শ্রাবণ ধারায় পর্ব-১৫

0
200

#শ্রাবণ_ধারায় |১৫|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

পাহারাদার দু’জন ফারিশের বুকে চাপ দিতে শুরু করল।ফারিশের কোনো রেসপন্স না পেয়ে তারা তাকে হাসপাতালে নিয়ে আছে।অনেক চেষ্টার পর চিকিৎসকরা ফারিশের হার্টবিট খুঁজে পান।সর্বপ্রথম কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় ফারিশের হৃৎপিণ্ডে শ্বাসপ্রশ্বাস সঞ্চালন করানো হয়।তৎক্ষনাৎ তাকে আইসিউতে নেওয়ায় কোনো মতে পরাণ টেনেটুনে রেখেছে চিকিৎসকগণ।রাণী হাসপাতালে প্রবেশ করেই প্রথমে বারিশকে ফোন করে।ফারিশের অবস্থা সম্পর্কে অবজ্ঞাত হওয়ার পর তার মস্তিষ্ক শূন্য হয়ে যায়।সে পৃথিবীর সব ভুলে ছুটে আসে তার ভাইয়ের কাছে।এদিকে চিনির কথা মাথা থেকেই বের হয়ে যায় তার।

মুষ্টিবদ্ধ হাত ধীরে ধীরে আলগা হতে থাকে বারিশের।কি হটাউ মনে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে যায় তার।মৃদুস্বরে উচ্চারণ করে, “চিনি?”

চট করে মনে পরে যায় সে চিনিকে শো রুমে একা ফেলে চলে এসেছে।অজানা আতঙ্কে শুঁকনো ঢোক গেলে বারিশ।নিউরন কাজ করা বন্ধ হয়ে যায়।কোনোকিছু না ভেবেই দৌড়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে সে।রাণী বারিশের যাওয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো একবার।বারিশকে প্রচন্ড গতিতে গাড়ি চালিয়ে বেরিয়ে যেতে দেখে চোখ ছোট ছোট করে নিজে নিজেই বলল,” এর আবার কি হলো?কোথায় যাচ্ছে এতো তাড়াহুড়ো করে?একবার ফোন করে দেখবো?”

ভাবতে না ভাবতেই ফোন বের করে কল করল রাণী।কিন্তু ফোন রিসিভ হলো না।আবারও কল করলো রাণী।এবারও কল রিসিভ হলো।পরেরবার ব্যস্ত আছে শোনা গেল।হাল ছাড়ল না রাণী সে অনবর কল করতে থাকল।বারিশ ইশান্তকে কল করে বলল চিনিকে শো রুম থেকে যেন বাড়ি নিয়ে যায় এবং বাড়িতে গিয়ে তাকে জানায়।প্রতিত্তোরে ইশান্ত সম্মতি জানিয়ে কল রেখে দিল।কিছুক্ষণের মধ্যে ইশান্তের কল পাওয়া গেল।সে বিচলিত স্বরে বলল,
– স্যার ম্যাম নাকি আরো একঘন্টা আগে শো রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছে।

বারিশ ফিরে আবারও হাসপাতালে আসছিল।ইশান্তের কথায় গাড়ি থামিয়ে দিলো।চিন্তিত স্বরে বলল,
– চিনি বাড়িতে যায়নি?

– না স্যার আমি বাড়িতে খোঁজ নিয়ে দেখেছি ম্যাম বাড়িতে ফেরেনি।

কপালে চিন্তা ভাঁজ পড়লো বারিশের। গাড়ি আবার ঘুরিয়ে শো রুমের দিকে গেল সে।সেলস গার্লের থেকে যতটুকু জানা গেল চিনি জুতো নিয়ে আরো আগে বেরিয়ে গিয়েছে।বারিশ মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করল,
– কোন দিকে গিয়েছে বলতে পারবেন?

মেয়েটি হাতের ইশারায় বাম দিকে দেখিয়ে বলল,
– মনে হয় এদিকেই যেতে দেখেছিলাম।

– কোনো অটো বা রিকশায় গিয়েছিল?

– না উনি তো হেঁটেই গেল এদিকে।স্যার আমাদের এখন শো রুম ক্লোজ করতে হবে।যদি তেমন কোনো প্রয়োজন হয় তাহলে আপনি কাল সকালে আসেন তাহলে খুব ভালো হয়।

মুখ বাঁকিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে বারিশ।ইশান্তকে বাম দিকে ইশারা করে নিজেও গাড়ি নিয়ে রাস্তার বা দিকে যায়।কিছুদূর গিয়েই গাড়ি সাইড করে নেমে পড়ে বারিশ।বারিশকে নামতে দেখে ইশান্তও নেমে যায়।এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
– কি হয়েছে স্যার?

– শোনো তুমি গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যাও আমি আশেপাশে খুঁজে দেখি।সামনে চিনিকে পেলে আমাকে জানাবে।

– জ্বী স্যার।

বারিশের কথা মতো গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ইশান্ত।অনুভূতি শূন্য বারিশ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে প্রিয় সে মুখটা খোঁজার চেষ্টা করে।

বাংলা শ্রাবণ মাসে আজ চার তারিখ।থেকে থেকে বৃষ্টি নামছে।কখনো তো আবার এক টানা তিন চার দিন ধরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে।তবে বৃষ্টির কারণে শহুরে জনজীবন থেমে নেই।সবাই বৃষ্টি মাথায় করে নিজেদের কাজের তাগিদে এদিক ওদিক ছুটছে।তেমনি সাদা আর আকাশী মিশ্রিত শাড়িতে ছুটছে এক যুবতী।আজ তার চাকরির ইন্টারভিউ। প্রতিবার ইন্টারভিউতে কিছু না কিছু একটা হবেই।হতে পারে তা ভালো কিছু আবার হতে পারে তা চরম দুর্ভোগের।আজ যেমন বৃষ্টি তার জন্য দুর্ভোগ বয়ে এনেছে।জরজেট শাড়ির কুঁচি একহাতে আরেক হাতে ইন্টারভিউয়ে প্রয়োজনীয় কাগজ যা একটি প্লাস্টিকের ফাইলে সুরক্ষিত রাখা হয়েছে।সেই হাতেই কালো ছাতা ধরে হাঁটছে যুবতী।একদিকে রাস্তার ময়লা পানি কুঁচিকে ভিজিয়ে দিচ্ছে অন্যদিকে ছাতা ভালোভাবে ধরতে না পারায় হাতসহ পিট ভিজে যাচ্ছে।তবু থেমে নেই যুবতী নাক মুখ কুঁচকে এগিয়ে যাচ্ছে সে।মুখে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা!
পঁচিশ তলা বিল্ডিং এর সামনে এসে স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে সে।বিল্ডিং এর একদম মাঝ বরাবর সিলভার কালারের নেমপ্লেটে বড় বড় করে “বারিশ..”এর পর ল্যাটিন অক্ষরে কি লেখা তা ঠিকভাবে বুঝতে পারল না মেয়েটি।বারিশ নামটা দেখে বাইরে বৃষ্টির ধারার দিকে তাকালো যুবতী।ঠোঁট নাড়িয়ে উচ্চারণ করল,” বা….রিশ! মানে বৃষ্টি?” ঠোঁট এলিয়ে মৃদু হাসে সে।নামের নিচেই লেখা “দ্যা ভেলভেট ক্লজেট”।তা দেখে ভ্রু কুঁচকায় চিনি।ভিতরে প্রবেশ করে সে।বেশ খানিকটা সময় পর বেরিয়ে আসে সে।মুখে তার আকাশের মতো কালো মেঘ।নিচের ঠোঁটটা সামান্য এগিয়ে রেখেছে।শূণ্য চোখে বাইরে তাকিয়ে দেখলো অনাবরত বৃষ্টি হয়েই চলেছে।এখন বেগ আরো বেড়েছে।তা দেখে পাশে ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ালো সে।সাথে একজন কোট প্যান্ট পরা একজন তার পাশে এসে দাঁড়ালো।সে কোট ঝেড়ে বৃষ্টির পানি মোছার চেষ্টা করছে।তার দিকে একপলক দেখে আকাশের দিকে তাকাল চিনি।অপেক্ষা করতে থাকল কখনো বৃষ্টি একটু কমে আসবে আর সে বাড়ি যাবে।পাশ থেকে কেউ গলা ঝেড়ে বলল,
– এসকিউজ মি..আপনার পার্সটা পড়ে গিয়েছে।

তৎক্ষনাৎ পাশ ফিরে নিচে তাকাল মেয়েটি।তার সাদা পার্সটি নিচের পড়ে আছে।বৃষ্টির পানির ছিটে এসে পড়ছে তাতে।সে দ্রুত পার্সটি উঠিয়ে নিল।মলিন স্বরে বলল,
– থ্যাংকস।

মাথা নাড়ালো ছেলেটি।যুবতীর হাতে সাদা ফাইল দেখে ছেলেটি বলল,
– ইন্টারভিউ দিতে এসেছিলেন?কেমন হলো ইন্টারভিউ?

এটারই যেন অপেক্ষা করছিল যুবতী।কে তাকে জিজ্ঞেস করবে আর সে তার পেটের সব কথা উগড়ে দিবে।ছেলেটির জিজ্ঞেস করতে দেরি কিন্তু যুবতীর উত্তর দিতে দেরি নেই।সে কোমরে হাত বেঁধে নেমে পড়লো তার সকল অভিযোগ উগড়ে দিতে,
– একদমই বাজে। আমি আমার জীবনে কখনো এমন বাজে ইন্টারভিউ দিইনি।আরে এমন এমন প্রশ্ন তো আগে মানুষ বিয়ে করতে এসেও করত না।

বারিশ এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
– এখানে তো আপনার বিয়ের ইন্টারভিউ নিতে ডাকেনি।এটা যেহেতু একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি তো এখানের ইন্টারভিউ সহজ হবে না এটা নিশ্চয়ই আপনার জানার কথা?

– কঠিনেরও তো একটা লিমিটেশন আছে।এরা সব লিমিট ক্রস করে ফেলছে।

– আচ্ছা?

– আপনিও ইন্টারভিউ দিতে এসেছেন?

ছেলেটি কিছুক্ষণ ভাবল অতঃপর সামান্য মাথা নাড়ালো।সাথে সাথে মেয়েটি উৎসাহিত দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করল,
– আপনার ইন্টারভিউ কেমন হয়েছে?

ছেলেটি নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখের মণি নিচে নামিয়ে আবারও কিছুক্ষণ ভাবল।নিচু স্বরে বলল,
– হুম… ভালোও না খারাপও না।

– তাও তো খারাপ হয়নি!আমার তো খারাপের থেকেও খারাপ হয়েছে।আমার না মনে হয় এটাকে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি না বানিয়ে মানসিক হাসপাতাল বানানো উচিত ছিল।সবার মাথায় সমস্যা।সবাই কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করে।আমি যদি সাইক্রেটিস্ট হতাম সবার মাথার স্ক্র টাইট দিয়ে দিতাম।সবার আগে দিতাম ঐ যে কোম্পানির ওনার বারিশ না বিষ! হোয়াট এভার…ওনার।উনিই হলো গুরু পাগল।ওনাকে ঠিক করলে সবাই এমনিই ঠিক হয়ে যাবে।

মেয়েটি তর্জনি তুলে উপরে নেমপ্লেটের দিকে ইশারা করে ভিষণ ক্ষোভে কথাগুলো বলছিল।এদিকে ছেলেটি ভ্রুযুগল উঁচু করে চোখ বড় বড় কথাগুলো শুনলো।কথা শেষ হতেই ফ্যাশফ্যাশে কন্ঠে বলল,
– নাম কি আপনার?

মেয়েটি মিষ্টি হেসে তার দিকে তাকালো।হাসির রেখা বড় করে বলল,
– চিনি বুশরা।

ছেলেটি বড় বড় চোখেই মাথা নাড়ালো।চিনি ভ্রু কুঁচকে বলল,
– আপনার?

ছেলেটি মেকি হেসে বলল,
– বারিশ মৃধা।

চিনি হাসতে হাসতে বলল,
– বাহ্! সুন্দর নাম তো..

সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ কপালে তুলে বারিশের দিকে তাকালো চিনি।তর্জনি দিয়ে নেমপ্লেটের দিকে ইশারা করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বারিশ নামের যুবকের দিকে তর্জনি রাখল।বারিশের মুখে এখনও সেই মেকি হাসি রয়েছে।এই মুহুর্তে তার কেমন অনুভূতি প্রকাশ করা উচিত তা বুঝে উঠতে না পেরে মুখে একটি অবলা হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।চিনির মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরতে শুরু করলো।বারিশের পাশে একজন যুবক এসে বলল,
– সরি স্যার এতোক্ষণ অপেক্ষা করানোর জন্য গাড়ি চলে এসেছে।চলুন..

বারিশ দাঁত বের করে চিনির উদ্দেশ্যে বলল,
– ভালো থাকবেন।

বলেই কপালে তর্জনি ঠেকিয়ে বিড় বিড় করতে করতে গাড়িতে উঠে গেল বারশি।কপাল কুঁচকে বিড় বিড় করে বলল,
– কি বলল?আমি গুরু পাগল?হোয়াট’স দ্য মিনিং ওফ গুরু পাগল?

গাড়িতে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো।চিনি বাকরুদ্ধ হয়ে বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে বারিশের যাওয়ার দিকে।বারিশ ভ্রু কুঁচকে আড় চোখে একনজর চিনিকে দেখে নাক কুঁচকে ফেলল।চিনি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।ধাম করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।সাইড মিরর থেকে তা দেখে চমকে উঠলো বারিশ।বিচলিত স্বরে বলল,
– গাড়ি থামাও গাড়ি থামও।

সঙ্গে সঙ্গে ব্রেক কষলো ড্রাইভার।দরজার লক খুলে বেরিয়ে এলো বারিশ।ছুটে এসে চিনির মাথাটা তুলে মুখে মৃদু আঘাত করে নাম ধরে ডাকল,
– চিনি!চিনি!চিনি…

চিৎকার করে কেউ চিনি নাম ধরে ডাকতেই হাঁটু থেকে মাথা তুলল চিনি।সারা চোখ মুখ চোখের জলে শ্যাত শ্যাত করছে।নাক বন্ধ আছে।চোখ মুখ টকটকে লাল হয়ে আছে।মাথা তুলে নাক টানলো সে।পরিত্যক্ত একটি টং দোকানের ভাঙা চটার বেড়ার পিছনে হাঁটুতে মাথা গুঁজে বসে ছিল সে।উচ্চস্বরে তার নাম ধরে কেউ ডাকতেই হুঁশ ফেরে তার।উঠে দাঁড়ায় সে উত্তেজিত স্বরে সাড়া দেয়,
– বারিশ…বারিশ!

পা থেমে যায় বারিশের কন্ঠে উৎস কোন দিকে নির্ণয় করতে কান খাঁড়া করে সে।চিনির নাম ধরে আবারও ডাকে,
– চিনি?

দোকান থেকে বেরিয়ে আসে চিনি।রাস্তায় বারিশকে দেখে ফুঁপিয়ে ওঠে।ফুঁপানোর শব্দে ঘুরে তাকায় বারিশ।চিনিকে এমন বিদধস্ত অবস্থায় দেখে থমকে যায় সে।চিনি এগিয়ে এসে রাগে দুঃখে একটি চড় বসিয়ে দিলো বারিশের ডান গালে।ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল,
– আমি বলেছিলাম আপনাকে আমাকে নিয়ে ঘুরতে চলুন?প্রেমিক হিসেবে যতটা পারফেক্ট হাসবেন্ড হিসেবে ততোটাই লুজার আপনি।

মাথা নত করে বারিশ।অপরাধী সুরে বলল,
– সরি..

সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা চড় পড়লো বারিশে ডান গালে।মুখে হাত দিয়ে ঢোক গিলল বারিশ!

চলবে…