আমার আছে জল পর্ব-০১

0
249

#আমার_আছে_জল
#পর্ব_১
#আহানা_জেরিন

এবারো পাত্রপক্ষের অপছন্দ হলো চিত্রাকে। এমনকি সেখানে উপস্থিত পাত্রের মা তো বলেই উঠলো আমার সুন্দর ছেলের সাথে ওমন কালো কুৎসিত মেয়ের বিয়ে আমি দেবো না। চিত্রার মায়াবী মুখখানী এক লহমায় অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এরূপ ঘটনা তার সাথে বহুবার হয়েছে। তবুও তার ছোট্ট মনে কিঞ্চিত আঘাত হানতে পারেনি। তবে এবার খুব বাজে কিছু হয়েছে।

পাত্রপক্ষ চিত্রাকে পছন্দ না করলেও তার বয়সে ১১ মাসের ছোট বোন বিনা কে ঠিকই পছন্দ করে। করবেও না কেন। বিনা দেখতে পুরো ওর মায়ের মতো। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ, চোখ মুখে কি সুন্দর মাধুর্যতা, যে কেও দেখলেই যেন প্রেমে পরে যাবে। অপরদিকে চিত্রার গায়ের রঙটা ঈষৎ কালো। ডাগর ডাগর আঁখিযুগোলের মধ্যে যেন এক গভীর ক্ষত লুকিয়ে আছে। রুক্ষ নিষ্প্রাণ দেহের অধিকারীনি চিত্রার মনটা যে ভীষণ সুন্দর তা বাইরের লোকের কাছে বরাবরের মতোই অজানা।

দুপুর থেকে চিত্রার মনটা মেঘলা আকাশটার মতোই অস্পষ্ট। আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুনি ঝাপিয়ে বৃষ্টি হবে। মানুষের মনও বুঝি আকাশটার মতোই ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যায়। এইতো সকালেই চকচকে আকাশের মতো চিত্রার মনটা ভীষণ ভালো ছিলো। আর এখন ভীষণ খারাপ। খারাপ কেন? নিজের পাত্রের সাথে ছোট বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে এজন্য? মোটেও না।

সাগরেদ গ্রামের ছেলে পিয়াসের সাথে আমার সম্বন্ধ এসেছিল। ছেলেটা কি সুন্দর। সাদা ধবধবে একটা পাঞ্জাবি পড়েছিল। কি মুগ্ধতা আহ! দেখেই ভেবে নিয়ে ছিলাম এই মানুষটা আমার। তবে সব আশা যে পূর্ণ হতে নেই।

মাথায় ঠান্ডা হাতের স্পর্শে ঘুম ছুটে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখি বাবা। মৃদু ধমকে বলে, “এখন কেও ঘুমায়? যা তোর মা খাবার বাড়ছে। গরম গরম খেয়ে নিবি।

আমি চোখ মুখ কচলে বললাম, মা কি রেগে আছে বাবা? আমায় কি মারবে?

বাবা শক্ত কন্ঠে বললো, আর কেন মারবে? তোকে পছন্দ না করলেও বিনা কে তো করেছে। বিয়েতো হবে। আজ আর তোকে মারবে না রে মা।

চিত্রার চোখজোড়া খুশিতে ঝলমল করে ওঠে। তবে বাবার যে মন অল্প হলেও খারাপ তা সে বুঝে গেছে। এ বাড়িতে শুধু বাবা আর বোনটাই যে তার মনের ব্যথাটা বুঝে।

বারান্দায় পাটি বিছিয়ে জগে পানি এনে রাখলাম। বাবা এসে এক কোণায় বসলো। বিনা আর মা রান্নাঘর থেকে খাবার আর বাসন এনে রাখছে। বাবার ভারাক্রান্ত মুখ দেখে মা সহসা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, মেয়ের এতো ভালো বিয়ে এসেছে আর তুমি পেঁচার মতো মুখ করে আছো। কারণ কি?

বাবা মাথা তুলে আস্তে আস্তে বললো, বড় মেয়ে রেখে ছোট মেয়ে কেমন হয়ে যায় না রাজিয়া?

সঙ্গে সঙ্গে মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। চোখ কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, এই অপয়া অলক্ষিরে কেও বিয়ে করবে বলে তোমার মনে হয়? তার চেয়ে বিনার বিয়ে হচ্ছে এই ভালো।

– আহ চুপ করো তো। বিনার বিয়ে আগে হলে চিত্রার আর সম্বন্ধ আসবে না লোকে খারাপ বলবে।

– উহ ধঙের কথা। বড়টার বিয়ে হয়নাই দেখেও তারা যে রাজি হয়েছে সেই অনেক। আর তোমার সামান্য মাস্টারির বেতন দিয়ে কি সারাজীবন চলবে। একটা একটা করে বিয়ে দিলেও তো খরচটা কমে। বুঝলে বিনাকে দেখই পছন্দ করে ফেলেছে এজন্য যৌতুকের কথাটাও ধামাচাপা পরেছে। নইলে বুঝতে!

– রাজিয়া দুটোই তোমার মেয়ে এ কথা তোমাকে বারবার মনে করিয়ে দিতে আমার রুচিতে বাধে।

বাবা আর কিছু বললো না। প্লেটে হাত ধুয়ে চলে গেলো। আমি দৌড়ে বাবাকে ধরার জন্য উঠতেই মা আমার হাত টেনে গালে কষিয়ে চড় মারলো। বললো, তোর জন্যই আজ এই অবস্থা। শান্তিতে থাকতে দিবিনা আমাদের। বিনা তখনো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।

রাতে আর খেলাম না। বিছানার এক কোণে কাঁথা মুড়িয়ে শুয়ে অঝোরে কান্না শুরু করলাম৷ বাইরে তখন তুমুল বৃষ্টি। টিনের চালে টঙটঙ শব্দ হচ্ছে। বিনা আমার মাথায় হাত বুলাতেই শিউরে উঠলাম। চোখের পানি মুছতে মুছতে ওপাশে ফিরলাম।

বিনা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে,
– আপা আমার জন্য তোমার খুব কষ্ট তাই না? তুমি যদি বলো বিয়ে না করতে আমি কোনোদিনই করবোনা।

– কি বলিস এসব! খবরদার আর বলবি না।

– আমার বিয়ে হলে তো সকলে তোমাকে খারাপ বলবে আপা।

– আরে পাগলি মেয়ে বাবার কথা ধরে বসে আছিস কেন? কেও কিছুই বলবে না। এখন গ্রামের মানুষ অনেক উন্নত হয়ে গেছে বুঝলি। তুই আর একটুও কাঁদবি না। এখন ঘুমা।

তখনো অন্ধকার। বাড়ির সকলে বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। বাইরে আযান দিচ্ছে। এ সময়টাতে চিত্রার ঘুম ভাঙে। সে ফজরের নামাজ পরে শলা কাঠির ঝাড়ুটা নিয়ে ঝাঁট দিতে থাকে। ওদের বাড়িটা চার চালা টিনের ঘর। ঘরও মোটে চারটা। এক ঘরে ওর মা বাবা আরেক ঘরে দুই বোন একটা রান্নাঘর আর তার সাথে একটা ঘর সেখানে অবশ্য কেও থাকে না। তবে সে ঘরে একটা কাঠের টেবিল আছে। চিত্রা মায়ের ঘর বাদে সব ঘর ঝাঁট দিয়ে চুপিচুপি টেবিল ওয়ালা ঘরটায় ঢুকে। টেবিলের উপর থাকা বই গুলো আলতো করে ছুঁয়ে দেয়। বিনা এবার মাধ্যমিক দিলো। তার সেই বইগুলোই এই ঘরে থাকে। মা এই ঘরটাতে আমাকে খুব কমই আসতে দেয়। কালো হওয়ার কারনে অনান্য সমস্ত কিছুর মতো পড়াশোনা থেকেও আমাকে দূর করে দিয়েছে। আচ্ছা কালো মেয়েদের কি মন, শরীর বলে কিচ্ছু নেই।

চিত্রা রান্নাঘরে যায়। ফুলকপি কাটে। নিষ্প্রাণ চাহনি নিয়ে টিনের ফুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে। চিত্রার বাবা ততক্ষণে মসজিদে চলে গেছে। রাজিয়া বেগম উঠে নামাজ পরে বাইরে গেছে। তার কাজ একটাই সারাদিন চিত্রার খুঁত খুজে বের করা। তবে সে ও যে মেয়েকে একেবারেই ভালোবাসেনা তা না। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মাঝে মাঝে কেমন অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। মেয়ের বিয়ে নিয়েই তার যত চিন্তা।

আজ বিনার হবু শশুর বাড়ি থেকে দুইজন মহিলা এসে শাড়ি, চুড়ি, আলতা দিয়ে গেছে। বিনা নেড়েচেড়ে দেখছে। খুব সুন্দর না আপা!

বিনার প্রশ্নে চিত্রার ঘোর ছুটে। হালকা হেসে বলে “আমার বোনটা তারচেয়ে বেশী সুন্দর।” প্রতিউত্তরে বিনা খিলখিলিয়ে হাসে। চিত্রা অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

অবশেষে সেই শুক্রবারটা চলেই এলো৷ মা বাবা সকাল থেকে ভীষণ রকম ব্যস্ত। পাশের বাড়ির লোকমান চাচার ছেলের বউ বিনাকে সাজিয়ে দিচ্ছে। বিনা সে বাড়ির দেওয়া লাল টুকটুকে শাড়িটা পড়েছে। পায়ে আলতা চোখে গাঢ় কাজল মাথায় সুন্দর একখানা টিকলি। সবমিলিয়ে বোনটাকে অপ্সরির মতো লাগছে। বউ সাজলে বুঝি সব মেয়েকে এমনি লাগে? আমাকেও কি লাগবে? আনমনে বলে ওঠা প্রশ্নে লজ্জায় লাল হয়ে যায় চিত্রা।

হঠাৎ কোথা থেকে রাজিয়া বেগম হন্তদন্ত হয়ে এসে চিত্রাকে হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে আসে। কটমট করে বলে, তোর কি আক্কেল বলতে কিছু নেই নাকি? বিনার পাশে ওভাবে বসে আছিস কেন? বড় বোন হয়ে ছোট বোনের বিয়েতে ধেই ধেই করে যেতে খুব ভাল্লাগছে।

চিত্রা ছলছল চোখ নিয়ে দাড়িয়ে থাকে। আস্তে আস্তে করে বললো, “আমি তো শুধু দেখছিলাম মা।”

রাজিয়া বেগমের পাথরের মতো মনট হঠাৎ কেমন নরম হয়ে যায়। সত্যিই মেয়েটা তো এখন কিছু করেনি। তেমন কিছু আর বললেন না তিনি।

সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ আসে। পিয়াস ছেলেটা আজও সাদা পাঞ্জাবি পরেছে। তবে আজকের পান্জাবিতে সাদা পাথরের কারুকাজ করা। কি সুন্দর লাগছে। বিনাকে দৌড়ে গিয়ে কথাটা বলতেই লজ্জায় লাল হয়ে যায়। আমিও মুখ টিপে হেসে চলে আসি। আচ্ছা ছেলেটা বারবার সাদা পান্জাবি কেন পরে বুঝি না।

শেষমেশ বিনার বিয়েটা হয়েই গেলো। মোটামুটি ভালোই আয়োজন করেছিলাম আমরা। বিদায়ের সময় বিনা সে কি কান্না। মা বাবার গলা জড়িয়ে কান্নায় নুইয়ে পরে। আমার বুকের ভেতরটা কেমন চিনচিন করে ওঠে। এটাই বুঝি রক্তের টান। আশেপাশের লোকজন আমার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। মা অবশ্য ঘরে যেতে বলেছিলেন আমিই যাইনি। হঠাৎ পিয়াস ছেলেটার দিকে চোখ পড়লো। করুন দৃষ্টিতে বিনার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখেমুখে লেপ্টে থাকা বিষন্নতা দেখে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম বিনার ওমন কান্নাতে তার মনের মধ্যেও কষ্টের সঞ্চারন হচ্ছে। এর মানে ছেলেটা আমার বোনটাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে। এতটা দুঃখের মাঝেও যেন এক টুকরা হাসি চিত্রার ঠোঁটের কোণায় সসম্মানে স্থান পেয়েছে।

রাত ৯ টা ছুইছুই। বিনা ততক্ষণে চলে গেছে। বাবা বারান্দায় অন্যমনষ্ক হয়ে বসে আছে। মা ও এককোণায় শাড়ির আঁচল মুখে নিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে। আমি ঘরে গিয়ে শুয়ে পরলাম। কিছুতেই ঘুম আসছে না। কতক্ষণ যে এপাশ ওপাশ করেছি তার ঠিক নেই। বোনের কথা খুব মনে পরছে। যদি যেতে পারতাম ভালো হতো। তবে আমার কি সে ন্যায্য আছে।

আযানের শব্দে ঘুম ভাঙে। মায়ের ঘরে উঁকি দিতেই দেখি জানালার পাশে বসে আছে। বাবা নেই। মনে হয় নামাজে গেছে। রান্নাঘরে গিয়ে কালকের এঁটো বাসনগুলো নিয়ে বাইরে গেলাম। আমাদের বাথরুমটাও বাইরে। উঠোনের একপাশে আবার কল। সেখানে বাবা ইট বিছিয়ে দিয়েছে। বাসনগুলো রেখে পরিষ্কার করছিলাম। হঠাৎ কারো জোড়ালো আওয়াজে হাতের গ্লাসটা পরে নিমিষেই ভেঙে গেলো৷ আমি ঘাড় ঘুরিয়ে অবাক চোখে তাকাতেই দেখি একটা লম্বামতো ছেলে। কিছুটা ভড়কে যাই। ছেলেটা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বলে, কিরে ভিতুর ডিম। এখনো এমন ভিতুই আছিস দেখছি।

চিত্রা চোখ বড় বড় করে উঠে দাড়ায়। অস্পষ্ট ভাবে বলে, র ন ক ভা ই।

ছেলেটা খিলখিলিয়ে হাসে। চিত্রার মাথায় হালকা করে চাপড় মেরে বলে, চিনছিস তবে! তা তোতলানো আবার কবে থেকে শিখলি?

চিত্রার চোখ মূহুর্তেই টলমল করে উঠলো। একজনই তাকে ভিতুর ডিম বলে ডাকতো। আর সে হচ্ছে চেয়ারম্যানের ভাইয়ের ছেলে রনক। লোকমান চাচার বাড়ির সামনের দোতলা বাড়িটা রনকদের। চিত্রা সামনে থাকা ছেলেটার পা থেকে মাথা অব্দি দেখে। ছোটবেলায় একমাত্র রনকই ছিল চিত্রার খেলার সঙ্গী যদিও রনক গুনে গুনে চিত্রার চেয়ে ৩ বছরের বড়। মাধ্যমিকের পর সে শহরে চলে যায় লেখাপড়া করতে। সেই যে গেলো আর দেখা হলো না।

রনক আবারো চিত্রার মাথায় চাপড় মারে। বিরক্ত হয়ে বলে, তোর চোখে কি সারাজীবন শুধু কান্নাই লেগে থাকবে? কিছু বললেই চোখ ছলছল করে ওঠে। কেন রে?

চিত্রা হালকা হেসে বলে, তুমি তো জানই রনক ভাই আমার আর কিছু থাকুক বা না থাকুক এই চোখের কিনারায় সবসময় এক কলস জল ঠিকই থাকবে।

রনক খিলখিলিয়ে হেসে বলে, বেশ কঠিন কথা শিখেছিস দেখা যায়।

এমন সময় রাজিয়া বেগমের চিৎকারে চিত্রা আর রনক দুজনেই সামনে তাকায়। চিত্রা ভয়ে কুকিয়ে ওঠে। রনক ভ্রুকুঁচকে চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলে, চাচি তোর সাথে এখনো এমন করে? চিত্রা কিছু বলে না মাথা নিচু করে ঠায় দাড়িয়ে থাকে। রনকের আর কিছু বুঝতে বাকি থাকলো না।

চলবে,,,,