শান্তি সমাবেশ পর্ব-৪৫

0
732

#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৫

মৃত্তিকা’কে নিয়ে হসপিটালে বসে আছে পূর্ণ। ডক্টর দেখে গিয়েছে কিন্তু ততটা শিওর হয়ে কিছু বলে নি। টেস্ট করিয়েই বাকিটা বলবে। এদিকে পূর্ণ অস্থির হয়ে আছে। শশুর’কে কি জবাব দিবে ও যে একদিন ও বাবাহীনা মেয়ে’কে সে দেখে রাখতে পারে নি? মৃত্তিকা’র একটা হাত পূর্ণ’র হাতের মুঠোয়। শক্ত করে তা ধরে আছে ও। জ্ঞান ফিরতেই মৃত্তিকা তাকায় পূর্ণ’র দিকে। এক মলিন চেহারা নিয়ে তারই দিকে তাকিয়ে আছে সিনিয়র ভাই পূর্ণ। মৃত্তিকা কিছু বলার আগেই হঠাৎ করে পূর্ণ ওর গলদেশে মুখ গুজে দিলো। এতেই ক্ষ্যান্ত না পূর্ণ বরং এই প্রথম পূর্ণ’র মতো পুরুষটা কেঁদেও ফেললো।
ঘটনার প্রেক্ষিতে কিংকর্তব্য বিমূঢ় মৃত্তিকা। অসুস্থ হলো মৃত্তিকা। কান্নাটা তো তারই করা উচিত তাই না? উল্টো পূর্ণ’র কান্না করার কারণটা ও বুঝলো না। কিছু বলার সুযোগটা ও যেন হচ্ছে না ওর। নিজের ই দূর্বল দূর্বল লাগছে এরমধ্যে পূর্ণ’র কান্না যেন ওকে আরো দূর্বল করে তুলতে সক্ষম। গলা তার ভিজে গিয়েছে এতক্ষণে অনেকটা। পূর্ণ ফুঁপিয়েই যাচ্ছে। থামাথামি নেই। সারাজীবনের আদুরে মৃত্তিকা আজ পূর্ণ’র মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললো,

— আর কাঁদতে হবে না। আমি ঠিক আছি পূর্ণ।

পূর্ণ থামে না। মৃত্তিকা’র ও কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছে না। শরীর তার অনেকটা দূর্বল। পূর্ণ এমন ভাবে ধরেছে উঠার ও জোঁ নেই। এক হাত মৃত্তিকা’র পেটে রেখে অন্যহাতে ওকে আঁকড়ে আছে। না পেরে মৃত্তিকা ও ওকে আঁকড়ে ধরে। ভাঙা গলায় ডাকে পূর্ণ,

— মৃত্ত?

— হু…বলুন।

— আমার কেমন জানি লাগছে?

— আপনার কেন কেমন লাগছে? অসুস্থ তো আমি।

পূর্ণ’র মাথাটা নিজের গলা থেকে বহু কষ্টে ঠেলে তুলে মৃত্তিকা। অস্থির লাগছে ওর। ততক্ষণে হুরমুর করে কেবিনে ঢুকে পূর্ণ’র মা-বাবা। পিছু পিছু উজ্জ্বল আর হিমু হাজির। তাদের পেছনে উপস্থিত মিঠি আর ওর মা। মৃত্তিকা অবাক চোখে তাকিয়ে পুণরায় তা বুজে নিলো। এত মানুষ তার চাই না। বাবা নেই ওর কাছে। বাবা থাকলে অসুস্থ শরীরটা তার বুকে এলিয়ে দিতো ও৷ একটু শান্তি পাওয়া যেত। হঠাৎ সবাই’কে অবাক করে দিয়ে পূর্ণ ডেকে উঠলো বাচ্চা গলায়,

— আব্বু?

ওর বাবা তাকিয়ে এক পা এগুতে নিলেই পূর্ণ ছিদ কাঁদুনের ন্যায় কেঁদে ঢলে পড়ে বাবা’র উপর। হঠাৎ ওর এহেন দশায় সবাই চমকায়। যেই সেই চমকানো না বরং ভয়ংকর চমকানো। জন্মের পর এই প্রথম কি না এই ছেলে জ্ঞান হারালো। কিন্তু কেন? শুধু মাত্র মৃত্তিকা অসুস্থ বলে?

_____________

মৃত্তিকা আর পূর্ণ’কে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে সকলে। বাকি ছিলো সাফারাত? সে ও হাজির। সকলের মুখ হাসিহাসি অথচ কাঁদছে মৃত্তিকা। পূর্ণ’র বুকে মুখ চেপে কেঁদেই যাচ্ছে। এই মুহূর্তে তার বাবা’কে দরকার অথচ মৃন্ময় হাওলাদার নেই। হঠাৎ করে এত এত মানুষের মাঝে একটা পুরুষ কন্ঠ শুনা গেলো,

— আম্মা?

মৃত্তিকা ঝট করে মুখ তুলে পূর্ণ’র বুক থেকে। তাকায় বিস্ফোরিত চোখে। ওর বাবা দাঁড়িয়ে। মৃত্তিকা ফ্যালফ্যাল করে যখন তাকিয়ে রইলো তখনই মৃন্ময় হাওলাদার এগিয়ে এসে এক হাত বাড়িয়ে দেন। মৃত্তিকা তাতে নিজের হাত রাখে। হ্যাঁ এটাই তার বাবা। উঠে দাঁড়িয়ে ঝাপ্টে পরে ও বাবা’র বুকে। মৃন্ময় হাওলাদার বুক ভরে শ্বাস টেনে নেন। অনেকক্ষণ যাবত আটকে রাখা শ্বাসটা ত্যাগ করেন তিনি। মৃত্তিকা বাবা’র বুকে নাক,মুখ ঘঁষে মুছতে মুছতে বলে উঠলো,

— তোমার রাজকন্যা মা হবে বাবা।

থমকে যান মৃন্ময় হাওলাদার। থমকে গেলো না বুঝি সময়টা? প্রীতিকর অনুভূতি সারা সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে গেলো মুহুর্তেই। হঠাৎ খেয়াল হলো তার নিজেকে অনেকটাই হালকা হালকা লাগছে। তার রাজকন্যা’র কি না রাজকুমারী আসছে? এত খুশি কোথায় রাখবেন তিনি? আচ্ছা আজ খুশিতে পাগল হলে কি ক্ষতিটা অনেক হবে? হলে হোক। মৃন্ময় হাওলাদার ঝট করে মেয়েকে পাজা করে কোলে তুলতেই দুই হাতে বাবা’র গলা জড়িয়ে বুকে মাথা গুজে মৃত্তিকা। সকলকে অবাক করে দিয়ে পরপর তিনটা ঘুন্না খান মৃন্ময় হাওলাদার। উচ্ছসিত গলায় বলতে থাকেন স্ব শব্দে চেঁচিয়ে,

— আমার রাজকন্যা মা হবে। আমার মায়ের মা আসবে। আল্লাহ! এত খুশি কোথায় রাখব আমি।

সকলের মুখ জুড়ে হাসি। পূর্ণ বোকা’র মতো তখনও চোখে পানি নিয়ে তাকিয়ে আছে। তার কান্না পাচ্ছে এখনও। বাবা বাবা অনুভূতি গুলো বুঝি এমনই হয়?
.
বাবা’র কোলে মাথা দিয়েই ঘুমাচ্ছে মৃত্তিকা। স্বভাব সুলভ মেয়ের চুলে হাত মৃন্ময় হাওলাদারের। পূর্ণ’র মাথা ও তার পাশের বালিশে। দরজায় নক হতেই দু’জন তাকায় ওদিকে। পূর্ণ’র মা-বাবা দাঁড়িয়ে। ওর মায়ের হাতে মোটা কিছু একটা। মৃন্ময় হাওলাদার হাসি মুখে ভেতরে আসতে বলতেই পূর্ণ’র মা এগিয়ে এসে মৃত্তিকা’র মুখে হাত বুলান। কপালে চুমু খেয়ে কেঁদে ফেলেন। মৃন্ময় হাওলাদার শান্ত চোখে তাকিয়ে। পূর্ণ আস্তে ধীরে উঠে বসে। বাবা’র দিকে তাকিয়ে লাজুক ভাঙ্গিতে হাসে। পূর্ণ’র বাবা জোরেই হেসে উঠলেন। ঠাট্টা মিশ্রিত কন্ঠে বললেন,

— অনেক জ্বালিয়েছো আমাকে৷ এবার নিজের একটা আসবে। এখন বুঝবা কেমন লাগে?

পূর্ণ হেসে ফেলে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর মা-বাবা। এই ছেলে এভাবে প্রাণ খুলে শেষ কবে হেসেছিলো? কবেই বা প্রাণ খুলে মেলিছিলো তার অশ্রু দ্বার? বাবা হবার সুখ তাকে দিয়ে সবটা করিয়ে নিয়েছে। পূর্ণ’র মা মৃত্তিকা’র পেটে হাত রেখে অশ্রু ভরা চোখে বলে উঠেন,

— অনেক ক্ষমতাশালী তুুমি। পৃথিবীতে আসতে না আসতেই আমার ছেলের মতো শক্ত মানুষকে হাসিয়েছো, কাঁদিয়েছো। আজ থেকে আমার ছেলেকে তোমাকে দিয়ে দিলাম দাদুভাই। তার দুটো মা হোক। তুমি তার জন্য রহমত আর বারাকাহ্ নিয়ে এসো। তোমার পাষাণ বাবা’কে নমনীয় করে তুলো। যা আমি এবং তোমার মা পারি নি তা তুমি করে দেখাও।

পূর্ণ মন ভরে শুনে তার মায়ের কথা। আচ্ছা তোর ছোট্ট সোনাটা ও কি শুনলো তার দাদু’র কথা? পূর্ণ’র কেমন একটা লাগে? বুঝে আসে না এই অনুভূতি। এই ভেতরে টাইটুম্বুর লাগে আবার ফাঁকা লাগে পরক্ষণেই লজ্জা লাগে আবার কেমন হাসি পায় ততক্ষণে কেমন কান্না ও পায়। সকল অনুভূতি গুলো মিলে কেমন জগা খিচুড়ি হয়ে আছে। সব গুছাতে তার মৃত্ত’কে লাগবে। একটা বার একা পাক আগে। পূর্ণ থেকে এতবড় কথা লুকানোর জন্য পূর্ণ তাকে শাস্তি দিবে। শান্তিময় শাস্তি।

পূর্ণ’র মা হঠাৎ মৃন্ময় হাওলাদারকে উদ্দেশ্য করে ডেকে উঠে,

— দুলাভাই।

চোখ বুজেন মৃন্ময় হাওলাদার। কানে বাজে কিশোরী এক কন্ঠ। যে ঝলমলিয়ে হাসতে হাসতে ডাকতো হুটহাট করে “দুলাভাই”। আজ অনেক বছর এই ডাকটা কানে আসে তার।
মৃত্তিকা’র মা আর পূর্ণ’র মা আপন চাচাতো বোন ছিলো। পূর্ণ’র মা ভালোবেসে পূর্ণ’র বাবাকে বিয়ে করাতে তার পরিবার তাকে ত্যাগ করেছিলো। যখন অনেক আকুতি মিনতি করেও পরিবারের মন গলে নি তখন তারা পারি জমান কানাডায়। ভিন্ন একটা পরিবার হয় তাদের। মৃন্ময় হাওলাদার আবার পালানো পছন্দ করতেন না। তিনি সোজা বউ তুলে নিয়ে বিয়ে করেছিলেন। এখন অবশ্য মৃত্তিকা’র মায়ের পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। তাদের ছোট্ট ছোট্ট তিন সদস্যের পরিবার ছিলো৷

আলমারিতে পুরাতন একটা এলমাবে তখন পূর্ণ’র মা তার বোনের একটা ছবি দেখেছিলেন। এমনটা না তার আগে সন্দেহ হয় নি। চেহারা তো কারো সম্পূর্ণ বদলায় না কিন্তু চেনা যায় নি মৃন্ময় হাওলাদারকে। সুদর্শন মৃন্ময় হাওলাদারের মুখের চাপ দাঁড়ি আর সুঠাম দেহ হয়তো লুকিয়ে ফেলছিলো তার যুবক কালের ছাপ।
এয়ারপোর্টেই যখন পূর্ণ’র বাবা কল দিয়ে জানায় তার মেয়ে জ্ঞান হারিয়েছে তখনই ফ্লাই করার ঠিক আগ মুহূর্তে তিনি ফিরে আসেন। এই মুহূর্তে তার রাজকন্যা থেকে গুরুত্বপূর্ণ তার নিকট আর কিছুই না। হয়তো প্রেয়সীর কোন একটা ইচ্ছে পূরণ করার জন্যই এত দূরে যেতে চেয়েছিলেন তিনি কিন্তু তার প্রেয়সীর একমাত্র অস্তিত্ব থেকে অবশ্য সেটা বড় না।

#চলবে….