তেরো ফাল্গুন পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
175

#তেরো_ফাল্গুন (অন্তিম পর্ব)
#মেঘা_সুবাশ্রী (লেখিকা)

হতাশায় আচ্ছন্ন ইমরান। কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পেল না। নিজেদের বলতে একখান জমিই আছে। বোন তার বিবাহ যোগ্য। চারদিক থেকে বিয়ের জন্য চেপে ধরেছে সবাই। মায়েরও আজকাল কোমর ব্যাথা বেড়েছে। বসে বসে কাজ করতে পারে না আগের মত। নিরুপায় হয়ে একদিন সে মায়ের কাছে একটা প্রস্তাব রাখল। নূরবানু প্রথমে রাজি হলেন না। তার ভয় চেপে ধরল। যদি সফল না হয় তাহলে পথে বসতে হবে তাদের। তবুও ছেলের কথায় ঝুঁকি নিলেন। আল্লাহ চাইলে হয়তো মুখ তুলে তাকাবে।

ইমরান মায়ের কথায় আশ্বাস পেয়ে উদ্যোগ নিল জমিতে একটা পুকুর খনন করবে। পুকুর খুব বেশি গভীর হবে না। তার একপাশে হাঁসের খামার থাকবে। চাকরির জন্য তো কম চেষ্টা করেনি। কিন্তু একটা ভালো চাকরি তার আজও হল না। ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে নিজেই উদ্যোক্তা হওয়ার ইচ্ছে পোষণ করল। কিছু টাকা মায়ের ছিল। আর কিছু টাকা লোন নিল ব্যাংক থেকে। ব্যাংকের আর মায়ের টাকা মিলিয়ে বেশ বড় একটা টাকার অংক হল। প্রথমে পুকুর খনন করল। অন্যপাশে থাকবে পুকুরের সাথে লাগোয়া হাঁসের খামার। যাতে হাঁসদের পানিতে নামতে অসুবিধে না হয়।

গ্রীষ্মের উত্তপ্ত দিনের মধ্যে তার খামার আর পুকুর খননের কাজ শেষ হল। কাজ শেষ হওয়ার পাঁচ’দিন পর টানা দু’দিন অর্তকিত ভারী বর্ষণ হল। হঠাৎ বৃষ্টিতে তার পুকুরে ঢের পানি জমল। ইমরান খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। শুকরিয়া জানাল আল্লাহর প্রতি। তার পুকুরের জন্য পানির প্রয়োজন ছিল। সেই কাজ’টা প্রাকৃতিকভাবে হয়ে গেল। এজন্য হয়ত বলে বিপদে ধৈর্য্য ধারণ কর। তোমার লক্ষ্য স্থির কর, সৎ ইচ্ছে পোষণ কর। দেখবে একদিন তুমি সফল হবে।

প্রায় তিন’মাসের মধ্যে পুকুরের মাছ বিক্রির উপযোগী হল। দু’মাসের মধ্যে তার হাঁসের ডিমও দেয়া শুরু করেছে। পুকুরের ধরন আর বর্তমান বাজারের মাছের চাহিদার কারণে সে পাঙ্গাস মাছ চাষ করল। তার পুকুরের চাষকৃত মাছ গ্রামের মানুষজনই বেশি ক্রয় করে নিল। হাঁসের ডিম আর হাঁস কিনার জন্য তার কাছে ছুটে আসত লোকজন। সে নতুন হিসেবেও বেশ সফল হল। প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে মোটামুটি ভালোই ছিল তার আয়। কিন্তু তা দিয়েই সংসার ভালো চললেও অন্যকিছু করা সম্ভব হচ্ছিল না। খামার আর পুকুর আরও বাড়াতে হবে। তার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। কিন্তু তার যৎসামান্য আয় দিয়ে জমি কিনা সম্ভব নয়। সে ধৈর্য্য ধরল। কিছু টাকা জমানোর জন্য চেষ্টা করে।

প্রায় দু’বছরের কঠোর পরিশ্রমের ফলে তার খামার থেকে বেশ ভালোই আয় হল। নিজের কিছু টাকা জমল। মায়ের সাথে একদিন পরামর্শ করে বাড়ির মধ্যে ছোট করে একটা গরুর খামার দিল। প্রথমে তিনটে গরু নিল। পরে আরও কিছু টাকা জমিয়ে এর দু’মাস পর আবার তিনটে গরু নিল। পাঁচমাস নিজে’রা পালন শেষে তা কুরবানীর সময় বেশ চড়া দামে বিক্রি করল। তার হাতে এবার বেশ বড় অংকের টাকা আসল। সেই টাকা দিয়ে দু’টো পুকুর বন্ধক নিল। আবার দু’টো খামার ভাড়া নিল। আর পাশের একটা জমি ক্রয় করল সে। সেখানে পুকুর খনন করবে একটা আর খামার দিবে। ভালোই দিন যাচ্ছিল তার।

এর মাঝে তার বোনের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসল ভালো পরিবার থেকে। পার্বত্য অঞ্চলে বিশাল রাবার বাগান আছে তাদের। পাশাপাশি তাদের নিজেদের কাঠের ব্যবসা। ছেলে স্নাতক শেষ করেছে আরও দু’বছর আগে। তার থেকে বছর দুয়েকের ছোট। পরিবারে তিন ভাইয়ের মধ্যে ছেলে সবার ছোট। দু’বোন ছিল বিয়ে হয়ে গেছে। তার পরিবার পছন্দ হল। বোনকে ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে দিল। বোনের বিয়ের পর তার মা’ তাকেও বিয়ের জন্য চাপ দিল। ইমরান প্রথমে রাজি হল না। শেষে মায়ের কথা রাখতে বিয়ের জন্য হ্যাঁ’ বলল। মেয়ে দেখার জন্য তাকে যেতে বললেও সে গিয়ে দেখল না। মা’কে বলল, তুমি যেমন পছন্দ করবে আমি বিয়ে করব।

সময় গড়াল আরও ছ’মাসে। ইমরান মায়ের পছন্দেই বিয়ে করল। বউ দেখে বেশ অবাকই হল। মেয়ে সত্যিই অতুলনীয় সুন্দরী। সে ভাবতেই পারিনি এমন মেয়ে বিয়ে করতে পারবে। মেয়ের পরিবারের ইতিবৃত্ত শুনে সে আরও বেশি চমকাল। বাবা একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তিন ভাইবোন। মেয়েরা দু’বোন এক ভাই। ভাই সবার ছোট। তার বউ পরিবারে সবার বড় মেয়ে। বিয়ের রাতে সে বউকে প্রশ্ন করল,

“আমার মত এমন নিম্ন পরিবারের ছেলের কাছে কিভাবে বিয়ে দিল তোমার ম্যাজিস্ট্রেট বাবা।”

বউ’ নিজের লজ্জা ভুলে তার দিকে তাকিয়ে থাকল দীর্ঘসময়। বেশ ক্ষানিক বাদেই উত্তর দিল,

“সেটা তো আমার বাবাই জানে। আমি কি করে বলব।”

ইমরান নিশ্চুপ হাসল। বউ তো তার বেশ বুদ্ধিমতি। কিন্তু মানুষ হিসেবে কেমন? তা তো জানা নেই। সে নামটাও ঠিক করে জানে না। সবকিছুই তার মা’ করেছে। এখন কিভাবে জিজ্ঞেস করবে তোমার নাম কি? এই মেয়ে বলে ডাকবে না’কি বউ বলবে। কি বললে খুশি হবে। বেশ দো’টানায় পড়ল সে। বুদ্ধি খাটিয়ে বলল,

“আচ্ছা, তোমার পুরো নাম কি?”

‘তাইজুম তানিন’

“আমি তোমাকে ‘জুম’ ডাকলে রাগবে না’তো।”

তানিন লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেল। মুখে উত্তর দিল না। তার মনে বেশ রাগ জমে আছে। কেমন জামাই তার, তাকে একবারও বিয়ের আগে দেখল না। কোনদিন একটা ফোনকলও দেয়নি। সে কত অপেক্ষা করেছে। একবার হলেও কথা বলবে, তাকে দেখতে চাইবে। কিন্তু এর কিছুই হল না। সে ইমরানের জবাবে কিছুই বলল না।

ইমরান জবাব না পেয়ে ঘাবড়ে গেল। পুনরায় বলল, ‘রাগ করেছো জুম।’

তানিন না বলে মাথা নাড়াল। ইমরান তানিনের একটা হাত নিজের মুঠোয় নিল। তারপর নিজের একান্ত কিছু কথা বলল,

“বিয়ের আগে কেনো তোমাকে দেখিনি জানো, আজকে মন ভরে দেখব বলে। যেন আমি অবাক হই তোমায় দেখে। একটা কথা বলব শুধু। আমাকে কখনও ছেড়ে যেওনা। যদি আমার কখনো ত্রুটি খুঁজে পাও তবে নির্দ্বিধায় বলে দিও। আমি রাগ করব না। কিন্তু কখনও ছেড়ে যেও না। তাহলে আমি নিঃস্ব হয়ে যাব।”

তানিন হতবাক ইমরানের কথা শুনে। বিয়ের রাতে কোনো স্বামী এমন কথা বলতে পারে তার জানা নেই।
_

সময়ের পালাবদলে সময় গড়াল পাঁচ বছরে। ইমরানের খামারের ব্যবসা ব্যাপক প্রসারিত হল। নিজের একটা বিশাল প্রজেক্ট করল। সেখানে সাতটা খামার নির্মিত হল। গরু, মোরগ, হাঁস সবই ছিল এই খামারে। পাশাপাশি পুকুর ছিল চারটা। পুকুরের ধরন দেখে মাছের চাষ করল। মাসিক ইনকামও বাড়ল তার। পাশাপাশি নিজেদের জন্য একটা পাকাবাড়ি নির্মাণ করল। ইমরান আর তানিনের একটা কন্যা সন্তান হল। মেয়ের নাম রাখল ইনায়া। মেয়ের বয়স বর্তমানে তিন বছর পাঁচ মাস। স্ত্রী, সন্তান আর মা’ নিয়ে বেশ ভালোই দিন যাচ্ছে তার।

তানিন ইনায়াকে নিয়ে নিজের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে। ইমরানের সময়ের অভাবে খুব বেশি যাওয়া হয় না শ্বশুর বাড়ি। একদিন সকালে তানিন কল দিল ইমরানকে। ইমরান রিসিভ করার পর বলে উঠল,

“আজকে দুপুর বেলায় আমাদের বাড়িতে আসবে। আসার সময় কিন্তু আম্মাকেও নিয়ে আসবে।”

এরপর তাদের মধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কথা চলল। ইনায়ার সাথেও কথা বলল। তারপর কথা বলার একপর্যায়ে তানিন বলে উঠল,

“জানো, আজ একটা ঘটনা শুনে চমকালাম। একজন মহিলার জীবন কেমন করুণ হতে পারে ভাবতেও পারবে না। কেমন ভাবে দিনের আলোর মত আজ ভিখারিতে পরিণত হয়ে গেল তারা। তার স্বামীর পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দেনা-পাওনা ছিল। সময় মত টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তার স্বামীর নামে মামলা দেয়া হয়। এলাকার সন্ত্রা,সী’রা তার উপর হামলাও করেছিল কয়েকবার। বর্তমানে তিনি পলাতক। লুকিয়ে সৌদিআরব চলে গিয়েছে। দেশে আসতে পারে না গত পাঁচবছর। তেমন একটা আয় উপার্জনও নেয়। মহিলার কথা শুনে আমার বেশ খারাপ লেগেছে। তাদের ফেনীতে দু’টো কাপড়ের শোরুম ছিল। সেটা বর্তমানে সন্ত্রা,সীদের দখলে। ফ্ল্যাট বাসাও বিক্রি করে দিয়েছে। গ্রামের বাড়িতেও থাকতে পারে না লোকজনের হুমকির ভয়ে। এখন মহিলা দু’বাচ্চা নিয়ে বাবার বাড়িতে কোনোরকম দিনযাপন করেন। তাও ভাইয়ের বউয়ের বিভিন্ন কটুবাক্য শুনতে হয়। অনেক কষ্টে আছে বেচারি।
আমার বাবার কাছে এসেছিল মামলা নিয়ে কথা বলতে। কোন সুরাহা পায় কি’না। জানো, মহিলা অঝোরে কাঁদছিল। শ্বশুর বাড়ি থাকতে দেয় না। আবার বাবার বাড়িও থাকতে হয় অনেক কষ্টে।”

ইমরান নিরবে সব শুনল। সব শুনে বলে উঠল, ‘বাড়ি কোথায় মহিলার?’

“আমি তো জানি না। তবে মহিলা আজ বিকেলে আবার আসবে। সকালে বাবা বাড়িতে ছিল না। তাই দেখা হয়নি।”
_

দুপুর বেলায় ইমরান তার মা’কে নিয়ে হাজির হল। খাবার শেষে বিকেলের সময়’টাতে কিছুক্ষণ বসল। এরপর পড়ন্ত বিকেলে বউ আর মেয়েকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিল। সে মোটরবাইকে করে বাড়ি ফিরছে। তানিনদের গাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। মোটরবাইক নিয়ে মোড় ঘুরতে আচমকা তার দেখা হল এক মহিলার সাথে। অর্ধ পুরাতন বোরকার আদলে মুখ ঢাকা থাকলেও তার চিনতে অসুবিধে হল না। সময়ের চাকায় দশবছর থেকেও বেশি হয়েছে। মহিলা তার পথ আগলে দাঁড়াল। ইস্ততঃবোধ করছিল প্রথমে। কিছুসময় পর বলে উঠল,

“কেমন আছ ইমরান?”

ইমরান বেশ গম্ভীর গলায় বলে উঠল,
“কে আপনি? এভাবে পরপুরুষের পথ আগলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

ফাহিয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। আরও কিছু বলতে উদ্বত হতেই ইমরান নিজের বাইক স্টার্ট দিল। পিছন ফিরে তাকানোর প্রয়োজন মনে করল না। তবে কাকতালীয় ভাবে আজকের তারিখ তেরোই ফাল্গুন। সে নিশব্দে হাসল। মনে মনে ধন্যবাদ দিল ফাহিয়াকে। তুমি ছেড়ে গেছ বলেই ঝুমের মত বউ পেয়েছি। ব্যর্থতা থেকে সফলতার মুখ দেখিছি। হারতে হারতে আজ জিততে শিখেছি। তবে এই তেরো ফাল্গুন আমার জন্য অভিশাপ নয় আশীর্বাদ।

_____ সমাপ্তি_____