শেষ প্রান্তের মায়া পর্ব-১৮+১৯

0
237

#শেষ_প্রান্তের_মায়া (১৮)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_________________

তিন্নির কেবিনেই ওর মেয়েকে কোলে নিয়ে বসে আছি। সোহান ভাই এসেছে আরো অনেকক্ষণ আগে। এসেই পাগলের মতো করছিলো। অনেক কষ্টে সামলানো গেছে। তিন্নির এখনো জ্ঞান ফিরেনি। মেয়েটার এতো ব্লাড গেছে যে ওর শরীর খুবই দুর্বল। ডাক্তার ম্যাম বলেছে কিছুটা সময় লাগবে। কিন্তু কোনোভাবেই যেনো আর ব্লিডিং শুরু না হয়। আমরা নিজেরাও সেই দোয়াই করছি। আরাফ এখনো যায়নি। অবশ্য এটা নিয়ে কেউ তেমন কিছু বলেওনি। সে রক্ত দিয়েছে তাই তিন্নির জ্ঞান ফিরা অব্দি সে থাকতেই পারে। মাহমুদা আর হেনা আপা বাড়িতে গেছে। হাসপাতালে থাকতে হবে তাই বাচ্চার জন্য কিছু কাপড়, আর তিন্নির কাপড়, রাতে থাকার জন্য চাদর, কাথা সব আনতে গেছে। মাহিদ রক্ত দেওয়ায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাই ‘ও’ যায়নি। আরাফ বারবার উসখুস করছে কিছু বলার জন্য। আমি তার দিকে তাকালাম। বার বার বাচ্চার দিকে তাকাচ্ছে। আমি ধীর কন্ঠে বললাম,

‘নিবেন?’

মাহিদ আর সোহান ভাই আমার দিকে তাকালেন। আরাফ একবার তাকিয়ে আবার দুজনের দিকে তাকালেন। মাহিদ ভদ্রতার স্বরে বলে, ‘নিলে নেন ভাইয়া।’

আরাফের চোখ চকচক করে উঠলেন। বাচ্চা যে সে খুব পছন্দ করে তা বুঝে গেলাম। আমার কোল থেকে আলগোছে বাচ্চাটা কোলে নেয়। আমি উনার কোলে দিয়ে তিন্নির কেবিনের পাশে এসে বসলাম। আরাফ বাচ্চাটা নিয়ে একা একাই কথা বলছে। আমি শুধু তাকিয়ে থেকে দেখলাম। এর মধ্যেই জ্ঞান ফেরে তিন্নির। তিন্নিকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই সোহান ভাই জাপ্টে ধরে তিন্নিকে। পাগলের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। তিন্নি ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে আছে। কোনো রকমে ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে,

‘আমাদের বাবু কই? ‘ও’ ঠিক আছে?’

সোহান ভাই নিজেকে সামলে তিন্নির মুখ হাতের আজলে নেয়। হেঁসে বলে, ‘একদম ঠিক আছে। আমাদের রাজকন্যা হয়েছে। একদম তোমার মতো।’

তিন্নি তাকায় আমার দিকে। আরাফ এগিয়ে এসে বাচ্চাটা আমাকে দিয়ে চোখ দিয়ে ঈশারা করে তিন্নির কাছে দেওয়ার জন্য। আমিও আলগোছে তিন্নির পাশে মেয়েকে শুইয়ে দিলাম। তিন্নি আঁকড়ে ধরে মেয়েকে। মেয়ের চোখে মুখে চুমু দিয়ে বুকের সাথে মিশিয়ে নেয়। তার ঠিক কয়েক সেকেন্ড পরই হুট করে চেঁচিয়ে উঠে। ভয় পেয়ে যাই সকলেই। মাহিদ নিজের শরীরের কথা ভুলে গিয়ে দৌড়ে আসে। সোহান ভাই বার বার জিজ্ঞেস করতে থাকে কি হয়ছে! আমি দ্রুত বাবুকে কোলে নিয়ে আরাফের কোলে দিলাম। আরাফ বাবুকে কোলের সাথে মিশিয়ে নিয়ে থাকে। আমি দ্রুত তিন্নির কাছে বসে ওর মাথায় হাত বুলাতে থাকলাম। তিন্নি ভাঙা ভাঙা ভাবে বলে,

‘মায়া আমার পেট! আমি সহ্য করতে পারতেছি না। গলা শুকিয়ে গেছে একটু পানি দাও প্লিজ।’

কি করবো বা বলবো বুঝে উঠলাম না। আরাফ দ্রুত কন্ঠে বলে, ‘নাহ নাহ পানি দেবেন না। সিজারের অন্তত ২৪ ঘন্টা পর কিছু খাওয়াতে হয়। দাঁড়ান আমি নার্সকে ডাকছি!’

আরাফ বাবু কোলে নিয়েই বাইরে গিয়ে নার্স ডাকে। আমরা ৩ জন যথেষ্ট চেষ্টা করতে থাকলাম তিন্নিকে শান্ত করতে কিন্তু কেউই তেমন পারলাম না। নার্স ছুটে এসে বলে,

‘শান্ত হোন। এভাবে নড়াচড়া করবেন না। সেলাই খুলে গেলে বা আপনার ব্লিডিং শুরু হলে অনেক সমস্যা হবে। আর আপনারা এতো প্যানিক করবেন না এমন ব্যাথা হবেই।’

তিন্নি দাঁতে দাঁত চেপে থাকে। চোখের কোণা বেয়ে পানি পড়তে থাকে। সোহান ভাইয়ের অবস্থা খারাপ। বিষয়টা এমন যেনো কষ্ট তিন্নি না সোহান ভাই নিজেই পাচ্ছে। কোনো রকমে তিন্নি নড়াচড়া বন্ধ করতেই বাবু কেঁদে ওঠে। তিন্নি চোখ মেলে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,

‘মায়া বাবুকে দাও। ওকে খাওয়াতে হবে না!’

‘হওয়ার পর পরই খাওয়ানো হয়েছিলো। তুমি খাওয়াতে পারবে তো?’

তিন্নি মাথা নাড়ে। আরাফ বাবু আমার কোলে দিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে যায়। সাথে মাহিদ আর সোহান ভাইও যায়। আমি আর নার্স মিলে কোনো রকমে ধরে ধরে বাবুকে খাওয়ালাম। বুঝলাম তিন্নির কি ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

________
সেদিনের পর ৪ দিন কেটেছে। এই ৩ টা দিনই তিন্নির খুব কষ্টে গেছে। সোহান ভাই ভীষণ খেয়াল রেখেছে। আল্লাহর রহমতে আর একটুও ব্লিডিং হয়নি। সিজারের জায়গাটার ব্যাথাটাও কমেছিলো তবে আজ আবার জায়গাটা পরিষ্কার করে দেওয়ায় ওর ব্যাথাটা বেড়েছিলো। পরে আবার ওষুধ খেয়ে ঠিক হয়ে গেছে। ৪ দিনেই আরাফ এসে দেখে গেছে। হেনা আপা আমাকে ছুটি নিয়ে দিয়েছিলো। আজ বাড়ি ফিরে কাল থেকে আবার জয়েন করতে হবে ডিউটিতে। অন্যের চাকরী কিছু করার নাই আর। মাহিদ ২ দিন পরই জয়েন করেছিলো যাতে সোহান ভাইকে চাপ না দেওয়া হয়। মাহমুদা, আমি আর সোহান ভাই সব সময়ই এখানে। শুধু রাতে মাহমুদাকে নিয়ে বাড়ি চলে যায় মাহিদ। বাড়িতে সিহাব আর মাইশা আছে। বাবুকে কোলে নিয়ে মাহমুদা কথা বলছে আর পিচ্চিটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। ওহ হ্যাঁ যত যায় হোক বাচ্চাটা প্রচুর ভদ্র। সারাদিনের বেশির ভাগ সময় তাকিয়ে থাকে আর রাতে ঘুমোয়৷ রাতে জ্বালালে ওর মায়ের অনেক কষ্ট হয়ে যেতো। আমি তিন্নিকে আলগোছে বসিয়ে চুল গুলো বেধে একদম হালকা খাবার খাাইয়ে দিলাম। তিন্নি হেঁসে বলে,

‘মাহমুদার সাথে দেখি বাবুর দারুণ ভাব হয়ে গেছে।’

আমি হাসলাম। সোহান ভাই আর মাহিদ এসে বললো সব গুছিয়ে নিতে। রিলিজ দিয়ে দিয়েছে। আমি আর মাহিদ টুকটাক সব গুছিয়ে নিলাম। সোহান ভাই বাবুকে কোলে নিয়ে আদর করতে থাকে ততক্ষণে মাহমুদাও আমাদের হাতে হাতে সাহায্য করে দেয়৷ সোহান ভাই মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে,

‘ওহ মায়া আপু! তিন্নিকে ৬ দিন পর আসতে বলেছে। সেলাই কে’টে দিবে।’

তিন্নি চোখ মুখ কুঁচকে বলে, ‘এটার কি দরকার!’

‘দরকার আছে। বাচ্চাদের মতো জিদ করবে না। আর ৩ মাস একদম রেস্ট।’

‘আমি তো এমনেও রেস্টেই থাকি।’

তিন্নির মুখ ফুলানো দেখে সোহান ভাই হাসে। সব গুছিয়ে নিয়ে ধীরে ধীরে সবাই নিচে নামলাম। বাচ্চাটা আমার কোলে ঘাপটি মে’রে আছে। তিন্নিকে সোহান ভাই ধরে নিয়েছে। মাহিদ গেছে সিএনজি আনতে। সিএনজি আসলে সবাই উঠলাম। তিন্নিকে সাবধানে বসিয়ে আমি আর মাহমুদা দুপাশে বসলাম। বাচ্চাটাকে একদম ভালো মতো ঢেকে নিয়েছি। তিন্নি আমার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘আজকাল তোমাদের মতো মানুষ খুব কম হয় গো। রক্তের কেউ না হয়েও আমাদের জন্য কত কি করলে! তোমরা না থাকলে বোধহয় আজ আমি আর আমার বাবুটা এভাবে বাড়ি ফিরতে পারতাম না।’

আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললাম, ‘তুমি তো এসবই বলবে! আমাকে তো আর বোন ভাবো না। ভাবলে যত যায় হোক এমন বলতে না হুহ।’

তিন্নি নিঃশব্দে হাসে। আমি জানি এখনকার যুগে কেউ কারো পাশে দাঁড়ায় না। বিপদের দিনে সাহায্য না করে দুরে সরে যায় কিন্তু আমরা যখন খালি হাতে এই শহরের কিছু না চিনে এসেছিলাম তখন এই মেয়েটা আর তার স্বামী আমাদের সাহায্য করেছিলো। তিন্নি যদি হেনা আপার সাথে যোগাযোগ না করে আমার কাজের ব্যবস্থা না করতো তাহলে হয়তো অনাহারে ম’রতে হতো। জানি রিজিকের মালিক আল্লাহ। সোহান ভাই নিজের ভাইয়ের মতো করে ভেবে মাহিদকে একটা কাজ পাইয়ে দিয়েছে। আমাদেরকে অল্পতেই আপন করে নিয়েছে। তবে এতোকিছুর জন্য কি আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ নই? উপকারের বদলেই না হয় করলাম উপকার। তারা আমাদের বিপদে পাশে ছিলো সেই হিসেবেই না হয় তাদের পাশে থাকলাম! আর সব থেকে বড় কথা মনুষ্যত্ব বলেও তো একটা কথা আছে! প্রশান্তির শ্বাাস নিয়ে বাচ্চাটাকে বুকের সাথে আঁকড়ে রাখলাম যাতে ওর ঠান্ডা না লাগে।

_______
সকাল সকাল উঠে রান্না করে, গরম পানি করে তিন্নিকে দিয়ে আসছি। মাহমুদাকে বলছি যেনো সবসময় ওর সাথে থাকে। জলদি করে হেঁটে ফুটপাতে পা দিতেই আরাফকে চোখে পড়লো। ছেলেটার সাথে একয়দিন ঝামেলার জন্য তেমন একটাা কথা হয়নি। আমাকে দেখেই এগিয়ে আসে। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

‘আপনাকে দেখার তৃষ্ণা আমার দিন দিন বেড়েই চলেছে। কবে বিয়ে করবেন?’

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আশে পাশে তাকালাম। আরাফ পকেট থেকে রুমাল বের করে বলে, ‘মুখটা একটু মুছিয়ে দেই?’

আমি দুপা সরে দাঁড়ালাম। সন্দিহান কন্ঠে শুধালাম, ‘কি হয়েছে বলুন তো! আজ আপনি এমন করতেছেন কেন? মাথা কি খারাপ হয়ে গেছে?’

আরাফ সাথে সাথেই উপর নীচ মাথা নাড়ায়। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলে, ‘আসলেই আপনাকে ভালোবেসে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। এবার জলদি করে আমার বউ হয়ে মাথার চিকিৎসা করে দেন প্লিজ!’

ভেংচি কেটে বললাম, ‘আমি ডাক্তার না সাহেব। আপনি ডাক্তারের কাছে যান।’

আরাফ বুকে হাত দিয়ে আমার দিকে ঝুঁকে আসে। মাথাটা কাছে এনে ফিসফিস করে বলে, ‘আমার অসুখ, ওষুধ সবই তো আপনি৷ শুধু একবার পেয়ে গেলে আমি আজীবন বুকের মধ্যে শক্ত করে বেধে রেখে দিবো।’

উনার এই ফিসফিস আওয়াজের বাক্যগুলো আমার ভেতরটা অস্থির করে তুললো। চোখ পিটপিট করে এদিক ওদিক তাকালাম। হৃদপিণ্ডের গতি বেড়ে গিয়ে মনে হলো এই বুঝি সে বের হয়ে আসবে। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে রাখলাম কয়েক সেকেন্ড। যারা কখনো সুখ পায় না তাদের কাছে এই ছোট ছোট বাক্যগুলোই সুখ। এই যে প্রেমিক পুরুষের মুখের এই কয়েকটা বাক্যই মনে প্রশান্তির ঝড় তোলার কারণ৷ আমি চোখ মেলে চেয়ে দেখি সে মানুষ ঠোঁট চেপে হাসছে। আমি দ্রুত পা চালিয়ে হাঁটা লাগাতেই পেছন থেকে ডাকে। আমি শুধু দাঁড়ালাম পেছন ফিরে তাকালাম না। সে এগিয়ে এসে সামনে দাঁড়িয়ে হাতে একটা গোলাপ ফুল আর চুলে বেলি ফুলের মালা গুজে দেয়। আমি আড়চোখে তার দিকে তাকাতেই সে হাত দিয়ে বোঝালো ‘সুন্দর’। আমি আর দাঁড়ালাম না। ছুটে চলে আসলাম গার্মেন্টসের কাছে। একবার পিছনে তাকিয়ে দেখি আরাফ তখনো তাকিয়ে আছে। আমি ভেতরে ঢুকে গেলাম। হাতের গোলাপটা ব্যাগে রেখে কাজের জায়গায় বসলাম। সোমা কাছে এসে হেঁসে বলে,

‘তোমার বোন কেমন আছে আপু?’

‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো?’

‘আলহামদুলিল্লাহ।’

সোমা জিজ্ঞেস করে বাবু কেমন হয়েছে! কার মতো হয়েছে! কথা বলার এক পর্যায়ে সোমার খেয়াল হয় আমার চুলের খোঁপায় ফুলের মালার। অবাক চোখে তাকিয়ে বলে,

‘আপু তুমি তো কখনো এগুলো পড়ে আসো না। আজ হঠাৎ!’

কি উত্তর দেবো বুঝলাম না। ঢোক গিলে বললাম, ‘এমনিতেই। ভালো লাগলো তো তাই!’

সোমা হেঁসে বলে, ‘ভালোই করেছো। খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।’

হেনা আপা আর মিতাও এগিয়ে আসে। হেনা আপা দাঁত বের করে বলে, ‘আসলেই তোকে অনেক সুন্দর লাগছে মায়া।’

আমি কিছু বললাম না৷ হেনা আপা কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললো, ‘আপনার আরাফ সাহেব দিয়েছে বুঝি!’

আপার কথায় অবাক হলাম। সাথে লজ্জায় নুইয়ে পড়লাম। মুখ অন্য দিক করে মাথা নাড়ালাম। সাথে সাথেই মিতা আর হেনা আপা হাসতে শুরু করলো। বান্ধবীরা যেমন কিছু হলেই একটু পর পর খোঁচা মা’রে! মজা করে! ঠিক তেমন ভাবেই হেনা আপা আর মিতাও তাই করলো। ষোড়শীর মতো ৩ জনে মেতে উঠলাম। ৩ জন যেনো একই বয়সের, একই স্কুলের, একসাথের বান্ধবী। সবাই এমন করে মিশতে পারে না। আর যারা অপরিচিত হয়েও এমন মিশুক বান্ধবী পায় তারা ভীষণ ভাগ্যবান। এই মানুষগুলো সবসময় এমনই হয়ে থাক।

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)

#শেষ_প্রান্তের_মায়া (১৯)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

বিকেলে কাজ শেষ করে বের হয়ে দেখি আরাফ হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে। উনাকে দেখতেই আমার সকালের কথা মনে পড়ে যায়। মুখে লাল আভা ছড়ায়৷ হেনা আপা আমাকে কাধ দিয়ে ধাক্কা মা’রে। আমি তাকাতেই চোখ মে’রে ঠোঁট চেপে হাসে। আমি হেনা আপার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে সামনে এগোলাম৷ আপা নিজের মতো চলে যায়। আরাফ আমাকে দেখে নিজেই কাছে আসে৷ আমি উনার দিকে তাকালাম না। উনি পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করে। দুজনেই চুপ। উনি কয়েকবার কেশে আমার মনোযোগ নিজের দিকে ঘুরানোর চেষ্টা করেছে। যেনো কিছু বলতে চায়! আমি কোনো শব্দ না করে অন্যদিকে চেয়ে শুধু হেসেছি। সিহাব আজ স্কুল যায় নি তাই আমার ওকে নিতে যাওয়ার তেমন তাড়া নেই। রাস্তা পার হতেই আরাফ বলে,

‘আজ সিহাব স্কুল যায়নি?’

আমি দুদিকে মাথা নাড়ালাম। আরাফ গলা পরিষ্কার করে বলে, ‘আপনি কি আমাকে নিয়ে দ্বিধায় আছেন?’

আমি তাকালাম তার দিকে। ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। উনি হাতের তালু অন্য হাতে ঘষছে। আমি হাতের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম,

‘যা বলার তা সরাসরি বলুন। এভাবে হাত কচলালে কি সমাধান পেয়ে যাবেন নাকি!’

‘আসলে আপনি কোনো উত্তরই দিচ্ছেন না। আমি চাই আপনাকে বিয়ে করতে কিন্তু আপনি বরাবরই চুপ থাকেন। কোনো উত্তর দেন না। এটা নিয়ে আসলে আমি কনফিউজড। আপনি কি কোনোভাবে আমাকে মেনে নিতে পারতেছেন না?’

আমি হাঁটতে শুরু করলাম। এই প্রশ্নের উত্তর আমার নিজেরও অজানা। আমি জানি মানুষটার প্রতি আমার একটা দুর্বলতা আছে কিন্তু তারপরও আমি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি। আসলেই কি কোনো ডিভোর্সীকে কেউ এতো ভালোবাসতে পারে? যেখানে সোমা নামের মেয়েটা অবিবাহিত হওয়া স্বত্বেও এতো বড় বি’শ্বাস’ঘা’তকতার সামনে পড়েছে সেখানে আমি ডিভোর্সী। বার বার মনে হয় যদি আরাফও আমাকে ঠকায়! যদি তন্ময়ের মতো সেও হয়! যদি গত ৪ বছরের মতো আবারও কষ্ট পেতে হয় আমার! আমি তো কেবল কয়েকটা মাস হলো চিনি তাকে। মন মানলেও মস্তিষ্ক মানছে না। শুকনো ঢোক গিললাম। আরাফ নিভে যাওয়া কন্ঠে বলে,

‘সমস্যা নেই মায়া। আপনি ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। আপনি যেই সিদ্ধান্ত নিবেন আমি তা সম্মান করবো। আমি বুঝতে পারি আপনার দিকটা।’

আমি স্পষ্ট দেখলাম আরাফের মুখে কষ্টের ছাপ। সে হয়তো ভাবছে আমি এখনো তাকে ভালোবাসতে পারিনি। আমি ফোন বের করে মাহিদকে কল দিলাম। মাহিদ ফোন রিসিভ করতেই ওকে বললাম,

‘মাহিদ আমার একটু ফিরতে দেড়ি হবে। তোরা কেউ চিন্তা করিস না।’

মাহিদ প্রশ্ন করতে গিয়েও করলো না। ‘সাবধানে আর তাড়াতাড়ি ফিরো’ বলে কল কেটে দিলো। আমার ভাইটা ভীষণ রকম বুঝদার। যত যায় হয়ে যাক ছেলেটা কখনোই আমাকে বা আমার পার্সোনাল জীবন নিয়ে প্রশ্ন করে না। হাসপাতালে ‘ও’ বুঝেছিলো আরাফ আমার পরিচিত কিন্তু তাও জিজ্ঞেস করেনি সে আমার কে হয়! এটার মানে এই না যে সে তার দায়িত্ব বোঝে না বরং সে আমাকে নিজেকে আরেকটাা সুযোগ দেওয়াতে চায়। দীর্ঘশ্বাস ফেললাাম। আরাফের দিকে তাকাতেই দেখলাম সে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি ফোনটা ব্যাগে রাখতে রাখতে বললাম,

‘সামনের দিকে একটা পার্ক আছে। ওখানে যাই?’

আরাফ ভদ্র ছেলের মতো মাথা দুলায়। দুজনে পুরো রাস্তা চুপ করেই পার্কের কাছে আসলাম। বিকাল বেলা হওয়ায় মানুষজন কম হলেও ছোট ছোট বাচ্চারা খেলা করছে। আমি আর আরাফ একটা বেঞ্চে বসলাম। সে এক মাথায় আমি আরেক মাথায়। ব্যাগটা মাঝখানে রাখলাম। আরাফ জড়তা কাটিয়ে বললো,

‘কিছু আনবো? বাদাম খাবেন?’

আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। কন্ঠ কাঁপছে তার। মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বললাম, ‘নাহ খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনার কি প্রশ্ন ছিলো যেনো? আমি আপনাকে নিয়ে দ্বিধায় আছি কি না! আপনাকে কোনোভাবে মেনে নিতে পারছি কি না!’

আরাফ উপর নীচ মাথা নাড়ায়। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে আরাফের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ আমি আপনাকে নিয়ে দ্বিধায় আছি। আপনাকে সহজে মেনে নিতে পারছি না। এটা সত্য।’

আরাফ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকায়। আমি এড়িয়ে গেলাম তা। দৃষ্টি অন্যদিকে নিয়ে ধীর স্বরে বললাম,

‘আমার যখন বিয়ে হয় তখন আমার বয়স ছিলো ১৬ বছর। কিশোরী আমি। দরিদ্র পরিবারের মেয়ে হওয়ায় এসব প্রেম ভালোবাসাতে আমি ছিলাম না। হঠাৎ করেই বাবা বিয়ে ঠিক করলেন এক বড়লোক বাড়ির ছেলের সাথে। তাদের কথা ছিলো ‘আমরা কিছু নিবো না। আমাদের শুধু সুন্দরী বউমা চাই।’ আমরা ৪ ভাই বোন ছিলাম। আমাদের সবাইকে একসাথে টানতে বাবা-মায়ের কষ্ট হওয়ায় বোঝা নামাতে তারা বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। বিয়ের আগে আব্বার পা ধরে কেঁদে বলেছিলাম বিয়ে না দিতে। আমি পড়ালেখা করতে চাই। কিন্তু আব্বা মানলেন না। বিয়ে দিয়ে দিলেন।’

আরাফ আগ্রহী দৃষ্টিতে তাকায়। আমি নিজেকে সামলে ফের বলতে শুরু করলাম,
‘জানেন অতোটুকু আমির ওপর প্রথম রাতেই স্বামী তার চাহিদা পূরণ করে নিলো। ভয়ে কান্না করে, তার পা ধরেও তাকে থামাতে পারিনি। আমি তো নতুন ছিলাম একটু কষ্ট করে কয়েকটা দিন আমার সাথে থাকতো! নাহ সে প্রথম রাতেই স্বামীর অধিকার ফলালো। কিছু বলতে পারলাম না। নীরবে কান্না ছাড়া কিছুই করার ছিলো না। কাউকে বলতেও পারলাম না। বিয়ের সব নিয়ম শেষ করার পর থেকেই শুরু হলো অ’ত্যা’চা’র। তারা কিছু চায়নি বলে কি আমার আব্বা দিতে পারেনি! খালি হাতে মেয়েকে পাঠিয়ে দিবে নাকি! এটা ছিলো তাদের অভিযোগ। দিনের পর দিন মা’র খেয়ে, অ’ত্যা’চা’র সহ্য করে পড়ে থাকলাম। অদ্ভুদ ভাবে আমার বাবা-মা কে বলেছিলাম তারা আমাকে যৌ’তুকের জন্য খোঁ’টা দেয়, অ’ত্যা’চা’র করে। কিন্তু আমার বাবা-মা আমার জন্য কিছু করলো না৷ রাতের পর রাত মা’র খেয়ে কাতরাতাম অথচ কেউ দেখতেও আসতো না। বড় জা মাঝে মাঝে আসতো কিন্তু শ্বাশুড়ির কড়া নজর থেকে তিনি বাঁচলেন না। তাকে ব্যস্ত রাখতো সবসময়। অসহ্য য’ন্ত্রণা নিয়ে কাটালাম ৪টা বছর। জানেন যেদিন আমার ভাই ওই ন’র’ক থেকে আমাকে নিয়ে আসলো সেদিনও আমার শরীরে ছিলো ক্ষ’ত আর ক্ষ’ত। পু’ড়ে যাওয়া হাত, শরীরে রক্ত জমে কালো দাগ এসব নিয়েই সেদিন বাড়ি ছেড়ে এসেছিলাম। নিজের আব্বা-মায়ের কাছেও ঠাই পাইনি। এতো কিছুর পরও এতো সহজে কি আমার আপনাকে মেনে নেওয়া সহজ? আমার কি দ্বিধায় পড়াটা ভুল আরাফ? যেখানে নিজের স্বামী আমাকে দিনের পর দিন কষ্ট দিয়েছে! ধোঁ’কা দিয়েছে! সেখানে কি আমার অন্য একটা ছেলেকে মেনে নেওয়া সহজ? যেখানে নিজের আপনজনরা আমাকে বছরের পর বছর শুধু ক্ষ’ত দিয়ে গেছে সেখানে কি আমার অপরিচিত একটা ছেলেকে মেনে নেওয়া সহজ?’

আরাফের কি হলো কে জানে! হুট করে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি হতভম্ব। চোখের কোণের পানিটুকু হুট করেই গড়িয়ে পড়লো। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হলো না। আরাফ ভাঙা গলায় বলে,

‘আপনার আমাকে সহজে মেনে নিতে হবে না মায়া। ভালোবাসতেও হবে না। আপনি যখন, যেভাবে আমাকে চাইবেন আমাকে পাবেন। আমি অপেক্ষা করবো আপনার দ্বিধা কেটে যাওয়ার। অপেক্ষা করবো আমাকে মেনে নেওয়ার। অপেক্ষা করবো আপনাকে আমার জীবনসঙ্গী করার। আপনাকে কখনো পেলে আমি আপনাকে একটুও কষ্ট দিবো না কথা দিলাম মায়া।’

ভীষণ করে বলতে ইচ্ছে করলো ‘আমিও তো আপানকে ভালোবাসি। কিন্তু বলার যে সাহস নেই আরাফ। ভয় পাই আমি। ভালোবাসা, সংসার এগুলোকে ভীষণ ভয় পাই।’ কথা গুলো এসে গলায় আটকে গেলো। মুখ দিয়ে টু শব্দও বের হলো না। হঠাৎ ঘাড়ে ভেজা অনুভব করলাম। আরাফ কি কাঁদছে! ছেলেরা বুঝি এতো সহজে কাঁদে! আমি কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

‘আপনি কি কাঁদছেন আরাফ?’

আরাফ জবাব দিলো না। আমি কাঁপা কাঁপা হাতে তার পিঠে হাত বুলালাম। এই ছোঁয়াতে একটুও খারাপ উদ্দেশ্য নেই। নেই কোনোকিছু পাওয়ার আকাঙ্খা। গত ৪ বছরের পর ভাই বোন বাদে এই প্রথম আমাকে কেউ এতোটা ভালোবেসে জড়িয়ে ধরলো। ইচ্ছে করলো ছেলেটার সামনে নিজেকে উজাড় করে কাঁদি। কিন্তু পারলাম না। কারো সামনেই আমি নিজেকে দুর্বল করবো না৷ আরাফ আমাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। অন্যদিকে ফিরে নিজের চোখ মুছে নেয়। আমি দেখেও কিছু বললাম না। আরাফ গলা পরিষ্কার করে বলে,

‘আপনার জীবনে একটা ভ’য়ং’কর অতীত ছিলো জানতাম তবে এতোটা! জানতাম না। মানুষ এতোটাও খারাপ হয়!’

আমি হাসলাম। বললাম, ‘মানুষ এর থেকেও খারাপ হয়। সয়ে গেছে আমার এসব। আপনি এতো কিছুর পরও আমাকে চান? আমার কাছে দেবার মতো কিছু নেই।’

আরাফ লাল টকটকে চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি নামিয়ে নিলাম চোখ। আরাফ আমার গালে হাত রেখে বলে, ‘ভালোবাসাও নেই?’

আমি জবাব দিলাম না। আরাফ উঠে চলে যায়। সাথে সাথেই চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। মানুষের জীবন কাকে কখন কোথায় নিয়ে যায় কেউই বলতে পারে না। আমি কখনো ভাবিনি যে কখনো আমাকে কেউ এতোটা ভালোবাসতে পারে! আমি সবসময় ভেবেছি জীবনে ভালোবাসা নামক বস্তুর দেখা বোধহয় পাবো না৷ তবে জীবনে এভাবে বসন্ত এসে যাবে কল্পনাও করিনি। আমার ভাবনার মাঝেই আরাফ আমার সামনে একটা হাওয়াই মিঠাই এগিয়ে দেয়। আমি চোখ তুলে একবার তার দিকে আরেকবার হাওয়াই মিঠাইয়ের দিকে তাকালাম। আরাফ চোখ দিয়ে ঈশারা করলো নিতে। আমি নিলাম। আরাফ আবার দৌড় দিলো। আমি উঠে উঁকি দিয়ে দেখি ওখানে আরো কয়েকটা বাচ্চা আছে। সবার হাতেই একটা করে হাওয়াই মিঠাই। নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। আমি এগিয়ে গেলাম। আরাফ আমাকে দেখে দ্রুত যাওয়ার জন্য হাত দিয়ে ঈশারা করে। আমি একপ্রকার ছুট লাগালাম বাচ্চাগুলোর দিকে। বাচ্চা গুলোর কাছে আসতেই তারা খেলতে শুরু করে। খাচ্ছে আর খেলছে। একেকজনের চোখ মুখ মেখে মেখে যাচ্ছে তাও খাওয়া বাদ দিবে না আর না বাদ দিবে খেলা! আমি হাসলাম। আরাফ পকেটে হাত গুজে বলে,

‘ওরা আমাদের মতোই একা। আমাদের চারপাশে তো কেউ না কেউ আছে কিন্তু ওদের কেউ নেই। আপনার মন ভালো করার জন্য এদিকটা আসতেই ওদের পেয়ে গেলাম। আপনি তো বাচ্চা খুব ভালোবাসেন তাই না!’

আমি জবাব না দিয়ে হাসলাম। আরাফ কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, ‘সমস্যা নেই এমন দিনের জন্য আমি আজীবন অপেক্ষা করবো মিস মায়া।’

বলেই নিজে ছুটে গেলো বাচ্চাদের মধ্যে। আমি তাকিয়ে রইলাম মানুষটার দিকে। এতোটাই কি নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবাসে নাকি এগুলো সবই দেখানো! কিন্তু মানুষের ঠোঁট মিথ্যে বললেও চোখ কখনো মিথ্যে বলে না। যতটুকু বুঝি তাতে আজ অব্দি আমাকে নিয়ে আরাফের চোখে ভালোবাসা ছাড়া খারাপ কোনো ইচ্ছে দেখিনি। ছেলেটা আমাকে দেখলেই সবসময় চোখের দিকে তাকিয়ে মুখ ভর্তি করে হাসে। আচ্ছা এমন হাসি দেখলে বুঝি কোনো মেয়ে ভালো না বেসে থাকতে পারে! নিজ মনেই ঠোঁট কামড়ে হাসলাম। নিজের কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে হাসি মুখেই পিছনে তাকালাম। সাথে সাথে হাত থেকে হাওয়াই মিঠাই পড়ে গেলো। মুখের হাসিটুকু মিলিয়ে গেলো মুহুর্তেই। অস্পষ্ট স্বরে মুখ থেকে বেরিয়ে আসলো,

‘তন্ময়!’

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম৷ ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)