শরতের এক সাঁঝবেলায় পর্ব-১৯+২০

0
571

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ১৯
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

রাতে খাবারের সময় পালক পুরোটা সময় রাদের পাশে থেকেছিলো।ভু’লেও আদিব শাহরিয়ার পাশে যায়নি,যদি আবারো কথা শোনায় এই আ’শং’কায়।রাদের খাবার শেষ হলে পালক নূরজাহান বেগমের সাহায্যে তাকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আবারো ডাইনিং টেবিলের কাছে এসেছে।সব গুছিয়ে যখন সে লাইট অফ করবে তখন নূরজাহান বেগম তাকে নিজের কাছে ডাকালেন।

” কিছু বলবে মামুনি?”

” পালক তোমার ফুফুা শশুর তোমাকে ডাকছে।তুমি একটু আমাদের রুমে গিয়ে দেখবে কেন সে তোমাকে ডাকছে।হয়তো জরুরি কিছু বলবে।”

পালক ক্ষাণিকের জন্য দ্বিধায় পড়ে গেলো যাওয়া নিয়ে তবে খানিকক্ষণ চিন্তা করেই সে তাদের রুমের দিকে পা বাড়ালো।যেহেতু তিনি নিজে থেকে যেতে বলেছেন না গেলে সেটা বেয়া’দবি হবে।

” আসবো ফুফা?”

” এসো।”

পালক মাথার ঘোমটাটা আরেকটু টেনে ভেতরে গেলো।

” আমাকে আপনি ডেকেছিলেন?”

” না ডাকলে নিশ্চয়ই তুমি আসতে না।” এবারো গম্ভীরভাবে বললেন আদিব সাহেব।পালক চোখ নামিয়ে ফেললো।সে এখনো বুঝতে পারছেনা সে একটা সোজা কথা বললেও কেন আদিব সাহেব তার উল্টো মানে বের করেন।

” এদিকে এসে বসো।”

পালককে সামনের চেয়ারে বসতে বলে আদিব সাহেব উঠে গেলেন।পালক কথা না বাড়িয়ে বসে পড়লো।কালো একটা ব্যাগ থেকে একটা রেপিং পেপারে মোড়ানো কিছু একটা বের করে তিনি পালকের সামনে বিছানায় বসলেন এবং হাতে থাকা জিনিসটা পালকের দিকে এগিয়ে দিলেন।পালক আস্তে করে সেটা নিয়ে কোলের উপরে রাখলো।

” এটা কি কোলে নিয়ে বসে থাকার জন্য দিয়েছি?খুলে দেখো কি আছে।পছন্দ না হলে এখুনি দিয়ে দাও পরিবর্তন করে এনে দেবো।”

পালক ব্যস্ত হাতে রেপিং পেপারটা খুললো।ভেতরে ছিলো একটা গোলাকৃতির বক্স।পালক বক্স খুলে তাকে একজোড়া সোনার বালা দেখতে পেলো।পালক অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে আদিব সাহেবের দিকে তাকালো।

” পছন্দ হয়নি নাকি?না হলে দাও পরিবর্তন করে এনে দেবো।”

” না না পছন্দ হবেনা কেন।আপনি আমাকে এটা উপহার হিসেবে দিয়েছেন,উপহার কি পরিবর্তন করে নেওয়ার জিনিস নাকি।উপহার পরিবর্তন করলে প্রথমবার হাতে পাওয়ার পর যে অনুভূতিটা থাকে তা পরেবার ফিকে হয়ে যায়।কিন্তু আপনার এসব দেওয়া কি দরকার ছিলে ফুফা।আমার এসবের দরকার ছিলো না।”

” কাকে কি দেওয়া দরকার তা আমি জানি সেটা তোমাকে বলতে হবে না।” কিছুক্ষণ চুপ থেকে আদিব সাহেব পালককে বললেন,

” এদিকে আমার পাশে এসে বসো।”

পালক আস্তে করে উঠে বিছানায় গিয়ে বসলো।আদিব সাহেব নিজের হাত পালকের মাথায় রেখে বলতে লাগলেন,

” জানো আমার না কোন ছেলে নেই আয়না আমার একমাত্র সন্তান।নূর আয়নাকে জন্ম দেওয়ার সময় তার মাতৃ’ত্বের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।তখন সে অনেক ডিপ্রে’শনে ছিলো,সুই’সাই’ড করার চিন্তাও তার মাথায় এসেছিলো।আমি একা তখন স্ত্রী,নবজাত মেয়ে,চাকরি সব সামলাতে পারছিলাম না।তখন ফরহান ভাই এবং রামিয়া ভাবি নূর আর আয়নাকে এই বাড়িতে নিয়ে আসে।তখন রাদ আট-নয় বছরের ছিলো।ছোট রাদ নবজাত আয়নাকে পেয়ে অনেক খুশি ছিলো।সারাদিন আয়নার সাথে সাথে থাকতো।কাছের মানুষের সঙ্গ,ভালোবাসা পেয়ে নূর সুস্থ হয়ে উঠে।আমিও রাদকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসি।তার এমন আচমকা আমাকে না জানি বিয়ে করে নেওয়াটা আমি ঠিক মানতে পারিনি।তাই তোমার সাথে এমন রু’ঢ় করেছি।আমার কথায় কষ্ট পেওনা তুমি।”

পালক অনুমান করতে পারলো আদিব সাহেবের এধরণের ব্যবহারের কারণ তাই সে মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে কিছু মনে করেনি।

রুমে এসে পালক দেখলো রাদ ফোনে হেসে কারো সাথে কথা বলছে।একপলক রাদের দিকে তাকিয়ে পালক আলমারির কাছে গিয়ে বালা জোড়া তুলে রাখলো।

” কোথায় গিয়েছিলে পালকসাহেবা?”

” ফুফার কাছে,তিনি ডেকেছিলেন।জানো ফুফা আমাকে একজোড়া বালা দিয়েছে।” উৎফুল্ল হয়ে বললো পালক।

” উপহার পেয়ে কি পালকসাহেবা অনেক খুশি?”

” অবশ্যই।বহুদিন পর কেউ এতো যত্ন করে আমাকে উপহার দিয়েছে।তা রাদসাহেব,তুমি তখন কার সাথে এভাবে হেসে হেসে কথা বলছিলে?” হাত খোপাটা খুলে বেনুনি করতে করতে জিজ্ঞেস করলো পালক।

” আমার মুলার সাথে।”

” ইয়াসিন ভাইয়ের সাথে এতো রাতের কিসের কথা?আবার কোন দুঃখেন কাহিনী শুনিয়েছে তোমাকে?” হেসে জিজ্ঞেস করলো পালক।

” গুরুত্বপূর্ণ কিছু ইনফরমেশন দিয়েছে।” অধরজোড়া হালকা প্রসারিত করে বললো রাদ।
.
.

হাতে দু’টো ব্যাগ,তাকে বাচ্চাদের পরীক্ষার খাতায় টাসা।স্কুল ছুটির প্রথমদিকে যানবাহন অনেক থাকলেও যখন আস্তে আস্তে সবাই চলে যায় তখন যানবাহন পাওয়া খুবিই মুশকিল।বর্তমানে প্রিসা পড়েছে সেই পরিস্থিতিতে।অন্যদিন হলে হেঁটে যেতো কিন্তু এতো ভারী দু’টো ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাওয়া মুশকিল কিন্তু একটাও রিকশা নেই আর যা আছে তাদের ভাড়া অনেক বেশি মনে হচ্ছে প্রিসার কাছে।

আচমকা প্রিসার সামনে এসে দাঁড়ালো একটি বাইক।বাইকে বসে থাকা মানুষটা হেলমেট পড়ে থাকলেও প্রিসার বুঝতে অসুবিধে হলো না এটা নিহাদ।হেলমেটটা খুলে প্রিসার দিকে তাকালো নিহাদ।

” এখনো দাঁড়িয়ে আছেন যে?বাড়ি যাবেন না?”

” যাবো কিন্তু যাওয়ার জন্য রিকশা পাচ্ছিনা।তাই রিকশার জন্য অপেক্ষা করছি।”

প্রিসার কথা শুনে নিহাদ চট করেই বলে বসলো,

” তাহলে আমি পৌঁছে দি?”

নিহাদের কথা শুনে প্রিসা চমকে গেলো।সে নিহাদের থেকে যে এটা আশা করেনি তা তার মুখভঙ্গি দেখে স্পষ্ট।

” না আমি যেতে পারবো।আপনি বরং চলে যান।”

” আমরা তো একই জায়গায় যাচ্ছি তাহলে যেতে কি সমস্যা?অন্তত বন্ধু মনে করলেও আমার সাথে চলুন।”

আরো কিছু কথা বলে নিহাদ প্রিসাকে তার সাথে যাওয়ার জন্য মানিয়ে নিলো।প্রিসা আজ তার সাথে যাবে এটা ভেবেই নিহাদ মনে মনে অনেক খুশি।নিজেকে সে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে খুশি ব্যক্তি মনে করছে।ব্যাগদুটো ভালো করে সাইডে বেঁধে প্রিসাকে উঠতে বললো নিহাদ।প্রিসা উঠে বসলে নিহাদ আস্তে ধীরে বাইক স্টার্ট দিয়ে চালাতে লাগলো।সাইড মিররে প্রিসার ক্লান্ত,ঘামার্ত মুখশ্রী দেখে নিহাদ প্রিসার আড়ালেই হাসলো।তবে নিহাদ তো জানে না সে ভাবছে প্রিসা তার হাসি দেখেনি কিন্তু পেছন থেকে প্রিসা তা ঠিকই লক্ষ্য করেছে তবে সে জানেনা এই হাসি কারণ।

রাদ এবং পালকের বিয়ে হয়েছে প্রায় দু’সপ্তাহ থেকে বেশি।তারা দু’জনের সম্পর্ক আরেকটু এগিয়েছে,আগের থেকে তাদের জড়তা কমেছে,একে-অপরকে বুঝতে চেষ্টা করছে তারা।একেয়কদিন পালক একজন কর্মচারী হিসেবে রাদ থেকে তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়েছে।তার কারণ সে চাই বিয়ের প্রথম কয়েকটা দিন সম্পূর্ণ রূপে সংসারে মন দিতে,সংসার জিনিসটাকে ভালো মতো বুঝতে,সবার সাথে একটু মিশতে।তবে পালক ছুটিতে থাকলেও রাদের কোন ছুটি নেই।সে প্রতিদিন নিয়ম করে অফিসে যায় এবং সময় মতো ফিরে আসে।

রাদ এবং আয়না চলে যাওয়ার পর পালক এবং নূরজাহান বেগম দু’জনে মিলে গাছে পানি দিলো,হাতে হাতে সবার জন্য রান্না করলো।নূরজাহান বেগম বিশ্রামের জন্য চলে গেলে পালক চিন্তা করলো আজ তাদের রুমটা নিজ হাতে আরেকবার গুছাবে।ভাবনা অনুযায়ী পালক পুরো ঘরটা পানি,লাইজল দিয়ে মুছলো,সেল্ফ-বিছানা সব আবারো গুছিয়ে রাখলো।এবার সে হাত দিলো আলমারিতে।সব কাপড়গুলো বের করে ঝেড়ে আবারো গুছিয়ে রাখতে লাগলো সে।কিন্তু কাপড়গুলো আবারো আলমারিতে তুলে রাখার সময় সে খেয়াল করলো আলমারির কোণেতে একটা অ্যালবাম,একটা ডাইরি এবং একটা বক্স।পালক সেগুলোও মুছে রাখার জন্য টেনে বের করলো।বালি মুছে তুলে রাখার সময় সেই ডাইরি থেকে একটা জিনিস নিচে পড়ে গেলো।পালক তাকিয়ে দেখলো একটা ছবি।নিচ থেকে তুলে ছবিটার দিকে তাকিয়ে পালক ক্ষাণিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো।রাদের কাঁধে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে আছে একটা মেয়ে।দু’জনেই হাসিহাসি মুখ করে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে।ছবিটা বেশ পুরোনো না চার-পাঁচ বছরের পুরোনো হয়তো।পালকের মাথায় ক্ষাণিকের জন্য এই ধরণের ভাবনা এলো,

” রাদসাহেব কি আগে কাউকে ভালোবাসতেন?তাহলে আয়না যে বললো…..।”

কিন্তু পরমুহূর্তেই পালক নিজেকে একটা ধ’ম’ক দিলো।

” কারো সমন্ধে না জেনে এধরণের ভাবনা ঠিক নয়।” পালক মনস্থির করলো রাদ এলে তাকে সামনাসামনি জিজ্ঞেস করবে।তারপর দেখা যাবে বাকিসব।সব গুছিয়ে পালক অপেক্ষা করতে লাগলো রাদ আসার।

পালকের অপেক্ষার প্রহর শেষ করে সন্ধ্যার পর বাড়িতে এলো রাদ।অন্যদিনের মতো আজো পালক তাকে একগ্লাস শরবত দিলো তবে তার মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছে আর তার এই অস্থিরতা রাদ ঠিকই খেয়াল করলো।

” কি পালকসাহেবা আজ এতো অস্থির লাগছে কেন?”

” তোমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আছে।তাড়াতাড়ি জামা-কাপড় বদলে এসো তারপর বলছি।”

রাদকে ওয়াশরুমে দিয়ে এসে পালক অপেক্ষা করতে লাগলো রাদ কবে বের হবে এবং সে তার প্রশ্নের উওর পাবে।

চলবে……….

#শরতের_এক_সাঁঝবেলায়
#পর্বঃ২০
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

একমাস যাবত সেই অন্ধকার ঘরে পড়ে আছে তূর্য মিত্র।আলো কি সেটাও তিনি এখন ভুলতে বসেছেন।স্বাস্থ্যবান শরীরটা অযত্নে জীর্ণশীর্ণ হয়ে গিয়েছে।চুল উষ্কখুষ্ক,ময়লা লেগে গায়ের রং কালো বর্ণের হয়ে গিয়েছে।শরীরের ভিন্ন জায়গায় কা’লসি’টে দাগ,র’ক্ত জমে গিয়েছে।এতো ক্লান্ত শরীর যে তূর্য মিত্রের উঠে বাসার মতো শক্তিটুকু পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই।

দীর্ঘ কয়েকদিন পর আবারো শোনা গেলো কারো পায়ের শব্দ।তূর্য মিত্র ভ’য়ে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিলেন।লোকটির নিঃশ্বাস তূর্য মিত্র অনুভব করতে পারছে অর্থাৎ লোকটি তার সামনেই বসে আছে।আচমকা তূর্য মিত্র নিজের হাতে গরম কিছু অনুভব করলেন।

” হে ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করুন।আমার খুব জ্বালা করছে।দয়া করে ওটা সরাও তুমি।” আর্তনাদ করে বললেন তূর্য মিত্র কিন্তু লোকটি সরালোনা আরো চেঁপে ধরলো।

” খুব কষ্ট হচ্ছে বুঝি?আমি আমার মণির কষ্টের কাছে এই কষ্ট তো কিছুই না।তোরা আমার মণিকে কথা দ্বারা যে আঘাত করেছিস তার কাছে এসব একদম নগণ্য।”

লোকটি উঠে গেলো।জুতোতে শব্দ করে হেঁটে গেলো সামনে।

” আমার মণিকে তুই যে মুখ দিয়ে বা’জে কথা বলেছিস সেটা আজকে জ্বা’লি’য়ে দেবো।একদম জ্বালিয়ে শেষ করে দেবো।তবে চিন্তা করিস না মর’বিনা।তোদের কাউকে আমি প্রা’ণে মর’বো না।কারণ তোদের মতো কি’টকে মেরে আমরা কেউ জেলে যেতে চায়না।ওদের এমন অবস্থা করবো যে তোরা বাঁচতেও পারবিনা আর চাইলে ম’রতেও পারবিনা।”

আচমকা লোকটি তূর্য মিত্রের মুখ চেপে ধরলো এবং কিছু বুঝে উঠার আগেই অত্যাধিক গ’র’ম কিছু একটা মুখে ঢুকিয়ে দিলো।জিহ্বায় জ্বালা করছে অন্যদিকে নিঃশ্বাস আটকে আসছে।একসময় সহ্যকরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো তূর্য মিত্র এবং অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে ঢলে পড়লেন।
.
.
পালকের মুখোমুখি বসে আছে রাদ।হাতে তার সেই ছবিটা এবং এলবামটা।পালক উৎসুক দৃষ্টিতে রাদের দিকে তাকিয়ে আছে।

” ছবি দেখে তোমার কি মনে হয়েছে পালকসাহেবা?তোমার মনে কি আমার সম্পর্কে খারাপ কিছু ধারণা এসেছে?” মুখে হাসি রেখেই বললো রাদ।পালক তার কথা শুনে বিব্রতবোধ করলো কারণ রাদ যা বলছে তা খুব একটা মিথ্যা তা কিছু নয়।

” এই মেয়েটাকে রাদসাহেব?”

” না বললেই কি নয়?” রাদের কন্ঠ ব্যথিতভাবটা পালক ঠিক আন্দাজ করতে পারলো।

” আমাকে কি বলা যায় না?নাকি আমাকে এখনো স্ত্রীর মর্যাদাটা দিতে পারছেন না?”

রাদ নিজের হুইলচেয়ারটা টেনে পালকের আরেকটু কাছে এলো।একহাতে পালকে কাছে টেনে তার কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে হাসি মুখে বললো,

” এমন কথা বলোনা পালকসাহেবা বড়ই কষ্ট হয়।ছবিতে আমার পাশে যে মেয়েটিকে দেখছো সে হচ্ছে আমার বড় বোন ফাল্গুন রহমান রামিশা।”

রাদের একটা বড় বোনও আছে এই কথাটা শুনে পালক ভিষণ অবাক হলো।কারণ রাদের সাথে তার এতো মাসের পরিচয়,সে এতোদিন ধরে এবাড়িতে আছে কেউ তাকে এই কথাটা বলেনি।এমনকি যখন তার ফুফা শশুর আদিবের সাথে তার কথা হয়েছে তখনও তিনি এই কথাটা বলেননি।

” আপনার একটা বড় বোন আছে এটা তো আগে জানতাম না।আপু এখন কোথায়?কাউকে তো আপুকে নিয়ে কথা বলতে শুনিনি।”

” জানো বাবা-মা আমার থেকে আপুকে বেশি ভালেবাসতো তাই সেও বাবা-মায়ের সাথে আমাকে একা করে দিয়ে চলে গিয়েছে।” রাদের কথা শুনে পালকের কষ্ট হলো ভীষণ,সে জানে আপন মানুষ ছেড়ে চলে যাওয়ার কষ্ট।কিন্তু রাদের মুখে হাসিভাবটা এখনো আছে।পালক বুঝতে পারেনা রাদ কেন নিজের কষ্টটা এই হাসির আড়ালে লুকিয়ে রাখে।

” জানো পালকসাহেবা তারা চলে যাওয়ার পর না আমার জীবনটা একদম অন্যরঙ ধারণ করেছে,একদম ভিন্ন একটা রঙ।জানো যখন তাদের ক’ব’র দেওয়া হয়েছিলো তখন আমি সেখানে থাকতে পারিনি।তাদের শেষ দেখাটাও দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার কারণ আমি তখন হসপিটালের বেডে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম।একসপ্তাহ পর যখন অজ্ঞান ফিরে এলো তখন জানলাম আমি হাঁটতে পারবোনা।সেই থেকে আমি হুইলচেয়ারে বসে নিজের আপন মানুষগুলোকে ছাড়া নিজের জীবনের নতুন রঙ উপভোগ করছি।”

পালক চুপ করে রইলো।তার চোখ ছলছল করছে তবে সে সেটা আটকে রাখার চেষ্টা করছে।নিরবতা ভেঙে রাদ করুনস্বরে আবদার করলো,

” তোমার কোলে একটু মাথা রাখতে দেবে পালকসাহেবা?আমি না সেইদিনের পর থেকে কারো কোলে মাথা রাখিনি।কেউ যত্ন করে আমার মাথায় বিলি কেটে দেয়নি।”

পালক দ্রুতে বিছানা থেকে উঠে রাদকে হুইলচেয়ার থেকে বিছানায় নিয়ে গেলো এবং রাদকে নিজের কোলে মাথা রাখার ব্যবস্থা করে দিলো।পালকের কোলে মাথা রেখে রাদ চোখ বন্ধ করে রইলো।ক্ষাণিকবাদেই তার চোখের কার্ণিশ বেয়ে পানি পড়তে লাগলো।মুছলোনা রাদ,একইভাবে চোখ বন্ধ করে পালকের বিলি কাটা উপভোগ করতে লাগলো।রাদের চোখের পানি পালকের দৃষ্টির অগোচর হলোনা।রাদের আড়ালে নিজের চোখের জলটা মুছে নিলো সে।
.
.

বিয়ের পর এই প্রথম অফিসে যাচ্ছে পালক।তার সাথে গাড়িতে আছে আয়না এবং রাদ।মাঝরাস্তা রাদ গাড়ি থামাতে বললো এবং কিছুসময় পর ইয়াসিন এসে ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা আয়নার পাশে বসে পড়লো।ইয়াসিনকে নিজের পাশে দেখে আয়না ক্ষে’পে গেলো।

” এই জুতো চো’র আপনি আমার পাশে কি?বসতে হলে পেছনে যান।”

” ভা’ঙা আয়না তোমার বুদ্ধি দেখি তোমার মতোই ভা’ঙা।পেছনে বসে আছে একজোড়া নবদম্পতি।এটা হচ্ছে তাদের রোমান্স করার সময় আর তুমি কিনা বলছো তাদের পাশে বসতে।মিঙ্গেলের সাথে আমি সিঙ্গেল বসলে কেমন দেখাবে।আমি আবার দয়ালু মানুষ।অন্যের অধিকার আমি ছিনিয়ে নিতে পারবো না।তাই না স্যার?”

” আয়না মুলা তোর পাশে বসলে সমস্যা কোথায়?সে তো প্রতিদিন আমাদের সাথেই অফিসে যায়।”

” কিন্তু আজ তো প্রতিদিন না।অন্যদিন এই জুতো চো’র তোমার পাশে বসতো কিন্তু আজ তো আমার পাশে বসেছে।”

” আচ্ছা আয়না আজকের দিনটা একটু মানিয়ে নাও,কাল থেকে আমি বসবো তোমার পাশে।এখনো গাড়ি চালো করো বোন,অফিসে পৌঁছোতে দেরি হয়ে যাবে।”

পালকের কথায় আয়না চুপ হয়ে গেলো।ইয়াসিন একটা বিজয়ের হাসি দিলো যা দেখে আয়না চোখ গরম করে তার দিকে তাকালো।

অফিসে এসে ইয়াসিন,আয়না,রাদ তারা তিন রাদের কেবিনে চলে গেলে আর পালক বসলো নিজের ডেস্কে।ইতিমধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গিয়েছে।কেউ হাসাহাসি করছে,কেউ টিটকারি মারছে আবার কেউ হাসিমুখে নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানাচ্ছে।তবে একটা জিনিস যেটা পালকের সবচেয়ে বেশি খা’রা’প লেগেছে সেটা হচ্ছে এখানে কয়েক কর্মচারী যারা সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলো,তারা জানে পালক আর রাদের বিয়েটা কোন পরিস্থিতির মধ্যে হয়েছে কিন্তু তাও তারা হাসাহাসি করছে,বা’জে ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলছে।

” কি ব্যপার পালক তাহলে এই ছিলো তোমার মনে।তাই তো বলি স্যারের সাথে তোমার কিসের এতো কথা।বারবার এসিস্ট্যান্টকে দিয়ে তোমার এতো খোঁজ খবর কেন নেয়।তা আসলেই কি এটা অনাকাঙ্খিত ছিলো নাকি প্ল্যান করে পালিয়ে বিয়ে করেছে তোমরা?তা কি দেখে এরকম প’ঙ্গু ছেলেকে বিয়ে করলে?শুনলাম তোমার অবস্থা নাকি খুব একটা ভালো না নিশ্চয়ই টাকা দেখে বিয়ে করেছে।ঠিক বলছিনা?” তাচ্ছিল্যভাবে বললো নোরা।নোরা কথাগুলো একটু জোড়ে বলার কারণে আশেপাশে থাকা মানুষগুলো তা শুনে মিটিমিটি হাসছে।পালক চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নোরার চোখে চোখ রেখে হাসি মুখেই জবাব দিলো,

” আসলে কি বলোতো নোরা মানুষ যেমন চরিত্রের হয় অন্যকেও সে সেইরকম ভাবে।যে মানুষ নিজে প্রেম করে,শখানেক মানুষকে ঠ’কিয়ে নিজের কার্যসিদ্ধি করে থাকে সেই মানুষটাই অন্যজন প্রেম করলে ছিঃ ছিঃ করে তাকে হাজারটা জ্ঞান দিতে আসে।কিন্তু সে ভুলে যায় তার নিজের চরিত্রটাই ঠিক নেই।এখন তোমার যদি মনে হয় আমি লো’ভে পড়ে এসব করেছি তাহলে আমার তো আর সাধ্য নেই তোমার চিন্তাধারা পরিবর্তন করার।”

পালকের হাসি মুখে অপমান শুনে নোরা থমথম করে জায়গাটা ত্যাগ করলো।
.
.

” কি ভাইয়া ভাবীকে মানাতে পারলি?”

” ধুর সে তো আমার মনের কথাটাই বোঝেনি এখনো,মানাবো কি করে?আগের থেকে এখন একটু হাসিখুশিভাবে কথা বলে আমার সাথে কিন্তু এইসময় মনে কথা বললে আমার থেকে সে দূরত্ব বজায় রাখবে।বন্ধুর মতো ব্যবহারটাও সে করবেনা।” হতাশ হয়ে বললো নিহাদ।

” তো এখন কি করবি?ভাবীকে যদি অন্যকেউ নিয়ে যায় তবে?”

” এখন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।আর শান্তি নগরের রাজকন্যা আমার।আমার রাজকন্যাকে আমি ছাড়া কেউ নিজের ঘোড়ায় চড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবেনা।শান্তিনগরের রাজকন্যা তো আমার ঘোড়ায় চড়ে আমার রাজ্যেই আসবে।” ফুলের দিকে তাকিয়ে বললো নিহাদ।

চলবে……..