শেষ প্রান্তের মায়া পর্ব-২৬+২৭

0
183

#শেষ_প্রান্তের_মায়া (২৬)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
_______________

জ্বর নিয়েও আজ গার্মেন্টসে যেতে হবে। কিছু করার নাই। এখন কাজের চাপ বেশি তাই ছুটি পাবো না। কিন্তু আমার যাওয়া নিয়ে মাহিদ আর মাহমুদা ঘ্যানঘ্যান করছে। তিন্নি আর সোহান ভাইও নিষেধ করতেছে। এদের এতগুলোর সাথে না পেরে উঠে চুপচাপ বসে থাকলাম। এখন তো জ্বরটা তেমন নেই তাহলে এরা নিষেধ করছে কেনো! আজব একেকজন। আমি চুপচাপ ওদের কথা শুনে বসে থাকলাম। একসময় ওরা বলতে বলতে যখন ক্লান্ত তখন আমি সবাইকে টাটা বাই বাই করে গার্মেন্টসের উদ্দেশ্যে ছুটলাম। পেছন থেকে সবগুলো ফুঁসছে। আজ বাড়ি আসলে আমার খবর আছে। কিন্তু ঘরে থাকতে আমার ভালো লাগে না। যতক্ষণ কাজের মধ্যে থাকবো ততক্ষণ নিজের ভবিতব্য ভুলে থাকবো কিন্তু ঘরে থাকলেই আমার কষ্ট হবে। আমার আদরের ভাই বোনগুলোকে ছেড়ে যাওয়ার ভয় থাকবে। ভালোবাসার মানুষকে হারানোর ভয়ে ভেতরটা তিতকুটে হয়ে আসে। নিজেকে কতটা কষ্টে দমিয়ে রেখেছি তা কেবল আমিই জানি। গলি পেড়িয়ে মোড়ের কাছে আসতেই চোখ থেকে টুপ করে কয়েক ফোঁটা জল গড়ালো। খুব করে কাঁদতে পারলে ভেতরটা হালকা হয়ে যেতো। ভাই বোন, ভালোবাসার মানুষগুলোর থেকে এতো বড় সত্যি লুকিয়ে ভেতরটা আরো ভাড়ি হয়ে আছে। যতটা সম্ভব নিজেকে সামলে একটা সিএনজি নিলাম। রিপোর্টটা তখনো আমার ব্যাগে। ব্যাগের ওপরের দিকে চেয়েই নিজেকে শক্ত করলাম। ভাগ্যে যা আছে তা হবেই কিন্তু আমার জন্য আরাফ কষ্ট পাবে এটা তো হতে পারে না। অনেক ভেবে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মাথার মধ্যে এতো সব চিন্তার পোকাদের সড়াতে সড়াতেই গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। প্রতিদিনের মতো আজও আরাফ দাঁড়িয়ে আছে। তবে তার চোখ মুখে সেই উজ্জ্বলতা নেই। নেই ঠোঁটের কোণের মুচকি হাসি। দৃষ্টি বিভ্রান্তের ন্যায় ছোটাছুটি করছে। চোখ দুটো অসম্ভব লাল। তার এই রুপের কারণ আঁচ করতে পারলাম না। কোনো রকমে নিজেকে সামলে আরাফের সামনে আসলাম। কিন্তু দাঁড়ালাম না। প্রতিদিনের মতো আরাফের সাথে কথা বললাম না। আরাফ যেনো অবাক হলো। অবাক চোখে চেয়ে রইলো। দাঁতে দাঁত চেপে তাকে ইগনোর করে ঢুকে গেলাম গার্মেন্টসের ভেতরে। পেছনে ফিরে দেখলামও না আরাফের দৃষ্টি। আমি জানি সে কষ্ট পাবে কিন্তু আমাকে ভালোবেসে সে আরো বেশি কষ্ট পাবে। তার থেকে না হয় কিছুটা অবহেলার জন্য, ভুল বুঝাবুঝিতে আমাকে ঘৃণা করে যাক। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আড়াল থেকে একবার উঁকি দিলাম। আরাফ অবাক চোখে তাকিয়ে আছে গেইটের দিকে। চুলগুলো দু’হাতে চেপে ধরে এলোমেলো পায়ে কোনোরকমে সরে গেলো। বুকের ভেতরটা চিনচিনে ব্যাথা অনুভব করলাম। নিঃশ্বাসটাও ভাড়ি হয়ে আসলো। আমিও সরে এলাম। আমাকে তাড়াতাড়ি ঢুকতে দেখে মিতা আর হেনা আপা এগিয়ে আসলেন। হেনা আপা চিন্তিত স্বরে বলে,

‘কিরে কাল কতবার কল দিলাম, রিসিভ করলি না কেনো?’

আমি উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বসলাম। হেনা আপা আর মিতা কপালে ভাজ ফেললেন। আমার কাছে এসে বললেন, ‘কি হলো? কথা বলছিস না কেনো?’

‘কিছু হয়নি আপা। শরীরটা একটু খারাপ তো তাই চুপ করে আছি।’

‘তোমার রিপোর্ট এসেছে কাল? কি বললেন ডক্টর?’

আমি মিতার দিকে তাকালাম। মেয়েটা উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে। আমি কাউকেই সত্যিটা বলতে পারবো না কিন্তু বলবোই বা কি! মিতা আরো একবার একই প্রশ্ন করে। আমি কোনো রকমে হাসার চেষ্টা করে বললাম,

‘হ্যাঁ কালই এসেছে রিপোর্ট। আর সব ঠিকঠাক।’

‘তাহলে তোর ওমন হলো কেন?’

‘শরীরটা একটু দুর্বল তো তাই। বাদ দাও ওসব।’

মিতা আর হেনা আপা কথাটা বিশ্বাস করলো কি না বুঝতে পারলাম না। তবে তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে ভড়কে গেলাম। এর মধ্যেই ছুটে আসে সোমা। আমাকে কাছে টেনে ব্যস্ত গলায় বলে,

‘তুমি নাকি কাল অসুস্থ হয়ে গেছিলে আপা! কি হয়েছে তোমার? ঠিক আছো তো তুমি? শরীর খারাপ নিয়ে আজ আসলে কেনো?’

আমার এতো কষ্টর পর এতোগুলো মানুষের ভালোবাসাটা পাওয়ায় সুখ। আমি যে এতটুকু পাবো তাও কখনো কল্পনা করিনি। কখনো ভাবিনি এই মানুষগুলো আমার জীবনে আসবে। আমাকে ভালোবেসে আপন করে নিবে। কিন্তু এরা সত্যিই আমার জীবনে এসেছে এবং বোনের মতো ভালোও বেসেছে। আচ্ছা আমার জীবনের এতো বড় সত্যিটা জানলে ওরা আমাকে দুরে সরাবে নাকি ভেঙে পড়বে! ভালোবেসে পাশে থাকবে নাকি ছেড়ে যাবে! আমার কোনো উত্তর না পেয়ে সোমা আমাার বাহুতে ধাক্কা দেয়। আমি চমকে উঠলে সোমা বলে,

‘মন কোথায় তোমার? তোমাকে কিছু তো জিজ্ঞেস করেছি!’

‘হ্যাঁ! হ্যাঁ ঠিক আছি। শরীর ঠিক আছে এখন। তুই খবর পেলি কোথায়?’

‘হেনা আপা বলেছে।’

আমি হেনা আপার দিকে তাকালাম। হেনা আপা দাঁত দেখিয়ে হাসে। তার এই হাসি দেখলে আমার পেট ফাটিয়ে হাসতে ইচ্ছে করে। আজও তার ব্যাতিক্রম হলো না। হেঁসে ফেললাম। মিতা আমার চুলে হাাত দিয়ে বলে,

‘কি গো তোমাার আরাফ সাহেব আজ আসেনি? বেলিফুলের মালা কই?’

আরাফের কথা শুনে মনটা বিষন্নতায় ঘিড়ে গেলো। নিজেকে কোনোরকম সামলে বললাম, ‘এসেছিলো। আসলে অভিমান করে আছে তো তাই বেলিফুলের মালা দেয়নি। ঠিকমতো কথাও বলেনি।’

এটা নিয়ে সবাই হাসাহাসি শুরু করে। সবার কথার সাথে তাল মেলালেও মন পড়ে আছে আরাফে। আমার ব্যবহারে নিশ্চয় অনেক কষ্ট পেয়েছে! কিন্তু আমার কাছেও যে আর কোনো উপায় নেই। এই মানুষটাকে স্বপ্ন দেখিয়ে তা ভাঙারও কোনো অধিকার নেই আমার। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। চোখ বন্ধ করে কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে সামলে নিলাম।
_____

আজ কতগুলি দিন থেকে আরাফকে ইগনোর করতেছি। শরীরটাও বেশ একটা ভালো না। ডক্টর ম্যাম বলেছিলেন হসপিটালে গিয়ে রক্ত নিয়ে আসতে। কিন্তু আমি যাইনি। এই কয়দিন আরাফকে দেখলেই মুখ ফিরিয়ে চলে এসেছি। তার চোখ মুখের দিকে তাকানো যায় না৷ কি একটা অবস্থা করছে নিজের! চোখ দুটো যতবারই দেখি ততবারই লাল টকটকে হয়ে থাকে। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে। ছেলেটা কি রাতে ঘুমায় না! কথাগুলো ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। একটু আগেই গার্মেন্টস ছুটি হয়েছে। সিহাবকে স্কুল থেকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে। আশে পাশে তাকিয়ে দেখলাম আরাফ কোথাও নেই। সকালে যখন দেখা হয়েছিলো তখন তাকে তার দেওয়া রিং টা ফিরিয়ে দিয়েছি। সে শুধু হতবাকের ন্যায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিলো৷ আমি রিং টা ফিরিয়ে দিয়েই কিছু না বলে চলে এসেছি। তার চোখ তখন আগুনের ফুলকির মতো ফুটছে। আমি দুর থেকে একবার দেখে দ্রুত চলে গেছিলাম। হয়তো সকালের বিষয়টা সে হজম করতে পারেনি তাই আজ আর আসেনি। আমি রাস্তা পার হয়ে সিহাবের স্কুলের দিকে হাঁটা দিলাম। কোথা থেকে যেনো হাওয়ার বেগে ছুটে আসলো আরাফ। সরাসরি আমার সামনে দাঁড়ালো রক্তবর্ণ চোখ নিয়ে। আমি প্রথমে ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নিলাম। আরাফকে কিছু না বলে পাশ কাটিয়ে চলে আসতে নিলে পেছন থেকে টেনে ধরে হাত। আমি কন্ঠ শক্ত করে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,

‘রাস্তাঘাটে এটা কি ধরনের অ’সভ্যতামো? হাত ধরেছেন কেনো? ছাড়ুন!’

আরাফ ছাড়লো না। উল্টো আরো শক্ত করে ধরলো হাত। ব্যাথায় আর্তনাদ করতেই টেনে নিজের একদম কাছাকাছি নিয়ে আসে। আমি ভীতু দৃষ্টিতে তাকালাম। এতোটাই কাছে সে আমার যে তার নিঃশ্বাসের শব্দটাও আমি শুনতে পাচ্ছি। কোনোরকমে ভাঙা ভাঙা ভাবে বললাম,

‘ছাড়ুন!’

আরাফ হাত পেছনে মুচড়ে ধরে। অন্যহাতে আমার ব্যাগটা টেনে নিয়ে কোনরকমে ব্যাগ থেকে রিপোর্ট বের করে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,

‘এটার জন্য আমাকে ইগনোর করছেন! এটার জন্য! এই সামান্য রিপোর্টের জন্য আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন! আমাকে পু’ড়াচ্ছেন!’

আমি যেনো আকাশ থেকে পড়লাম। চমকালাম ভীষণ। আরাফের দিকে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আরেকবার তাকালাম রিপোর্টের দিকে। আরাফ আমার হাত ছেড়ে দিলেন। ছাড়া পেয়ে হাতটাা আগলে নিলাম। চট করে আরাফের থেকে রিপোর্ট ছিনিয়ে নিলাম। আরাফ তাচ্ছিল্যের সুরে হেঁসে বলে,

‘এটা কেড়ে নিয়ে কি হবে? এটার সম্পর্কে জানি আমি। দেখেছিলাম সেদিন আপনার রিপোর্ট।’

আমি অবাক হলাম। আরাফের চোখে মুখে বিষন্নতা জুড়ে গেছে। কন্ঠও মলিন হয়ে গেছে। ছেলেটা জানে রিপোর্ট সম্পর্কে! আমি কি বলবো খুঁজে পেলাম না। কতক্ষণ কেটে গেলো দুজনের নীরবতাতেই। আরাফ হুট করেই আমার হাত থেকে রিপোর্ট টা নিয়ে বললো,

‘এই সামান্য রিপোর্ট আর আপনার অবহেলা আপনাকে আমার থেকে দুর করতে পারবে না মায়া। আমি ভালোবাসি আপনাকে। আর শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এভাবেই বাসবো।’

রিপোর্ট ছেড়ে আমার হাত টেনে খুলে দেওয়া সেই রিং টা আবার পড়িয়ে দিলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো, ‘অপেক্ষা করছিলাম এই রিপোর্ট সম্পর্কে আপনার নিজ মুখ থেকে শোনার জন্য আর আপনি আমাকে একদম লাইফ থেকে আউটই করে দিচ্ছিলেন! কত বড় সাহস আপনার! শুনুন এই যে আঙুলে রিং উঠলো এটা ২য় বারের মতো খুললে একদম হাত ভেঙে রেখে দিবো।’

আমি হা করে তাকালাম। আরাফ আমার হাত শক্ত করে ধরে সিহাবের স্কুলের দিকে হাঁটা লাগালো। আমি কি বলবো তাই ভুলে বসলাম। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম সামনের পুরুষটির দিকে। আমাকে কি সত্যিই এতোটাই ভালোবাসে? আমি কি আসলেই যোগ্য এতোটা ভালোবাসা পাওয়ার?

সিহাবকে নিয়ে রাস্তা পর্যন্ত এসে যখন আমাদের সাথে আরাফও সিএনজিতে উঠলো তখন অবাক হয়ে তাকিয়ে বললাম, ‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’

এতক্ষণ দুজনের কেউই একে অপরের সাথে কথা বলিনি৷ দুজনেই বুঝেছি দুজনের ভেতরের অবস্থাটা। আমি অসুস্থ এটাা তার কাছে সবথেকে বড় ধাক্কা ছিলো৷ আমি তো ভেবেছিলাম সে জানে না তাই তার থেকে দুরে থেকেছি। কিন্তু তিনি একাই তার কঠিন সময় পার করলেন। নিজেকে ছোট মনে হলো ভীষণ।
আমার ভাবনার মাঝেই আরাফ বলে, ‘শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছি।’

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকালাম। শ্বশুরবাড়ি মানে! পাশে তাকিয়ে দেখি সিহাব মুখে হাত দিয়ে হাসছে। ওকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে। আমি আর কিছু বললাম না। গাড়ি এসে আমাদের বস্তির সামনের মোড়ে দাঁড়াতেই আরাফও নেমে আসে। আরাফ কি করতে চাইছে বুঝে উঠলাম না। শুধু আরাফের মুখের দিকে তাকালাম। বাড়িতে এসে দেখলাম আগে থেকেই মাহিদ, মাহমুদা, মাইশা, তিন্নি, সোহান ভাই সবাই একসাথে বসে আছে। আমি ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই আরাফ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘যাক সবাই এসেছো তাহলে! ধন্যবাদ।’

বুঝলাম আরাফ ডেকেছে। মাহিদ পাশ থেকে চিন্তিত কন্ঠে বলে, ‘হঠাৎ এতো জরুরি তলব কেনো আরাফ ভাই? কিছু হয়েছে? আমি তো ভেবেছিলাম আবার বুঝি বুবুর কিছু হয়েছে!’

আরাফ মুচকি হেঁসে বলে, ‘নাহ নাহ তেমন কিছু না। আসলে আমি চাচ্ছিলাম আমাদের বিয়েটা আজই হোক। আমার গার্ডিয়ান হিসেবে থাকবেন আমার অনাথ আশ্রমের এক আঙ্কেল। তোমাদের কোনো সমস্যা আছে কি?’

আরাফের কথায় যেনো আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। এই ছেলে এই অবস্থায় বিয়ে করতে চাচ্ছে! পাগল হয়ে গেছে নাকি! বাকি সবাই খুশি হলো৷ মাহিদ হঠাৎ বিয়ের কারণ জানতে চাইলে আরাফ ফাজলামি করে বলে,

‘তোমার বোনকে ছাড়া একা থাকতে আর ভালো লাগে না শালাবাবু।’

একথায় সবাই হাসাহাসি করে। আমার মাথা ঘুরাতে লাগলো৷ মুখ থেকে অস্পষ্ট স্বরে বেড়িয়ে আসলো, ‘অসম্ভব।’

বসে পড়লাম ফ্লোরে। সবাই দৌড়ে আসে৷ আরাফ কপালে, গালে হাত দিয়ে বলে, ‘ঠিক আছেন? কোনো সমস্যা? আপনি কি আমাকে বিয়ে করতে চান না?’

একবার ‘না’ বলতে গিয়েও বললাম না। বিয়ে করবো না বললেই সবাই তার কারণ জানতে চাইবে। আমার পক্ষে সত্যি বলা সম্ভব না। আর অন্য কোনো কারণ বললে তা কেউ মানবেও নাা কারণ সবাই জানে আমিও আরাফকে ততটাই ভালোবাসি যতটা আরাফ আমাকে বাসে। আমি আর কিছু বললাম না। এরপর সবটাই হলো ভীষণ দ্রুত। যেনো কোনো কল্পনার রাজ্যে বসে আছি। আরাফের বাড়িতে এসে দেখি সে আগে থেকেই সব রেডি করে রেখেছে। চোখের পলকেই সবার সামনে আমাদের আইনত এবং ধর্ম মতো তিন কবুলে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো।

চলবে..

#শেষ_প্রান্তের_মায়া (২৭)
#বোরহানা_আক্তার_রেশমী
________________

বিয়েটা যেনো আমার মাথার ওপর দিয়ে গেলো। হুট করে কি হয়ে গেলো ভাবতেই যেনো গায়ে কাটা দিয়ে ওঠে। শুকনো ঢোক গিলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রইলাম। সামনেই আরাফ আর বাকি সবাই মেতে উঠেছে বিয়ের আমেজে। মাহিদ আমার পাশে এসে বসে। আমি ওর দিকে তাকাতেই মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

‘অবশেষে আমার বুবু সুখের দেখা পাবে। আমার বুবুও সকল কষ্টের শেষে একফোঁটা সুখের বৃষ্টি পাবে।’

আমি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। মাহিদকে কিভাবে বলবো তার বুবু কখনোই সুখের দেখা পাবে না। মৃত্যু হয়তো খুব কাছে তার। চোখের কোণা ভিজে আসে। মাহিদ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘বুবু তোমাকে ছাড়া থাকতে আমাদের অনেক কষ্ট হবে।’

আমি দ্রুত গতিতে ওকে ছেড়ে বললাম, ‘মানে? আমি কোথায় যাবো?’

‘ওমা তুমি তো এখন থেকে আরাফ ভাইয়ের এখানেই থাকবে।’

মাহিদের ঠোঁটের কোণের হাসি আর কথা শুনে প্রশান্তির শ্বাস নিলাম। ভেবেছিলাম আমার ভাইটাও বুঝি সত্যিটা জেনে গেছে। বড় বড় করে শ্বাস নিলাম। পরক্ষণেই মাথায় এলো মাহিদের পুরো কথা। আমি আরাফের সাথে থাকবো মানে! পাগল নাকি! চট করে মাহিদের হাত ধরে বললাম,

‘আমি থাকবো না এখানে।’

মাহিদ থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘কেনো? কি হয়েছে? থাকবা কেনো? বিয়ে হয়ে গেলো তোমার তাহলে ভাইয়ার সাথে কেনো থাকবে না?’

‘বিয়ের খেতায় আগুন দে। আমি তোদের সাথে থাকবো। এখানে থেকে কি করবো আমি! বিয়ে হয়েছে হোক। কিন্তু তোরা ওখানে একা থাাকবি আর আমি এখানে থাকবো তা কখনো হয়?’

পাশ দিয়ে তিন্নি এসে মাথায় গাট্টা মে’রে বলে, ‘গা’ধী। আমরা আছি না! আর তুমি এমন পাগলামো করছো কেনো? বিয়ে হলে তো মানুষ শ্বশুরবাড়িতে নয়তো নিজের বরের সাথেই থাকে।’

আমি কিছু বলার আগেই মাহমুদা বলে, ‘আরেহ বুবুর কথা ধরছো কেনো? বাদ দাও। ‘ও’ যে কখন কি বলে না বলে ওর মাথার ঠিক নেই। ছাড়ো ছাড়ো!’

আমি তেড়ে গেলাম মাহমুদার দিকে। মাহমুদা ভোঁ করে দৌড় দেয়। সবাই হাসাহাসি শুরু করে। আরাফ কাছে এগিয়ে এসে মাইশা আর সিহাবের মধ্যে বসে পড়ে। হাসিমুখে বলে,

‘কি হয়েছে? সবাই এতো দৌড়াদৌড়ি কেনো করছে?’

তিন্নি হেঁসে বলে, ‘আপনার বউ নাকি আপনার সাথে না থেকে আমাদের সাথে থাকবে। নিয়ে যাবো নাকি আপনার বউকে?’

আরাফ ভ্রু কুঁচকে তাকায় আমার দিকে। আমি উনার তাকানো দেখে চুপ করে মাহিদের কাছে সরে বসলাম। আড়চোখে তাকিয়ে দেখি মাহিদ ঠোঁট চেপে হাসছে। আরাফ শান্ত গলায় বলে,

‘আপনাদের আর কষ্ট করতে হবে না আপু। বউ নিয়ে কালই তো যাবো আপনাদের বাড়ি। তখন না হয় রেখে দিয়েন।’

সবাই হাসে। আরাফ আর আমাকে নিয়ে ফাজলামি করতে থাকে। রাতে আরাফ সবাইকে খাইয়ে তারপরই ছেড়েছে। এখানে তো সে ছাড়া আর কেউ থাকে না তাই সম্ভবত বাহির থেকে খাবার এনেছে। আরাফ সবাইকে থাকতে বললেও কেউ থাকলো না। সবাই আমাদের নিজেদের একা ছেড়ে চলে গেলো। পুরো ফ্ল্যাটে আমি আর আরাফ শুধু একা। আরাফ নিচে গেছে কিছু আনতে। ওহ হ্যাঁ তিন্নি আর মাহমুদা মিলে বেডরুম সাজিয়েছে টুকটাক। আমি একবার সে ঘরে উঁকি দিয়ে পুরো ফ্ল্যাটে ঘুরলাম। একটা বেডরুম, একটা গেষ্ট রুম, কিচেন আর ছোট একটা ড্রয়িং রুম। একদম ছোট একটা ফ্ল্যাট তবে সুন্দর। দেয়ালটা সাদা রঙ করা। ড্রয়িং রুমে সোফা রাখা। আমি সোফাতেই পা তুলে গালে হাত দিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ বাদেই হাজির হলো আরাফ। আমাকে এমন সোফায় বসে থাকতে দেখে গম্ভীর মুখে কাছে এগিয়ে আসে। আমি তখনো তার দিকে গালে হাত দিয়েই তাকিয়ে আছি। উনি পাশে বসে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

‘নতুন বউ ঘোমটা দিয়ে বাসর ঘরে না বসে সোফায় পা তুলে বসার ঘরে কি করছেন?’

আমি উনার প্রশ্নের জবাব না দিয়েই নিজে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি এমন একটা ভাব করছেন যেনো সব ঠিক আছে! বিয়েটা কেনো করলেন?’

‘ভালোবাসি তাই।’

উনার শান্ত গলার ‘ভালোবাসি তাই’ শুনে নড়েচড়ে বসলাম। দৃষ্টি সরিয়ে এদিক ওদিক করলাম। উনি নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। হাই তুলে এগিয়ে গেলেন বেডরুমের দিকে। আমিও যাবো কি না দোনামোনা করতে করতে বসে রইলাম। আমার বিয়ে এর আগেও হলেও অনুভূতি এমন যেনো এটাই প্রথম বিয়ে। এটা সত্য আমি লজ্জা, ভয়, অস্বস্তি নিয়েই আরাফের সাথে স্বাভাবিক হতে পারছি না। বার বার মনে হচ্ছে বিয়েটা করে বোধহয় ভুল করে ফেললাম। আরাফের জীবনটাও ন’ষ্ট হবে না তো! দাঁত দিয়ে নখ কামড়াচ্ছিলাম আর চিন্তার সাগরে ডুবে ছিলাম। হুট করেই আরাফের ডাক শুনে চমকে উঠলাম। এতোটাই চমকেছি যে সোফা থেকে একটুর জন্য পড়তে পড়তে বেঁচে গেছি। বুকে থু থু করতে করতে ছুট লাগালাম রুমের দিকে। আরাফ একটা প্যাকেট হাতে ভ্রু কুঁচকে বললেন,

‘রুমে আসার ইচ্ছে আছে নাকি সারা রাত ওই ড্রয়িং রুমেই পার করার শখ?’

আমি বিড়বিড় করে বললাম, ‘আমার তো বাড়ি যাওয়ার শখ।’

আরাফ কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে কাবাড থেকে কাপড় বের করতে করতে বলে, ‘বিয়ে যখন করেছি তখন বউকে আর একা ছাড়ছি না কোথাও। ওই ব্যাগে শাড়ি আছে। চুপচাপ পড়ে নেন।’

আমি ব্যাগের দিকে তাকাতেই উনি ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন। পুরো রুমের পরিবেশ দেখে বুঝলাম আমার শ্বশুর আব্বা বিরাট বড়লোক না হলেও ভালোই ছিলেন। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাগটা হাতে নিয়ে দেখলাম তার ভেতরে একটা লাল শাড়ি। রীতিমতো টাস্কি খেলাম যেনো। বিয়ের পর শাড়ি দেয় কে ভাই! আমি বোকার মতো ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চিল্লিয়ে বললাম,

‘বিয়ে শেষ হওয়ার পর শাড়ি পড়ে কে? বিয়ে শুরু হওয়ার আগে যে শাড়ি দিতে হয় তা জানেন না!’

ভেতর থেকে সাড়া শব্দ পেলাম না। ব্যাগ এক সাইডে রেখে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলাম। এটা কি ধরনের বোকামি! মাথাটাই খারাপ হওয়ার জোগাড়।

কতক্ষণ বাদে আরাফ সাহেব বের হলেন তার হিসেব নেই। উনি বের হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শাড়ি পড়েননি কেনো?’

‘বিয়ে শেষ হওয়ার পর শাড়ি দিচ্ছেন কেনো? আগে দেন নাই কেনো?’

‘তাতে কি হয়ছে?’

আমি কপাল চাপড়ে বসে রইলাম। এই লোকের সাথে তর্ক করতে চাওয়াটাই ভুল। চুপচাপ ব্যাগটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। ব্যাগের মধ্যে আমার প্রয়োজনীয় সবটাই ছিলো। দাঁতে দাঁত চেপে শাড়ি পড়ে নিলাম। এরপর বেরিয়ে আসলাম। আরাফ তখন বিছানায় বসে পা দলাচ্ছে। আমি উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আয়নার সামনে বসলাম। আরাফের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখি সে হা করে তাকিয়ে আছে। আমি নিজের দিকে ভালো করে দেখলাম। সবই তো ঠিক আছে। নিজের মতো চুলটা আঁচড়ে বেঁধে নিলাম। পেছনে তাকিয়ে তার সামনে এগিয়ে এসে বললাম,

‘আমার মধ্যে এমন কোনো বিশাল পরিবর্তন হয়নি যে হা করে তাকিয়ে থাকবেন! রাতের বেলা হুদাই তো শাড়ি পড়ালেন এবার কি রাতের বেলা শাড়ি পড়ে নেচেও দেখাবো?’

আরাফ আমার দিকে গম্ভীর মুখে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে হেঁসে দেয়। ইশশ কতদিন পর তার হাসি দেখলাম। আজ কাল আমার মনে হয় আমি তার এই হাসিতেই ম’রে যাবো। তার হাসিতে আমার নিজের ঠোঁটও প্রসারিত হয়ে গেলো। আরাফ আমাকে টেনে বসিয়ে দিয়ে টুপ করে কপালে চুমু খেয়ে একটা বেলীফুলের মালা খোঁপায় গুজে দিয়ে বলে,

‘আপনি আমার কাছে সব পরিস্থিতিতেই সুন্দর মায়া। আর এই যে লাল শাড়ি! এটাতে আপনাকে একদম বউ বউ লাগছে। একদম আমার নতুন বউ। আর আমার বিয়ে করা বউকে আমি হা করে দেখবো নাকি সামনে বসিয়ে মন ভরে দেখবো তা আমার একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার। এই ব্যাপারে আমি আপনার কোনো হস্তক্ষেপ মেনে নিবো না। বুঝেছেন!’

আমি তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। তার ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। চোখ দুটো একদম চোখের দিকে। আমি শুকনো ঢোক গিললাম। চোখ দুটো মুহুর্তেই জ্বালা করে ওঠে। নিজেকে সামলাতে গিয়েও পারলাম না। জাপ্টে ধরলাম আরাফকে। চোখ থেকে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। আরাফ নিজেও শক্ত করে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখলো। কপালের এক কোণায় চুমু দিয়ে বললো,

‘আমি আপনাকে আজীবন এভাবেই ভালোবাসবো মায়া। কোথাও হারাতে দেবো না আপনাকে।’

ভাঙা গলায় বললাম, ‘আমাকে তো হারাতে হবে আরাফ। আপনি তো জানেন আমার ব্লাড ক্যান্সার। হয়তো আমি আর কিছুদিন..’

আরাফের হাতের বাঁধন শক্ত হলো। এমন ভাবে জড়িয়ে ধরে থাকলো যেনো আমাকে কেউ কখনো তার থেকে আলাদা করে নিয়ে যেতে পারবে না। কান্না পেয়ে গেলো ভীষণ রকম। নিজেকে উজাড় করে কাঁদতে না পারলেও চোখ থেকে তখনো জলের স্রোত বয়ছে। কতক্ষণ সেভাবে কেটেছে আমার জানা নেই। একটা সময় আমি যখন আরাফকে ছাড়াতে নিলাম তখনও আমাকে আরাফ ছাড়লো না। বিড়বিড় করে বললো,

‘আমি আপনাকে আজীবন এভাবেই শক্ত করে বুকের মাঝে আটকে রেখে দেবো। কোথাও যেতো দেবো না আপনাকে। আপনি আজীবন আমার কাছে এভাবেই থেকে যাবেন।’
_____

আরাফের নিজেকে স্বাভাবিক করতে সময় লাগে বেশ অনেকক্ষণ। এরপরও তার চোখ মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না। চোখ দুটো অসম্ভব লাল হয়ে ছিলো যেমনটা কেউ কান্না আটকানোর সময় করে। উনার মন ভালো করার জন্য নিজে থেকেই বললাম,

‘নামাজ পড়বেন না? কত কথা বলে সময় নষ্ট করতেছেন অথচ বিয়ের রাতে যে নামাজ পড়ে পথচলা শুরু করতে হয় জানেন না!’

আরাফ হাসার চেষ্টা করে। এরপর দুজনে একসাথে নামাজ আদায় করে জায়নামাজেই বসে থাকলাম। কিছুক্ষণ ওভাবে থেকে দুজনে ব্যালকনিতে দাঁড়ালাম। বাইরে সুন্দর একটা চাঁদ উঠেছে। একদম গোল। চাঁদ দেখেই ঠোঁট প্রসারিত করে হাসলাম। আরাফ আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘এক চাঁদ আকাশে একা আরেক চাঁদ আমার পাশে। আমার বউ।’

আমি লজ্জা পেলাম। চোখ মুখ খিচে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। আরাফ পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুতনী রেখে বলে,

‘আমি আমার চাঁদ কে হারাতে দেবো না। ভাালোবেসে আগলে রাখবো আজীবন।’

আমি উনার খুশিটা ন’ষ্ট করলাম না। যে কয়দিন বাঁচবো ততদিন না হয় এই মানুষটার সাথে, তার বুকে মাথা রেখেই কাটালাম। আমার একটা আক্ষেপ তো মিটে গেলো। হোক ক’দিনের জন্য তবুও ভালোবাসার মানুষকে তো আপন করে পেলাম। যতদিন বাঁচবো না হয় তাকে ভালোবেসেই বাঁচলাম। হ্যাঁ হয়তো আমি হয়েছি স্বার্থপর তবে এবার না হয় একটু স্বার্থপর হয়েই বাঁচলাম। আর দূরত্ব না-ই বা আসলো আমাদের মাঝে। নয় হয় এবার দূরত্ব টুকু মিটিয়ে একে অপরের মাঝে মিশেই থাকলাম। হলাম না হয় একে অপরের পূরক।

চলবে..
(আসসালামু আলাইকুম। ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন)