। এট এনি কস্ট। তাই করছি।”

রুশা এক সাথে তিনটা গুলি ছুড়ল শানের দিকে। শান ছটফট করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। রুশা ধপ করে বসে পড়ল। কেমন পাথর হয়ে গেছে। সবাই ওর কাজ দেখে হতবাক। আদ্রিশ বুঝতে পারেনি রুশা এমন কিছু করবে।
রুশা এহেন অবস্থা দেখে প্রশ্ন করল,
“রুশা, তুমি ঠিক আছো?”

“প্রতিশোধ নিয়েছি আমি। আমার ভাইয়ের খুনের প্রতিশোধ নিয়েছি।”

আদ্রিশ কিছু ভেবে উঠে গিয়ে পকেট থেকে রুমাল বের করে শানের পিস্তল তুলে নিজের হাতে একটা গুলি করল। সেজানসহ সবাই কেঁপে উঠল।
সেজান দৌড়ে গিয়ে বলল,
“ভাই এটা কী করলেন?”

আদ্রিশ ব্যথায় কুকড়াতে কুকড়াতে বলল,
“ঠিক আছি। ভিডিও তো আছেই স্বীকারোক্তির। আমি চাই শানের অপরাধ আইনের সম্মুখে আসুক। কেসটা এমন ভাবে সাজাতে হবে যাতে রুশার শাস্তি না হয়। শান রুশাকে মারতে চেয়েছে তাই আমি শানের হাতে গুলি করেছি। শান আমাকে আর রুশাকে মারতে চেয়েছে তাই রুশা নিজেদের বাঁচানোর জন্য ওকে গুলি করেছে। আমাকে শান একটা গুলিও করেছে ওর রিভলবার দিয়ে। এমনিতেই শান ফাঁসির আসামী হত। শহরের সবচেয়ে বড় ল-ইয়ার হাইয়ার করো। রুশার যেন কিছু না-হয়। আর পুলিশকে কল করো। এখান থেকে গার্ডদের সরিয়ে দেও।”
আদ্রিশ রুমাল দিয়ে নিজের হাত চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছে। রুশা নিস্তেজ হয়ে আছে। নীরবে চোখের পানি ফেলছে। সেজান, শানের লাশের দিকে একবার চেয়ে পুলিশকে কল করছে।

চলছে……