শান্তি সমাবেশ পর্ব-৪৬ এবং শেষ পর্ব

0
897

#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#সমাপ্তি_পর্ব (প্রথমাংশ)

পূর্ণ পদত্যাগ করবে। কথাটা যেন আগুনের বেগে ছড়িয়ে গেলো। শাজাহান খান চিন্তিত হলেন। পূর্ণ’কে অনেক কষ্টে দলে এনেছিলেন তাদের দলে এছাড়াও পূর্ণ’র মতো বিচক্ষণতা খুব কম মানুষের মাঝেই আছে। ও দলত্যাগ করলে এটা নিয়ে কথাও কম উঠবে না। চিন্তিত ভঙিতে পূর্ণ’কে কল লাগান তিনি। কাজ হয় না। পূর্ণ কিছুতেই আর এসব রাজনৈতিক কাজে জড়াবে না। সে বাঁচবে। সংসার করবে। ঝুট ঝামেলাহীন সংসার। একটা সন্তান ই হয়তো যথেষ্ট পূর্ণ’র মতো কঠিন বাবা’কে এতটা শায়েস্তা করতে। কথাগুলো ভাবতেই ওর বাবা-মা হেসে ফললেন৷ মৃত্তিকা তখন নিজের রুমে। বাকিরা বসা ড্রয়িং রুম জুড়ে। আজ রাতে এখানেই ডিনার হবে একসাথে।
ওদের মাঝে সাফারাতের উপস্থিতি যেন সবটা একদম নিস্তব্ধতায় ঘিরে ফেলে। পূর্ণ’র মা-বাবা হঠাৎ সাফারাতে’র উপস্থিতিটা হয়তো মানতে পারছে না। অপলক তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তাদের দিকে সাফারাত তাকিয়ে আছে মায়াময় দৃষ্টিতে। আজ শুধু মাত্র সাফারাতে’র জন্য এরা মেয়ে হারা। কানাডায় ফিরত যাওয়ার পূর্বে একবার শুধু তাদের সাথে দেখা করতে চায় ও। এছাড়াও পূর্ণ’র এত বড় খুশি’র সংবাদে না এসেও তার পক্ষে থাকাটা সম্ভব ছিলো না। হঠাৎ সকল পরিস্থিতি বদলে গেলো পূর্ণ’র মায়ের বাঁধ ভাঙা কান্নায়। দৌড়ে বলিষ্ঠ সাফারাতে’র দেহটা নিজের বুকে আগলে নিতে চাইলো। সাফারাত স্তব্ধ। বিমূঢ়। এমনটা আশা করে নি সে। ভেবেছিলো হয়তো শুনতে হবে অনেক কটু কথা অথচ পরিস্থিতি ভিন্ন। পূর্ণ’র মা’কেও দুই হাতে জড়িয়ে ধরে সাফারাত। কান্না আটকে ডাকে,

— মামনি?

ব্যাস সবটা যেন শান্ত। এই ডাকের বিনিময়েই সজোরে এক চড় পরলো সাফারাতে’র সুদর্শন মুখটায়। একটা তেই থেমে রইলো না। পরপর ওর বুকে অসংখ্য চড় বসালেন পূর্ণ’র মা। কন্ঠে তার অভিযোগ,

— কে…..কে তোর মামনি? একদম মামনি ডাকবে না? আমার কোন রাত নেই। শুধু মাত্র একটা পূর্ণ আছে। আর কেউ নেই। কেউ নেই আমার।

সাফারাত দুই হাতে জোর করে তাকে জড়িয়ে ধরতেই পুণরায় কান্নায় ভাঙেন উনি। বলতে থাকেন,

— কোথায় ছিলি আব্বু? মামনি কত খুঁজেছি তোকে। একটা বার মনে পরলো না আমাদের কথা? এই রাত? আব্বু আমার আমার মেয়েটা তো চলেই গেলো তুই কেন সবটা ভুলে গেলি?

সাফারাত কথা বলে না। শুধু শুনে। বলতে পারলো না সে ও যে ভালো ছিলো না। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তার সঙ্গী ছিলো কানাডার হসপিটালের সফেদ দেয়াল। আজও সে কতটা সুস্থ তা জানা নেই ওর। এই মনে হয় রুহা বসে আছে পাশে। এই মনে হয় এসে বুঝি জড়িয়ে ধরে। আবার মনে হয় কেউ তাকে বাবা ডাকে। কতকিছু কল্পনা হয় অথচ সাফারাতের কাছে সবটা বাস্তব। তার বাস্তব দুনিয়ায় একটা সংসার রয়েছে। সেই সংসারে তাদের মেয়ে সন্তান আছে। তার আর তার রুহা’র একটা এঞ্জেল আছে। সে রোজ তার বাবা’র সাথে কথা বলে। আদো আদো বুলিতে কথা আবদার তার। সাফারাত শুনে তার এঞ্জেলের আবদার। রুহা কথা বলে কম। সে রেগে আছে তার রাতের সঙ্গে। সাফারাত আর এঞ্জেল ই কথা বলে। চুপচাপ তা শুধু শুনে রুহা। নীরবে।

পূর্ণ’র বাবা ও এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে নেয় ওকে। তাদের কাছে সাফারাত কখনো বাইরের কেউ ছিলো না বরং সে ছিলো তাদের কাছে পূর্ণ’র মতোই। প্রতিশোধ কখনো মঙ্গল বয়ে আনে না। প্রতিশোধ আনে ধ্বংস। সেই ধ্বংসের মাদুলে এগুলোই বিধ্বংস হয় প্রতিশোধ দান কারী। শোয়েব মির্জা’কে ভয়ংকর শাস্তি দিতে চেয়েছিলো পূর্ণ। সবটা পরিকল্পনা মাফিক হলেও শেষে এসে ওর মা যখন নিজের কসম দিয়ে বসলেন তখনই রেগে গিয়েছিলো পূর্ণ। আল্লাহ বাদে কোন সৃষ্টির কসম কাটা নিষেধ। মা-বাবা’র দিকে তাকিয়ে পূর্ণ শুধু পিছু হটে। কিন্তু একেবারে ছেড়ে দেয়ার মতো ভালো আবার পূর্ণ না। সে শোয়েব মির্জা’র ভালো মুখোশটা সকলের সম্মুখে নির্মোচন করবে। তার বিরুদ্ধে সবটা প্রমাণ হাতে আছে তার। অফিসার মায়ানকে দায়িত্বটা দেয়া হয়েছিলো। এখন সময় সময়ের। পূর্ণ ভেবেছে পদত্যাগ করার দিনই সবটা করবে সে। এত সহজে তার বোনের খু*নি’কে ছাড়বে না সে।

একদিকের পরিস্থিতি তখন অনেকটা স্বাভাবিক। পূর্ণ ধীর পায়ে উঠে চলে যায়। এখন আর টিকা সম্ভব নয়। তার মৃত্ত’র দরকার। ভীষণ ভাবে দরকার। তাকে বুকে নিয়ে চেপে ধরে রাখলে হয়তো কিছুটা শান্তি মিলবে এই বুকে। পূর্ণ উঠে চলে যেতেই পেছন থেকে সবাই হেসে উঠে। এই বউ পাগল পূর্ণ নিয়ে কোথায় যাবে সবাই?
.
পূর্ণ রুমে ঢুকতেই দেখলো মিঠি’র সাথে কথা বলছে মৃত্তিকা। মিঠি পূর্ণ’কে দেখেই উঠে চলে যায়। বুদ্ধিমতি ও সে কম না। দরজাটা বাইরে দিয়ে আটকে ও দিয়ে গেলো। পূর্ণ মনে মনে বেশ খুশি হলো। মিঠি’কে কিছু দিতেই হবে। যেখানে এখানকার সকলে তাকে তার বউ থেকে আজ দূরে দূরে রেখেছে সেখানে মিঠি তাদের একসাথে করে দিয়ে গেলো। নিশ্চিত পূর্ণ কৃপণ নয়। শালি’কে কিছু তো দিবেই সে।

পূর্ণ’র আগমনে মৃত্তিকা যেন মূর্ছা যায়। মাথাটা একদম নামিয়ে রাখে। এদিকে এই প্রথম মৃত্তিকা’র সামনে পূর্ণ লজ্জা পাচ্ছে। এত রোপধোপ নিয়ে এসেছিলো সে। ভেবেছিলো মৃত্তিকা’কে শাসন করবে কেন লুকিয়েছে তার জন্য কিন্তু হলো কোই? পূর্ণ তো নিজেই কেমন কেমন করছে। পূর্ণ’র কোন হেলদুল না পেয়ে মৃত্তিকা মাথা তুলে তাকায়। মূর্তি’র ন্যায় পূর্ণ’কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃত্তিকা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। পূর্ণ’র হাবভাব বুঝার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও লাভ হয় না। বুঝা দায় তার মনোভাব। অবশেষে কিছুটা বিরক্ত ই হয় মৃত্তিকা। এভাবে দাঁড়িয়ে আছে অথচ মুখভঙ্গি অথবা নড়চড়ে পরিবর্তন নেই। এর মানে হয়?
মৃত্তিকা উড়ে দাঁড়ায় মাত্র ওমনি খপ করে তাকে ঝাপ্টে ধরে পূর্ণ। মৃত্তিকা অবুঝ হলো যেন৷ পূর্ণ চাইছেটা কি তা বুঝতে সে একদমই পারলো না। বেশ সময় গড়াতেও যখন পূর্ণ ছাড়লো না তখন মৃত্তিকা মোচড়াতেই ধমক কানে এলো,

— আর একটুও যদি নড়েন একদম বুকে চেপে ধরে ভেতরে পুরে নিব।

মৃত্তিকা শান্ত হয়ে গেলো। এই তো সিনিয়র পূর্ণ ভাই। ধমক যার ঠোঁটে এসে বসে থাকে। পূর্ণ নিজ থেকেই রঙ বদলালো। আবেগি গলায় বললো,

— এই মৃত্ত?

— হু।

— আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

— কি?

— বাবু।

— তাহলে?

— কি?

— বাবু তো আছে। বিশ্বাস না করলে কি করব?

— ও নড়ে না? আমাকে ছুঁয়ে দিতে দিন ওকে।

— নড়ে না তো।

— একটুও না?

— উহু।

— কি করে তাহলে?

— ধমক দেয়।

— কাকে?

এবার যেন মৃত্তিকা বিরক্ত হলো। কি সব আজিরা কথা শুরু করলো পূর্ণ। মানে থামার নাম গন্ধ নেই। বাচ্চা এলো শনিতে শনিতে আষ্ট দিন এরমধ্যে কি না নড়বে? গুটাতে? এসবের মানে হয় কোন? মোটেও না। মৃত্তিকা পূর্ণ থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলে উঠে,

— ছাড়ুন। উপফ। আপনার বিশ্বাস না হলে নাই। পূর্ণ ছাড়ুন। আমার অসস্তি লাগছে।

পূর্ণ ছাড়লো না তবে বন্ধনটা ঢিল করলো। মৃত্তিকা’র চোখে হাসি মুখে তাকিয়ে বলে উঠলো,

— ও নড়লে আমি সেটা ফিল করব মৃত্ত। একটা বাবু….ভাবুন। আমার বুকে থাকবে। আমি ওর সব করব মৃত্ত। ওকে অনেক অনেক ভালোবাসব। ও শুধু বাবা’কেই চিনবে দেখবেন।

— হ্যাঁ। মা তো থাকবে না।

পূর্ণ’র কপাল কুঁচকে এলো। এটা কেমন কথা মা থাকবে না? মুহূর্তেই মুখটা কেমন হয়ে এলো। মৃত্তিকা’র মুখটা নিজের হাতের আজলায় ভরে বলে উঠলো,

— এটা কেমন কথা মৃত্ত? এভাবে বলে কেউ? আর বলবেন না। ঠিক আছে? ওর মা-বাবা, দাদা-দাদু,নানা, খালা মিঠি এমনকি দুটো মামা হিমু,উজ্জ্বল আর চাচা রাত ও তো আছে।

মৃত্তিকা একপলক তাকিয়ে বললো,

— আমার দাদু বাবা হওয়ার পরই মা*রা যান। আমার ও আমার মা’কে মনে নেই। একটু ও না। সে আমার স্মৃতির কোথাও নেই পূর্ণ। আমি আমাদের সন্তানের স্মৃতিতে কিভাবে থাকবো?

পূর্ণ’র মুখটা ক্রমশ লাল হচ্ছে। চোখে যেন আগুন। মৃত্তিকা শরীরে চাপ অনুভব করলো যা ধীরে ধীরে বাড়ছে।

#চলবে…..

#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#সমাপ্তি_পর্ব (শেষাংশ)

অফিসার মায়ানের সামনে বসে আছে পূর্ণ। যদিও অফিসার মায়ান ভেবেছিলো পূর্ণ হয়তো অনেকটা চমকাবে কিন্তু তা হয় নি। পূর্ণ পুরোদমে স্বাভাবিক। এতটা স্বাভাবিক মানা যায়? মোটেও না। এত বড় এক ঘটনা ঘটলো অথচ পূর্ণ নির্বিকার। অফিসার মায়ান কিছুটা গলা ঝাঁড়ার ভঙ্গিতে ডাকলেন,

— ভাই?

— বল।

— কি করব না মানে…ইয়ে…

— এত ইতস্তত করার কি আছে? পুলিশ তুই যা করার দায়িত্ব তা ই কর।

— ভাই?

বেশ চিন্তিত স্বর মায়ানের। কি বলে এটা পূর্ণ ভাই? দায়িত্ব পালন করতে গেলে আজ বাঁশ’টা কে খাবে? দিন শেষে মায়ান ই তো খাবে৷ ওদের কথার মাঝে অফিসার জোহান হাজির। জুবায়ের হ*ত্যা মামলা’র তদন্ত সেই করছিলো। খু*নি যথেষ্ট সার্প ভাবেই কাজটা সম্পূর্ণ করেছিলো। এটাকে আদো খু*ন ও বলা যাচ্ছে না। নেশাখোরদের আবার মামলা? দায়টা মন্ত্রী’র ছেলে বলেই না এতটা? তবুও ও তো পূর্ণ জোর করলো নাহয় পুলিশ হিসেবে ততটা দায় না জোহানের যে নেশাখোরদের হ*ত্যাকারী খুঁজে বেরাবে।
পূর্ণ’কে যথাসম্ভব শান্ত দেখে অফিসার মায়ান’কে ইশারা করে জোহান। মায়ান অদ্ভুত মুখভঙ্গি করে মানে সে ফেঁসে আছে। জোহান ইশারায় জিজ্ঞেস করতেই শুনা যায় পূর্ণ’র কন্ঠ,

— রিপোর্ট কি দেখলি?

জোহান ঢোক গিলে। মিনমিন করতেই পূর্ণ ধমক লাগায়। ওমনিই গড়গড় করে জোহান বলতে থাকে,

— ভাই জুবায়ের নেশায় বুদ ছিলো। মানে ভাবি’কে যদিন খারাপ ভাবে স্পর্শ..আর কি ঐদিন রাতেই খু*ন হয়েছিলো। ওর শুধু কেউ হাত কেঁটে দিয়েছিলো। বন্ধুরা ও কেউ ছিলো না পাশে। একা ড্রাইভ করেই কাঁচা বাজারের ব্রীজের দিকে গিয়েছিলো। ওখানেই সবটা হয়। কিন্তু পানিতে ও নিজেই ব্যালান্স হারিয়ে পরে যায়।

— হু বুঝলাম। তো হাতটা কে কেটেছে?

— ভা..ভাই।

— তোতলানো বন্ধ কর।

— আপনার শশুর ভাই।

— প্রমাণ?

— তার গাড়ি লাস্ট ওখানে ছিলো।

— আর কোন প্রমাণ?

— না ভাই।

— তাহলে কি বলে এরেস্ট করবি আমার শশুর’কে?

জোহান চমকে উঠে প্রশ্ন করে,

— এরেস্ট করব মানে?

— তাহলে তুই না বললি আমার শশুর খু*নি?

— ভাই খু*ন হয় নি এটা। জাস্ট হাতের ব্যাপারটা নিয়ে আপনার শশুর’কে সন্দেহ করছি। খু*ন করেন নি উনি। লোক দিয়ে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে….

জোহান থেমে যায়। পূর্ণ বাঁকা হাসে। বলে উঠে ব্যাঙ্গ করে,

— শুকরিয়া আদায় কর। আমার শশুর ঐ দিন হাত না ভাঙলে ওর জানটা আমার হাতেই যেত। শশুড়ের মতো অত মায়া দয়া আমার আবার কাজ করত না তখন। আমার মৃত্ত’কে নোংরা ছোঁয়া দেয়া,তাকে কাঁদানোর উশুল সরুপ ওর জানটা খুব খারাপ ভাবে কেড়ে নিতাম।

জোহান আর মায়ান উভয় মুখ চাওয়া চাওয়ি করতেই পূর্ণ সরস গলায় বললো,

— এবার বল কি করবি? আমার বউ’য়ের সাথে অসভ্যতা করার জন্য ডায়রি লিখবি নাকি শশুর হাত ভাঙার জন্য তাকে গ্রেফতার করবি?

দুইজন চুপ করে বসে রইলো। দু’টোর কোনটা ই করে লাভ নেই। তার থেকে ফাইল ক্লোজ করাটাই বুদ্ধি মানের কাজ।

পূর্ণ ওখান থেকে বের হতেই দেখলো সাফারাত দাঁড়িয়ে। একটু হেসে পূর্ণ এগায়। জড়িয়ে ধরে সাফারাত’কে। এমন না পূর্ণ জানতো না সাফারাতে’র কোন দোষ নেই। সবটা জানতো ও। দোষ সাফারাতের একটাই। বাবা’কে বিশ্বাস করা। হয়তো ক্ষমতা লোভী শোয়েব মির্জা’র জন্য ক্ষমতা হারা হয়ে জীবন কাটানোটা ই সবচেয়ে বড় শাস্তি।

সাফারাত আর পূর্ণ একসাথে হেটে পাশের চায়ের দোকানে বসলো। গরম গরম চায়ে চুমুক বসিয়ে আড্ডা জমিয়ে তুললো। সাফারাত এক দুই মাস পরই কানাডা চলে যাচ্ছে। তার স্ত্রী আর সন্তান সেখানেই আছে। পূর্ণ শুধু জানিয়েছে রুহা এদেশে নেই। এর মানে তাকে কানাডায় ই দাফন করা হয়েছে।
ছোট্ট একটা নামের জেদী একটা মেয়ে। প্রেম করে জোর করে সবটা উশুল করলো। ভীনদেশে তাদের প্রেমের মাদুল বাজলেও অচিরেই বিনষ্ট হলো এ দেশের মাটিতে। এই দেশের মাটিই সাক্ষী একটা অর্ধ মৃত মানুষের গোঙানির অতঃপর আজীবনের জন্য দুনিয়া ত্যাগ করা। একটা ছোট্ট স্বপ্ন দেখা মেয়েটা’র দুনিয়া ধ্বংস হয়। সে দুনিয়া ত্যাগ করলেও তার স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে সাফারাত। আজীবন থেকে যাবে এক অসম্পূর্ণ প্রেম গাঁথা “মাশরুহা সাফারাত”।

__________________

রাত কয়টা ঠিক নেই। মৃত্তিকা’কে ঝাপ্টে নিজের সাথে মিশিয়ে গল্প জুড়েছে পূর্ণ। কথা তার কম কল্পনা বেশি। মৃত্তিকা মুখ চেপে হাসছে শুধু। কেউ কিভাবে এতটা কল্পনা বিলাসি হয়? তাও কি না লোকটা পূর্ণ ভাই। একটা না আসা প্রাণ কিভাবে বদলে দিলো মৃত্তিকা’র জীবন। পূর্ণ’কে শাসন করার জন্য এই সন্তান ই হয়তো যথেষ্ট হবে। হঠাৎ ই পূর্ণ লাফিয়ে উঠে বসে। হকচকিয়ে যায় মৃত্তিকা। বড় বড় চোখ করে পূর্ণ তাকিয়ে এক টানে তুলে দেয় মৃত্তিকা’র পরিহিত পোশাক। লজ্জায় মরি মরি মৃত্তিকা’কে পাত্তা না দিয়ে পূর্ণ কিছুটা চিৎকার করে বলে উঠলো,

— মৃত্ত! মৃত্ত, আমার বাবু নড়েছে। ও নড়েছে। আমি ফিল করেছি। আল্লাহ! মৃত্ত আপনি….

মৃত্তিকা শুধু হাসছে। সাত মাস চলছে তার। বাবু অনেক নড়ে তবে বাবা’কে ধরা দেয় না। এটা নিয়ে পূর্ণ’র আফসোসের শেষ ছিলো না। আজ বাবু রহম হয়েছে তার বাবা’র প্রতি। পূর্ণ’র চোখ ছলছল করে উঠে। মৃত্তিকা দেখে। হাত বাড়িয়ে পূর্ণ’কে ছুঁয়ে দিয়ে বললো,

— আপনার বাবু তার বাবা’কে কত ভালোবাসে দেখলেন। মা’কে কষ্ট দিয়ে বাবা’কে নিজের অস্তিত্ব ফিল করায়?

পূর্ণ হঠাৎ ই ঝুঁকে ফুলে উঠা পেটে চুমু খায়। একটা দুইটা। পরপর অনেকগুলো। মৃত্তিকা যেন ভেজা ভেজা অনুভব করে চামড়ায়। হাত বাড়িয়ে পূর্ণ’র চুলে বুলাতে বুলাতে বলে,

— আর কাঁদবেন না প্লিজ। আমার আগের পূর্ণ ই ভালো ছিলো। আপনার মতো এত কাঁদতো না।

— মৃত্ত?

— হু।

— আমাকে বাবা বাবা সুখ ফিল করানোর জন্য ধন্যবাদ। আমি এখনও অনুভূতিগুলো গোছাতে পারছি না। সব উলোট পালোট।

— আমারও।

পূর্ণ আস্তে করে মৃত্তিকা’র পেট ঢেকে দেয়। উঠতে নিলেই মৃত্তিকা ওর হাত টেনে ধরে বলে,

— কোথায় যাচ্ছেন?

— আব্বু’র কাছে। আমাকে নিয়ে অনেক মজা নিয়েছে। আমার বাবু কি না আমাকে চিনে না তাই কিক মারে না আমার সামনে। এখন বলে আসি।

— মানে কি? রাত কয়টা বাজে?

— বাজুক।

বলেই পূর্ণ বের হলো। মৃত্তিকা পেটে হাত দিয়ে হাসছে। ফোনটা হাতে নিয়ে কল দিলো ওর বাবা’কে। মৃন্ময় হাওলাদারের ও আফসোসের শেষ ছিলো না। কেন তার নাতি-নাতনি তার জামাই’কে এতটা ডেস্পারেট করলো।
পূর্ণ’কে এত রাতে দরজায় দেখে ওর বাবা চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো,

— কি হয়েছে? মৃত্তিকা ঠিক আছে?

পূর্ণ হাসি মুখে জড়িয়ে ধরে বাবা’কে। উচ্ছাসিত অথচ আবেগী গলায় বলে,

— আমার বাবু’কে আজ ফিল করেছি আব্বু। ও কিক মারলো আমার হাতে। আমার কেমন জানি লাগছে। পুরাই সব এলোমেলো।

ওর বাবা ছেলের পিঠ জড়িয়ে ধরলেন। তার চোখে ও পানি। তার ছেলের সুখগুলো হয়তো ঐ বাবু’টার অস্তিত্বেই মিশে আছে।
.
এত রাতে কলিং বেল বাজতেই পূর্ণ ভ্রু কুঁচকায়। মৃত্তিকা আজ এখনও না ঘুমিয়ে খাচ্ছে আর টিভি দেখছে বলে ঘুমায় নি ওরা। এমনকি ওর মা-বাবা ও পাশে বসা। ওর বাবা উঠতে উঠতে বলে,

— রাত একটা বাজে। কে এলো?

দরজা খুলতেই দেখলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে তিনটা মাথা। ওর বাবা কিছুটা চমকালেন। পূর্ণ ওদের দেখে চমকে গিয়ে বললো,

— এতরাতে তোমরা? আর হিমু এটা কি? রুপা এখানে কেন? আর রুপা তুমি এমন হলুদ সাজে কেন?

দু’টোর মুখে রা নেই। ওদের ভেতরে আনা হলেই উজ্জ্বল আস্তে ধীরে বলে,

— ভাই এই রুপা টুপা…না মানে রুপালী আপু তার হলুদ থেকে পালিয়ে এসেছে।

— আশ্চর্য। কেন?

— হিমু’র জন্য।

— কি? ইয়ে।

বলেই উঠে দাঁড়ায় মৃত্তিকা। পূর্ণ দিলো সাথে সাথে এক ধমক। মৃত্তিকা চুপ করে গেলো। পূর্ণ চোখ রাঙিয়ে বললো,

— এভাবে লাফাতে নিষেধ করেছি না মৃত্ত?

মৃত্তিকা মুখ কালো করে শাশুড়ী’র সাথে বসে পরলো। মনে কষ্ট পেয়েছে ও। এতগুলো মানুষের সামনে ধমকটা না দিলেও তো পারতো।

পূর্ণ চিন্তিত হলো। কি করবে এখন? দু’টোকে বসিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— দুজন সিরিয়াস?

— জ্বি ভাই।

একসাথে উত্তর এলো। পূর্ণ হাসলো কিছুটা। বয়স আসলেই একটা সংখ্যা মাত্র। ভালোবাসা বয়স মানে না। এটা প্রমাণিত। এমনকি ভালোবাসা নোংরাতেও ফুল ফুটাতে সক্ষম। এই যেমন রুপালী মেয়েটা কিছুটা খারাপ সঙ্গে জড়িত ছিলো অথচ হিমু’র প্রেমে পড়ে সে সব ছেড়েছে। হয়তো এদের সাংসারিক জীবনটা শুরুতেই সমৃদ্ধ হবে না কিন্তু ভালোবাসার কমতিও থাকবে না।
পূর্ণ ভরসা দেয় দু’জনকে। জানায় এদের বাসায় কথা বলবে বিয়ের জন্য। উজ্জ্বল মিনমিন করে বলে উঠে,

— তার দরকার নেই ভাই।

— কেন?

— দুজন অলরেডি বিয়ে করে নিয়েছে। এখন আপনি বাসরের পারমিশনটা দিন।

_______________

পূর্ণ’র গায়ে সাদা একটা পাঞ্জাবি। ধবধবে রঙে বেশ লাগে সিনিয়র ভাই পূর্ণ’কে। মুগ্ধ হয় মৃত্তিকা। মনে মনে শাসায় ও নিজেকে, যদি নজর লেগে যায়?
মৃত্তিকা’র অবস্থান ওর বাবা’র কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। মৃন্ময় হাওলাদার মেয়েকে মাত্রই মেয়ে’র মাথায় তেল দিয়ে সুন্দর একটা মোটা বেণী করেছেন। পূর্ণ একপলক শশুরের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আব্বু এখন খেয়ে নিতেন। আমি পাশে বসছি৷ আপনি খেয়ে আসুন।

মৃন্ময় হাওলাদার কিছু বলার আগেই মৃত্তিকা আস্তে ধীরে উঠার চেষ্টা করে। মৃন্ময় হাওলাদার একদম বুকে ঠেস দিয়ে যত্নসহকারে তার মেয়ে’কে তুলেন। মৃত্তিকা কিছুটা রাগী স্বরেই বলে,

— আমি বুঝি না প্রেগন্যান্ট কি আমি নাকি তোমরা দু’জন?

মৃন্ময় হাওলাদার মেয়ে’র কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,

— চিন্তা হয় আম্মা।

— কেমন চিন্তা এসব? আমার চিন্তায় তুমি সব ছেড়ে দিচ্ছো বাবা আর উনি কি করছে? এত কষ্ট করে যেই সফলতা পেলো তা কেন ত্যাগ করতে হবে? আর কোন রাজনীতিবিদ’দের কি বাচ্চা হয় না? তারা এমন করে?

পূর্ণ শুনছে কিন্তু উত্তর দিতে চায় না। মৃন্ময় হাওলাদার ও জানেন তার মেয়ে’র মুড ঠিক নেই এখন। ইদানীং একটু ছ্যানছ্যান মেজাজে থাকে সে। কিছু বলার আগেই মিঠি খাবার হাতে রুমে ঢুকে। মৃন্ময় হাওলাদার হেসে উঠে বললেন,

— এই তো আমার আরেক মেয়ে। খাবার নিয়ে এসেছে।

মিঠি খাবারের ট্রে থেকে ফলের জুসটা মৃত্তিকা’কে দিতেই মৃত্তিকা মুখ কুঁচকে ওয়াক করে উঠে। পূর্ণ আর মৃন্ময় হাওলাদার দুইজন ই তারাতাড়ি এগিয়ে আসেন। মৃত্তিকা পুণরায় চোখ কটমট করে তাকায়।
পূর্ণ এবার কিছুটা ধমকে উঠে,

— চুপচাপ এটা ফিনিস করুন মৃত্ত। দুই দিন ধরে কি শুরু করেছেন? এটা খাব না ওটা খাব না। ডক্টর বলেছে না সব খেতে তবুও এমন করার মানে কি?

— বাবা আছে এখানে।

মৃত্তিকা’র তেঁজ কমলো না। তার বাবা’র সামনে তাকে ধমকায়? সাহস আছে বলতে হবে। মৃত্তিকা ফুঁসে উঠে বললো,

— খাব না। যান আপনি এখান থেকে। শশুর বাড়ী এত কি হ্যাঁ?

পূর্ণ চোখ বড় বড় তাকালো। এই দিন ই বুঝি দেখা বাকি ছিলো? ওকে খোঁটা খেতে হলো শশুর বাড়ী থাকে বলে? মনে মনে ভীষণ আফসোস হয় ওর। মিনমিন করে বলে,

— আমার বাবুটা আসুক আগে। সব উশুল করব।

মৃন্ময় হাওলাদার চুপচাপ খাচ্ছেন আর মিঠি তখনও জুস হাতে দাঁড়িয়ে। পূর্ণ শান্ত ভাবে এগিয়ে এসে মিঠি’র হাত থেকে জুসের গ্লাসটা নিয়ে একহাতে মৃত্তিকা’র হাতটা ধরলো কিছুটা আগলে নেয়ার মতো। ভরা পেট নিয়ে মৃত্তিকা পূর্ণ’র উপর ভর দিয়ে ওর সাথে গেলো। এতক্ষণ ওরা ছিলো মৃন্ময় হাওলাদারের রুমে। পূর্ণ মৃত্তিকা’কে নিয়ে সোজা মৃত্তিকা’র রুমে গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিলো। গ্লাসটা পাশে রেখে মৃত্তিকা’কে কোলে নিয়েই বসলো বিছানায়। পূর্ণ শান্ত চাহনি দিতেই মৃত্তিকা চালাকি করে ওর গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে অভিযোগ করলো,

— দেখলেন আপনার বাবু কত পাঁজি? এসব কিন্তু আমি বলি না, ও বলে।

— তাই?

— হ্যাঁ তো আমি কখনো বলি এসব?

— একদমই না। বিড়ালের ছানা এখন বাঘের বাচ্চা হয়েছে না।

মৃত্তিকা চোরা হাসে। পূর্ণ’র উঁচু নাকের ডগায় চুমু দিয়ে বলে,

— সত্যি বলছি আমার মেজাজ বিনা কারণেই খারাপ হয়ে যায়।

— কোন ব্যাপার না মৃত্ত। এই যে ছোট্ট শরীরটাতে আমার বাবু’কে রাখছেন তাতেই হবে।

— কখন বের হবেন?

— একটু পরই।

কিছুক্ষণ নীরবতায় কাটে। পূর্ণ গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে তার পূর্ণ্যময়ী’কে। মৃত্তিকা তখন আদুরে একটা ছানা। এই হলো পূর্ণ’র জ্বালা। বাঘিনীটা’কে আদর দিতেই সে গলে পানি৷ বেশ সময় নিয়ে পূর্ণ থামে। গভীর শ্বাস টেনে মৃত্তিকা’র পেট কাপড় মুক্ত করে ওর বাবু’র সাথে আলাপ করে। জানায় স্বাভাবিক ভাবে,

— বাবা, আপনি তো এসে যাবেন খুব তারাতাড়ি। আপনার মা সুযোগের সৎ ব্যাবহার করছে। আপনি আসুন। বাবা আর বাবা’র ছানা মিলে শশুর বাবা’র ছানা’কে পাত্তা দিব না। ঠিক আছে?
আর হ্যাঁ, বাবা আজ সব ছেড়ে দিব বাবা’র জান। শুধু মাত্র আপনার জন্য। বাবা আর রাজনীতি করব না। চিন্তা নেই বেকার থাকবে না আপনার বাবা। ভার্সিটিতে জয়েন হব। কাজের পর বাকিটা সময় আপনার। ঠিক আছে? বাবা এসেই আপনাকে ভালোবাসা দিব অনেকগুলো।

মৃত্তিকা আড় চোখে তাকিয়ে শুনলো। এসব যে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পূর্ণ ওকেই বললো তা ওর জানা আছে ঢের। পূর্ণ উঠে মৃত্তিকা’র কপালে দীর্ঘ এক চুম্বন করে। আদরের সহিত হাত বুলায় গালে। ঠান্ডা গলায় বলে,

— চিন্তা করবেন না মৃত্ত। আজকে শান্তি সমাবেশ শেষ করেই পদত্যাগের ঘোষণা দিব।

মৃত্তিকা ও পূর্ণ’কে চুমু খেলো। পূর্ণ মৃত্তিকা’কে জুসটুক খায়িয়েই বের হলো।

মৃন্ময় হাওলাদার খাবার শেষ করতেই মিঠি’র মা রুমে আসেন। রাগী চোখে মিঠি’কে দেখেন। মৃন্ময় হাওলাদার শ্বাস ফেলে বললেন,

— বসো মিঠি’র মা। কথা আছে।

উনি বসতেই মৃন্ময় হাওলাদার বলে উঠলেন,

— ওকে কেন মে*রেছো?

— আপনি জানেন না….

— তোমার থেকে বেশি জানি।

দমে যান মিঠি’র মা। মৃন্ময় হাওলাদার শান্ত গলায় বলেন,

— আমাকে তুমি অনেক বছর ধরে চিনো মিঠি’র মা৷ মৃত্তিকা’র মায়ের অনেক কাছের তুমি। ও কখনো গরীর, বড়লোক ভেদাভেদ করে নি। তোমাকে নিজের বোন ভেবেছে। সেভাবে আমিও তোমাকে বোন ভাবি। মিঠি যে মামা ডাকে ডাকটা অবশ্যই শুধু মুখের না। ছোট থেকে তুমি মৃত্তিকা’র অনেক খেয়াল রেখেছো। মিঠি আমার দায়িত্ব। উজ্জ্বল কে ও ভালোবাসে। ছেলে ভালো উজ্জ্বল। আমি চিনি। পূর্ণ জানে। কি জানতে চাও আর?

— ভাই আমি সেভাবে…

— তুমি রাজি না থাকলে আমি উজ্জ্বলকে মানা করব।

— আমার ভয়…

— সবাই মিঠি’র বাবা’র মতো মাঝরাস্তায় হাত ছাড়ে না। যদি উজ্জ্বল কোনদিন হাত ধরে তবে আমার মেয়েকে আমি ফিরিয়ে আনব।

কেঁদে ফেলে মিঠি। বাবাহীনা বড় হওয়াটা ওর জন্য সহজ ছিলো শুধু মাত্র মামা নামক মৃন্ময় হাওলাদারের জন্যই। মিঠি’র মা মাথা নাড়েন। সে রাজি। মৃন্ময় হাওলাদার হেসে বলেন,

— আম্মা সুস্থ হোক। উজ্জ্বল তো দ্বিতীয় বর্ষে। গ্রাজুয়েট হোক আগে অতঃপর পারিবারিক ভাবেই বিয়েটা দিব।

মিঠি’র মা সস্তি পান। হঠাৎ মৃত্তিকা’র চিৎকার শুনা গেলো। মৃন্ময় হাওলাদার ছুটে গেলেন ঐ রুমে। লেবার পেইন উঠেছে বুঝতেই ওকে নিয়ে ছুটলেন হসপিটালে। এদিকে পূর্ণ’কে কল দিয়ে ও পাওয়া যাচ্ছে না। নিশ্চিত সমাবেশ চলছে। সমাবেশে যখন গাড়ি আটকে গেলো তখনই মৃত্তিকা ব্যাথা’র মাঝে চিল্লাতে থাকে,

— এই লোককে আমি আমার বাবু ধরতেও দিব না। অসভ্য সিনিয়র ভাই। এটা কেমন শান্তি সমাবেশ? কোথায় শান্তি? শুধুই অশান্তি।

মৃন্ময় হাওলাদার গাড়ি থেকে যেই না নামতে নিবেন ওমনি দেখলেন পূর্ণ দৌড়ে এদিকে আসছে। হয়তো কেউ ফোন দিয়ে বলেছে। অতঃপর? পাগলামি শুরু তার।
.
হসপিটালে মোটামুটি ঝগড়া লেগে গেলো। পূর্ণ’র মা-বাবা মিলেও ওকে বুঝাতে পারছেন না। ছেলে তাদের পাগল হয়ে গিয়েছে। এদিকে মৃত্তিকা সমান তালে চেঁচিয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই সি সেকশন করবে না ও। আর পূর্ন? তার একটাই কথা নরমালে হতে দিবে না। যদি ওর মৃত্ত’র কিছু হয়ে যায়? মৃন্ময় হাওলাদার শুধু ঘামছেন দরদর করে। তার মেয়ে কেমন কাতরাচ্ছে। দুই হাতে মেয়েকে আগলে ধরে বসে দোয়া পড়ছেন তিনি। চোখে তার পানি। মৃত্তিকা’র মাথাটা বুকে নিয়ে কম্পমান গলায় ডাক্তারকে বললেন,

— যেটা ভালো হয় করুন। দয়াকরে আমার আম্মা’র ব্যাথাটা কমিয়ে দিন।

ওনার কাঁতর কন্ঠে মৃত্তিকা কিছুটা দাঁত চেপে কান্না দমিয়ে শাশুড়ী’কে বলে উঠে,

— আম্মু আপনার ছেলেকে সরান। পগল লোক একটা। আমার বাচ্চা… আআআ।

— মৃত্ত…মৃত্ত? কি হয়েছে?

মৃত্তিকা এবার পূর্ণ’র উপর মহাবিরক্ত হয়। দুই হাতে খামচে ধরে বলে,

— আপনি যান এখান থেকে। একটা বার বাবু আসুক নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে আপনাকে।

_____________

— মৃত্ত? মৃত্ত? বাবু’র ডায়পার পাচ্ছি না।

মৃত্তিকা শাশুড়ী’র কোলে মাথা দিয়ে ঠ্যাটার মতো শুয়েই আছে। এরমধ্যেই মৃন্ময় হাওলাদার আবার নাতনি’কে চেঞ্জ করায়। দশ মিনিট যেতেই পূর্ণ’র গলা,

— মৃত্ত? মৃত্ত? বাবু’র ঠান্ডা লাগছে। টুপি’টা কোথায়?

এবার পূর্ণ’র বাবা উঠে গিয়ে দিয়ে এলো। শান্তি কি তখনও মিললো? এবার ডাকতে ডাকতে বাইরে হাজির পূর্ণ। অসহায় কন্ঠে ডাকে,

— মৃত্ত? বাবু খাবে।

মৃত্তিকা তাকায় না। এক ঘন্টা আগেই পূর্ণ ওকে ধমকে দিয়ে বলেছিলো, “আমার মেয়ে আমি দেখে নিব,আপনি যান এখান থেকে”। ব্যাস মৃত্তিকা আর রুমে যায় নি। পূর্ণ আবারও ডাকতেই মৃত্তিকা থমথমে গলায় বললো,

— কেউ একজন বলেছিলো সে পেলে নিবে তার রাজকন্যা।

পূর্ণ অসহায় ভাবে তাকায়। তার রাজকন্যা কাঁদছে। ফিডারও মুখে নিচ্ছে না। মৃত্তিকা মেয়ের কান্না শুনে টিকতে পারে না। উঠে চলে যায় রুমে। বাইরে বসা তিনজন হেসে ফেলে। পূর্ণ ও বউয়ের পিছনে ছুটে।
ফিড করাতেই পূর্ণ’র মেয়ে চুপ। একদম শান্ত। সে আসলেই একটা শান্তি প্রিয় মেয়ে। একদম বাবা’র রাজকন্যা। বাবা পেলে তার মায়ের দরকার নেই। ঐ খাওয়া আর একটু পরপর মায়ের ঘ্রাণ এটা পেলেই হলো। খাওয়া হতেই পূর্ণ মেয়ে’কে কোলে তুলে নেয়। কপালে চুমু খেয়ে আদুরে গলায় ডাকলো,

— আম্মা? পেট ভরেছে?

— উউউ বাবাবা।

পূর্ণ হেসে চুমু খায় মেয়েকে। আট মাসের মৃন্ময়ী ও বাবা’কে হাসতে দেখে হাসে। মৃন্ময় হাওলাদার রুমে আসতেই পূর্ণ চোখে হাসে। মৃন্ময়ী’কে ওর নানা’র হাতে দিয়ে বলে,

— ধন্যবাদ বাবা।

— তোমাকেও আব্বু।

অতঃপর চোখে চোখে কিছু কথা আদান-প্রদান করে তারা যা কেউ জানে না। আজ পর্যন্ত পূর্ণ এবং মৃন্ময় হাওলাদার বাদে কেউ ই জানে না কেন পূর্ণ’র সাথে তিনি মেয়ে এত তারাহুরো করে বিয়ে দেন। এটা তাদের ব্যাক্তিগত রহস্য।

মৃন্ময় হাওলাদার যেতেই পূর্ণ দরজা আটকে মৃত্তিকা’র কাছে আসে। মৃত্তিকা হেসে ফেলে কিছুটা। সারাটাদিন ভার্সিটিতে খাটাখাটুনি করে সিনিয়র ভাই ক্লান্ত হয় না। ফিরেই মেয়ে নিয়ে উঠে পরে লাগে। পূর্ণ মাথা এলিয়ে দেয় মৃত্তিকা’র কোলে। নরম হাত দুটো টেনে নিজের গালে রাখে। শান্তি গলায় বলে,

— আমার জীবনের শান্তি হওয়ার জন্য ধন্যবাদ মৃত্ত। এক শান্তি সমাবেশে আমাকে পুণরায় একবুক শান্তি এনে দেয়ার জন্য ও ধন্যবাদ।

মৃত্তিকা ঝুঁকে। চুমু খায় পূর্ণ’র খাড়া নাকে। বলে উঠে,

— আমাকে মৃন্ময়ী এনে দেয়ার জন্য ধন্যবাদ যথেষ্ট নয় সিনিয়র ভাই।

পূর্ণ দুষ্ট হাসে। বলে উঠে,

— আরেকটা লাগবে?

মৃত্তিকা লজ্জা পায় না। বলে উঠে,

— দুই তিনটা লাগবে।

পূর্ণ শব্দ করে হাসে। জড়িয়ে ধরে তার পূর্ণ্যময়ী’কে। তার জীবনের শেষ শান্তি সমাবেশটা ছিলো পুরোটা শান্তিতে ঘেরা। মনে মনে বলে আওড়ায় পূর্ণ,
” আমার ছন্ন ছাড়া জীবনটাকে গোছাতে এক শান্তি সমাবেশ ই যথেষ্ট ছিলো”।

#সমাপ্ত…..