শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-০৫

0
579

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ০৫
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

” এইযে ময়ূরের পালক।কোন দেশের রাজপুত্রের চিন্তায় এতোটা বিভোর হয়ে আছেন?”

খানিকটা পরিচিত কন্ঠ শুনে পালক অতীতের স্মৃতি থেকে ফিরে এলো।বাম হাত দিয়ে চোখে জল মুছে ঘাড় বাঁকিয়ে দেখলো রাদ তার পাশে।আজকেও সে হুইলচেয়ারে বসে আছে।রাদকে এভাবে হুইলচেয়ারে বসে থাকতে দেখলে পালকের কেন যেন খারাপ লাগে।

” আপনি আজকেও একা একা বেরিয়েছেন?কিছুদিন আগেই না কত বড় বিপদে পড়েছিলেন।কাউকে সাথে নিয়ে বের হলে কি হতো?” খানিকটা রাগ নিয়ে বললো পালক।

” আরে পালক সাহেবা এতো রেগে যাচ্ছেন কেন?রেগে গেলে আপনাকে অদ্ভুত লাগে দেখতে।আর আমি একা আসিনি।আমার এসিস্ট্যান্ট কম বন্ধু মুলা থুরি ইয়াসিনও এসেছে আমার সাথে।জানেন আপনাকে আমি কতবার ডেকেছি।কিন্তু আপনি তো অন্যগ্রহের এলিয়েনের চিন্তায় বিভোর ছিলেন।আমার গলা ব্যথা করছে আপনাকে ডাকতে ডাকতে।এখন আমার কন্ঠ যদি রাগ করে আমাকে ছেড়ে অন্যকারো গলার সাথে রিলেশনশীপে চলে যায় তখন কি হবে?আমাকে কি আপনি নতুন কোন কন্ঠ এনে দিতে পারবেন?কন্ঠের শোকে আমার গলাটা যদি কান্না করতে করতে বেহুশ হয়ে যায় তখন তার দায় ভার কে নেবে কবুতরের পালক?” হতাশার সুরে বললো রাদ।রাদের এইধরনের ভীতিহীন কথা শুনে পালকের কপাল কুঁচকে গেলো।মনে মনে সে নিজেকেই বললো,

” ইনি নাকি একটা কোম্পানির মালিক?অন্যকেউ এসব কথা শুনে নিশ্চয়ই বলবে পা’ব’নার মে’ন্টা’ল হসপিটাল থেকে পালানো পে’শে’ন্ট।”

” কি হলো পালকসাহেবা?কিছু বলছেন না কেন?নাকি আপনার কন্ঠও আপনার সাথে ব্রেকআপ করে চলে গিয়েছে?”

” আমি এখানে কেন এসেছেন?” প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য জিজ্ঞেস করলো পালক।

” ঘুরতে এসেছি।” ছোট বাচ্চাদের মতো হেসে জবাব দিলো রাদ। “আসলে কি বলুন তো সারাদিন অফিসে একজায়গায় বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগে না।বাসায় গেলেও বোরিং লাগে,বের হতেও দেয়না।আমি তো আর নিজের পায়ে হাঁটতে পারিনা তাই সবসময় আমার সাথে কেউ না কেউ থাকে।তারউপর ভরসা করে আমার চলতে হয়।মাঝেমাঝে ভালো লাগেনা অন্যের উপর ভর করে চলতে তাই সবসময় এই হুইলচেয়ারেই বসে থাকি।” কষ্ট হলেও মুখে হাসি নিয়ে কথাগুলো বললো রাদ।রাদের কথায় পালকের মন খারাপ হয়ে গেলো।নিজের অজান্তেই পালক বলে বসলো,

” আমার সাথে পার্কে ঘুরবেন?” এহেন কথা বলায় পালক নিজেও অবাক হলো বটে তবে রাদের মুখে হাসি দেখে কিছু বললো না।

” অবশ্যই।চলুন আজ আপনি আর আমি মিলে পার্কটা ঘুরি।” কথাটা বলেই রাদ একটা বোতাম চাপ দিলো এবং তার হুইলচেয়ারটা খানিকটা এগিয়ে গেলো।এতে পালক খানিকটা চমকে গেলে।

” আমার হুইলচেয়ারটা স্পেশালি বানানো।এটা রিমোট দিয়েও নিয়ন্ত্রণ করা যায়।চলুন এবার পার্কটা ঘুরে দেখি।”

রাদের পাশে পাশে হাঁটছে পালক।রাদের মুখ থেকে যেন হাসি সরছে না।অনেক কথা বলছে সে,যেন অনেকদিন পর মন খু্লে কারো সাথে কথা বলতে পারছে।পালক চুপচাপ শুনছে,মাঝেমাঝে উওর দিচ্ছে।আশেপাশের মানুষরা অদ্ভুতদৃষ্টিতে তাদের দেখছে বিশেষ করে রাদকে।পালকের এতে কিছুটা অস্বস্তি লাগলেও রাদ একদম স্বাভাবিক ভাবেই কথা বলে যাচ্ছে।

হাঁটতে হাঁটতে তারা দু’জন অনেক কথা বলেছে।আস্তে আস্তে সন্ধ্যাও হয়ে আসছে।এরই মাঝে তাদের সামনে ইয়াসিন এসে উপস্থিত হলো।তাকে দেখে পালক কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলো বটে কারণ ইয়াসিনকে সে মাত্র দু’বার দেখেছে।

” আরে আমার মুলা বাবু যে।এতোক্ষণে তোমার আসার সময় হলো।তা কোন চি’পায় গিয়ে গার্লফ্রেন্ড এর সঙ্গে প্রেম করছিলে শুনি?”

” ধুর স্যার কি বলেন এসব।” খানিকটা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বললো ইয়াসিন। ” আমি এই ইয়াসিন হচ্ছি সিঙ্গেল কমিউনিটির একশতম সদস্য।আর একজন কমিটির বিশ্বস্ত সদস্য হিসেবে আমি কি করে নিয়ম ভঙ্গ করে মিঙ্গেল হতে পারি।”

” হুম বুঝতে পেরেছি।আমার মুলা সিঙ্গেল কমিউনিটির একজন বিশ্বস্ত সদস্য।তো মুলা ইনি হচ্ছেন পালকসাহেবা।আর পালকসাহেবা ইনি কে সেটা তো আপনি জানেনই।”

পালক এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই স্যার এসিস্ট্যান্ট এর কীর্তিকলাপ দেখছিলো।মনে মনে সে আবারো বললো,

” স্যার যেমন,তার এসিস্ট্যান্টও তেমন পাবন থেকে পালানো পা’গ’ল।এদের একটা ইউটিউব চ্যানেল খুলে দেওয়া দরকার।তাহলে বাড়তি একটা ইনকাম হতো।”

” কিগো পালক সাহেবা আবারো কোন এলিয়েন এর সাথে ডেটে গেলেন?”

” আমি এখন আসি,কেমন?সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।বাসায় মা চিন্তা করবে।সাবধানে যাবেন।”

” আশা ঠিক আছে।আপনিও সাবধানে যাবেন।আপনার সাথে সময় কাটিয়ে ভালো লাগলো।অনেকদিন পর কারো সাথে মন খুলে কথা বললাম।ধন্যবাদ আমাকে এতো সুন্দর একটা বিকেল উপহার দেওয়ার জন্য।” এবার রাদ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো।পালক মাথা নাড়িয়ে হেসে তাদের থেকে বিদায় নিলো।

” মুলা চলো এবার আমারও প্রস্থান করি।অনেক কাজ বাকি।অনেক হিসেবে মিলাতে হবে।চলো চলো।” তাড়া দেওয়ার ভঙ্গিতে রাদ ইয়াসিনকে বললো।

অন্যদিকে,

সকালে টিউশন থেকে বাড়ি ফেরার পথে পালক মোটামুটি দামের কিছু মিষ্টি নিয়ে এসেছে প্রতিবেশীদের দেওয়া জন্য।দু’বোন বাইরে চলে যাওয়ার পর অনিলা বেগম সবাইকে মিষ্টি দিতে লাগলেন।একটা বাটিতে কয়েকটা মিষ্টি নিয়ে উপরের তলায় এসেছেন এখন তিনি।মহিলাটি ওনাকে দেখে বড় একটা হাসি দিলেন।জোড় করে ওনাকে ভিতরে নিয়ে বসালেন।

বাটি ফেরত দিতে দিতে মহিলাটি বললেন, ” তা ভাবী আপনার বড় মেয়ে তো দেখি খুবই সাহসী।কোন ছেলেও তো এতো দুঃসাহস দেখায় না।”

” কিছু কি হয়েছে ভাবী?হঠাৎ এধরণের কথা বলছেন যে?”

মহিলাটি অবাক হওয়ার ভঙ্গিমাতে বললেন,” সেকি ভাবী আপনি জানেন না?এই মিলি তোর ফোনে পালকের ভিডিওটা তাড়াতাড়ি বের করতো।ভাবীকে দেখা সেটা।”

মিলি দৌড়ে গিয়ে ফোনটা নিয়ে এলো।তারপর কিছু একটা বের করে অনিলা বেগম এর সামনে ধরলো।এটা আগের দিনের ঘটনার ভিডিও।মহিলাটি মনে করেছেন এটা দেখে অনিলা শেখ অবাক হবেন কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া একদম স্বাভাবিক।ভিডিও শেষ হতেই তিনি মোবাইলটা মিলিকে ফেরত দিয়ে দিলেন।

” দেখলেন তো ভাবী আপনার বড় মেয়ের কান্ড!কত বড় সাহস তার।ভাবী আপনার মেয়ে কিন্তু হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে।মেয়েকে হাতে রাখুন নয়তো কোনদিন জানি লাগাম ছুটে যায়।তাই বলছি কি তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিন।এমনিতেও বাবা হারা মেয়ে,বয়সও তো কম হলো না।আর কতদিন ঘরে বসিয়ে রাখবেন।সময় এখনো আছে,বিয়ে দিয়ে দিন।নয়তো পরে কোন বুড়ো বাবার বয়সী ছেলেকে না বিয়ে করতে হয়।” অনেকটা ব্যঙ্গ স্বরে বললেন মহিলাটি।

” ভাবী আমার মেয়ে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী।সে যেই কাজ করে ভেবে চিন্তেই করে।নিজের ভালো বোঝার বয়স,বুদ্ধি দুটোই তার হয়েছে।বিয়ে করার বিষয়টা নাহয় তার উপরই ছেড়ে দি।আর প্রিসা কখনো অন্যায় সহ্য করতে পারে না,একদম তার বাবার মতো।আপনি বরং মিলিকে একটু নজরে রাখুন ভাবী।এখনো স্কুলে পড়ে,একটু সাবধানে রাখবেন।আসি আজ তাহলে,পড়ে নাহয় আবার আসবো।”

হাসিমুখে বেরিয়ে এলেন অনিলা বেগম।প্রিসা কালকেই ওনাকে এসব বলেছে।প্রথমে তিনিও একটু বকেছিলেন তবে মনে মনে তিনি প্রিসার কাজে গর্ববোধ করেন।
____________________________________________

আজ মাসের প্রথমদিন।পালকও আজ প্রথমবার অফিসে যাবে।সবার থেকে ভালোভাবে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে সে।প্রথমদিন তাই রিকশা নিয়ে এসেছে যেন দেরি না হয়।ভেতরে সে রিসেপশনিস্ট থেকে জিজ্ঞেস করে নিলো তার ডেস্ক কোনটি।মেয়েটি নম্রভাবে তাকে তার ডেস্ক নম্বর বলে দিলো।সেইসাথে এটাও বললো আগে ম্যানেজার এর সাথে দেখা করে আসতে,তিনি নতুনদের সাথে কথা বলবেন।

রিসেপশনিস্টের দেখানো কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে পালক।মনকে শান্ত করে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো সে।রাদ প্রথমদিনই বলেছিলো সে নিজের যোগ্যতায় চাকরিটা পেয়েছে নাকি সাহায্য করার কারণে।পালকের মনে একটু একটু সন্দেহ বা অস্বস্তি থাকলেও এখন আর তা নেই।কারণ তার সাথে আরো চারজনকে নেওয়া হয়েছে।সে সহ তিনজন মেয়ে,দু’জন ছেলে।পালক প্রবেশ করার পর সবাই একপলক তার দিকে তাকিয়ে আবারো নিজেদের ফোন বা ল্যাপটপ দেখায় মনোযোগ দিলো।বাকি চারজনই একদম টিপটপভাবে তৈরি হয়ে এসে।সবাই শার্ট,জিন্স পড়ে একদম ফর্মাল লুকে এসেছে।তাদের মাঝে পালকের নিজেকে একদম বেমানান মনে হলো কারণ সে একটা কালো রঙের থ্রী-পিস পড়ে এসেছে।তবে ক্ষাণিকবাদেই সে নিজেকে ধ’ম’ক দিলো।

” ছিঃ পালক এসব কোন ধরণের ভাবনা।তারা ফর্মাল ড্রেসে এসেছে বলে কি তোকেও আসতে হবে?তাদের সামর্থ আছে তাই তারা এসেছে।সার্মথের বাইরে কোন কিছু করা ঠিক নয়।এমনতো নয় যে তোর ড্রেসটা খারাপ।তাই নিজেকে ছোট করে দেখার কোন কারণ নেই।”

কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার এসে তাদের সবাইকে তাদের কাজ এবং বিভিন্ন নিয়ম বুঝিয়ে দিলেন।

কেবিন থেকে বের হয়ে পালক রাদের কেবিনের উদ্দেশ্য পা বাড়ালো।শেষবার যখন পার্কে দেখা হয়েছিলো তখন রাদ তাকে বেশ কয়েকবার বলেছিলো অফিসে এসে যেন তার সাথে দেখা করে।যার জন্যই পালকের যাওয়া।

কথায় আছে “ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না।” বর্তমানে এই প্রবাদ বাক্যটাই পালকের মনে পড়ছে।না বলে দরজা খুললে যে সে এরকম কিছু দেখবে সেটা পালক মোটেও আশা করেনি।

” এটা কি অফিস নাকি বাসা?কি করছেন ওনারা এসব!”

চলবে…….

(ভুলক্রটি ক্ষমা করবেন।গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি।)