শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-৩১ এবং শেষ পর্ব

0
672

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ৩১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

প্রকৃতি আজ হয়তো রু’ষ্ট আবার হয়তো তার মনে আজ অনেক কষ্ট যা বর্ষণ রুপে পৃথিবীতে নেমে আসছে।বারি,গুমোট একটা পরিবেশ,এই পরিবেশটাকে আরো বারি করে তুলছে একজন নারীর আ’র্ত’নাদ,একজন স্ত্রীর আ’র্তনা’দ।যিনি তার স্বামীর শো’কে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন।তিনি আর কেউ নন রাদের একমাত্র ফুপি নূরজাহান রহমান।উনার মুখ থেকে শুধু একটাই বাক্য শোনা যাচ্ছে,

” রাদরে আমার স্বামীকে তুই ফিরিয়ে দে।মানুষটাকে তুই ফিরে নিয়ে আয়।মানুষটা অনেক ভালো মনের,সে কখনোই রকম করতে পারেনা।ও জামাই তুমিও একটু দেখো,তোমার এই আরেক মা তোমার কাছে ভি’ক্ষে চাইছে।আমার স্বামীকে তোমরা ফিরিয়ে দাও।” নূরজাহান বেগমের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে এলো।আবারো জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে ঢলে পড়লেন তিনি।পালক আবারো দৌড়ে গেলো পানি আনতে।আয়না মায়ের পাশে বসে হাত পাখা দিয়ে বাতাস করছে।নূরজাহান বেগমের এই আহাজারির কারণ আদিব সাহেবকে বিকেল বেলা পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছে।উনার বিরুদ্ধে নাকি অনেক বড় বড় অভিযোগ আছে এবং পুলিশ নাকি পালানোর সময় ওনাকে এয়ারপোর্টে থেকে আটক করেছেন।এই খবরটা জানার পর থেকেই নূরজাহান বেগমের আহা’জা’রি শুরু।

” রাদসাহেব কিছু করো।ফুফাকে নিশ্চয়ই পুলিশ অন্যকেউ মনে করে ধরে নিয়ে গিয়েছে।ইয়াসিন ভাই তুমিও একটু দেখো।”

” হুম পালকসাহেবা দেখছি আমরা কি করা যায়।তোমরা দু’জন ফুপির খেয়াল রেখো।আমরা উকিলের সাথে কথা বলে আসছি।”

রাদ এবং ইয়াসিন দ্রুত বেড়িয়ে গেলো।

রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা।সবাই দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে পুলিশ স্টেশনে ঢুকলো।নূরজাহান বেগম দ্রুত গতিতে আদিব সাহেবের সেলের কাছে গেলেন।উকিল পুলিশের সাথে আলাদাভাবে কিছু কথা বললো যা মেয়েরা কেউ জানেনা।কিছুক্ষণ পর পুলিশ সেলের কাছে এলেন তবে ছেড়ে দিলেন না।বলেছে কাল সকালে আসতে,সকালে সবকিছু দেখবে এখন যেন তারা চলে যায়।সবাই অনেক মিনতি করলো কিন্তু পুলিশ কঠোরভাবে বলে দিয়েছেন এখন কিছু করা সম্ভব নয়,সকালে যেন তারা আসে।আশাহত হলো সবাই,নূরজাহান বেগম কিছুতেই আসতে চাইছিলেন না।অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে উনাকে গাড়িতে উঠাতে সক্ষম হয়েছে তারা।যাওয়া আগে রাদ একবার সেলের কাছে এলো।

” চিন্তা করোনা সবঠিক হবে।যে যেখানে থাকার সে সেখানেই থাকবে,শুধু একটু সময়ের অপেক্ষা।”

রাদ চলে গেলো,ইয়াসিনও যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো তবে একবার পেছন ফিরে শান্ত চোখে আদিব সাহেবের দিকে তাকালো সে।

সারারাত নূরজাহান বেগম ছোট বাচ্চাদের মতো অস্থির হয়ে প্রলাপ বকে গিয়েছেন।উনার অবস্থা দেখে সবার চিন্তা আরো বেড়ে গিয়েছে।ভালো করে ভোরের আলো ফুটে উঠতেই নূরজাহান বেগম পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার জন্য উতলা হয়ে পড়লো।সবাই কোনবতে মুখে কিছু দিয়ে বেড়িয়ে পড়লো।সবার মন উত্তেজিত,কেউ জানে না ভবিষ্যতে কি হতে পারে।

অনেক সময় পর পুলিশ আদিব সাহেবের সাথে দেখার করার সুযোগ করে দিলেন।নূরজাহান বেগমকে নিয়ে রাদ এসেছে কক্ষটার মধ্যে।স্বামীকে দেখে নূরজাহান বেগম ওনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেন,জরিয়ে ধরে আরো জোড়ে কান্না করতে লাগলেন তবে আদিব সাহেব নির্বাক।

” তুমি চিন্তা কারো না আদিব,তোমাকে আজকেই আমরা বাড়ি নিয়ে যাবো।রাদ আর ইয়াসিন ওরা তোমাকে নিশ্চয়ই ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে।আমি জানি তো পুলিশের কোন ভু’ল হচ্ছে।একবার তোমাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়,তারপর আমি পুলিশের বি’রু’দ্ধে পদক্ষেপ অবশ্যই নেবো।তুমি একদম চিন্তা করবে না।”

আদিব সাহেব কোন কথা বলছেন না দেখে রাদ এগিয়ে এলো।ওনার থেকে ছাড়িয়ে নিলো নূরজাহান বেগমকে।

” ফুপি চলো,আমরা বাইরে গিয়ে কথা বলি।”

বর্তমানে কেসের দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র পুলিশ তন্ময় পালের সামনে বসে আছে বাড়ির সবাই।নূরজাহান বেগম উনার উপর বেশ রুষ্ট।পুলিশ অফিসার গলা খাঁকারিয়ে তাদের দিকে মননিবেশ করলেন।

” তো আপনারা চান আমরা যেন আদিব শাহরিয়ারকে ছেড়ে দি।”

” অবশ্যই কারণ আমার স্বামী কোন কিছু করেননি।আপনারা আসল অপরাধীকে না পেয়ে আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে এসেছেন।যাতে তাড়াতাড়ি কেস ক্লোজ করতে পারেন।”

অজ্ঞাত কারণে হাসলেন অফিসার।

” দুঃখিত আমরা তাকে ছাড়তে পারবোনা কারণ আমাদের কাছে যথেষ্ট প্রমাণ আছে।সেইসাথে আমি শতভাগ বিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি প্রমাণগুলো আপনারা দেখলে আপনারাও ওনাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করবেন না বরং কেন এতো ছোটাছুটি করছেন তার জন্য আফসোস হবে।”

” কি যা তা বলছেন এসব?কি এমন প্রমাণ আছে আপনাদের কাছে?” চেঁচিয়ে বললেন নূরজাহান বেগম।আয়না ওনাকে শান্ত হয়ে বসতে বললো।তন্ময় পাল অন্যএকজন অফিসারকে ইশারা করে কিছু আনতে বললেন।অফিসারটা একটা ড্রয়ার থেকে কিছু ফাইল এবং একটা পেনড্রাইভ নিয়ে এলো।পেনড্রাইন ল্যাপটের সাথে সংযুক্ত করে তাদের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন তন্ময় পাল।সবার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছোট পর্দাটাতে।প্রথমে তাদের দৃষ্টি স্বাভাবিক থাকলেও কিছুক্ষণ পর হয়ে উঠলো অশান্ত,অবিশ্বাস্য ভাব ছেয়ে গেলো তাদের মুখমন্ডলে।নিঃশব্দে কান্না করছে পরিবারের প্রত্যেকটা মানুষ।তন্ময় পাল হতাশা ভরা নিঃশ্বাস নিলেন,খারাপ লাগছে ওনার।

কক্ষের ভিতরে আবারো প্রবেশ করলো সবাই।এবার পরিবারের সবাই একসাথে এসেছে।প্রথমবার নূরজাহান বেগম শো’কে ওনার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লেও এবার হলো বিপরীতটা।সজোরে অনেকগুলো থা’প্প’ড় মারলেন আদিব শাহরিয়ার মুখমণ্ডলে,রাগে ঘৃ’ণা’য় চো’য়া’ল শক্ত হয়ে গেলো ওনার।

” মানুষ ঠিকই বলে কু’কু’রের পে’টে কখনোই ঘি স’হ্য হবেনা।তোর ব্যপারটা হচ্ছেও তেমন।আমাদের স্ট্যাটাস এর সাথে তোর স্ট্যাটাস কোন কালেই মিলতোনা,নিম্ন মধ্যবিত্ত ছিলো তুই আর আমরা ছিলো উচ্চবিত্তের মধ্যম স্তরে।তারপরও আমার ভাই আমার দিকে তাকিয়ে তোকে মেনে নিয়েছিলো।তোকে শূণ্য থেকে নিজের রাজ্যে স্থান দিয়েছে।আমার সন্তান হচ্ছিলোনা,তখন কতই না ডিপ্রেশনে ছিলাম আমি,বাচ্চা হওয়ার পরেও কত ঝামেলার মধ্যে ছিলাম আমি।এই ভাই-ভাবী আমাকে আর আমার মেয়েটাকে আগলে রেখেছে।আমার ভাইয়ের মেয়ে রামিশা কত শ্রদ্ধা করতো তোকে,বিশ্বাস করতো তোকে কিন্তু তুই বেই’মা’নটা কি করলি লোভের পড়ে ধোঁ’কা দিলি।আমাদের সবাইকে ধোঁ’কা দিলি তুই।ঘর শক্র বিভীষণ এর মতো যার থালায় খেয়েছিস তার থালাই ফুটো করে দিয়েছিস।আমি ভাবতাম তুই মনে হয় কাজের জন্য বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকতি,পরিশ্রম করতি কিন্তু আমি তো ভুল ছিলাম।তুই তো অ’বৈ’ধ ওষুধের ব্যবস্থা করতি,নি’ষি’দ্ধ প’ল্লি’তে মেয়েদের পা’চা’র করতি।আমার ফুলের মতো ভাগ্নীটা তোকে বিশ্বাস করে তাকে দেওয়া কাজের কথা বলেছিলো কিন্তু তুই টাকার লোভে ওই শয়’তান’গুলোর সাথেই হাত মেলালি।আমার ভাইয়ের সম্পত্তিতে তোর নজর আছে জানলে তোকে লা’ত্থি মেরে আমার জীবন থেকে বের করে দিতাম।শেষে কিনা সম্পত্তি হাতানোর জন্য তুই তিনটে মানুষকে খু’ন করলি।উপরওয়ালার দয়া ছিলো বলে ছেলেটা বেঁচে গিয়েছে।আর কিছু না হক অন্তত রামিশার জন্যও তোর বুকটা কাঁপলো না,তোর একবারো মনে হলোনা তোরও একটা মেয়ে আছে।তুই মানুষ না,তোর মনে শয়’তা’ন বাস করছে।খু’ন করা যদি অপরাধ না হতো তবে আমি সেটাই করতাম।আমি পা’গ’ল এতোটা সময় একটা শয়’তা’নের জন্য কান্না করেছি।শোন আদিব শাহরিয়া আমি ভেঙে পড়বোনা,আর কেউ তোকে শাস্তি দিক না দিক আমি অবশ্যই দেবো।তোর বিরুদ্ধে আমি আরো কে’স করবো,ফাঁ’সি তোর হবেই।”

এতোটা সময় পর আয়না মুখ খুললো।ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বললো,

” আমি জানিনা আপনি এরকমটা কেন করেছেন তবে আফসোস হচ্ছে আপনি আমার জন্মদাতা পিতা।তবে আমি ভাগ্যবতী যে আপনার কোন স্বভাব আমার মধ্যে তৈরি হয়নি।আমার মামা-মামীর সুশিক্ষায় আমি বড় হয়েছি।এবার আমি বুঝতে পারছি কেন আপনি রাদ ভাইয়ার সাথে আমাকে বিয়ে দিতে চাইলেন এবং কেনই বা বারবার রাদ ভাইকে অফিসে যেতে বারণ করতেন।লোভ কখনোই মানুষের ভালো করেনা,লোভী মানুষদের গল্পের শেষটা কখনোই ভালো হয়না।”

” আয়না চলো,এই মানুষটার সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক নেই।সব সম্পর্ক আমি ছিন্ন করে দিয়েছি,কিছুদিনের মধ্যেই কাগজে-কলমেও সম্পর্কের ইতি টানবো।কোন খু’নির সাথে আমি সম্পর্ক রাখতে চাইনা।

আয়নাকে টেনে নিয়ে গেলেন নূরজাহান বেগম,তাদের পেছন পেছন পালক এবং ইয়াসিনও গেলো।তবে যাওয়ার আগে আদিব শাহরিয়ার দিকে তাকিয়ে ইয়াসিন হাসলো।

সবাই চলে যেতে রাদ চেয়ার টেনে বসলো।

” ফুফাজান না মিস্টার আদিব শাহরিয়ার কখনো হয়তো ভাবতে পারেননি ধরা পড়ে যাবেন।কিন্তু কষ্টের সাথে বলতে হচ্ছে আপনি ধরা পড়ে গিয়েছেন।আমি নিজের পায়ে হাঁটতে পারছি দেখে আপনি অনেক অবাক হয়েছেন কারণ এরকমটা হওয়ার তো কথা ছিলোনা বরং আমার পা আরো অ’কে’জো হয়ে যাওয়ার কথা ছিলো।আপনার হিসেব আমি মিলিয়ে দিচ্ছি।আমি শুরু থেকেই আপনার দেওয়া ডাক্তারের ওষুধ খাইনি।আমি শুধু নামে মাত্র সেই ডাক্তারের কাছে যেতাম।সবার অগোচরে আমি আর ইয়াসিন অন্য ডাক্তারের কাছে যেতাম,যার কারণেই আমি আজ সুস্থ।” রাদের কথা শুনে আদিব সাহেব চমকে উঠলেন।সে বোকা এতোদিন ভাবতো রাদ তার ডাক্তারের ওষুধ খাচ্ছে।কিন্তু সবার অগোচরে রাদ যে অন্য কিছু করছে সেটা কেউ টের পায়নি।তার এখন আফসোস হচ্ছে কেন মাহাবুব সিনহার কথা শুনলোনা।যদি ওনার সন্দেহের উপর বিশ্বাস করতো তাহলে জল এতোদূর আসতো না।আদিব শাহরিয়ার রাদের বলা একটা কথা মনে পড়ছে,

“আমার অভিনয় দেখে তুমি একদম অবাক হয়ে যেতে।নিজেকেই প্রশ্ন করতে,এটা কি আসেই রাদ?”

হ্যাঁ আদিব সাহেব আসলেই নিজেকে এই প্রশ্নটা করেছে।সাদাসিধে রাদ যে সবার দৃষ্টির আড়ালে অন্যকিছু করতে পারে সেটা তিনি ভাবতেও পারেননি।

” সেইদিনের ঘটনা আমি নিজের চোখে দেখেছিলাম যারকারণে আমার অনেকের উপর সন্দেহ হয়েছে।পুরোটা ঘটনা কি জানার জন্য আমি সন্ধানে করতে নেমে পড়লাম।সেইরাতে আমার মতো আমার বাবা-মা,মণি সবাই বেঁচে যেতো যদিনা দ্বিতীয়বার আরেকটা ট্রাক এসে গাড়িতে চাপা দিতো।আপনি সিসিটিভি ফুটেজটা ডিলেট করে দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু সাক্ষী নয়।আমার আপনার উপর তখন থেকে সন্দেহ হতে লাগলো যখন আপনি বারবার আমাকে ডাক্তারের কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলেন,অফিস যেতে বারণ করতেন।যেদিন জানতে পারলাম আয়নার সাথে বিয়ে দেওয়া বন্দবস্ত হচ্ছে তখনই আমি পালককে হুট করেই বিয়ে করে ফেলি যাতে কেউ কিছু করতে না পারে।দ্বিতীয়বার অন্য একট ট্রাক আপনার কথাতেই ধাক্কা দিয়েছে এটা আমি জানি।আমি সত্যিটা অনেক আগেই জানতে পেরে গিয়েছিলাম কিন্তু শক্ত কোন প্রমাণ জোগাড় করতে না পারার কারণে এতোদিন আপনাকে সহ্য করতে হয়েছে।আপনার সাথে কথা বলতেও আমার ঘৃ’ণা লাগতো।সম্পত্তির জন্য আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন কিন্তু আফসোস আমিই আপনার সব খেলা উল্টে দিলাম। আপনার সব কিছুর সমাপ্তি এখানেই মিস্টার আদিব শাহরিয়া।”

আদিব শাহরিয়ার কেসটা কোর্টে উঠেছে।অনেক ঝামেলা করে,শত প্রমাণ দেখিয়ে অনেক মাস পর অবশেষে আদিব শাহরিয়া সহ শাকিল হোসেন,কাদের আলী,তূর্য মিত্র এবং মাহাবুব সিনহাকে একজন সাংবাদিককে পরিবার সহ পরিকল্পনা করে মা’রা এবং বিভিন্ন অ’বৈ’ধ এবং অ’পক’র্ম করার কারণে তাদের ফাঁসির শাস্তি দেওয়া হয়েছে।বর্তমানে প্রতিটা নিউজ চ্যানেলের হেডলাইন এটি।

কোর্টের সময় শেষ হলে বেরিয়ে এলো সবাই।তাদের মনে যেমন রয়েছে প্রশান্তির ছোঁয়া তেমনি ছেঁয়ে আছে কষ্ট।

তন্ময় পাল বের হলে রাদ উনার কাছে এলো।

” আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার।আপনি সাহায্য না করলে এতো তাড়াতাড়ি সবার আড়ালে এতো প্রমাণ আমি জোগাড় করতে পারতাম না আর না পারতাম সিসিটিভি ফুটেজ জোগাড় করতে।আপনার জন্য আমি আমার পরিবারের খুনিদের শাস্তি দিতে পেরেছি।”

” এভাবে বলোনা,এটাই তো আমার কাজ।এই পোশাক আমি পরিধান করেছি অপরাধীদের শা’স্তি দেওয়া জন্য।তুমি অনেক সাহসী একজন মানুষ।পরিবারের মৃ’ত্যু’র রহস্য উদঘাটন করতে তুমি অনেক বড় ঝুঁ’কি নিয়েছিলে।এখন অতিত ভুলে হাসি-খুশি ভাবে জীবনটা উপভোগ করো।ঈশ্বরের কাছে আমি প্রার্থনা করি তোমাদের বাকি জীবনটা যেন সুখের হয়।”
.
.

পালকদের মামাবাড়িতে বর্তমানে ছোটখাটো একটা ভীড় জমেছে।সবাই কানাঘুষা করছে।প্রিসা এবং পালক এককোণে দাঁড়িয়ে আছে।রাদ এবং নিহাদ ওদের পৌঁছে দিয়ে দু’জনে সদর দরজা থেকেই চলে গিয়েছে।

” পালিয়ে বিয়ে করলে এরকমই তো হয়।”

” আরে মেয়েটা মনে হয় এই কারনেই বিয়ে করেছে।ছিঃ কত বা’জে একটা মেয়ে।”

” নিশ্চয়ই ছেলেটারও কোন দোষ না,না হলে কেন মেয়েটা বিয়ের এতোদিন পর এরকমটা করবে?”

ফিসফিস কথার মধ্যে এধরণের কথায় শোনা যাচ্ছে।এতো গুণগুণ শব্দ ,ভীড় এসবের কারণ দীপ্তি অয়নের আলমারি থেকে সবকিছু নিয়ে পালিয়েছে।শুধু টাকা পয়সা নয় ভালো ঘড়ি,জামা-কাপড় সহ নিয়ে গিয়েছে।সবাই ছিঃ ছিঃ করছে আবার কেউ বা বলছে বাবা-মায়ের মন ভাঙার ফল এটা।

প্রিসা পালকের সাথে দাঁড়িয়ে অয়নকে দেখছে।সোফার এককোণে মুখ কালো করে বসে আছে অয়ন।যে কেউ দেখলে মনে করবে বউ পা’লি’য়ে যাওয়ার কারণে তার এই অবস্থা কিন্তু আসল ব্যপারটা তা নয়।টাকা,গয়না,দামী ঘড়ি এসবের কারণে তার মন খারাপ,দীপ্তিকে নিয়ে বলতে গেলে তার কোন মাথাব্যথায় সে।প্রিসা বড়ই অবাক হচ্ছে।একটা মানুষ কি ধরণের মা’নসিক’তার হলে বউ পা’লি’য়ে গিয়েছে সেটার থেকে বেশি টাকা-পয়সা নিয়ে গিয়েছে এটাতে বেশি মন খারাপ করে থাকে।আসলে কিছু কিছু মানুষ আছে যারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে টাকা-পয়সাকেই রাখে,অন্য কোনকিছুর জন্য তাদের মন টানেনা।এর একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ হচ্ছে অয়ন।
.
.

সময় এবং প্রকৃতি কারো জন্য থেমে থাকেনা।সময়ের সাথে সাথে প্রকৃতিও সেজে উঠে নতুন সাঁজে।বর্ষা গিয়ে আগমন ঘটেছে শরতের।চারিদিকে মিলছে কাশফুল সহ আরো বাহারি ফুলের দেখা।সবার জীবন এখন স্বাভাবিক।হাসি,মজা,ঝগড়া,খুনসুটি সবমিলিয়ে চলে যাচ্ছে সবার জীবন।সবাই নিজের জীবনটা নতুনভাবে,নতুন রূপে সাজিয়ে তুলেছে।

স্কুলের খাতা দেখছিলো প্রিসা।নিহাদ ধপ করে তার পাশে বসে পড়লো।

” রাণী।”

” বলুন।” খাতার দিকে তাকিয়েই বললো প্রিসা।

” তোমার ক্লাসে অথৈ নামে একটা বাচ্চা আছে না,বাচ্চাটা না অনেক কিউট।চলো কালকে স্কুলে গিয়ে ওকে তু’লে নিয়ে আসি।”

” মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে নাকি!বাচ্চা চু’রি করবেন আপনি!”

” তো কি করবো?বাচ্চাটা এতো সুন্দর,ওর বড় বড় চোখগুলো অনেক সুন্দর।কিন্তু বাচ্চাটা আমার সাথে কথাই বলেনা।আমাকে দেখলে দৌড়ে পালিয়ে যায়।” মুখ ভার করে বললো নিহাদ।

” আচ্ছা বাবা আর মন খারাপ করতে হবেনা।কাল আমিও যাবো আপনার সাথে।এবার উঠুন,আর বাড়ির চাবিটা নিন।”

” কেন?”

” বাইরে যাবো।দেখুন এই সাঁঝবেলার আকাশটা কি সুন্দর এবং মেঘগুলোও কত সুন্দর ভাবে ছেঁয়ে আছে।বাড়িতে তো কেউ নেই,চলুন ছাদে গিয়ে এই শরতের সুন্দর সাঁঝবেলাটা আমরা উপভোগ করি।”

প্রিসার কথা শুনে নিহাদের মন খারাপ এক নিমেষে চলে গেলো।দরজায় থালা লাগিয়ে তারা চলে গেলো ছাদে সুন্দর সাঁঝবেলাটা উপভোগ করতে।
.
.

বারান্দায় মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে আয়না।ইয়াসিন এসে তাকে পেছন থেকে জরিয়ে ধরে তার কাঁধে নিজের থুতনি রাখলো।

” আমার ভাঙা আয়নার মনটা কি খারাপ?”

উওর দিলোনা আয়না।ইদানীং তার কিছুই ভালো লাগছেনা।ইয়াসিন জানে আজ কেন আয়নার মনটা খারাপ।আয়নাকে নিজের দিকে ঘোরালো ইয়াসিন।কপালে ভালোবাসা মিশ্রিত একটা স্পর্শ এঁকে দিলো সে।

” তুমি এখনো ওনার কথা ভেবে মন খারাপ করো?”

” তুমি তো জানতে বাবাই মামাদের মৃ’ত্যুর সাথে জড়িত তাহলে কেন আগে বললেনা,তাহলে এতোটা কষ্ট পেতাম না সেদিন।সেদিনের পর থেকে মা আরো চুপচাপ হয়ে গিয়েছে।প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলেনা।আর আজ সারাদিন তো মা রুম থেকেই বের হয়নি কারণ আজকের দিনেই যে বাবাকে ফাঁ’সি দেওয়া হয়েছিলো।যতই দোষ করুক,যতই মা বলুন সে শক্ত আছে কিন্তু আমি তো বুঝি মায়ের কষ্ট হয়।এতো বছরের সংসার,যাকে কিনা এতোটা ভরসা করেছিলো সেই তার পরিবারকে কেঁড়ে নিয়েছে।আমার মায়ের জন্য খুব কষ্ট হয় ইয়াসিন,কেন এরকমটা হলো?আমরা কি আগের মতো সুন্দর,স্বাভাবিকভাবে থাকতে পারতাম না?কেন বাবা এরকমটা করতে গেলো?তার জন্য আজ সবার জীবনচিত্র ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে।”

” লোভ বড়ই খা’রা’প জিনিস।লোভ মানুষকে অনেক নিচে নামিয়ে ফেলে যা সে মানুষটা বুঝতেও পারেনা।” কিছুক্ষণ চুপ করে ইয়াসিন হাসি মুখে বললো, ” যাও মা-বাবা আর মামণিকে তৈরি হতে বলো,তুমিও তৈরি হয়ে নাও।আজ আমরা পুরো পরিবার মিলে এই সুন্দর শরতের সাঁঝবেলায় ঘুরতে যাবো।আজ আমরা পায়ে হেঁটে শরতের সাঁঝবেলার প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করবো।দেখবে শরতের এই সুন্দর পরিবেশের ছোঁয়ায় সবার মন ভালো হয়ে গিয়েছে।”
.
.

পরিবেশ হয়ে আসছে অন্ধকার,নীল আকাশটা আস্তে আস্তে কালো বর্ণ ধারণ করছে,ছোট ছোট মেঘগুচ্ছ খোলা আকাশে কোন বাঁধা ছাড়া ছোটাছুটি করছে।একটা কাশফুলের বাগানের মাঝে হাতে হাত রেখে হাঁটছে পালক এবং রাদ।তাদের মতো আরো অনেক কপোত-কপোতী এসেছে এই শুভ্র কাশফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

” সময়ের সাথে সাথে কতো কিছু পরিবর্তন হয়ে গেলো তাই না পালকসাহেবা?”

” হুম অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে।প্রত্যেকটা সম্পর্ক নতুন রূপ ধারণ করেছে,কিছু সত্যি সামনে এসেছে।এখনো ভাবতে অবাক লাগে কোন #শরতের_এক_সাঁঝবেলায় তোমাকে প্রথমবার দেখেছিলাম।অপরিচিত তোমাকে দেখে বড্ড মায়া হয়েছিলো,তাই সাহায্য করেছিলাম।তখন তুমি হাঁটতে পারতে না আর এখন আমার সাথে পা মিলিয়ে হাঁটছো তুমি।”

” সেই শরতের আমরা ছিলাম অপরিচিত কিন্তু এই শরতে আমরা হচ্ছি একজন অপরজনের পরিপূরক।আমি আমার জীবনের বাকি শরৎকালগুলো তোমার সাথে কাটাতে চায়।আমার মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত প্রতিটা শরতের সাঁঝবেলায় আমি তোমাকে চাই,তোমার সাথে এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাই।থাকবে তো আমার পাশে।”

রাদের আরেকটু কাছে ঘেঁষে ধারালো পালক।মিষ্টি হেসে বললো,

” আমিও মৃ’ত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার সাথে শরতের এই কাশফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাই।”

” ভালোবাসি পালকসাহেবা।”

” আমিও তোমাকে ভালোবাসি রাদসাহেব।”

আবারো হাঁটতে শুরু করলো দু’জনে।পালক এখনো জানেনা তাদের বিয়েটা আসলে একধরনের পরিকল্পনা ছিলো,সেইসাথে আদিব সাহেবের সাথে রাদের শেষ কথাগুলো।রাদ চাইনা এসব কেউ জানুক,থাক না কিছু কথা গোপন।যেগুলো সে একান্ত সেই জানবে।

আস্তে আস্তে চোখের আড়াল হয়ে যেতে লাগলো তারা দু’জন।হাতে-হাত রেখে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে,উপভোগ করছে প্রকৃতির মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য।

__________________ সমাপ্তি ____________________