শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-১৭+১৮

0
561

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ১৭
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

প্রত্যেক মানুষের জীবনে স্বরণীয় দিনগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি দিন হলো তাদের বিয়ের দিন এবং বিয়ের পর প্রথম রাত।কিন্তু পালকের ক্ষেত্রে এ দু’টো বিষয়ই হয়েছে ভিন্ন।অচেনা জায়গায় কোন পূ্র্বসংকেত ছাড়ায় বিয়ে হয়ে গিয়েছে তার আর বাসরঘরে নেই কোন জাঁকজমক ভাব।

সাদা-কালো রঙের মিশ্রণের চাদরে জড়ানোর বিছানায় বসে আছে পালক।মাথায় তার হাজারো চিন্তা।জীবনের অংক মিলাতে ব্যস্ত সে।তার জীবনের বেশিরভাগ ঘটনায় আচমকা কোন পূর্ব সংকেত না দিয়েই ঘটেছে।তার বাবাও আচমকা তাদের ছে’ড়ে চলে গেলো এখন তার বিয়েটাও হলো আচমকা।

দরজা ঠেলে কেউ ভেতরে প্রবেশ করলো তবে পালক তাকালো সেদিকে,সে নিজের ভাবনায় মত্ত।

” পালক।”

পালক শীতল দৃষ্টিতে তাকালো।রাদ এর আগে পালক বলতো না সবসময় পালকসাহেবা বলতো।পালক বুঝতে পারছে রাদেও এই বিয়ে নিয়ে ভিষণ বিব্রত,লজ্জিত।মুখে তার অপ’রাধ’বোধের চাপ স্পষ্ট।দরজা লাগিয়ে হুইলচেয়ারটা নিয়ে পালকের কাছে এসে থামলো রাদ।

” পালক আমি সত্যিই জানতাম না এরকম কিছু হতে পারে।আমি আগে থেকে জানলে কখনোই সেখানে যেতাম না।আপনি প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না।আপনি যদি চান তাহলে আমি আপনাকে এই সম্পর্ক থেকে মুক্ত করে দেবো।আমি মোটেও এই সম্পর্কে আপনাকে থাকতে বাধ্য করবো না।তবে একটাই অনুরোধ আমাকে ভুল বুঝবেন না।আপনার এই চুপ থাকা যে আমাকে বড়ই কষ্ট দিচ্ছে,মনের মধ্যে অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে।আপনি আমাকে যা ইচ্ছে বলতে পারেন আমি কিছু মনে করবো না তাও প্লিজ একটি বার কথা বলুন।প্লিজ একটি বার কথা বলুন পালকসাহেবা।”

পালকের কি হলো সে নিজেও জানে না।আচমকা সে হুহু করে কান্না করে দিলো।অনেকক্ষণ সে এই জলস্রোত আটকে রেখেছিলো কিন্তু রাদের কথা শুনে তা বাঁধ ভেঙে বেরিয়ে এলো।আচমকা পালকের কান্না শুনে রাদ ঘাবড়ে গেলো।রাদ আরেকটু কাছে এলে পালক রাদের কাঁধে কপাল ঠেকিয়ে কান্না করতে লাগলো।রাদ অস্থির হয়ে বলতে লাগলো, ” পালকসাহেবা প্লিজ কান্না করবেন না।আপনি সম্পর্ক রাখতে না চাইলে আমি জোড় করবো না,কেউ জোড় করবেন না আপনাকে আমার সাথে থাকতে।আমি জানি আপনি খুবই কষ্ট পেয়েছে।আমার মতো একজন মানুষ যে কিনা হাঁটাচলা করতে পারেনা তার সাথে আপনার যায় না।আমি জানি আমাকে আপনার স্বামী বলতে লজ্জা লাগবে।কিন্তু আমি তো বলেছি আপনাকে এই প’ঙ্গুর সাথে থাকতে হবে না।আমি মুক্তি দিয়ে দেবো আপনাকে।অন্তত বন্ধু হিসেবে একটি বার ভরসা করুন,মুক্তি দিয়ে দেবো আপনাকে।আমি চায়না সারাজীবন আপনি মানুষের কথা শুনুন,মানুষ আপনাকে নিয়ে হাসি-মজা করুক কিংবা কেউ টিটকারি মারুক।আমি চায়না আপনি এগুলো সহ্য করুন।প্লিজ কান্না বন্ধ করুন,প্লিজ।” কথাগুলো বলতে বলতে রাদের মনে হলো তার স্বর আটকে আসছে।রাদ ছলছল চোখে পালকের মাথায় আলতো করে হাত বোলাতে লাগলো।আরো কিছুটা সময় কান্না করে পালক আস্তে আস্তে শান্ত হলো।একদম কান্না বন্ধ হয়ে গেলেও আরো কিছু সময় সে রাদের কাঁধেই মাথা রেখে বসে রইলো।

পালক মাথা তুললে রাদ দেখলো তার চোখ,নাক লাল হয়ে গিয়েছে,সারা মুখে চোখের পানিতে একাকার।রাদের ইচ্ছে হলো যত্ন সহকারে জলটুকু মুখে কপালে একটা আদুরে পরশ দিতে তবে রাদ নিজেকে আটকালো।দু’হাতে চোখের জলগুলো মুছে বড় একটা নিঃশ্বাস নিলো পালক।

” রাদসাহেব বিয়ে যেভাবেই হোক হয়েছে আর এটা একটা পবিত্র সম্পর্ক।আমার মা বলে সত্যিকার অর্থে বিয়ে মানুষের জীবনে একবারই হয়।তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি এই সম্পর্কটা এগিয়ে নিয়ে যাবো।আপনার সাথে সংসার করবো আমি।তবে এটা ভাববেন না নিজের সাথে জোড় করে আমি একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।আমি সম্পূর্ণ মন দিয়ে সংসার করবো।ভালোবেসে এই সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবো তবে আমাকে মানিয়ে নেওয়ার জন্য কিছুটা সময় দিতে হবে।আশা করি সেটা আমাকে দেবেন।এমন নয় যে আমার অন্য কোথাও সম্পর্ক ছিলো।যেহেতু কোন বাঁধা নেই তাহলে সম্পর্ক ভাঙার কোন দরকার নেই।আর একটা বিষয় আপনি হাঁটতে পারেন না এতে আমার কোন সমস্যা নেই।আয়না বলেছে আপনি হাঁটাচলা করতে পারতেন,কিছু সমস্যার কারণে পারেন না।আমার বিশ্বাস আপনি আবারো হাঁটতে পারবেন।কখনো এটা মনে করবেন না আপনার হাঁটতে না পারার কারণে আমি আপনাকে স্বামী হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করবো।সবশেষে একটাই কথা আমি আপনার সাথে সংসার করবো রাদসাহেব।আপনার সাথে যখন এই পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি তখন আমি মন দিয়ে ভালোবেসে সব আগলে রাখবো।আপনাকে এবং আপনার পরিবারকে নিজের আরেকটা পরিবার ভেবে আগলে রাখবো,ভালোবাসবো।তবে একটা কথা মনে রাখবেন রাদসাহেব রা’গ করুন,ঝগ’ড়া করুন,ভালোবাসুন কিন্তু কখনো বিশ্বাস ভাঙবেন না।আমি বিশ্বাসঘাতকদের সবসময় ঘৃ’ণা করি।আপনি আমার বিশ্বাস ভাঙলে ভাবেন না আমি সব ছেড়ে চলে যাবো।যেহেতু কথা দিয়েছি সংসার করবো তাহলে আমি করবো কিন্তু বিশ্বাস ভাঙলে এই আগের পালককে আপনি কোনদিনও ফিরে পাবেন না।তাই আর যাই করুন আপনার প্রতি আমার যে বিশ্বাস তা ভাঙবেন না রাদসাহেব।”

রাদকে পাশ কাটিয়ে ব্যাগ থেকে শাড়ি বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো পালক।রাদ পলকহীনভাবে বিছানার দিকে তাকিয়ে আছে।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে পালক রাদকে ওয়াশরুমে দিয়ে এলো।তারপর তাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে নিজেও তার পাশে শুয়ে পড়লো।
.
.
ছাদে দাঁড়িয়ে পড়ন্ত বিকেলের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে প্রিসা।পালক নেই আজ দু’দিন হতে চললো।বড্ড একা লাগছে তার।আগে দু’বোন শত ক্লান্ত থাকার পরেও রাতে একজন অপরজনের চুল যত্ন সহকারে বেঁধে দিতো,গল্প করতো শুয়ে শুয়ে।কারো গায়ের কাঁথা সরে গেলে মাঝরাতে উঠে তা ঠিক করে দিতো।একটা মাছ দু’জনে ভাগ করে খেতো যেন তাদের মা ভালো করে খেতে পারে কিন্তু আজ দু’দিন কেমন যেন সব খালি খালি লাগছে তার।এখন সে দু’দন্ড কারো সাথে মুখ ফুটে দু’টো কথা বলতে পারে না।দু’দিনে এতো কথা জমে গিয়ে প্রিসা ভাবছে বাকি জীবনটা তাহলে কিভাবে সে পাড় করবে।এই ছোট বোনটাই তো ছিলো তার শান্তজীবনের একমাত্র কথা বলার সঙ্গী এখন তো সেও তাকে একা করে দিয়ে চলে গেলো।

” মন খারাপ?”

ঘাড় গুঁড়িয়ে নিহাদকে দেখতে পেলো প্রিসা।কোন উওর দিলো না সে আপাতত কথা বলতে ইচ্ছে করতে না তার।

” তোমার ছোটবোনের হুট করে বিয়ে হয়ে গেলো শুনলাম।হঠাৎ এরকম করে বিয়ে কেন হলো?”

” এখন কি আপনিও এটা নিয়ে কথা শোনাবেন?” তাচ্ছিল্যভরা হাসি দিয়ে বললো প্রিসা।এ কয়েকদিনে তারা কম টিটকারি শোনেনি তবে তারা চুপচাপ মেনে নিয়েছিলো সব।তবে প্রিসা জানে না কেন এতোজনের কথা প্রেক্ষিতে সে কিছু না বললেও নিহাদের কথা শুনে সে পাল্টা প্রশ্ন করলো।

” না না আমার কথায় কষ্ট পাবেন না।আমি তো ওইভাবে কিছু বলিনি কিন্তু তো শুধু এমনিতেই জিজ্ঞেস করেছিলাম।আমি মোটেও আপনাকে হার্টকরে বা মজা করে কথাটা বলিনি।”

প্রিসা উওররে কিছু বললো না।তার এখন মোটেও কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

একটা অন্ধকার ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে তূর্য মিত্র।হাত এবং পা উভয়ই শি’ক দিয়ে বাঁ’ধা।গায়ে থাকা দামী পোশাকগুলো এই কয়েকদিনে ধারণ করে বির্বণ রঙ।সারা গায়ে মা’রের দাগ,কপালের এককোণে ফুলে গিয়েছে।সারা গায়ে অসহ্যনীয় ব্য’থা তবে তার ব্য’থা দেখার মতো কেউ নেই।প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে কারা যেন তাকে খুব মা’রে,তাদের ইচ্ছে হলে খেতে দেয় না হলে নয়।তূর্য মিত্রের ভাবতেও অবাক লাগছে সে কোনদিন নরম তুলতুলে সোফা,চেয়ার,বিছানা ছাড়া বসেনি এখন সে মাঠিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।কিছুদিন আগেও একটা পিঁপড়া তাকে কা’মড় দিলে তাকে সে পি’শে মে’রে ফেলতো কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে আজ কয়েকশ পিঁপড়া তাকে কা’মড় দিচ্ছে কিন্তু সে কিছু করতে পারছেনা।কিছুদিন আগেও সে অনেক খাবার নষ্ট করেছে।লবণ কম হলেই সে ডাস্টবিনে ফেলে দিতো,খাবার কয়েকঘন্টা আগের রান্না করা হলেও সে ফেলে দিতো আর এখন সে একবেলা খাবারের জন্য ছটফট করে কিন্তু তার এই অবস্থা দেখার মতো কেউ নেই।তূর্য মিত্র বুঝতে পারছে তার পা’পের ঘ’ড়া হয়তো পূর্ণ হয়ে এসেছে।তবুও সে তার ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছে,তার কাছে ভি’ক্ষে চাইছে এবারো মতো তাকে যেন তিনি বাঁচিয়ে নেন।তবে তূর্য মিত্র জানে না সে এতো পাপ করেছে ঈশ্বর কি আধো তাকে ক্ষমা করে দিয়ে তাকে বাঁচিয়ে নেবেন নাকি আরো কোন কঠিন শা’স্তি তিনি দেবেন।
.
.

বাড়ির বেলটা শব্দ করে জানান দিচ্ছে বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে,ঘরের ভেতরে থাকা কেউ যেন প্রবেশ দ্বার খুলে দেয়।নূরজাহান বেগমকে যেতে না দিয়ে পালক এগিয়ে গেলো দরজার কাছে।দরজা খুলে অপরপাশে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখে পালক খানিকটা হকচকিয়ে গেলো।তবে সে অপরপাশের মানুষটিকে ঠিক চিনতে পারলো না।

চলবে……..

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ১৮
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

” আপনি কে এবং কাকে চাইছেন?”

পালক নম্রভাবে জিজ্ঞেস করলেও দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটি কর্কশ স্বরে বললেন,” আমি কে তা তোমাকে কেন বলবো?তুমি কি এই বাড়ির মালিক নাকি?এসেই কি নিজেকে মালিক মনে করা শুরু করে দিয়েছে নাকি?এখন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার মুখ দেখবে নাকি ভেতরেও ঢুকতে দেবে?”

ব্যক্তিটির কথায় পালক অপমানিতবোধ করলো এবং ঘাবড়ে গেলো।সে তাড়াতাড়ি দরজার সামনে থেকে সরে দাঁড়ালো।লোকটি পায়ের জুতো শেল্ফে তুলে রেখে ভেতরে ঢুকে গেলেন।লোকটি কে তা দেখার জন্য পালক তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে ভেতরে এলো।ড্রইংরুমে পা রাখতেই পালকের কানে এলো নূরজাহান বেগমের কথা।

” আরে তুমি এসেছো।এতোদিন কোথায় ছিলে?বুঝিনা বাপু তোমার কাজকর্ম।না বলে হুট করে চলে যাও আবার হুট করে চলে আসো।আমাদের কি টেনশন হয়না বলো।”

” নূর এখন আর কিছু বলো নাতো।ক্লান্ত লাগছে,একটু ঠান্ডা শরবত বানিয়ে দাও।”

নূরজাহান বেগম তাড়াহুড়ো করে রান্নাঘরে চলে গেলেন।পালক চোখ ঘুরিয়ে লোকটার দিকে তাকালো।চোখ বন্ধ করে সোফায় গা এলিয়ে বসে আছেন তিনি।পালক রান্নাঘরের এসে নূরজাহান বেগমের পাশে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

” মামুনি উনি কে?”

” আমার স্বামী আদিব।তোমার ফুফা শশুর।এসো আমার সাথে,পরিচয় করিয়ে দি।”

নূরজাহান বেগমের পেছন পেছন পালক বেরিয়ে এলো।তার খানিকটা ভয় করছে কারণ ক্ষাণিক আগেই আদিব শাহরিয়া তাকে কথা শুনিয়েছেন।

” এই নাও শরবত।আর এ হচ্ছে পালক,আমাদের রাদের বউ।”

” এভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কি আছে।সেকি কোন দেশের প্রধা’নম’ন্ত্রী নাকি?বাড়িতে যখন আছে তখন তো দেখবো।এতো ঘটা করে পরিচয় পর্বের কোন দরকার ছিলোনা।” কথা শেষ হতেই আদিব শাহরিয়া উঠে রুমে চলে গেলেন।পালক এবারো অপমানিত হলো এবং লজ্জায় মাথানিচু করে ফেললো।

” পালক মা তুমি রাগ করো না।আসলে ও এরকম না,অনেক ভালো সে।আসলে তাকে না জানিয়ে রাদ বিয়ে করে নিয়েছে তো তাই সে একটু রেগে আছে।তুমি চলো আমার সাথে।অফিসে তো গেলে না,চলো রাদ কি খেতে পছন্দ করে তা তোমাকে দেখিয়ে দি।”

টিউশন করিয়ে কিছুক্ষণ আগেই প্রিসা বাড়ি ফিরেছে।ইদানীং আগে থেকে সে আরো বেশি শান্ত হয়ে গিয়েছে তবে নিহাদের সাথে তার খানিকটা সখ্যতা তৈরি হয়ে।

” নিচের তলার নিহাদকে তুই চিনিস?”

রান্নাঘরের দিকে যেতে গিয়েও থেমে গেলো প্রিসা।নিহাদ আজ প্রায় চার মাসেরও বেশি সময় ধরে এই বিল্ডিং এ আছে আজকের আগে তার মা কখনোই নিহাদের কথা বলেনি।আজ হঠাৎ তার কথা জিজ্ঞেস করায় প্রিসা খানিকটা অবাক হলো।

” হ্যাঁ চিনবো না কেন।উনি তো আমাদের স্কুলে টিচার হিসেবে কয়েকমাস আগে যুক্ত হয়েছেন।কিন্তু তুমি আজ হঠাৎ ওনার কথা কেন বলছো?”

” ছেলেটা না অনেক ভালো,উপকারী।ছেলেটার কথাবার্তা,আচার-আচরণ অনেক ভালো।জানিস আজ বিকেলে বাজারে গিয়েছিলাম।পালক তো নেই,তুই আর একা কত দিক দেখবি তাই আমিই গিয়েছিলাম।কিন্তু এতো ভারী ব্যাগগুলো নিয়ে কিভাবে চার তলায় উঠবো সেটাই নিচে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম।তখন নিহাদ হয়তো কোথাও যাচ্ছিলো।আমাকে দেখে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলো কোন সমস্যা আছে কিনা।আমি প্রথমে বলতে চাইনি কিন্তু জোড় করার কারণে বললাম।তখন ছেলেটা কোন কথা না বলে ব্যাগদুটো উঠিয়ে আমাকে বললো আমি যেন আস্তে আস্তে উপরে উঠে আসি।আমাকে বারণ করার সুযোগ না দিয়েই নিহাদ ব্যাগগুলো নিয়ে চলে এলো।বসতে বলেছিলাম কিন্তু তার কাজ আছে তাই বসলোনা।ছেলেটা অনেক হাসিখুশি।কি মিষ্টি করে হেসে কথা বলে,দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়।বেচারা এতো মিষ্টি ছেলেটা পরিবার ছেড়ে একা থাকে জেনে কষ্ট লাগছে।শোন আমি ঠিক করেছি একদিন নিজ হাতে যত্ন সহকারে রান্না করে তাকে দাওয়াত দেবো।তুই ভাবতেও পারছিস না প্রিসা তার ব্যবহারে আমি কথাটা মন্ত্রমুগ্ধ হয়েছি।এমন ছেলে যেন প্রতিটা মায়ের কোল জুড়ে আসে।”

মায়ের মুখে নিহাদের প্রশংসা শুনে প্রিসা হাসলো।তার ভালো লাগছে।সে জানে তার মা মোটেও বাড়িয়ে কিছু বলেনি।নিহাদ আসলেই একজন চমৎকার ব্যক্তিত্বের মানুষ।

রাতে খাবার খাওয়ার আগে কি মনে করে যেন অনিলা বেগম এক বাটি তরকারি নিহাদকে দেবেন বলে মনস্থির করলেন।তিনি যেতে নিলে প্রিসা আটকে দিলো।এতোবার সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা করলে ওনার হাঁটুর ব্য’থা বেড়ে যাবেন আর রাতে ঘুমাতে পারবেন না।তাই প্রিসাই বাটিটা নিয়ে নেমে এলো।

দরজা খুলে প্রিসাকে দেখে চমকে গেলো নিহাদ।নিজেকে সামলে নিয়ে মিষ্টি হেসে প্রিসাকে জিজ্ঞেস করলো,

” এতো রাতে কি মনে করে আমার দ্বারে আপনি ঠোকা দিলেন?”

বাটিটা বাড়িয়ে দিলো প্রিসা।

” মা পাঠিয়ে।রাতের খাবার খেয়ে ফেলেছেন বুঝি?”

” বসেছিলাম খেতে আর তখনই আপনার আগমন।” বাটিটা নিয়ে বললো নিহাদ।

” আপনার ব্যবহারে মা তো একদম মন্ত্রমুগ্ধ।কি জা’দু করেছেন শুনি?প্রথমদিনই আপনার উপর এতো ইমপ্রেস।কত প্রশংসা করলো আপনার।আপনাকে মা একদিন দাওয়াত দেবেও চিন্তা করে রেখেছে কিন্তু মায়ের তর সাইছে না তাই আজই পাঠিয়ে দিলো।”

” তাই নাকি।বাহ্ আন্টি তো দেখি আমার উপর একদম ফুল ইমপ্রেস।”

” তা আর বলতে।ভালোই তো আমার মাকে জা’দু করে ব’শ করে ফেলেছেন।এতো ভালো জা’দু কোথা থেকে শিখেছেন শুনি?” মজা করে বললো নিহাদ।

” ইউটিউব দেখে শিখেছি।একজনকে জা’দু দিয়ে ব’শ করে নিজের উপর মন্ত্রমুগ্ধ করার জন্য শিখেছি।কিন্তু আমার কপাল যার ইমপ্রেস হওয়ার কথা সে তো হচ্ছেই না।” হতাশার সুরে বললো নিহাদ।নিহাদের কথা শুনে প্রিসা হালকা শব্দে হেঁসে উঠলো।প্রিসার হাসি দেখে নিহাদও হালকা হাসলো।

” এভাবে হেসো না শান্তি নগরের রাজকন্যা।তোমার মায়ায় এমনিতেই আটকে পড়েছি,এভাবে হাসলে সেই মায়ার জালে যে আরো আষ্টেপৃষ্টে যে জড়িয়ে পড়বো।” বিরবির করে বললো নিহাদ।

” ভালোই কথা বলতে পারেন আপনি।চেষ্টা করে দেখুন,সেও ইমপ্রেস হয়ে যাবে।আচ্ছা এবার তাহলে আমি যায়,মা একা আছেন।খেয়ে নেবেন।কাল দেখা হবে,শুভ রাত্রি।”

মিষ্টি হেসে হাত নাড়িয়ে প্রিসাকে বিদায় জানালো নিহাদ।আজও প্রিসার দরজার বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত নিহাদ নিজের দরজা বন্ধ করলো না।

ফোনে মুভি দেখছিলো আয়না তবে সেখানে ব্যঘাত ঘাটলো একটা ফোনকল।বিরক্তভরা নিঃশ্বাস নিয়ে আয়না ফোনটা রিসিভ করলো।

” মিস আয়না শাহরিয়া যা মজা করার এখনি করো নাও,তোমার হাতে মজা করার সময় আর বেশিদিন নেই।এখন যতখুশি আনন্দফূর্তি করে নাও কিছুদিন পর আর তা করতে পারবে না।কিছুদিন পর তোমার সব আনন্দ-ফুর্তির খাতা দি এন্ড হয়ে যাবে।” বেশ গম্ভীরস্বরে বললো ব্যক্তিটি।লোকটির কথা শুনি আয়নার বিরক্তিকর স্তর বেড়ে গেলো আরো।

” এই জু’তো চো’র কখন থেকে ভাঙা টেপরেকর্ডার হলেন?ফোন করার কি আর টাইম পাননি?কি সুন্দর এখন টানটান সিন চলছিলো তার মধ্যে ফোন দিয়ে পা’গলের প্রলাপ বকে চলেছেন।”

” তুমি এভাবে বলছো কেন ভাঙা আয়না,ভয় করে তো।”

” আপনার ভয় তরকারির সাথে মিশিয়ে খেয়ে ফেলুন।এখন বলুন কি কারণে ফোন দিয়েছেন?আমি মুভি দেখবো।”

” আমার না খু্ব বোর লাগছিলো কিন্তু একটা প্রেমিকাও নেই আর না বউ।তাই তোমার সাথে প্রেম করার জন্য ফোন দিয়েছি।চলো আমরা দু’জন এখন প্রেমালাপ করি।”

” এ্যা…..চলো আমরা প্রেমালাপ করি।আপনার মতো জুতো চোরের সাথে প্রেম করার কোন শখ আমার নেই।পৃথিবীতে কি ছেলের অভাব পড়েছে নাকি যে আপনার মতো জুতো চোরের সাথে প্রেমালাপ করবো।”

” এমন করে বলছো কেন জান,বুকে লাগে।”

” তাহলে তুই বুক ছু’রি দিয়ে কে’টে ফেলুন।এবার একটু ঝেঁড়ে কথা বলুন তো দেখি।কি জন্য ফোন দিয়েছেন।”

” দিয়েছিলাম তো তোমার সাথে প্রেমালাপ করার জন্য কিন্তু তোমার মতো ব’জ্জা’ত মহিলার সাথে কি আর প্রেম করা যায়।মহারানী ভাঙা আয়না আপনার ফোনখানা দয়া করিয়া রাদ স্যারের কাছে দিলে আমি ধন্য হইতাম।”

” ভাইয়ার সাথে কথা থাকলে তাকে ফোন না করে আমাকে করেছেন কেন?”

” স্যারজি তো ফোনই ধরছেন না।হয়তো রোমান্স করতে ব্যস্ত।ইশ…..আজ আমার একটা বউ থাকলে আমিও তার সাথে রোমান্স করতাম নাকি কোন একটা ভাঙা আয়নার সাথে ফোনে কথা বলতাম।”

আয়না নিজেকে শান্ত করলো।সে এখন কিছু বললে ইয়াসিন আরো তিন লাইন বাড়িয়ে বলবে যেটা এখন সে চাইছে না।

” আপনি দাঁড়ান আমি ভাইয়াকে বলছি আপনাকে ফোন করতে।”

” আরে লাইন কাটছো কেন?তোমার সাথে কথা শেষ হয়নি তো।যেটার জন্য ফোন করার সেটা তো হলোই না।”

” কিন্তু আপনার সাথে আমার কথা বলা শেষ।এমনিতেই আপনি আমার মুভি দেখার মুডটা নষ্ট করে দিয়েছেন আর এখন কথা বলে আমার মাথা খা’চ্ছেন।এর শা’স্তি তো আমি আপনাকে সুযোগ বুঝে দেবো।এখন রাখছি,গুড নাইট।”

ইয়াসিনের কথা না শুনে আয়না ফোনটা কেটে দিয়ে রাদের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

চলবে…….