শেষ পাতায় তুমি পর্ব-৪০+৪১

0
3391

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৪০|

ফায়াজ বক্স হাতে দরজার সামনে যেতেই মেহের বিছানায় বসা অবস্থায় কিছুটা কড়া সুরে বলল,
“আপনি একটু বেশীই রুড বিহেভ করছেন না?”

ফায়াজ থমকে দাঁড়িয়ে গেল। তারপর পেছনে ঘুরে মেহেরের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকাল। মেহের ফায়াজের রক্তচক্ষু দেখে চোখ নামিয়ে নিল। ফায়াজ ধীরে ধীরে মেহেরের কাছে গিয়ে বসে। মেহের নড়ে-চড়ে একটু দূরে সরে বসে।
ফায়াজ মেহেরের মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। মেহের তখনও দৃষ্টি নত করে রেখেছে।

তারপর ফিসফিস করে বলল,
“তুমি একটু বেশীই সাহস দেখাচ্ছো সেটা মনে হচ্ছে না?”

মেহের ফায়াজের দিকে চোখ তুলে একবার তাকাল। তারপর আবার নিচের দিকে তাকাল।
ফায়াজ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“যাকে আমি পছন্দ করি না। যার সাথে আমার সম্পর্ক নেই তার সাথে তুমি সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছো? তোমাকে যদি আমি এর পর ওই মহিলার আশেপাশে দেখেছি তো… ”

ফায়াজ থেমে গেল। কিন্তু মেহের পরের টুকু শোনার প্রতিক্ষায় আছে। কিন্তু ফায়াজ পুরো লাইন শেষ করে নি। তাই মেহের ফায়াজের দিকে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকাল।
ফায়াজ মেহেরের দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারল। মেহের পুরোটা শুনতে চায়। তাই বলল,
“মেরে দেব।”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে বিস্ময়ে আকাশ থেকে পড়ল। ফায়াজ ওকে মারার কথা বলছে। যে ফায়াজ ওর অসুস্থতার সময় এতটা ভেঙে পড়েছিল। সে আজ ওকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে।
ফায়াজ আবারও ধমকে বলল,
“তোমাকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আবারও বলেছি আমি ফায়াজ নওয়াজ খান। এগেইন রিপিট ফায়াজ নওয়াজ খান। আমি বদলে যেতে পারি কিন্তু নিজের চাওয়া আর নিজের জিনিসের দিকে কারো নজর পড়তে দেই না আর দেবও না।”

ফায়াজ কথা শেষ করে উঠে দাঁড়িয়ে মেহেরকে পাজা কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর কড়া গলায় শাসিয়ে বলল,
“তোমার একটা অপারেশন হয়েছে ভুলে যেও না। তুমি এখনো পুরোপুরি ফিট না। ডাক্তার ফুল রেস্টে থাকতে বলেছে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে তোমাকে। আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে।”

ফায়াজ বক্সটা হাতে বেড়িয়ে পড়ল।
ফাইজা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে। ফায়াজ দেখা করতে বলেছে। কিন্তু ফায়াজেরই খোঁজ নেই। ফায়াজ বলেছে, ১০মিনিটের মধ্যে দেখা কর। যেভাবে ছিল সেভাবেই দৌড়ে চলে এসেছে। কিন্তু ফায়াজ নেই। কিছুক্ষণ পরে ফায়াজের গাড়ি এলো। ফাইজা এগিয়ে গেল। ফায়াজ এডিটিউট নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে ফাইজার হাতে বক্সটা ধরিয়ে দিল। ফাইজার চিনতে বাকি নেই বক্সটা। এই নেকলেসটা ওর মা ওকে সাথে নিয়ে কিনেছে। ফাইজা বক্সের দিকে চেয়ে আছে।
ফায়াজের কথায় ঘোর ভাঙল।
“তোর মা’কে বলবি সে যেন এ-সব দিয়ে মেহেরকে হাত করার চেষ্টা না করে। আমি আমার প্রিয় জিনিসের পাশে অপ্রিয় জিনিসের ছায়া সহ্য করব না। আমি থিংক আমার কথা বুঝতে পেরেছিস। উনাকে বলে দিবি।”

ফাইজার চোখ ছলছল করছে। ওর ভাইয়া যে আজ প্রথম মা’কে অপমান করছে তা নয়। এর আগেও করেছে কিন্তু এতটা খারাপ লাগে নি। আজ কেন জানি খুব খারাপ লাগছে। বুক ফেটে কান্না আসছে। ফায়াজের ফাইজার ছলছলে চোখ উপেক্ষা করে গাড়িতে উঠে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। ফাইজা তখনও দাঁড়িয়ে আছে। ফায়াজ যাওয়ার পর ওর চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। আজ ওর প্রচন্ড অভিমান হচ্ছে।

.

ফায়াজ মেহেরের রুমে গিয়ে দেখে মেহের ঘুমিয়ে আছে। একটা কুশন জড়িয়ে ধরে ঘুমে আচ্ছন্ন। ফায়াজের আর এখানে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
ফায়াজ বিড়বিড় করে বলল,
“মেহের, তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাও। বাড়িতে চলে গেলে তোমাকে কষ্ট দেওয়া মানুষগুলো তোমাকে আর ছুতে পারবে না। আমি ছুতে দেব না।”

ফায়াজ মেহেরের পাশে গিয়ে বসে। ওর চুলে বিলি কাটে। মেহের মৃদু নড়ে ওঠে। তাতে করে ওর চোখের পাতা আর ঠোঁট নড়ে ওঠে। ফায়াজ লোভ সামলাতে পারে না। মেহেরের দিকে ঝুঁকে আলতো করে ওর ঠোঁটে চুমু খেল। মেহেরের ঘুম হালকা ছিল ফায়াজের ছোঁয়া পেয়ে চমকে যায়। ঘুমঘুম চোখ মেলে ফায়াজকে দেখে। মেহের চোখ ছোট ছোট করে ওর দিকে তাকায়। ফায়াজ হেসে ফেলে। সারাদিন পর ফায়াজের মুখে হাসি দেখল মেহের। স্নিগ্ধ হেসে ফায়াজ মেহেরের পাশে শুয়ে পড়ল। মেহেরের গলায় হাত দিয়ে মেহেরকে ঘেঁষে শুয়ে রইল। মেহের তখনও গাল ফুলিয়ে আছে।
ফায়াজ মেহেরকে চুপ দেখে মাথা উঁচু করে ওর মুখটা দেখল। মেহের মুখ ভার করে আছে। ফায়াজ আবারও আলতো করে মেহেরকে চুমু খেয়ে বলল,
“মুখ ভার কেন?”

মেহের জোরপূর্বক হেসে বলল,
“ঘুমিয়ে ছিলাম তাই।”

ফায়াজ আবারও মেহেরকে ঘেঁষে শুয়ে বলল,
“আমি তোমাকে মেরে ফেলব। তোমার তাই মনে হয়?”

মেহের ফায়াজের কথা শুনে ঘাবড়ে গেল। ফায়াজ তাহলে বুঝতে পেরেছে। মেহের ঘনঘন পলক ফেলল।
ফায়াজ বলল,
“জানো তো আমি স্বার্থপর মানুষ। আর স্বার্থপর মানুষ নিজের চেয়ে কাউকে বেশী ভালোবাসতে পারে না। ইনফেক্ট আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষের নিজেকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসা উচিৎ। যে নিজেকে ভালোবাসতে পারে না সে অন্যকে কি করে ভালোবাসতে পারে? তাই আমি মনে করি প্রত্যেক মানুষের নিজেকে ভালোবাসা উচিৎ। আমি নিজেকে কি করে মেরে ফেলতে পারি? তোমাকে মারা মানে তো নিজেকে মেরে ফেলা। আর সেটা আমি কল্পনাও করতে পারি না। তুমি ফায়াজের জীবন। ওটা তো রাগের মাথায় বলেছি। তুমি আমার অপছন্দের মানুষের সাথে নিজেকে জড়িও না প্লিজ।”

মেহের ফায়াজের দিকে ঘুরে বলল,
“ইউ আর সো রুড। আমি অনেক কষ্ট পেয়েছিলাম।”

ফায়াজ বাঁকা হেসে বলল,” সেজন্যই তো আদর করলাম এতক্ষণ।”

মেহের লাজুক হেসে আবার সোজা হয়ে গেল।

ফায়াজ মেহেরের লাজুক হাসি দেখে বলল,”এভাবে হেসো না লোভ লাগে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হও তো। তোমাকে নিয়ে আমার সম্রাজ্যে ফিরতে চাই। আমার সম্রাজ্ঞীকে নিয়ে।”

মেহের ফায়াজের দিকে ঘুরে সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল,
“আবারও এভাবে যাব?”

ফায়াজ না বুঝতে পেরে বলল,”কিভাবে?”

মেহের পলক ফেলে ঠোঁট কামড়ে ফায়াজের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“আমার কোন কালে বিয়ে, সংসার এ-সব নিয়ে স্বপ্ন ছিল না। আসলে নিজেকে অনেক ছোট ভাবতাম। এসব ভাবার উপযুক্ত হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি।”
মেহের শ্বাস নেওয়ার জন্য একটু থামল। ফায়াজ পরবর্তী কথা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
মেহের স্মিত হেসে বলল,”আসলে আমি দু-পরিবারের খুশি আর দোয়া নিয়ে নতুন জীবন শুরু করতে চাই। বউ সেজে ধুমধামে বিয়ে করে বাপের বাড়ি ছাড়তে চাই। আর পাঁচটা মেয়ের মতো। এছাড়া আমাদের ওই বিয়েটা তো বিয়ে ছিল না।”

ফায়াজ মেহেরের কথা বুঝতে পারল। তারপর বলল,”ওকে। সে কি এমন কথা। সব হয়ে যাবে।”

মেহের ফায়াজের আরেকটু কাছে এসে বলল,”আপনি যতটা ইজি ভাবছেন ততটা ইজি না। আমার বাবাকে তো জানেন। সে আমাদের দু’জনকেই অপছন্দ করেন। আমি অসুস্থ তাই দয়া করছে। আর আমার জন্য আপনাকে এলাও করছে।”

ফায়াজ ভেবেছিল মেহেরের বাবা ক্ষমা করে দিয়েছে কিন্তু এ তো নতুন কথা শুনছে। এখন তো নতুন সমস্যা।

পরেরদিন সবাই বিকেলে এক সাথে বসেছে আড্ডা দিতে। ফায়াজের বিরক্ত লাগা স্বত্তেও বসে আছে। কারণ ফায়াজ কিছু কথা বলতে চায়। সবার কথার মাঝে ফায়াজ বলল,
“আমি কিছু বলতে চাই।”
সবাই ফায়াজের দিকে মনোযোগ দিল।

ফায়াজ সবার দৃষ্টি ওর দিকে দেখে বলল,
“বাবা আসবে আপনাদের সাথে কথা বলতে। মেহেরের অপারেশন হয়ে গেছে। কিছুদিনের মধ্যে সুস্থও হয়ে যাবে। তাই মেহেরকে বাড়িতে নিয়ে যাব। বাবা আসবে আমাদের বিয়ের কথা বলতে। আসলে মেহের চায় আমাদের সামাজিক ভাবে বিয়ে হোক।”

তূর্জ তখনই বাড়িতে ঢুকেছে। ওর কথা শুনে মেহেরকে উদ্দেশ্য করে হেসে হেসে বলল,
“শালিকা ডাবল বিয়ে করতে চাইছে। বাহ! বেশ। ডাবল বিয়ে ডাবল গিফট। সব ডাবল।”

মেহের মুখ ভেংচি কেটে বলল,
“ডাবল কোথায়? ওটা কি বিয়ে ছিল? ওটা তো একটা চুক্তি ছিল।”
মেহের কথাটা বলেই জিব কাটল। মুখ ফস্কে কি বলে ফেলল। সবাই চমকে মেহেরের দিকে তাকাল। ফায়াজ অবাক চোখে চেয়ে আছে মেহেরের দিকে। মাহি ঢোক গিলছে। মেহের আড়চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে তার রিয়েকশন বুঝার চেষ্টা করছে।

মেহেরের বাবা গম্ভীরমুখে বলল, “মানে? চুক্তি! কিসের চুক্তি?”

মেহের এড়ানোর জন্য বলল,”না মানে চুক্তি না। ওটা তো কথার কথা। আসলে আমাদের মধ্যে একটা ঝামেলা হয়েছিল সেটাই বলছিলাম।”

মেহেরের বাবা সন্তুষ্ট হলেন না ওর কথা শুনে। তাই বললেন,
“সত্যিটা আমি তোমাদ দু’জনকে জিজ্ঞেস করছি।”

ফায়াজ মেহেরের দিকে তাকাল। মেহের আমতা আমতা করছে। মাহি ওর বাবার দিকে একবার আর একবার মেহেরের দিকে তাকাল। তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“আমি বলছি।”

মেহের মাহির দিকে চমকে তাকাল। তারপর উঠে দাঁড়াল।
মাহি মেহেরকে পাত্তা না দিয়ে বলল,”এতকিছু, এত ঘটনার মধ্যে একটা সত্য লুকিয়ে আছে। আর সে সত্যটা হচ্ছে সবকিছুর জন্য আমি দায়ী। আমি হচ্ছি মেইন কালপিট।”

কেউ কিছুই বুঝতে পারছে না। তূর্জ অবাক চোখে চেয়ে আছে মাহির দিকে।
“আমি হচ্ছি সেই যার জন্য এসব হয়েছে। আমার জন্য মেহেরের জীবনে ঝড় নেমে এসেছে। আমার খুশির জন্য মেহের সব কিছু মেনে নিয়েছে। মেহের আমার খুশি, তোমাদের খুশির জন্য অনেক বিসর্জন দিয়েছে। মুখ বুঝে সব অপবাদ মেনে নিয়েছে। আর আমি এতদিন যাবত সবার বিশ্বাস, ভরসা, ভালোবাসা নিয়ে খেলেছি। আমি তূর্জকেও ঠকিয়েছি। মেহেরকে ব্যবহার করেছি। আমি ওর জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছিলাম৷ আমার জন্য আজ সবাই ভুগছে আর আমি স্বার্থপরের মতো নিজের সংসারের কথা ভেবেছি।”
মাহির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।

চলবে…..

#শেষ_পাতায়_তুমি(Revenge story)
#ফাবিহা_নওশীন

|পর্ব-৪১|

তূর্জ মাহির দিকে পলকহীন ভাবে চেয়ে আছে। তূর্জের কেন জানি মনে হচ্ছে মাহি এমন কিছু বলতে যাচ্ছে যার প্রভাবে ওদের ভালোবাসা দিয়ে সাজানো গোছানো সংসারটা ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে। তূর্জ চোখ বন্ধ করে মনে মনে বারবার বলছে,
“মাহি, প্লিজ এমন কিছু বলো না। প্লিজ মাহি। আমাদের সম্পর্কটা তুমি নষ্ট করো না। এমন কিছু বলো না যার কারণে আমাদের এতদিনের সম্পর্ক, ভালোবাসা সবটা শেষ হয়ে যায়।”

তূর্জ চোখ খোলে মাহির দিকে তাকাল। মাহির সোফার ঠিক পেছনটায় দাঁড়িয়ে দু’হাতে শক্ত করে সোফা ধরে রেখে চোখ বন্ধ করে আছে। মাহির সবকিছু ফেস করতে যতটুকু সাহস প্রয়োজন সেটা সঞ্চার করার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না।

মেহের মাহির হাতের উপর হাত রেখে বলল,
“আপু বাদ দেও।”
মাহি হাত উঁচিয়ে চোখ মেলে মেহেরের দিকে শান্ত দৃষ্টি দিয়ে বলল,”আজ আমাকে পারতেই হবে মেহু।”

মেহের আর কিছু বলল না। মাহি সামনের দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে বলতে শুরু করল,
“আমার বিয়ের কয়েকমাস আগের কথা। হিমি নামে আমার এক ফ্রেন্ড আড্ডার মাঝে হটাৎ বলে ওঠে ফায়াজ না কি কোন মেয়েকে পাত্তা দেয় না। ওর কাছ থেকে কোন মেয়ে প্রপোজ আদায় করতে পারবে না। আমাকে বারবার বলছিল আমিও পারব না। রীতিমতো চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়৷ আমার হুট করে রাগ উঠে যায় আর আমি ঝুকের মাথায় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে নেই। তারপর শুরু হয় ফায়াজকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা। ওর নাম্বার জোগাড় করে ওকে ফোন করতাম, মেসেজ করতাম কিন্তু এতেও পাত্তা পাই নি। তারপর একদিন জানতে পারি ফায়াজ গান খুব পছন্দ করে৷ আমি মেহুর কিছু রেকর্ডিং ওর নাম্বারে সেন্ড করে দেই৷ এতেই কাজ হয়ে যায়। ফায়াজ আমাকে তারপর নিজে থেকেই ফোন করে৷ ওর কথা শুনে এটা বুঝেছিলাম যে ও এই কন্ঠের উপর ফিদা হয়ে গেছে৷ আর সেটা সামান্য নয়, অসামান্য ছিল। তাই আমি সিম ফেলে দিয়ে উধাও হয়ে যাই৷ কিন্তু ফায়াজ আমাকে খোঁজে বের করে আর সবার সামনে প্রপোজ করে। এতে আমি হিমির দেওয়া চ্যালেঞ্জে জিতেও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি। ফায়াজ আমাকে কোন কিছু বলার সুযোগ দেয় নি। আর হিমিও আমাকে ব্ল্যাকমেইল করতে শুরু করে। মেহেরের রেকর্ডিং-এর কথা ফায়াজকে বলে দেবে। ও চায় আমি কিছুদিন ফায়াজের সাথে রিকেশনে থাকি। বাধ্য হয়ে তাই করলাম৷ ফায়াজ এতদিনে জেনে গেছে আমি আমার ছোটবোনকে ভীষণ ভালোবাসি। বিষয়টা দিনদিন জটিল হয়ে যাচ্ছিল। আর আমি ফায়াজ সম্পর্কে অবগত হয়ে আরো বেশি সমস্যায় আটকে গিয়েছিলাম। সব কিছু থেকে পালাতে তূর্জকে বিয়ের কথা বলি। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ফায়াজ সব জেনে যায়। আর মেহেরও। তারপর ফায়াজ হিংস্র হয়ে যায়। গুটি হিসেবে ব্যবহার করে মেহেরকে। আমাকে কষ্ট দিতে ও হুট করে মেহেরকে বিয়ে করে নেয়। মেহেরকে কি বলে রাজি করিয়েছে জানি না তবে এটুকু জানি মেহের আমার জন্য, এই পরিবারের জন্য, পরিবারের সম্মানের জন্য এক কথায় ফায়াজকে বিয়ে করে নেয়৷ আমি ওর জন্য কিছু করতে পারি নি। আর আমি বলতেও পারি নি কন্ঠস্বরটা মেহেরের। আমি ইচ্ছে করেই বলিনি। আমার বারবার মনে হতো ফায়াজ মেহেরের যোগ্য নয়। মেহেরকে ও সুখী করতে পারবে না। মেহের আরো ভালো কাউকে ডিজার্ভ করে। তাই আমি চাই নি ফায়াজ সত্যিটা জানুক। এমন সব ঘটনা ঘটতো মাঝেমধ্যে মনে হতো মেহের ফায়াজের সাথে সংসারটা করতে পারবে আবার পরক্ষণেই এমন কিছু হতো তাতে আমি নিরাশ হয়ে পড়তাম। কিন্তু একদিন ফায়াজ আর মেহের রেকর্ডিং এর রহস্য জেনে যায়। সেদিন থেকে মেহের আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করে। তারপর একদিন সবার অজান্তেই ওদের মধ্যে সেপারেশন হয়ে যায়।”

মাহি কথার মাঝে থামল। ছোট্ট করে নিশ্বাস ফেলল কিন্তু কারো দিকে চোখ তুলে তাকায় নি। সে সাহস ওর নেই।
মাহি আবারও বলতে শুরু করল,
“আমি প্রথমদিকে সবটা সবার সামনে স্বীকার করতে চেয়েছিলাম কিন্তু মেহের আমাকে বাঁধা দেয়। আর পরবর্তীতে আমি নিজেই বলি নি। বলতে চাই নি। তখন আমি প্রেগন্যান্ট। আমার খুব ভয় হতো সবটা জানার পর তূর্জের রিয়েকশন কি হবে। আমার শ্বশুরবাড়ির লোক জানলে কি হবে। তারা কি বলবে, আমাকে কি ভাববে। মেহের বাড়িতে জায়গা পায় নি। একা একা হোস্টেলে থেকেছে। সবার কাছে দোষী হয়েছে। শত অবহেলা, অপমান সহ্য করেছে। বাবাও ওকে ভুল বুঝেছে। তবুও স্বার্থপরের মতো চুপ থেকেছি। শুধু নিজের সাজানো গোছানো সংসারের কথা ভেবেছি। কিন্তু আমি রোজ কষ্ট পেয়েছি। মানসিক যন্ত্রণায় তিলেতিলে শেষ হয়েছি। আমি বারবার চেয়েছি মেহেরের এলোমেলো জীবনটা গুছিয়ে দিতে। কিন্তু পারি নি।”
মাহি কান্নায় ভেঙে পড়ল। ফায়াজেরও অস্বস্তি লাগছে। এই ঘটনায় কোথাও না কোথাও তো ও নিজেও আছে। ওর নিজেরও অবদান আছে।

মাহির মা সবটা শুনে মিশানকে কোলে নিয়েই মাহির সামনে গিয়ে রক্তচক্ষু দাঁড়াল।
তারপর কড়া গলায় বলল,
“মাহি, তুই এটা কি করে করলি? এই শিক্ষা দিয়েছিলাম তোকে? এই শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি? একজনের সাথে বিয়ে ঠিক জেনেও কি করে বন্ধুদের ওই নোংরা খেলায় শায় দিলি? মেহের না তোর কলিজার টুকরো বোন? ওর সাথে এত জঘন্য আচরণ কি করে করলি? ছিহ! মাহি। আজীব তোকে নিয়ে গর্ব করেছি। তুই আজ আমাদের মাথা নত করে দিলি। এতদিন আমরা সবাই মেহেরকে ভুল বুঝে এসেছি তোর জন্য যেখানে ওর কোন অপরাধই নেই।”
মাহির মায়ের হটাৎ খেয়াল হলো তূর্জের কথা৷ তূর্জ এখানে আছে। তিনি আড়চোখে তূর্জের দিকে তাকালেন।
তূর্জ মনিল মুখে দৃষ্টি স্থির করে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে ওর ভেতরে কি ভাঙন হচ্ছে। মায়ের কথা থামায় মাহি চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তূর্জের থমথমে মুখটা দেখতে পেল। তূর্জের মুখটা দেখে ওর বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল।

নীরব পরিবেশ দেখে তূর্জ চোখ তুলে তাকাল। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মাহির মা’কে উদ্দেশ্য করে বিধ্বস্ত কন্ঠে বলল,
“আন্টি, আমাকে বাড়ি যেতে হবে। আমি যাচ্ছি।”

তূর্জ আর কারো কথার বা উত্তরের অপেক্ষা করল না। মাহি দৌড়ে তূর্জের পেছনে পেছনে গেল।
“তূর্জ আমার কথা শুনো। প্লিজ লেট মি এক্সপ্লেইন। প্লিজ তূর্জ এভাবে চলে যেও না।”
তূর্জ মাহিকে পাত্তা দিচ্ছে না।
মাহি তূর্জের হাত ধরলে তূর্জ হাত সরিয়ে দিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল,
“ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ মি।”

মাহি থমকে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর কান্না বিজড়িত কন্ঠে বলল,
“তূর্জ! আমার কথাটা তো….”

তূর্জ ধমকে উঠল। ধমকে বলল,
“লিভ মি এলোন।”
মাহি স্তব্ধ হয়ে রইল।
তূর্জ গাড়িতে উঠে চলে গেল। মাহি দরজার সামনে তখনও দাঁড়িয়ে আছে। ওর পেছনে পেছনে মেহের আর ওর মা-ও এসেছে।

মেহেরের বাবা চোখ মুখ শক্ত করে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর হনহন করে চলে গেলেন। ফায়াজ তখনও বসে আছে। আঁড়চোখে উনার যাওয়া দেখল।

মেহের মাহির অবস্থা দেখে ওর মা’কে বলল,
“ভুল আমারি হয়েছে, মা। আমি কেন যে মুখ ফস্কে ওই কথাটা বলে ফেললাম। তবে তো কেউ জানতে পারতো না।”

মেহেরের মা মেহেরকে কড়া গলায় বলল,
“তুই ভুল করিস নি। সত্য আজীবন সত্য। সত্য এমন মহিমান্বিত যে সত্য তার নিজ গুণেই প্রকাশিত হয়। সত্যকে হাজার চেষ্টা করেও ঢেকে রাখা যায় না। একদিন না একদিন সেটা সবার সামনে আসবেই। সেটা দুদিন আগে হোক অথবা পরে। আর আরেকটা কথা মনে রাখিস পাপ বাপকেও ছাড়ে না। মাহি ভুল না পাপ করেছে। আর ওর পাপের শাস্তি ও পাবেই।”
মিশানকে নিয়ে তিনি চলে গেলেন।

মেহের মাহির কাঁধে হাত রাখতেই মাহি বলল,
“তোর কোন দোষ নেই মেহের। মা কি বলল, শুনেছিস না পাপ বাপকেও ছাড়ে না।”

মেহের নিজের রুমে গিয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ওর নিজেকে অপরাধী লাগছে। মনে হচ্ছে এ-সব অজানাই ভালো ছিল। কিছু জিনিস প্রকাশিত না হলেই ভালো। মেহের রুমের ভেতরে ফায়াজের পায়ের শব্দ পেয়ে বারান্দার দরজা বন্ধ করে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ফায়াজ যেন বুঝতে না পারে। ফায়াজের পায়ের শব্দ এখন আর শুনতে পাচ্ছে না।

কিছুক্ষণ পরে ফায়াজ বারান্দার দরজা ধাক্কা মারছে।
“মেহের, দরজা খোল। তুমি নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করছো তাই না?”

মেহের মুখ চেপে ধরে রেখেছে৷ ফায়াজ আবারও বলল,
“মেহের কান্না থামাও। আর দরজাটা খোল প্লিজ।”
মেহের তবুও খুলছে না। ফায়াজ কন্ঠ মোলায়েম করে বলল,
“মেহের, জান আমার দরজা খোল।”

মেহের চোখ মুছে দরজা খুলে দিল। ফায়াজ ভেতরে ঢুকতেই মেহের ফায়াজকে জড়িয়ে ধরল। ফায়াজকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমার খুব ভয় লাগছে ফায়াজ। আমার জন্য সব হয়েছে। তূর্জ ভাই যদি আপুকে ক্ষমা না করে? যদি ওদের মধ্যে কোন সমস্যা হয়? যদি ওদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে যায়? আমি নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারব না।”

ফায়াজ মেহেরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“মেহের, রিলেক্স। তোমার কোন ভুল নেই। এটা হওয়ার ই ছিল। বরং ভালো হয়েছে কেউ আর মনে মনে দুমড়ে মুচড়ে মরবে না। সবটা ক্লিয়ার হয়ে গেছে।”

মেহের মাথা তুলে বলল,
“কিন্তু এর জন্য যদি আপুর সংসারটা ভেঙে যায়?”

ফায়াজ আশ্বস্ত করে বলল,
“কিচ্ছু হবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে। তূর্জ মাহিকে ক্ষমা করে দিবে। হয়তো একটু সময় লাগবে৷ ওরা তো একে অপরকে ভালোবাসে তাই না? ওদের ভালোবাসাই ওদের সম্পর্ক নষ্ট হতে দেবে না। আমিও তো তোমার সাথে অন্যায় করেছি। তুমি আমাকে ক্ষমা করেছো না? বলো?”

মেহের মাথা উঁচু নিচু করে হ্যাঁ বলল। ফায়াজ মেহেরের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,
“তূর্জও করে দেবে। তুমি কান্নাকাটি থামাও। তুমি আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে। তোমার ওষুধ খাওয়ার সময় হয়েছে। চলো।”

ফায়াজ মেহেরকে নিয়ে রুমে গেল।

আজ দুদিন হয়ে গেছে। তূর্জ না ওর ফোন তুলছে আর না কোন খোঁজ নিয়েছে। মাহির ও বাড়িতে ফোন করার সাহস হয় নি। তূর্জ যদি ওদের সাথে বিষয়টা শেয়ার করে থাকে তবে কোন মুখে কথা বলবে। মাহি নিজেও খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। সারাদিন শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। অপেক্ষা করে সময় পাড় করছে। ফোন রিসিভ করছে না। অস্থির হয়ে পড়ছে।

মাহির মা মাহির বাবাকে বলেছিল একবার তূর্জের সাথে কথা বলতে। তিনি বলেছেন,
“আমি কিছুতেই তূর্জ কিংবা তূর্জের পরিবারের সাথে কথা বলতে যাব না। কোন মুখে কথা বলব? তোমার মেয়ে যা করেছে তার পরেও কোন মুখে কথা বলব?”

“যাই করুক। আমরা তো আর আমাদের মেয়েকে ফেলে দিতে পারব না। ওদের কথা তো আমাদের ভাবতে হবে।”

মাহির বাবা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“তোমার মেয়েরা বড় হয়ে গেছে। ওরা নিজের কথা নিজেরাই ভাবতে পারে, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে। আমাদের আর প্রয়োজন হয় না। মেহের যে কি না নিজের খাবারটা নিজে খেতে পারত না, নিজের কোন কিছুই নিজে গুছাতে পারত না, একা ঘুমাতে পারত না, অন্ধকার দেখলে ভয় পেত, ঝড় বৃষ্টিতে ভয়ে গুটিশুটি হয়ে থাকত সেই মেয়ে দুম করে বিয়ে করে নিল। ওকে এত মহৎ হতে কে বলেছিল? ও কি পারত না একবার আমাদের এই কথাগুলো বলতে? তাহলে তো আজ এতকিছু হতো না। মাহিকে আমি সেদিনই উচিত শিক্ষা দিয়ে দিতাম।”

মাঝরাত। ফায়াজ ঘুমিয়ে আছে। কিন্তু মেহেরের ঘুম আসছে না। এপাশ-ওপাশ করছে। এক বিছানায় শুইয়ে থাকা অপর মানুষটা যদি ছটফট করে তবে পাশের মানুষটা ঘুমোয় কি করে? ফায়াজের ঘুম ভেঙে গেল। মেহেরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কি হয়েছে ঘুম আসছে না?”

মেহের ফায়াজের দিকে ঘুরে বলল,
“আমাকে একটু তূর্জ ভাইয়ার কাছে নিয়ে যাবেন?”

ফায়াজ বিরক্তি নিয়ে বলল,
“তুমি আবার ওদের নিয়ে পড়েছো? সমস্যা ওদের মধ্যে ওরাই মিটিয়ে নিক না। আমরা কেন ওদের মধ্যে যাব? আর তাছাড়া তোমার এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় মুভ করার দরকার নেই। তোমার একটা অপারেশন হয়েছে ভুলে যেও না। সো চুপ করে ঘুমাও।”

মেহের বুঝতে পারল ফায়াজকে এ-সব বলে লাভ নেই।
পরের দিন ফায়াজ ভার্সিটিতে গেলে মেহের তূর্জের অফিসে গেল তূর্জের সাথে কথা বলতে।
মেহেরের মা বারবার না করার পরেও মেহের চলে গেল। তূর্জের সাথে কথা বলাটা জরুরী।

চলবে…!