লাভ গেম পর্ব-৩৮ এবং শেষ পর্ব

0
1300

#লাভ_গেম
#ফাবিহা_নওশীন

৩৮(শেষ)

রুশা সোফার উপরে ফেলে রাখা আদ্রিশের জামাকাপড় ভাজ করছে। আদ্রিশ অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকেছে। ও শাওয়ার নিচ্ছে। রুশা বিরক্তি নিয়ে জামাকাপড় জায়গা মতো রাখছে। হঠাৎ শার্টের হাতার দিকে চোখ আঁটকে যায়। রুশা শার্টটা কুঁচকে
হাতে নিয়ে বড় করে শ্বাস নিল। কপাল থেকে ঘাম মুছল। একটা অস্থিরতা ওকে ঘিরে রেখেছে। আবারও শুরু হয়েছে নতুন লড়াই। রুশা এ লড়াইটাও লড়বে এবং জিতবে। নিজের জন্য না হলেও ছেলের জন্য লড়বে।
ওর সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য লড়বে।
আদ্রিশ তোয়ালে পেঁচিয়ে শাওয়ার নিয়ে বের হলো। রুশা ওর দিকে অস্থিরতা নিয়ে চেয়ে আছে। আদ্রিশ চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে যাওয়ার জন্য কয়েক পা বাড়ালেই রুশার দিকে চোখ পড়ল। রুশার দৃষ্টিতে প্রশ্ন, ভয়, অস্থিরতা।

আদ্রিশ রুশার কাছে গিয়ে বলল,
“কী হয়েছে? এভাবে চেয়ে কী দেখছো? কোন সমস্যা?”

রুশা হাতের শার্টটা আদ্রিশের চোখের সামনে মেলে ধরল। সাদা শার্টে ছিপছিপ রক্তের দাগ।আদ্রিশ সেদিকে একবার চেয়ে রুশার দিকে তাকাল। রুশা এতটা অবাক হচ্ছে কেন সেটা বুঝতে পারছে না। এ তো নতুন কিছু না। আদ্রিশ কোন ভাবাবেগ প্রকাশ না করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

রুশা শার্টটা ছুড়ে ফেলে আদ্রিশের সামনে গিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখাচ্ছো কেন? আর তোমার শার্টে রক্ত কেন?”

আদ্রিশ মুচকি হেসে রুশার দুবাহু ধরে বলল,
“তুমি এমন ভাব করছো যেন আমার সাথে রক্তের দাগের কোন সম্পর্ক নেই। এমন অনেক দাগ আগেও দেখেছো।”

“হ্যা দেখেছি কিন্তু আগে বিষয়টি অন্যরকম ছিল। আমি ভেবেছিলাম তুমি শুধরে গেছো। ভালো হয়ে গেছো। খুন খারাবি ছেড়ে দিয়েছো। কিন্তু না.. তোমার শার্টে রক্তের দাগ।”

“রুশা, আমি যেমন ছিলাম তেমন থাকব। এই লোকটা আমার সাথে চিট করেছে। আর তুমি জানো চিট করার শাস্তি কী।”

রুশা আকুতি নিয়ে বলল,
“আদ্রিশ প্লিজ, এসব ছেড়ে দেও। স্বাভাবিক জীবনযাপন করো। কিছুদিন আগে তুমিই তো আমাকে বোঝাচ্ছিলে সব ভুলে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে আর্দ্রের জন্য। আর্দ্র কি এই রক্ত, রিভলবার, খুন, উদ্ধততা, বিভৎসতার, অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতার সাথে বড় হবে? এমন অস্বাভাবিক জীবন যাপন করবে? ওর কথা ভাবো। ওর কথা ভেবে আমি আমার রিভলবার ফেলে দিয়েছি আর প্রতিজ্ঞা করেছি আর্দ্রকে এসবের সংস্পর্শে আনব না। ও জানবে না ওর বাবা আর মায়ের অতীত। আদ্রিশ প্লিজ, আমার জন্য না হোক, আর্দ্রের জন্য। ওকে তো তুমি খুব ভালোবাসো।”

“দেখো, রুশা ভালো আমি তোমাদের দু’জনকেই বাসি। তোমাদের জন্য সব বাজি রাখতে পারি কিন্তু এই কাজটা আমার পক্ষে ছাড়া সম্ভব না। আর্দ্র এসব কখনো জানবে না, আমি জানতে দেব না। ও আর দশটা বাচ্চার মতো স্বাভাবিকভাবেই বড় হবে। কেউ ওর দিকে আঙুল তুলবে না। ওর বাবাকে সবাই যেমন সম্মানের চোখে দেখে তেমনি ওকেও দেখবে।”

“আদ্রিশ, সত্য কখনো চাপা থাকে না। একদিন সত্য তার নিজ গুনেই প্রকাশিত হবে। তোমাকে বিশ্বাস করে ভালোবেসে বড় হওয়ার পর যখন ওর সামনে সত্যটা আসবে, নিজেকে সামলাতে পারবে? তোমাকে ঘৃণা করবে না? তোমার, আমার প্রতি ওর বিশ্বাস, ভরসা থাকবে? ভেঙে পড়বে না? যেমন শান ভাইয়ার সত্যিটা জানার পর আমি ভেঙে পড়েছিলাম, আঘাত পেয়েছিলাম, অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। আদ্রিশ একটু ভেবে দেখো।”

“রুশা, আমি বুঝতে পারছি। আগে না পারলেও এখন আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি। কিন্তু আমার জন্য এত সহজ হবে না। প্রতারক, লোভী, চরিত্রহীন মানুষ দেখলে আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। আমি নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না।”
আদ্রিশ অস্থির হয়ে পড়ছে। বিছানায় বসে পড়ল। চাদর খাঁমচে ধরে মেঝের দিকে চেয়ে রইল।

রুশা ওর পাশে বসে ওর বুকে হাত দিয়ে বলল,
“আমি আছি তো, আমি তোমাকে সাহায্য করব। সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে শুধু….

আদ্রিশ রুশাকে থেমে যেতে দেখে চোখ তুলে ওর দিকে চেয়ে কৌতূহল নিয়ে বলল,
” আমাকে কী?”

রুশা চোখ নামিয়ে নিল। তারপর আমতা আমতা করে বলল,
“আদ্রিশ, আমি তোমার ছোটবেলার রিপোর্ট দেখেছি। তুমি সুস্থ, স্বাভাবিক নও। তাই সাইকোর মতো বিহেভিয়ার করো। তোমাকে ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্টের…. ”

আদ্রিশ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর রাগান্বিত কন্ঠে বলল,
“ইউ মিন আ’ম ম্যাড?”

রুশাও বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর ওকে মানানোর জন্য বলল,
“তুমি এডুকেটেড ছেলে। সাইকিয়াট্রিস্ট কেন প্রয়োজন হয় তুমি ভালো করেই জানো। পাগল শব্দটা ব্যবহার না করলেই পারো। মানুষ যেমন শারিরীক ভাবে অসুস্থ হয় তেমনি মানসিক ভাবেও অসুস্থ হয়। কিছুদিন আগে আমিও হয়েছিলাম। ট্রিটমেন্ট করেছি। হ্যা কারো কম সমস্যা হয়, কারো বেশি। আমার কথাগুলো ভেবে দেখো। এখন চেঞ্জ করে নেও। আমি আর্দ্রের কাছে যাচ্ছি।”
রুশা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আদ্রিশ পলকহীনভাবে কিছু ভেবে চলেছে।

রুশা আর্দ্রকে কোলে নিয়ে আদর করছে আর কথা বলছে৷
“আমার সোনা বাবাটা, বড় হয়ে কী হবে তুমি?”

মিজান চাচা বলল,
“বাবার মতো বড় ব্যবসায়ী হবে। পুরো দুনিয়ায় ওর নাম ডাক থাকবে।”

“না চাচা, ও আগে মানুষের মতো মানুষ হবে। বড় ব্যবসায়ীর চেয়ে সত্যিকারের মানুষ হওয়াটা জরুরি। আর ও কারো মতো হবে না। ও ওর মতো হবে। আর্দ্রকে আমি প্রকৃত মানুষ করতে চাই। সবাই যেন ওকে দেখে বলে ছেলেটা এক পিচ।”

‘হ্যা, তা তো অবশ্যই। অনেক দোয়া করি। মানুষ হও।”

“হ্যা চাচা, দোয়া করবেন ওর জন্য। বড়দের দোয়াও প্রয়োজন। দোয়া মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে।”

“তোমরা ছাড়া আমার আর কে আছে? আদ্রিশ, তুমি আর আর্দ্র ভাই তোমরাই আমার পরিবার। তোমাদের জন্য সব সময় দোয়া করি।”

আদ্রিশ চেঞ্জ করে নিচে নেমে ওদের কথা শুনে ওদের দিকে এগিয়ে এল। আর্দ্রকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু খেল।

.

ডিনার শেষে আদ্রিশ শুয়ে শুয়ে কিছু ভাবছে আর আর্দ্রের দিকে তাকাচ্ছে। রুশা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। আদ্রিশ কী ভাবছে তা ওর অজানা নয়। রুশা শুধু মনে মনে বলছে আদ্রিশের সুবুদ্ধি হলেই হয়। রুশা ওর সাথে এ নিয়ে আর কথা বলতে চায় না। ও চায় আদ্রিশ নিজেকে সময় দিক, নিজেই সিদ্ধান্ত নিক। তাই কিছু না বলে মুচকি হেসে শুয়ে পড়ল। আদ্রিশের সারারাত ঘুম হয়নি। এটা সেটা অনেক কিছু ভেবেছে। সকাল বেলায় নাস্তা করে বের হওয়ার সময় রুশাকে বলল,
“আমি রাজি। বেষ্ট সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে এপয়েন্টমেন্ট নিয়েছি। অফিস শেষে পাঁচটায় যাব। তুমি রেডি থেকো।”

রুশা ওর কথা শুনে উৎফুল্ল হয়ে পড়ল। খুশিতে গদগদ করতে করতে স্থান,কাল ভুলে ওর গালে চুমু খেয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ! আমার কী যে খুশি লাগছে। আমি জানতান তুমি রাজি হবে। আমার বিশ্বাস ছিল তোমার উপর।”

আদ্রিশ ওকে ছাড়িয়ে মুচকি হেসে বলল,
“রেডি থেকো।”

আদ্রিশ রেগুলার ট্রিটমেন্ট নিচ্ছে। আগের চেয়ে অনেকটাই সুস্থ। অনেক পরিবর্তন এসেছে ওর মধ্যে। এখন সব সময় হাসিখুশি থাকে। অযথা রাগারাগি করে না। রুশা খুব খুশি।

শীত যাই যাই করছে। সকালের কাঁচা রোদে বাগানে পিকনিকের আয়োজন করেছে। কথা, সেজান আর আশ্রমের কিছু বাচ্চারা এসেছে। আর্দ্র সেজানের কোলে। রুশা আর কথা হাতে হাত লাগিয়ে কাজ করছে। আদ্রিশ এখনো আসেনি। বাচ্চাদের এই পিকনিক পিকনিক খেলায় ওর আসার ইচ্ছে নেই। অফিসের কাজ করছে। রুশা আদ্রিশের নাম্বারে বারবার মেসেজ করছে। কিন্তু আদ্রিশ তবুও আসছে না। রুশা ওদের রুমের বারান্দার দিকে তাকাল। তারপর একটা মেসেজ লিখল।
“তুমি যদি না আসো তবে আমি বাইরে থেকে হাসব্যান্ড ভাড়া করে আনব। আই মিন ইট। দশ মিনিটের মধ্যে নিচে আসবে।”

রুশা পকেটে মোবাইল রেখে আবারও বারান্দার দিকে তাকাল। তারপর নিজের কাজে মনোযোগ দিল। আদ্রিশ রুশার মেসেজ দেখে হেসেই যাচ্ছে। রুশা বদলালো না। কথায় কথায় হুমকি দেয়। এখন হাসব্যান্ড ভাড়া করে আনার হুমকি দিচ্ছে। আবার বলছে দশ মিনিটের মধ্যে যেতে। আদ্রিশ ডান হাতের আঙুল দিয়ে চুলে আলতো ব্রাশ করতে করতে ল্যাপটপ রেখে উঠে দাঁড়াল। তখনও ওর মুখে হাসি। এখন যদি নিচে না যায় তবে রুশা তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিবে।

রুশা আর কথা টেবিলের উপরে খাবার সাজিয়ে রাখছে। রুশা বারবার মেইন ডোরের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু আদ্রিশের খবর নেই। রুশা সেজানের কোল থেকে আর্দ্রকে নিয়ে চেয়ার টেনে বসল। ওর মেজাজ উনপঞ্চাশ হয়ে গেছে।
কিছুক্ষণ পরেই আদ্রিশ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। ওর মুখে হাসি। রুশা আদ্রিশকে আসতে দেখে মনে মনে বেশ খুশি হলো কিন্তু প্রকাশ করতে চাইছে না। কিন্তু ওর খুশি মুখে ছড়িয়ে পড়ল। আদ্রিশ রুশার সামনে এসে বাকা হেসে ওর দিকে তাকাল। চোখে চোখ পড়তেই রুশাও হেসে ফেলল। আদ্রিশ, আর্দ্রকে কোলে নিয়ে আবারও চুমু খেল।

সেজান বাচ্চাদের নিয়ে এল। ওরা সবাই এক সাথে বসে পিকনিক নামক সকালের নাস্তা করছে। স্বচ্ছ, স্নিগ্ধ, মিষ্টি রোদ বাড়ছে। ঝলমলে রোদ্দুর্র চিরে সুখ উপচে পড়ছে। লাভ গেমের দুটো গুটি দুই পক্ষের হয়ে খেললেও এক সময় তারা একে অপরের সুতোয় বাঁধা পড়ে এক হয়ে গেছে।

~সমাপ্ত~