শুধু তোমারই জন্য পর্ব-১১

0
679

শুধু তোমারই জন্য-১১

মায়ের কথা শুনে হা করে তাকিয়ে রইলো নীলি।
এটা কি বলছে মা, আবিরের সাথে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে! কিন্তু কেন!
গতকাল সন্ধ্যায় বাদামহাটি এসেছে নীলি। ঘাটে প্রচন্ড জ্যাম ছিলো, তাই অনেক দেরী হয়েছে। আবিরকে টেক্সট করেছে পৌছেছে। আবিরও ফিরতি টেক্সট করেছে।
কক্সবাজার থেকে গত পরশু ঢাকায় ফিরেছে নীলি।
আবির খুব ব্যস্ত থাকবে কয়েকটা দিন, বিশেষ করে এই দু তিনদিন। রাত ছাড়া কথাও হবে না।
মা বলছে, আবির নাকি বলেছে, কোন সমস্যা নেই, এসে সই করে দিবে। কিভাবে সম্ভব! আবিরকে ছাড়া নীলি থাকবে কিভাবে।
নীলি বললো, বিয়েই তো হয়ে গেছে, এখন ছাড়ার কি দরকার! কোন ছাড়াছাড়ি লাগবে না।
নীলির মা বললেন, সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, এখন আর পেছানোর উপায় নাই। তাছাড়া আবিরের সাথেও কথা হয়েছে, আবিরকে জানিয়েই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, আবির বলেছে তার কোন সমস্যা নেই, হঠাৎ হয়ে যাওয়া বিয়ে নিয়ে তারও কোন আগ্রহ নেই। সেটা আরও মাসখানেক আগের কথা!
আবির এটা বলতেই পারেনা। সেই আবির যে একশবার চুমু খেয়ে বলে আমাকে ছেড়ে যেও না নীলি, যে নীলির জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমিক হয়!
নীলির একটাই কথা, নীলি ডিভোর্সের জন্য রাজী না।
কিন্তু মনটা অস্থির লাগছে, আবিরের সাথে কথা বলা দরকার। নীলি আবিরকে ফোন করলো, আবির রিসিভ করলো না।
পরপর কয়েকবার ফোন করার পর, আবির টেক্সট করে জানালো, সে মিটিং এ।
নীলির অস্থির লাগছে। নীলি দাদাভাইয়ের কাছে গিয়ে বসলো, তিনি জড়ানো গলায় বললেন, চিন্তা করিস না, ভাই আসবে তোকে নিতে!
দাদাভাই কি সব জানে!
আবিরের নানাবাড়িতে ফোন করবে, নীলি বুঝতে পারছে না।
নীলির মা নীলিকে বুঝতে পারছেন না।
নীলি মোড় ঘুরে বসবে, আশা করেননি একদম।এখন তার আর তার ভাইয়ের মান সম্মানের বিষয়।
তিনি ভাইকে ফোন করে আনালেন!
তারপর নীলিকে নিয়ে আবার বোঝাতে বসলেন!
নীলি কিছুতেই রাজী হবে না, কোন ছাড়াছাড়ি হবে না।
নীলির মামা বললেন, ওই ছেলের তো তোর থেকে বয়স কত বেশি, কোথাও কোন সম্পর্ক আছে মনে হয়, নয়তো সেও তো ডিভোর্সে রাজী!
বারবার সবাই বলছে আবির রাজী, এটা কেন বলছে, আবির কি বলেছে সবাইকে!
আবিরের ফোন আসছে, নীলি রিসিভ করলো।
নীলি কাঁপা গলায় হ্যালো বললো, আবির খেয়াল করতে পারলো না।
-নীলি ঠিক দুই মিনিট সময় পাবে, বলো ফোন করছিলে
কেন বারবার!
-আপনি ডিভোর্সের বিষয়ে কিছু জানেন?
ওহ, এই সময়েই মেয়েটাকে এগুলো বলতে হলো,
আবির বললো, নীলি আমি তো এখন ব্যস্ত, আমি পরে তোমার সাথে কথা বলি?
–আপনি শুধু বলেন, আপনি কি জানতেন এ বিষয়ে?
–নীলি এককথায় বললে, বুঝতে পারবে না।
আমি ফ্রি হয়ে ফোন করছি!
–না, এখনই বলতে হবে, বলেন না, আপনি জানতেন?
–ছেলেমানুষি করে না নীলি!
–আপনি কখন ফ্রি হবেন, আজ তো অনেক ব্যস্ত থাকার কথা।
হু, নীলি জানে আজ থাইল্যান্ড থেকে ক্লায়েন্ট আসবে।
-একটু দেরী হবে!
-আপনি জানতেন?
-হু, জানতাম!
-আপনি বলেছেন আপনার সমস্যা নাই?
ইশ মেয়েটাকে কিভাবে কথা পাল্টে বলেছে, কনফারেন্স রুম থেকে রিশাদ ফোন করছে, আবিরের এখনি যেতে হবে।
-নীলি পরে কথা বলছি! কাজ শেষ করে ফোন করছি।
–আমার থেকেও এই কাজটা বড় হলো!!
নীলির সমস্যাটা আবির বুঝতে পারছে, কিন্তু কি করবে, এই মুহুর্তে এই কাজটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
-নীলি তুমি জানো তো, এই কাজটা কত ইম্পর্টেন্ট!
তুমি একটু অপেক্ষা করো!
–আপনি আমাকে বলেননি কেন?
-কি আশ্চর্য, তোমার বাসা থেকে বলেছে তোমাকে?
বলেনি তো! এটা তাদের সিদ্ধান্ত। আর তুমিও কিছুটা দায়ী, তোমাকে আমি বারবার বলেছি, বাসায় জানাও আমার সাথে আছো জানাও নি! এখন এটার ফলাফল তো মানতেই হচ্ছে!
আবির এভাবে কথা বলছে কেন! এ আবিরকে তো নীলি চেনে না। তাহলে এতদিন কি ছিল বাকি সব!
-নীলি তুমি পুরোটা ভাবো, আমি আমার সিদ্ধান্ত তোমাকে বলেছি, তুমি ভেবে দেখো পেয়ে যাবে।
এখন রাখছি!
-এটা হেয়ালির সময়?
-নীলি আমি রাখছি, আবির ফোন রেখে ভেতরে চলে গেলো।
নীলি আবার ফোন করলো, আবির কেটে দিয়ে ফোন অফ করে দিলো।
আজকের চুক্তিটা আবিরের জন্য খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
নীলি আবিরকে ছাড়বে না। ছাড়তে পারবে না!
নীলি কয়েকবার ফোন করলো আবিরকে, ফোন বন্ধ!
নীলির ভীষন অভিমান হচ্ছে, বুক ভেঙে যাচ্ছে, চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে! নীলি নিজের ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে ভেঙে ফেললো।
আবির এমন কেন করছে, জানেই যখন ডিভোর্স হবে,তাহলে কাছে এলো কেন! নীলির চাইতে বিজনেস ডিল গুরুত্বপূর্ন তাহলে, আচ্ছা তবে তাই হোক। কারো জন্য কিছু থেমে থাকে না।
নীলির জন্যও আবির বা আবিরের জন্য নীলি থামবে না।
নীলি চোখ মুছে মাকে গিয়ে বললো, মা আমি রাজী।
কি করতে হবে বলো! সই করে দিবো?
৩২
নীলির মায়ের মাথা আপতত ঠান্ডা। নীলির মন ফিরেছে।
সে আলমারি থেকে কাগজপত্র বের করে একবার দেখে নিলো।
নীলির বাবা বসে ছিল বিছানায়। নীলির মাকে খোশমেজাজে দেখে জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার, তুমি এত ভালো মেজাজে?
-নীলির সাথে কথা বলেছি, ওর কোন সমস্যা নাই, এখন কাগজপত্র দেবো ভাইজানকে, সে একবার দেখবে।
তারপর ওদের ফোন করলো। মোফাজ্জল চাচাকে তুমি একটা ফোন করো।
-আমার মান সম্মান আছে, কৃতজ্ঞতা আছে, যে আব্বার অসুস্থতার সময় নিজে পাশে এসে দাঁড়ালো তাকে এই কথা বলতে আমি ফোন করবো না।
-নীলির আব্বা, তুমি কেমন মানুষ, ওরা তো “না” বলে নাই, এত গরজ থাকলে তো “না” ই বলে দিতো তাই না।
এখানে নীলি ভালো থাকবে, কি মনে হয় তোমার!
-নীলি কেমন থাকবে, সে প্রশ্ন তো এখন আর নাই। তুমি মনে হয় একমাত্র মা যে মেয়ের সংসার ভাঙছো!
-সংসার কই হইছে, একটা সই দিলে সংসার হয়?
-সই দিলে সংসার হয় না। সংসার হয় মনে মনে। নীলি রাজি হয় নাই প্রথমে, সই করার সাথে সাথে ওর মনের মধ্যে একটা সংসার হইয়া গেছে, এইগুলা তুমি বুঝবা না।
একটা মেয়ে নিয়ে তুমি মেন্টাল হয়ে গেছো, সারা জীবন কোলে কোলে পালছো, এখন সংসার করতে দিবা না।
তুমি না বদলাইলে নীলি কোনদিন সংসার করতে পারবে না। এই ঘরে কেন, কোন ঘরেই পারবে না।
নীলির মা গজগজ করতে করতে চলে গেলেন।
তিনি আবিরের মাকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন, নীলি বাড়ি এসেছে, নীলির কোন আপত্তি নেই।
আবিরের মা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, নীলি রাজী হয়েছে?
নীলির মা জানালেন- হ্যা, নীলি রাজি, ডিভোর্সের বিষয়ে নীলির কোন সমস্যা নেই।
নীলির বুকটা ভেঙে যাচ্ছে, এত কষ্ট হচ্ছে, মনে হয় কেউ ছুড়ি দিয়ে বুকের ভিতর জোরে জোরে আঘাত করছে।
দম বন্ধ হয়ে আসছে, আবির কেন বললো না ওকে!
এখন যখন নীলি জিজ্ঞেস করলো, তখনো কেন বললো না, নীলি ডিভোর্সের বিষয়ে আমি কিছু বলিনি!
কেন কাজটাই এত গুরুত্বপূর্ণ হবে, নীলি কি কিছুই না।
আর যদি নীলি কিছুই না হবে তাহলে এতকিছু কেন!
উফ, আবির এমন কেন করলো!
নীলি সেই রাত গুলো কিভাবে ভুলবে।
আবিরের স্পর্শ, আবিরের ভালোবাসা! আবির তো ওর সাথে আর একটু কথা বলতে পারতো, কিচ্ছু বললো না কেন, সারাজীবন কি হেয়ালি করে চলে!
আবির কেমন উথাল-পাথাল আদর করেছে নীলিকে, ডিভোর্স হয়ে গেলে আবির আরেকটা বিয়ে করবে?
আরেকটা মেয়েকে এভাবে কাছে টানবে!
তার পায়ে আলতা দিয়ে দিবে, কিভাবে সহ্য করবে নীলি!
নীলি মাকে বলেনি আবিরের সাথে থাকার কথা, ও তো জানে মা খুব রাগ করতো, মা কখনো নীলিকে একা কোথাও ছাড়েনি। ক্লাশের ছেলে তো দূর, সব মেয়েদের সাথেও কথা বলা পছন্দ করতো না।
সারাক্ষণই ফোন করবে, নীলি কোথায় আছো, কার সাথে আছো, আবিরের সাথে তো এখনো প্রোগ্রাম হয়নি, তুলে নেওয়া হয়নি, ওর সাথে তাই যেতে না করতো।
নীলি তো আবিরকে ফেরাতে পারেনি।
নীলি প্রথমে তো আবিরকে ভালোবাসেনি, তখন মনে হয়েছে, বিয়ে হয়েছে, এর সাথে তো থাকতেই হবে, তাই একটু এডজাস্ট হোক!
আবিরের কাছে গিয়ে আবিরের সাথে জড়িয়ে গেছে, আবিরকে তো দোষ দেওয়া যায় না, আবির তো নীলিকে জোর করেনি কখনো, সব কিছুই স্বাভাবিক ছিল, এই স্বাভাবিক জীবনটা এমন অস্বাভাবিক হলো কি করে!
আজ সকালেও ঘুম থেকে উঠে আবিরকে ভেবে উষ্ণ হয়েছে নীলি, তিন চার ঘন্টায় আবির পর হয়ে গেলো!
আবির কেন আরেকটু কথা বললো না! নীলি ফোন করেছে বলে ফোনটা অফ করে দিলো!
নীলি দরজা বন্ধ করে বসে রইলো!
একবার ভাবলো, কতগুলো ওষুধ একসাথে খেয়ে নিবে, একপাতা প্যারাসিটামল আছে সাথে।কিন্তু সাহস করে উঠতে পারলো না। ডুকরে কাঁদতে লাগলো বালিশ চেপে।
একসময় কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো, নীলির মা ভাবলেন নীলিকে একটু সময় দেওয়া দরকার।
ও একা থাক একটু সময়।
৩৩
আবির ফিরেছে মাঝরাতে। আজকে দিনে দুমিনিট সময়ও সে পায়নি। আগামীকালও ব্যস্ত থাকতে হবে।
ডিনার বাইরে থেকে করেই এসেছে, নীলিকে একবার ফোন করেছিলো, নীলির ফোন বন্ধ। চার্য দিতে ভুলে গেছে মনে হয়, এতদিন পরে বাড়িতে আছে।
তাও ওর সাথে একটু কথা বলা দরকার। মেয়েটা অভিমান করে আছে।
আবিরের মা আবিরের ঘরে এলেন।
আবিরের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, আবির নীলি ডিভোর্সের বিষয়ে হ্যা বলে দিয়েছে, ওরা জানতে চেয়েছে তুই কবে যাবি! আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম।
আবিরের প্রচন্ড চমকে গেল!

শানজানা আলম