শ্রাবণ ধারায় পর্ব-১৩+১৪

0
108

#শ্রাবণ_ধারায় |১৩+১৪|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি

– একি ম্যাম আপনি এখানে দাঁড়িয়ে?

ইশান্তে কথায় পিচের রাস্তা থেকে দৃষ্টি উঠিয়ে চিনি ইশান্তের দিকে তাকালো।সামান্য ঠোঁট মেলে বলল,
– তোমার স্যার বলল অফিসের সামনে দাঁড়াতে।

ইশান্তের কপাল কুঁচকে এলো।থুতনিতে তর্জনি ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
– আচ্ছা ম্যাম আপনি একটু দাঁড়ান আমি স্যারের কাছে শুনছি।

চিনি বাধা দিয়ে বলল,
– আরে না উনি হয়তো কোনো মিটিং এ আছেন।আমি ম্যাসেজ করেছিলাম উনি কোনো উত্তর দেননি।আমি এখানেই অপেক্ষা করছি আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।

ইশান্ত মস্তক নিচু করে সামান্য দূরত্ব গিয়ে দাঁড়িয়ে বারিশকে ফোন করল।সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ হলো।ইশান্ত নম্র স্বরে বলল,
– গুড ইভিনিং স্যার।

অপর পাশ থেকে বারিশও ইশান্তকে “শুভ সন্ধ্যা” জানাল।ইশান্ত কন্ঠে ভদ্রতা বজায় রেখে জিজ্ঞেস করল,
-স্যার আপনি কি ম্যামকে অফিসের নিচে দাঁড়াতে বলেছেন?ম্যাম নিচে একা একা দাঁড়িয়ে রয়েছে।

বারিশের কপাল কুঁচকে গেল।কিছুক্ষণ ভেবে জিভ কামড়ে ধরলো।এতো এতো কাজে তার মাথা থেকে বেরিয়েই গিয়েছিল যে সে আজ চিনিকে বের হবে। চিনি নিচে একা একা দাঁড়িয়ে আছে শুনতেই কলিজা শুঁকিয়ে গেল তার।থতমত কন্ঠে জবাব দিল,
– ম্যামকে নিয়ে বের হওয়ার কথা ছিল।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।তুমি এক কাজ করো ম্যামকে নিয়ে উপরে চলে আসো।

ইশান্ত সম্মতি জানিয়ে চিনির কাছে এগিয়ে গেল।বিনয়ী স্বরে বলল,
– ম্যাম স্যার আপনাকে উপরে যেতে বলেছে।

চিনি কিছুক্ষণ ফ্যাল ফ্যাল করে ইশান্তের দিকে চেয়ে রইলো।বোকা চাহনিতে ইশান্তের সামান্য হাসি পেল।তবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এখন হাসির জন্য অনুপযোগী সময় বুঝে হাসি চেপে রাখল সে।চিনি মাথা নাড়িয়ে ধীর পায়ে প্রবেশ করল বিশাল দালানের ভিতর।লিফটের দরজা খুলতেই দৃশ্যমান হলো বারিশ।একগাল হেসে তাকিয়ে আছে চিনির দিকে।চিনিকে দেখতে পেয়েই দুহাত আলগা করে আলিঙ্গনের জন্য ইঙ্গিত দিলো।চিনি আশেপাশে তাকিয়ে বেশ বিব্রত হলো।আশেপাশে বারিশের কলিগসহ অফিসে অনেক স্টাফ তাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।চিনি মুখে হাত দিয়ে সামান্য গলা পরিষ্কার করে ডান হাত এগিয়ে দিলো হ্যান্ডশেক করার জন্য।তা দেখে ভ্রুযুগল কুঁচকে গেল বারিশের।অধর উল্টিয়ে সেও তার বাম হাত এগিয়ে হাত মেলাল।হাত মেলানো শেষ হতেই সেই হাত ধরে চিনিকে নিজের একহাতের ব্যাসার্ধে আবদ্ধ করে নিল।কোমরে মৃদু চাপ পড়তেই আরো একটুখানি দূরত্ব ঘুঁচলো।চিনি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।ডান হাতের সাহায্যে অনবরত কোমর থেকে বারিশের হাতটি সরানোর চেষ্টা করলো।এতে বিরক্ত বারিশ মৃদু খামচে ধরতেই মেরুদণ্ড সোজা হয়ে গেল চিনির।চোখ বড় বড় করে মূর্তির মতো সটান দাঁড়িয়ে রইলো সে।ঠোঁট টিপে হাসল বারিশ।অফিসের ভিতরে প্রবেশ করতেই বারিশ দু’হাতের তালু দ্বারা শব্দ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।সবাই তাদের দিকে তাকলে সে বিগলিত হেসে বলল,
– গুড ইভিনিং এভরি ওয়ান।

সবাই বারিশকেও প্রতিত্তোরে সন্ধ্যার শুভেচ্ছা জানাল।বারিশ চিনিকে ইশারা করে বলল,
– মিট মাই ওয়াইফ মিসেস চিনি বুশরা।

চিনি সবার উদ্দেশ্যে একটি অকৃত্রিম হাসি দিলো।সবাই চিনিকে হ্যালো বললো।বারিশ সবার উদ্দেশ্যে বলল,
– যেহেতু চিনিকে ফার্স্ট টাইম আপনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি তাই আমার পক্ষ থেকে আজ আপনাদের জন্য ডিনার পার্টি!

সবাই বেশ খুশি হলো।বারিশ সবার থেকে বিদায় নিয়ে চিনিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।প্রথমেই গাড়ি এসে থামলো একটি জুতার শো রুমে।গাড়ি থেকে নেমে শো রুমে প্রবেশ করলো দুজন।বারিশ চিনির উদ্দেশ্যে বলল,
– দেখ কোনটা ভালো লাগে।

চিনি মাথা নাড়িয়ে দেখতে লাগলো।কিন্তু একটিও তার পছন্দসই হলো না।দেখতে দেখতে এক পর্যায়ে মন খারাপ হয়ে গেল তার।ঠোঁট উল্টে এটাওটা দেখছে কিন্তু কোনোটাই তার পছন্দ হলো না।বারিশও দেখছে।একটি জুতোই চোখ আঁটকে যায় বারিশের। এগিয়ে গিয়ে হাতে নেয় সে জুতো।পুরো জুতো সাদা ঝলমলে স্টোনে কারুকাজ করা।নিচে আধা ইঞ্চি লম্বা পেন্সিল। জুতোটা হাসে নিয়ে মুচকি হাসে বারিশ। সেখানে থাকা একজন সেলস গার্লকে ঢেকে বলে,
– এটা ৩৬ সাইজটা একটু দেখান।

মেয়েটি তার মিষ্টি কন্ঠে উত্তর দেয়,
– জ্বী স্যার।

জুতোটা এনে চিনির পায়ে পরাবে মেয়েটি।এগিয়ে চিনির পাশে দাঁড়ালো বারিশ।মেয়েটি তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসতেই চিনি ইতস্তত বোধ করল।দ্রুত সেও নিচু হয়ে বিব্রত স্বরে বলল,
– আব…আমার কাছে দিন প্লিজ আমি দেখছি।

মেয়েটি আবার তার মিষ্টি কন্ঠে ধ্বনি তুলে বলল,
– আমি সাহায্য করছি ম্যাম।

পাশ থেকে শোনা গেল বারিশের ভরাট কন্ঠ,
– আমার কাছে দেন।

মেয়েটি আর কথা বাড়াল না।জুতোটা বারিশের হাতে দিয়ে প্রস্থান করল।বারিশ চিনিকে সোফায় বসিয়ে দিলো।হাঁটু গেড়ে চিনির সামনে বসে সযত্নে চিনির পায়ে জুতোটি পরিয়ে দিলো।চিনি শ্বাস আঁটকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার বীরপুরুষের দিকে।বারিশ জুতো পরিয়ে জাদুমাখা এক হাসিতে মুখ তুলে চায়লো চিনির দিকে।দু’হাতের ঘর্ষনে হাত ঝেড়ে উঠে দাঁড়াল সে।কোমরে হাত দিয়ে মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো চিনির পায়ের দিকে।পায়ের দিকে চোখ রেখেই বলল,
– বাহ্!জুতোটা তো বেশ মানিয়েছে তোমার পায়ে।

চিনির গলায় কোনো স্বর নেই।সে এক দৃষ্টিতে বারিশের মুখের আদলে তাকিয়ে ঘোরে চলে গিয়েছে।বারিশ মেয়েটিকে ডেকে বলল,
– এসকিউজ মি..এই জুতোটি প্যাক করে দিন।

মেয়েটি দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে জুতো জোড়া নিয়ে গেল বিল তৈরি করতে।ফোনের শব্দে ঘোর কেঁটে গেল চিনির।এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে বুঝতে পারলো শব্দটি বারিশের ফোন থেকে।বারিশ ফোন রিসিভ করে একটু পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।চিনি পূর্বের পায়ে দেওয়া জুতোটি পায়ে পরতে পরতে বারিশের দিকে ফিরে তাকাল। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বারিশ সেখানে নেই।ভ্রু কুঁচকে ফেলে চিনি।দ্রুত পায়ে জুতো পরে এদিকে ওদিকে খুঁজতে শুরু করে।কোথাও না দেখে কাউন্টারে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– আচ্ছা এখানে আমার সাথে যে স্যার ছিল সে কোথায় বলতে পারেন?

মেয়েটি একটু ভেবে বলল,
– আচ্ছা স্যার তো এই মাত্রই তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলেন।

চোখ ছোট ছোট হয়ে গেল চিনির।মেয়েটি জুতোর ব্যাগটি চিনির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
– ম্যাম আপনার সুজ…এবং বিলটা।

চিনি বারিশকে কল করতে করতে ব্যাগ আর বিলটি হাতে নিলো।বিলের কাগজের দিকে তাকাতেই চমকে উঠলো সে।অনবরত বারিশকে কল করতে থাকল সে।কিন্তু কোনোবারই কল রিসিভ হলো না।সর্বশেষ ফোন বন্ধ পাওয়া গেল।চিনি এখন কি করে?এতোগুলো টাকা তো তার কাছে এই মুহুর্তে নেই।মেয়েটি চিনির মতিগতি বুঝতে না পেরে নরম সুরে জিজ্ঞেস করল,
– কোনো প্রবলেম ম্যাম?

চিনি থমথমে মুখে মেয়েটির দিকে একপলক তাকিয়ে বিলের কাগজের দিকে তাকাল।কিছু একটা ভেবে এগিয়ে এলো মেয়েটির দিকে।সামান্য নিচু স্বরে ইতস্তত করে বলল,
– আসলে আমি এই মুহুর্তে পার্সেলটি নিতে পারছিনা।

মেয়েটি বোধহয় সামান্য বিরক্ত হলো তবু তার মিষ্টি কন্ঠে বিনয়ের সহিত বলল,
– দেখুন ম্যাম এটা সম্পূর্ণ কাস্টমাইজড প্রোডাক্ট এবং লিমিটেড এডিশন।তাই এসব প্রডাক্ট আমরা সেল করার পর ফেরত নিতে পারি না।যেহেতু এটা সোল্ড আউট এবং এর সব ডেটা আমাদের ব্রান্ড ওনারের কাছে মেইল করা হয়ে গিয়েছে তো এখন এটাকে…মানে বুঝতেই তো পারছেন ম্যাম।

চিনি কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারেনা।বারিশের উপর ভিষণ রাগ হচ্ছে তার।আরে এতোই যদি ব্যস্ত তাহলে তাকে নিয়ে বের হতে বলেছিল কে?সে তো বলেনি।বারিশ নিজেই তাকে নিয়ে বের হলো আর এখন এই ফ্যাসাদে তাকে একা ফেলে চলে গেল।চিনির মাথায় চট করে ইশান্তের নামটা এলো।সে চটজলদি ইশান্তকে ডায়াল করলো।কল রিসিভ হলো তৎক্ষনাৎ। বিনয়ের সাথে চিনিকে সালাম দিলো ইশান্ত। অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করল,
– এতো রাতে ম্যাম কোনো প্রবেলম?

চিনি কথা না বাড়িয়ে সোজাসাপ্টা বলল,
– ইশান্ত আমার একাউন্টে সেভেনটি থাউজ্যান্ড টাকা দিতে পারবে?এখনই..

থমকে গেল ইশান্ত। চুপ হয়ে রইলো কিছুক্ষণ।নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
– জ্বী ম্যাম এখনই পাঠাচ্ছি।

– থ্যাংক ইউ ইশান্ত।

– ম্যাম প্লিজ…

– ওকে ওকে একটু তাড়াতাড়ি করো।

কিছুক্ষণের মধ্যে একাউন্টে টাকাটা চলে আসলো। চিনি জুতোর বিল মিটিয়ে জুতোর ব্যাগটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো।রাগে তার গাল গরম হয়ে গিয়েছে। আশেপাশে বারিশের টিকিটাও নেই।গাড়ি নিয়েই চলে গিয়েছে সে।রাত বেশ অনেক হয়েছে।রাস্তায় যানবাহন তেমন নেই।শহরের বুকে পিচ ঢালাই দুইভাগে বিভক্ত রাস্তা যার একপাশ বরাদ্দ হয়েছে যাওয়া এবং অন্য পাশ বরাদ্দ হয়ে ফিরে আাসার জন্য।দুটি রাস্তাকে পৃথক করেছে ল্যামপোস্টের সারি।ল্যামপোস্টের দূর্বল আলোই আবছা নীলকালো রাস্তা আর বাতাসে উড়তে থাকা ধুলোর আবরণ দেখা যাচ্ছে। তবু তা অস্পষ্ট!ক্ষণে ক্ষণে একটি দুটি গ্যাস চালিত গাড়ির শব্দ কানে বারি খাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে তাদের মধ্যে থেকে একটিকে থামার জন্য ইশারা করলো চিনি।তবে তারা থামল না। দিন শেষে সবার গন্তব্য এখন বাড়ি।সারাদিনের করা পরিশ্রমের টাকা দিয়ে সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো মন্দ বাজার করে ঘরে ফিরে যাচ্ছে তারা।রাতে চুলোর পাশে গরম গরম ভরপেট খাবার খেয়ে পৃথিবীর সর্বোত্তম বিশ্রামে নিয়োজিত হবে তারা।তাই এই মুহুর্তে আর কোনো দিকে মনোযোগ দিতে চায়ছে তারা।এদিকে অসহায় চিনি একপা দুপা করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। গা ছমছমে নিস্তব্ধতা তার সাথে বাতাসের বিদঘুটে শব্দ।সব মিলিয়ে গায়ে লোম দাঁড়িয়ে গেল চিনির।চাপা কষ্টে চোখ জ্বলতে শুরু করলো তার।মুহুর্তেই চোখে জড়ো হলো একরাশ নোনা জল।তবে তা গড়িয়ে পড়লো না।তার আগেই হাতের তালুতে চোখ মুছে ফেলল চিনি।সারা শরীর বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আছে।হঠাৎ কেউ তার কর্কশ কন্ঠে গর্জে উঠতেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেল চিনি।পাশে তাকিয়ে দেখতে পেল ক্ষতবিক্ষত একটি কুকুর গলা ছেড়ে আর্তনাদ করছে।ভয়ে শ্বাস ঘন হয়ে এলো তার।শাড়ির আঁচল মুঠ করে বুকে চেপে ধরলো সে।একবার ভাবল ইশান্তকে কল করে আসতে বলবে কিনা।কোনো উপায় না পেয়ে কল করার জন্য ফোন বের করতেই আরো একধাপ ভয় বেড়ে গেল চিনির।ফোনটি বন্ধ হয়েছে আরো কিছুক্ষণ আগে।কিছুক্ষণ আগে যখন ইশান্তকে ফোন করেছিল তখনই ফোনে চার্জ ছিল আট পার্সেন্ট।তখনই চিনিকে ওয়ার্নিং করা হয়েছিল ফোন চার্জে দেওয়ার জন্য।গলায় যেন খরা পড়েছে।সেই শুষ্ক গলায় আদ্রতা আনতে ঢোক গিলল চিনি। তবে গলা আদ্র হলো না।আশেপাশে তাকিয়ে কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না সে।পাশ থেকেই কেউ তার আঁচল টেনে খানিকটা ছিঁড়ে ফেলল।ভয়ে লাফিয়ে উঠলো চিনি।পাশে তাকিয়ে দেখতে পেল উষ্কখুষ্ক এবং ময়লায় মোড়ানো একজন পুরুষ।বয়স শনাক্ত করা গেল না।মুখ ভর্তি দাঁড়িতে তার বলিরেখা অদৃশ্য তাই বোঝা গেল না তার বয়স।চিনি পিছন ফিরতেই লোকটি ময়লা দাঁতে হেসে চিনির পায়ে মাথা ঠেকিয়ে রাস্তায় শুয়ে পড়লো।বিড় বিড় করে বলল,
– মা মা আশির্বাদ করো মা।তুমি আমাকে শেষ পর্যন্ত দেখা দিলে মা!আশির্বাদ করো মা।

চোখ বেরিয়ে এলো চিনির। দ্রুত পায়ে পিছিয়ে এলো সে।আগেপিছে কিছু দেখে দিকবিদিক ভুলে এলোমেলোভাবে দৌড়াতে শুরু করলো সে।জরজেট শাড়ি হওয়ায় দৌড়ে তেমন সুবিধা করতে পারলো না চিনি।চিনি দৌড় দিতেই লোকটা উঠে দাঁড়াল। সেও চিনির পিছু পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে হাত বাড়িয়ে বলল,
– দাঁড়াও মা দাঁড়াও! তুমি আমাকে এভাবে একা ফেলে যেতে পারো না মা।তোমাকে আমি যেতে দিবো না মা।তোমাকে আমায় সাথে করে স্বর্গে নিয়ে যেতেই হবে মা….দাঁড়াও বলছি মা দাঁড়াও!

চিনি কি আর তাই দাঁড়ায়? সে তো কোনো দিক না তাকিয়ে তিড়িংবিড়িং দৌড়াতে ব্যস্ত!

– তোর বড় আমার ছেলেটাকে শেষ না করা অবধি থামবে না বুঝেছিস!আমাদের ঐ বাড়ি থেকে বের করে ওর শান্তি হয়নি তাই এখন আমার ছেলেটাকে পৃথিবীতে থেকেই সরিয়ে দিতে চায় তোর বউ।

হাসপাতলের বেঞ্চে বসে রাণী হাউমাউ করে কাঁদছে আর বারিশের উদ্দ্যেশে কথাটি বলছে।বারিশ তার ঠিক সামনেই চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।হাতে তার কিছু কাগজ আর ডায়েরি। রাণী গলা ফাটিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আবারও বলল,
– আজকে তোর বউয়ের জন্য আমার সুস্থ সবল ছেলেটা গলায় ফাঁ’শ নিয়েছে।আজ কতবছর ধরে আমি সত্যটা বুকের মধ্যে বন্দি করে রেখেছি।আর আজ ঐ দুইদিনের মেয়েটা এসে সব তচনচ করে দিলো।আমার ছেলের যদি কিছু হয় তাহলে আমি ওকে ছাড়বো না।

শেষের কথাটি বেশ ক্ষিপ্ত স্বরে বলল রাণী।বারিশ কাগজগুলো হাতের মুঠোয় দুমড়ে মুচড়ে ফেলল।ধীর পায়ে এগিয়ে এলো কেবিনের জানালার কাছে।যেখান থেকে দেখা যাচ্ছে ফারিশের নিস্তব্ধ দেহ খানা।অক্সিজেনের সাহায্যে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করছে চিকিৎসকরা।সাথে আরো যন্ত্রপাতির সাথে দেহটি সংযুক্ত। সেদিকে তাকিয়ে বারিশের চোখ লাল হয়ে গেল।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফেলল।হাতের শিরাগুলো যেন চামড়া ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়ছে।শরীরের রক্ত কণা দ্বিগুণ গতিতে একপাশ থেকে অন্য পাশে চলাচল করছে।কপালে জমা হয়েছে বিন্দু বিন্দু ঘাম।হলুদ ফর্সা কান গোলাপি বর্ণ ধারণ করেছে।সে দাঁতে দাঁত চেপে হিসহিসিয়ে বলল,
– এর জন্য সত্যিই তুমি দায়ী থাক।দেন আই সয়ার চিনি,আই উইল নেভার ফরগিভ ইউ।ইউ হ্যাভ টু পে ফর দিস!

ছেলের জন্য তার সকল প্রিয় খাবার রান্না করে ছেলেকে ডাকতে ছেলের ঘরে যায় রাণী।দরজা ভিতর থেকে লাগানো দেখে অবাক হয় সে।ফারিশ সচারাচর দরজা আঁটকায় না।কখনো প্রয়োজন হলে আঁটকায়। দু একবার দরজায় কড়া নাড়ে রাণী কিন্তু দরজা খোলে না ফারিশ।এবার অনবর দরজায় আঘাত করতে থাকে রাণী।বিচলিত হয়ে বলতে থাকে,
– ফারিশ! বাবা ফারিশ! দরজা খোল দেখ তোর প্রিয় সব খাবার রান্না করেছি।

কিছু ভিতর থেকে কোনো টু শব্দও আসে না।কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে রাণীর কপালে।সে বাড়ির বাইরে তাদের পাহারা দেওয়ার জন্য বারিশের ঠিক করা লোকদের কাছে দৌড়ে যায়।তাদের অনুরোধ করে ফারিশের ঘরের দরজা ভেঙে ফেলার জন্য।তারা কয়েকবার ফারিশের ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে ফারিশের উত্তরের আশায় কান পেতে থাকে।কিন্তু ভিতর একদম নিস্তব্ধ!তারা এবার তাদের সকল শক্তি দিয়ে দরজায় আঘাত করে।দু চার বার আঘাত করতেই দরজা ভাঙে ফারিশের ঘরের।চটজলদি ঘরে প্রবেশ করে রাণী মৃধা।দেখতে পায় দড়িতে ঝুলে আছে ফারিশের নিস্তব্ধ দেহখানি।ভয়ে সারা শরীর শীতল হয়ে যায় রাণীর।সে চিৎকার দিয়ে ফারিশের নাম উচ্চারণ করে।পাহারাদার লোক দুটি হতবাক হয়ে ঝুলন্ত শরীরটার দিকে চেয়ে আছে।মতি ফিরতেই দুজনে দৌড়ে ফারিশকে নামাতে শুরু করে তারা।ফারিশের শরীর ওজন যেন দশগুণ বেড়ে গিয়েছে। দুজন তাগড়া যুবক তাকে নামাতে হিমশিম খাচ্ছে।ফারিশকে নামিয়ে তার খাটের উপর শোয়ানো হলো!

চলবে…