শেষ পাতায় তুমি পর্ব-৩৮+৩৯

0
3415

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৩৮|

“সুখ সে যেন ক্ষনিকের বস্তু। যাকে বেশীক্ষণ আঁটকে রাখা যায় না। ফায়াজ সে তো সব ভুলে মেহেরকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিল। সুন্দর কিছু স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু সে সব কি মরীচিকা? একটু সুখের ছোঁয়া পেলেই কেন দুঃখ সাগড়ের স্রোত এসে সুখগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যায়? কেন সুখগুলো ওর কাছে থাকতে চায় না? তবে কি সুখ ওর কপালে নেই? মেহের কি হারিয়ে যাবে? দূরে কোথাও?”

ফায়াজ আর ভাবতে পারছে না। যন্ত্রণায় নিজের মাথা চেপে ধরেছে। দম আটকে আসছে ওর। ভেতরটা হু হু করছে। একটা চাপা আর্তনাদ আঁটকে আছে যেটা চিৎকার হয়ে বের হয়ে চাইছে। আর পারছে না ডাক্তারের সামনে বসে থাকতে। কাউকে কিছু না বলে ছুটে বের হয়ে গেল হাসপাতাল থেকে। গাড়িতে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। গন্তব্য অনির্দিষ্ট।

ফায়াজ গাড়ি থামাল। ওর চোখ গেল মসজিদের দিকে। ফায়াজ কাচ ভেদ করে মসজিদের দিকে চেয়ে আছে। তারপর কি মনে করে গাড়ি থেকে বের হয়ে মসজিদের সামনে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। অনেকের কাছে শুনেছে নামাজ মনকে শান্ত করতে পারে৷ মনে শান্তি ফিরিয়ে আনে। মেহেরের কাছেও অনেক বার শুনেছে। ফায়াজ গুটিগুটি পায়ে মসজিদে প্রবেশ করল। অদ্ভুত এক ফিলিংস হচ্ছে। শেষ কবে মসজিদে এসেছে, আল্লাহর দরবারে হাত তুলেছে মনে পড়ছে না। ফায়াজের সারা শরীর মৃদু কাঁপছে। কেমন অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে।

ফায়াজ ওজু করার জায়গায় গেল। সেখানে একজন সাদা পাঞ্জাবি পরা বৃদ্ধ লোক ওজু করছে। ফায়াজ কল ছেড়ে ওজু করে মাথায় রুমাল বেঁধে নিল।

মসজিদের ভেতরে গিয়ে সবার সাথে নামাজ পড়ল। সবাই চলে যাওয়ার পরেও ফায়াজ বসে আছে। কেমন একটা অদ্ভুত প্রশান্তি কাজ করছে। ফায়াজ দু’হাত তুলে মোনাজাত ধরল,
“হে আল্লাহ! আমি কবে ঠিক তোমার দরবারে হাত তুলেছি মনে নেই। তোমার প্রতি কখনো কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে হাত তুলি নি। আজও তা করছি না। আজ আমি কিছু চাইতে তোমার দরবারে হাত তুলেছি। আমার মেহেরকে চাই। ওকে ছাড়া আমি নিঃস্ব। আমি জীবনে প্রাচুর্য ছাড়া আর কিছু পাই নি। মা-বাবা, পরিবার কারো ভালোবাসা পাই নি। নিজের জন্য শুধু একজন চেয়েছি। আর তাকে যদি হারিয়ে ফেলি তবে আমার আর কিছু থাকবে না। মেহেরকে তুমি সুস্থ রেখো। ও খুব নিষ্পাপ মনের মেয়ে। সবার কথা ভাবে। কখনো নিজের সুখটা খুঁজে নি। ওর প্রতি তুমি এতটা নিষ্ঠুর হতে পারো না। তুমি এতটা নির্দয় হতে পারো না। এটা আমার বিশ্বাস।” ( ফায়াজের চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে)

পুরো বাড়িটা যেন ভারী হয়ে আছে। মেহেরের নিশ্বাসটাও যেন ভারী লাগছে। অন্ধকার পুরো বাড়িটা ঘিরে ধরেছে। ফায়াজ তখনও বাড়ি ফিরে নি। মেহের হসপিটালে লাস্ট চেকাপ করতে গিয়েছিল আজ। আর তাতে জানতে পারে মেহেরের অপারেশন করাটা বাধ্যতামূলক। আর তাতে রিক্স আছে৷ আর এটা শোনার পর থেকেই সবাই যেন হুট করে বদলে গেল। তবে মেহেরের মন খারাপ লাগছে না। কারণ এ বাড়িতে মন খারাপ করার লোকের অভাব নেই।
তাই ওর আর মন খারাপ হচ্ছে না। কাউকে না কাউকে তো মন ভালো রাখতে হবে৷ সে দায়িত্বটা নাহয় ও নিজেই নিবে।

মেহের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফায়াজের জন্য অপেক্ষা করছে। লাইটের ঝকঝকে আলোয় সাদা একটা গাড়িকে গেট দিয়ে প্রবেশ করতে দেখল। ফায়াজ গাড়ি থেকে কিছুটা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে নামছে। মেহের ফায়াজের প্রবেশ পানে চেয়ে আছে। ফায়াজকে বিধ্বস্ত লাগছে।
মেহেরের বুক চিড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।

ফায়াজ ঘরে ঢুকতেই মেহের ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। ফায়াজ চোখ তুলে একবার মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর আবার চোখ নামিয়ে আলমারির দিকে আগাচ্ছে।।
মেহের পেছনে থেকে বলল,
“আপনি সারাদিন কোথায় ছিলেন? হসপিটাল থেকে হুট করে কোথায় চলে গেলেন? আপনার জন্য আমি টেনশন করছি।”

ফায়াজ থমকে গেল। শুকনো মুখে পেছনে ঘুরে মেহেরের মুখ পানে তাকাল। যে মেয়ের এই অবস্থা সে নিজের জন্য টেনশন না করে ওর জন্য টেনশন করছে। মেহেরের কপাল এখনো কুচকে আছে।
ফায়াজ আচমকা গিয়ে মেহেরকে জড়িয়ে ধরল। ওর ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। মেহের নিজের কাঁধে পানি অনুভব করল। ফায়াজ কাঁদছে। ঢুকরে কাঁদছে।
মেহের নিজেকে আর শক্ত করতে পারছে না। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছে।

মেহের ধরা গলায় বলল,
“আপনি এমন করছেন কেন? আপনার বিহেভিয়ার দেখে মনে হচ্ছে আমি মরে যাব।”

ফায়াজ মুখ তুলে মেহেরর দিকে তাকাল। তারপর মেহেরের গালে আলতো ছুয়ে বলল,
” একদম আজেবাজে কথা বলবে না। তোমার কিছু হবে না। তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে। আমি তোমার কিছু হতে দেব না।”
ফায়াজ মেহেরকে আবারও বুকে চেপে ধরল।

মেহের ফায়াজের বুকে থেকেই বলল,” আমি তো সেটাই বলছি। দেখুন বাড়ির সবাই কান্নাকাটি করছে। সবাই মুখ ভার করে আছে। আপনিও যদি এমন করেন তাহলে কেমন হবে বলুন? আমার কি মন খারাপ হয় না?”

ফায়াজ নিজের চোখ মুছে বলল,
“আর কেউ কাঁদবে না। কেউ না। আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে। কিছু দিবে খেতে?”

মেহের মুচকি হেসে বলল,” ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

মেহের আর ফায়াজ পাশাপাশি শুয়ে আছে। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। দুজনেই জেগে আছে তবে দুজনের মধ্যে এক গভীর আচ্ছন্ন নীরবতা। মেহের অন্ধকারে হাতড়ে ফায়াজের বুকের উপর হাত রাখল। ফায়াজ মেহেরের হাতটা চেপে ধরে মোলায়েম গলায় বলল,
“ফজরের সময় আমাকে ডেকো।”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে বুঝতে পারল না ওকে কেন ডাকবে। এত সকালে কি করবে? কই যাবে? তাই জিজ্ঞেস করল,
“এত সকালে উঠে কি করবেন?”

ফায়াজ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিচুস্তরে বলল,
“নামাজ আদায় করব।”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে চমকে গেল। তারপর ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটল। আর মনে মনে বলল,”আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।”

ফায়াজ মেহেরকে অনবরত এভয়েড করে। মেহেরের কথাগুলো এড়িয়ে যায়। যতক্ষণ মেহেরের সামনে থাকে অস্থির হয়ে থাকে। কখন ছুটে পালাবে। মেহেরের সাথে সব সময় গম্ভীরমুখে কথা বলে। তবে মেহেরের খেয়াল রাখায় কোন কমতি রাখে না।

দেখতে দেখতে মেহেরের অপারেশনের দিন ঘনিয়ে আসে। সবাই মেহেরের জন্য অপেক্ষা করছে নিচে। কিন্তু মেহের তৈরি হচ্ছে না। কেমন ঢিলামি করছে। এটা ধরছে তো ওটা রাখছে। তৈরি হতে বেশ সময় পাড় করে দিল।
ফায়াজ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“মেহের, কি করছো? আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মেহের ফায়াজের দিকে একবার তাকাল তারপর আবার নিজের কাজ করছে। ওর কেন জানি যেতে ইচ্ছে করছে না। মনে হচ্ছে হসপিটালে যত তাড়াতাড়ি যাবে তত তাড়াতাড়ি ওর জীবনীশক্তি হারিয়ে যাবে। এই সুন্দর পৃথিবী আর ভালোবাসার মানুষটা হারিয়ে যাবে। তাই বাড়ি থেকে বের হতে চাইছে না। দেরি করার নানান বাহানা করছে।
ফায়াজ গিয়ে মেহেরের হাত চেপে ধরল। মেহেরের হাত ধরতেই মেহের স্থির হয়ে দাঁড়াল।

ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল। মেহের ফায়াজের দিকে তাকাচ্ছে না। মেহেরের থুতনি ধরে উচু করে বলল,
“লুক এট মি মেহের।”

মেহের ফায়াজের চোখের দিকে তাকাল। দু’জন দুজনার চোখে চোখ রেখেছে। ফায়াজ ভালোবাসা মাখা কন্ঠে বলল,
“মেহের, জান আমার। তুমি অপারেশন থিয়েটারে যাবে তোমাকে জাস্ট একটা ইঞ্জেকশন দিবে। এটুকুই তোমাকে সহ্য করতে হবে। তারপর যখন চোখ মেলবে আমাকে দেখতে পাবে। বুঝেছো? একদম ভয় পেও না।”

মেহের উত্তরে ছোট্ট করে বলল,”আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন?”
ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল। মেহেরের এমন আকুতি জড়িত কথা অগ্রাহ্য করতে পারছে না কিন্তু অগ্রাহ্য করবে। নয়তো মেহের আহ্লাদী হয়ে পড়বে। মেহেরকে এই মুহুর্তে ইমোশনাল করে নিজের ইমোশন প্রকাশ করতে চায় না। তাই শক্ত কন্ঠে বলল,
“দেরি হয়ে যাচ্ছে, মেহের।”

মেহের গাল ফুলিয়ে তাকাল। ফায়াজ এতটা নিষ্ঠুর কি করে হয়ে যাচ্ছে? একটু জড়িয়ে ধরলে কি হবে?
ফায়াজ চলে যেতে নিলে মেহের পেছনে থেকে বলল,
“ওই কথাটা তো শুনুন তাহলে।”

ফায়াজ ঘুরে মেহেরের দিকে তাকাল। কিন্তু এই মুহুর্তে জানতে চায় না। কিছু জানতে চায় না।
“মেহের, আমি সব কথা শুনব। তোমার সব ইচ্ছে পূরণ করব তবে সেটা যখন সুস্থ হয়ে বের হবে তখন।”

ফায়াজের মনে হচ্ছে মেহের এখন সব কথা বলে ফেললে আর ফিরে আসবে না। মেহের তার অব্যক্ত কথার জন্য হলেও ফিরে আসবে এটুকুই আশা।
ফায়াজ বের হয়ে গেল। মেহের ফায়াজের সাথে কথা বলবে না। নাক ফুলিয়ে রেডি হয়ে বের হলো।

মেহের সারা রাস্তা চুপ করে ছিল। কারো সাথে কথা বলে নি। ওর বাবা-মা, বোন, তূর্জ, সামিরা, অনু, ওলিদ, আলিফ, ফায়াজের বাবা, বন্ধুরা সবাই হসপিটালে গিয়ে হাজির। মেহের সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে যাচ্ছে। ফায়াজ পেছন থেকে মেহেরকে ডাকল। ফায়াজ আর নিজের ইমোশন কন্ট্রোল করতে পারছে না।
মেহের দাঁড়িয়ে গেল। পেছনে ঘুরে ফায়াজের দিকে স্নিগ্ধ চোখে তাকাল। ফায়াজ মেহেরের সামনে এগিয়ে গেল। মেহের তখনও প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে আছে।
ফায়াজ মেহেরকে আলতো করে জড়িয়ে ধরল।
“মেহের, তোমাকে ফিরতে হবে। তুমি ফিরবে। আমার জন্য নয়, আমাদের জন্য, আমাদের ভালোবাসার জন্য। এখনও অনেক কথা বাকি আমাদের। অনেকটা পথচলা বাকি। এখনও আমাদের সংসারটা গড়ে ওঠে নি। আমাদের হাতে হাত রেখে পথ চলা হয় নি। একসাথে বৃষ্টিবিলাস হয় নি, দুজনে একসাথে বসে জ্যোৎস্না দেখা হয় নি। এখনও প্রেমটা জমে ওঠে নি। তোমার অব্যক্ত কথা ব্যক্ত করা হয় নি। এই সব কিছু আমার চাই। আর এই চাওয়া পূরণের জন্য হলেও তোমাকে ফিরতে হবে।” ( এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে ফায়াজ দম নিল)

মেহের ফায়াজের পিঠে হাত রাখল। তারপর বলল,
” ইনশাআল্লাহ!”

ফায়াজ মেহেরকে ছেড়ে দিয়ে বলল,”ইনশাআল্লাহ!”

চলবে……!।

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৩৯|

“সময় আর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময় নিজের মতো বহমান। কিন্তু খারাপ সময় যেন যেতে চায় না। একেকটা মিনিট যেন কয়েক ঘন্টা সময়। ফায়াজের কাছেও এখন একেকটা মিনিটকে ঘন্টা মনে হচ্ছে। সব কিছু দুর্বিষহ লাগছে।”
ফায়াজ দু মিনিট স্থির হয়ে বসতে পারছে না। এদিক সেদিক পায়চারী করছে। আর অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকাচ্ছে। ফায়াজের মনে হচ্ছে ওর বুকটা যেন কেউ চেপে ধরে রেখেছে। দম বন্ধ করা ভয়ংকর অনুভূতি হচ্ছে।

ফায়াজ আবারও বসেছে। দুহাতে মাথা চেপে ধরে আছে। একদিনেই নিজের চেহারাটা কি বানিয়ে ফেলেছে। ফায়াজের মনে হচ্ছে কয়েকঘন্টার জন্য যদি ভ্যানিশ হয়ে যেত পারত। আর পারছে না অপেক্ষা করতে।

“অপেক্ষা সে তো ভয়ংকর অনুভূতির নাম, অপেক্ষা সে তো বুকের ভেতর রক্তক্ষরনের নাম।”

ফায়াজকে অস্থির অস্থির করতে দেখে তুষার এগিয়ে এল। ফায়াজের কাঁধে হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ভাই, কি করছিস? এমন করছিস কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে।”

ফায়াজ করুনসুরে বলল,”আমি আর পারছি না তুষার। আমার ভেতরটা এমন করছে কেন? মেহের ঠিক হয়ে যাবে তো? ওর কিছু হবে না তো?”

তুষার আশ্বস্ত করে বলল,
“তুই এমন করিস না। মেহের একদম ঠিক হয়ে যাবে। চুপ করে বস।”

ফায়াজ তুষারের কথা শুনে বলল,
“কি করে বলতে পারিস? আমি চুপ করে কি করে বসতে পারি? আমি জীবন মরণের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। তাই তো মৃত্যু পথযাত্রীর মতো ছটফট করছি। আমি পারব না স্থির থাকতে।”

মেহেরের পরিচিতি জনেরা কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। সবাই নিশ্চুপ হয়ে আছে। কারো কপালে, কারো মুখে হাত। সবার নীরব প্রার্থনায় মেহেরের সুস্থতা কামনা রয়েছে।
মেহেরের মায়ের কপালে চিকন ঘামের রেখা ফুটে ওঠেছে। উনার প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। মাহি মিশানকে নিয়ে ওঠে গেল। ছেলেটা অনেকক্ষণ ধরে কাঁদছে। এতক্ষণ মাহি বসে থাকলেও এখন আর পারছে না।

তুষার একমনে ফায়াজের দিকে চেয়ে আছে। তুষারের হুট করে একটু বেশীই ভয় লাগছে। অজানা আশংকায় বুক কেঁপে উঠছে। তবে মেহেরের জন্য নয়। এই ভয়টা ফায়াজের জন্য। মেহেরের যদি কিছু হয় তবে ফায়াজ পাগল হয়ে যাবে। ওকে বাঁচানো যাবে না। যদি খারাপ কোন নিউজ আসে তো দেখা যাবে ফায়াজ হসপিটালের সাত তলা বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়বে। তুষার ঢোক গিলছে। এ-সব আর ভাবতে পারছে না। চোখের সামনে বন্ধুর জীবনটা শেষ হতে দেখতে পারবে না।

ফায়াজ হসপিটালের জানালা থেকে বাইরে চেয়ে আছে। নগরীর ব্যস্ত রাস্তা দিয়ে কতশত মানুষ যাতায়াত করছে। এম্বুলেন্স করে কয়েকজন রোগী আসছে। মাত্রই হসপিটাল থেকে একটা লাশ নিয়ে গেল। সেখানে ছিল আত্মীয়স্বজনে আহাজারি, আর্তচিৎকার। এই অন্ধকারে তাদের আর্তচিৎকারে আকাশ ভারী হয়ে আসছিল। ফায়াজ এই মুহুর্তে অনুভব করতে পারছে একটা মানুষ মরে যাওয়া মানে একজন মরে যাওয়া না সাথে তার ভালোবাসার অসংখ্য মানুষকে জীবন্ত লাশে পরিণত করা।

মেহের বলেছিল,
“দুটো মানুষের মধ্যে যদি একটা সম্পর্ক থাকে আর সে সম্পর্কটা যদি হয় ভালোবাসার তবে সেই মানুষগুলো হারিয়ে গেলেও ভালোবাসাটা থেকে যায়। যদি আমি হারিয়ে যাই তবুও ভালোবাসাটা হারাবে না। আপনার প্রতি প্রার্থনায় আমি থাকব।”

ফায়াজ চোখ বন্ধ করে নিল। তারপর বিড়বিড় করে বলল,
“এ-সব কথায় আমার পোষাবে না। আমার তোমাকে চাই।”
ফায়াজ চোখ খোলে আকাশের দিকে তাকাল। রাতের আকাশে তারারা জ্বলে আছে। পুরো আকাশ জুড়ে তারার মেলা। আকাশপানে চেয়ে অতি গোপনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাল।

🥀🥀
কিছুক্ষণ পরে অপারেশন থিয়েটারের লাইট অফ হয়ে গেল। ফায়াজের বুকটা কেন জানি ধক করে উঠল। সাথে সাথে সবাই এগিয়ে গেল। ডাক্তার সবাইকে বিচলিত অবস্থায় দেখে হাসি মুখে বলল,
“অপারেশন সাকসেসফুল। কেবিনে শিফট করা হবে। জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে।”
সবার মুখে হাসি ফুটল। ফায়াজের গলার কাছে আঁটকে থাকা প্রাণটা যেন ফিরে এলো। ফায়াজের চোখ খুশিতে চিকচিক করছে। ফায়াজ খুশিতে তুষারকে জড়িয়ে ধরল। ফায়াজের খুশি দেখে তুষারের চোখেও পানি চলে এসেছে। এতক্ষণ ওর নিশ্বাসও আঁটকে ছিল। সবাই বেশ উৎফুল্ল। সবাই যেন আবার প্রাণ ফিরে পেল। মেহেরের মা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাচ্ছেন আর চোখের পানি মুছছেন৷ মাহি খুশিতে মিশানকে আরো শক্ত জড়িয়ে ধরল।

🌸🌸
মেহের পিটপিট করে চোখ মেলে। চোখ মেলার পর নিজেকে খুব ক্লান্ত লাগছে। শরীরটা নেতিয়ে গেছে। মেহের হাতটা নড়ানোর চেষ্টা করলে হাতে মৃদু ব্যথা অনুভব করে। মেহের হাতটা চোখের সামনে ধীরে ধীরে এনে দেখে তাতে ব্যান্ডেজ করা। মেহের চারদিকে চোখ বুলাল। একজন নার্সকে দেখতে পেল। মেহেরের তখন হুশ হলো। ও হসপিটালে এসেছে। আজ ওর অপারেশন। মেহের একটু নড়তেই বুঝতে পারল ওর অপারেশন হয়ে গেছে। আর ও বেঁচে আছে। মেহের খুশিতে কেঁদে দিল। আর মনে মনে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া জানাচ্ছে।
“ফায়াজ, আমাকে আল্লাহ ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমার প্রতি আর আপনার প্রতি দয়া করেছেন৷ আমি বেঁচে আছি ফায়াজ।”

নার্স মেহেরকে চোখ মেলা দেখে বাইরে চলে গেলেন।

.

ফায়াজ এক প্রকার দৌড়ে ভেতরে ঢুকল। ঢুকে দেখল মেহের অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে। ফায়াজ পা টিপে টিপে মেহেরের দিকে আগাচ্ছে। কেন জানি ওর বুক ঢিপঢিপ করছে আর শরীরটাও কাঁপছে। কেন কাঁপছে? নিশ্চয়ই এ কাঁপন সুখের কাঁপন।
ফায়াজ মেহেরের পাশে গিয়ে বসল। মেহের ফায়াজের অস্তিত্ব টের পেয়ে ফায়াজের দিকে অশ্রুভেজা চোখে তাকাল।
তারপর মেহের আবারও কেঁদে ফেলল। ফায়াজের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। ফায়াজ মেহেরের হাতটা ধরে ছলছল চোখে হাতে চুমু খেল।
ধরা গলায় বলল,
“কথা রেখেছে আমার মেহেরজান।”

ফায়াজ নিজের মাথাটা মেহেরের বুকে রাখল। মেহের ফায়াজের ঘাড়ে হাত রাখল। ফায়াজের মাথায় চুমু খেল। ফায়াজ মেহেরের চোখের পানি মুছে দিয়ে ওর কপালে চুমু খেল। ওরা একে অপরের সাথে সময় কাটানো শেষে একে একে সবাই মেহেরের সাথে দেখা করে গেল।

কিছুদিন পরে মেহেরকে রিলিজ দেওয়া হলো হসপিটাল থেকে। সবাই বাড়িতে গিয়ে চমকে গেল। ফাইজা আর ওর মা এসেছে। মেহের ভেতরে ঢুকতেই ফাইজা দৌড়ে এল ওর কাছে। ফায়াজ এতবছর পর ওর মাকে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেল। ফায়াজের মা ছলছল চোখে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজ বিস্ফোরিত চোখে ওর মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ফায়াজ দাঁতে দাঁত চেপে মেঝের দিকে স্থির দৃষ্টি দিয়ে আছে। তারপর এক বার মেহেরের দিকে তাকাল। ফাইজা মেহেরকে কি জানি জিজ্ঞেস করছে আর মেহের হাসিমুখে তার উত্তর দিচ্ছে। মেহেরের মা ফায়াজের মা কে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ফায়াজ চুপচাপ সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। ফায়াজের মা ফায়াজের যাওয়ার দিকে সবার আড়ালে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালেন।

এই প্রথম ফাইজার সাথে মেহেরের দেখা হয়েছে। ফাইজা কথার ঝুলি নিয়ে বসেছে। ওর মায়ের সাথে মেহেরকে কথা বলার সুযোগই দিচ্ছে না।
ফায়াজের মা মেহেরের সাথে কথা বলার জন্য একা বসেছে।
মেহের আর ওর শ্বাশুড়ি এক সাথে একা বসে আছে। মেহেরের খুব নার্ভাস লাগছে। এই প্রথম উনার সাথে দেখা। কি বলবে, কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।
ফায়াজের মা নীরবতা ভেঙে বলল,
“তুমি দেখতে বেশ মিষ্টি।”

মেহের মুচকি হাসল তার কথা শুনে। কি বলবে বুঝতে না পেরে বলল,
“আপনি কেমন আছেন?”
মেহেরের কথা শুনে তিনি মুচকি হাসেন। তারপর বলল,
“ছেলে, সংসার হীন যেমন থাকার কথা তেমনই আছি।”

মেহের ফায়াজের বাবার মতো ফায়াজের মায়ের চোখেও সেই লুকনো ব্যথা দেখতে পেল। তারপর দুজনে নানা বিষয় নিয়ে অনেকক্ষণ কথা বলল। ফায়াজ দূর থেকে নজর রাখছে। ওর মায়ের এখানে আসাটা একদম মেনে নিতে পারছে না। মেহেরদের বাড়ি তাই রিয়েক্ট করতে পারছে না। যেটুকু রিয়েক্ট করত সেটাও করছে না মেহেরের অসুস্থতার জন্য। সবেমাত্র হসপিটাল থেকে ফিরেছে। তাই কোন তামাশা দাড় করাতে চায় না।
মেহেরে না উনাকে থাকার জন্য অনেকবার বলল কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। ফায়াজের সাথে অনেক বার কথা বলার চেষ্টা করেও পারেন নি। এখানে থেকে ফায়াজকে আর কষ্ট দিতে চান না। যাওয়ার আগে মেহেরকে উপহার স্বরুপ একটা নেকলেস পড়িয়ে দিয়েছেন। মেহের কিছুতেই নিতে চায় নি ফায়াজের ভয়ে। কিন্তু ওর মা বলল,
“শ্বাশুড়ি মা প্রথম বার ভালোবেসে কিছু দিয়েছে। ফিরিয়ে দিস না। দোয়া হিসেবে রেখে দে।”

ওরা চলে যেতেই মেহেরকে রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে বলল। হসপিটাল থেকে আসার পর মেহের রেস্ট করার সুযোগ পায় নি।
মেহের ওড়নার আড়ালে নেকলেসটা লুকিয়ে রুমে নিয়ে গেল। উদ্দেশ্য ফায়াজকে কিছুই জানাবে না। আলমারিতে লুকিয়ে রাখবে। মেহের রুমে ঢুকে কোনদিক না চেয়ে সোজা আলমারির কাছে চলে গেল।
যখনই আলমারি খুলে নেকলেসটা রাখতে যাবে ফায়াজ হুড়মুড় করে এসে মেহেরের হাত থেকে বক্সটা নিয়ে মেঝেতে ছুড়ে মারে। মেহের চমকে যায়। তারপর ভয়ে ভয়ে ফায়াজের দিকে তাকাল। ফায়াজের চোখে যেন আগুন জ্বলছে। রাগে গজগজ করছে। ফায়াজ চোখ গরম করে মেহেরের দিকে চেয়ে আছে। মেহের ঢোক গিলে। আর চোখ বন্ধ করে বলল,
“যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত্রী হয়।”

মেহের চোখ খুলে ফায়াজের দিকে তাকাতেই ফায়াজ বলল,
“তুমি ওই মহিলার কাছ থেকে এটা কেন নিয়েছো?”

মেহের ওর কথা শুনে বলল,
“কি বললেন আপনি? উনি আপনার মা।”

ফায়াজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,”মা! কিসের মা? আমার কোন মা নেই। তুমি আর একবার যদি উনাকে আমার মা বলে সম্বোধন করেছো তবে ভালো হবে না? ওই মহিলা কেন এসেছে এখানে? কেন এসেছে? আর তোমার এত কথা কিসের উনার সাথে?”

মেহের আমতা আমতা করে বলল,
“আমাদের বাড়িতে আমাকে দেখতে এসেছে আর আমি কথা বলব না? আমি এতটা অমানবিক হতে পারি না।”

ফায়াজ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
“আচ্ছা, তাই? এইজন্য এই নেকলেস নিয়েছো?”

ফায়াজ নেকলেসটা তুলে বাইরে ছুড়ে মারতে নিলে মেহের ধরে ফেলল।
“কি করছেন?”

ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোমার কত গয়না চাই? আমাকে বলো আমি এনে দেব৷ কিন্তু এই মহিলার একটা সুতোও তুমি ছুবে না। বলো কি চাই তোমার?”

মেহের ফায়াজের হাত থেকে বক্সটা নিয়ে বলল,
“আমার কিছুই চাই না। আপনার সাথে উনার সমস্যা থাকলেও আমার নেই। আমাকে ভালোবেসে কিছু দিয়েছেন আমি তার অসম্মান করতে পারব না। আপনি না চাইলে আমি এটা পড়ব না কিন্তু নিজের কাছে যত্ন করে রেখে দেব।”

“প্রয়োজন নেই যত্ন নেওয়ার। সবাই যত্নের যোগ্য না। তুমি রাখবে না। আমি ফেরত পাঠিয়ে দেব।”
ফায়াজ মেহেরের হাত থেকে বক্সটা আবার নিয়ে নিল। মেহের কিছু বলতে গেলে বলল,
“অনেক করেছো দৌড়-ঝাঁপ, আনন্দ ফূর্তি। এইবার রেস্ট নেও।”
ফায়াজ মেহেরকে ধরে বিছানায় বসিয়ে দিল।
মেহের কিছুই বলতে পারল না।

চলবে…..!