সঞ্চারিণী
আফনান লারা
৫৩.
-‘জানো আমি আশাকে অনেক ভালোবাসতাম।আসলে বুঝোই তো সবসময় এক জিনিস ভালো লাগেনা।মাঝে মাঝে টেস্ট বদলাতে হয়।কিন্তু আমি তো ওকে ছাড়ার কথা কখনও বলিনি।ও থাকুক না।সমস্যা কি??
কিন্তু না!মেয়েদের এই এক সমস্যা। সে চায় সব ভালোবাসা সে একা পাবে।আরে বাকি মেয়েদের ও তো দিতে হবে তাইনা?
এই যে আমি এতবড় একজন বিজন্যাস ম্যান হলাম সেটা কি বসে শুয়েই হলাম?কত দিনরাত পরিশ্রম করে আমার এমন একটা পজিশন আসছে। দিনের কাজ শেষে রাতে একটু টেনসন ফ্রি থাকতে চাই।একটু মনোরঞ্জন চাই।তা না আমাকে সে কোনো মেয়ের দিকে তাকাতেও দিবেনা।আরে ভাই আমি কোটি কোটি টাকা কামাই।আমার তো চারপাশে মেয়ে থাকতে হবে তাহলে তো বোঝা যাবে আসলেই আমার টাকার পাওয়ার আছে।আর আশা কি চায়!!
সে ছাড়া কেনো মেয়ে থাকতে পারবেনা।কিছু না কিছু হলেই কান্নাকাটি শুরু করে।এভাবে তো জীবন চলেনা।
রাগ ওঠে।হাত ওঠে!!আবার এসব গিয়ে বাহিরের মানুষকে বলে দেয়।কেমন হয় বলোতো??আমি কি বেশি টর্চার করতাম ওরে?
মেরে তো ফেলতাম না।এমন মার মারতাম যেন দু তিনদিনেই ঠিক হয়ে যায়।আর সে কি করলো বাহিরের একটা মেয়েকে ধরে আমার নামে বিচার দিলো।বাহ বাহ।আমার রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক নয় কি?
আমি দেখতে চাইলাম সে ঠিক কি করে।ওমা সে দেখি আমার বাড়িতে থেকে আমার বিরুদ্ধেই প্রমাণ জোগাড় করতে দিন রাত এক করছে।
যাই হোক রেদোয়ান কখনও পথের কাঁটা রাখেনা।হয় কাঁটা সরায় আর নাহয় কাঁটা সমেত রাস্তা উপড়ে ফেলে।
আমি তো শুধু আশাকে মারতাম।তোমার কি দরকার ছিল এর ভেতরে প্রবেশ করার?তোমার জীবনের মায়া নেই?
হয়ত তোমার নেই,কিন্তু আমার কাছে জীবনের মায়া আছে।রকিকে যেভাবে জব্দ করেছিলে সে খবরটাও আমার কানে এসেছিল।রকির জন্য পাগল হয়না এমন মেয়ে এর আগে একটাও আমি দেখিনি।কিন্তু তোমাকে দেখলাম এত কিছু রেখে জাস্ট চাকরির জন্য রিস্ক নিলে।ঠিক ঐ সময় ধরে সন্দেহের খাতা খুলেছে।একটা মেয়ে আমার পি.এ হবার জন্য কেন এত কষ্ট করবে??
তোমাকে আমি অনেক আগেই ধরতে পেরেছি।শুধুমাত্র না বোঝার ভান করে ছিলাম।আমি এটাও জানতাম প্রয়োজনে তুমি আমাকে মেরে ফেলতেও পারবে।সেটাই হলো।রাগে ক্ষোভে মেরে ফেললে আমায়।ওপস সরি!আমার মতন দেখতে একজন অপরিচিত লোক!কিন্তু সে মরেনি।আমিই তাকে মারলাম।রেদোয়ানের একটা লাশ তো লাগবে তাইনা?
যাই হোক তোমাকে এর শাস্তি পেতে হবে।আমার যে রাগ তুমি উঠিয়েছিলে আমি পারতাম এখনই তোমাকে মেরে শোধ তুলতে।কিন্তু তা করছিনা কারণ আমার ভাই রকি তোমাকে চেয়েছে।
তোমাকে মারবো এটা ঠিক তবে এখন না।সময় আসুক।আগে রকি তার উপহারটা গ্রহণ করুক।রকিকে বাসায় রেখে এসেছিলাম।
গিয়ে দেখতে হবে।তাছাড়া তোমার হাসবেন্ড দ্যা গ্রেট শাওন তো আসতে চলেছে তোমার খোঁজে।তবে সে কখনও জানবে না এই ঠিকানা কোথায়।আমি রকির সাথে কন্ট্যাক্ট করে আসছি।তুমি রেস্ট নাও কেমন?’
——–
-‘শাওন??মেধার কি শরীর খারাপ??কি হয়েছে বল বাবা।আমাদের ও তো জানার অধিকার আছে’
রুম থেকে বেরিয়ে শাওন ভেজা হাত মুছতে মুছতে বললো,’না তেমন কিছুনা না।আসলে জানোই তো আমরা কাল রাতে মিশনে গিয়েছিলাম।সেখানে হালকা পাতলা চোট পেয়েছে মেধা।ঠিক হয়ে যাবে’
-“সেকি!!কোথায় চোট পেয়েছে?দেখি সর আমি দেখবো’
শাওনকে সরিয়ে মা হনহনিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লেন।মেধা বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসেছিল।মা ওর পাশে বসে মাথায় বুলিয়ে বললেন,’কই ব্যাথা পেয়েছো মা?’
মেধা শাওনের দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার মায়ের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বললো,’তেমন কিছুনা।হালকা ব্যাথা পেয়েছে। দাগ ও নেই।কাল সকাল অবধি সেরে যাবে’
-“আমি তো বাপু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।সত্যি শাওন তুইও না।যেভাবে আসার পর থেকে দরজা বন্ধ করে ছিলি আমি তো ভাবলাম মেধার না জানি কি হয়েছে”
শাওন হাসার চেষ্টা করে মাকে ধরে বললো নাস্তা করবে।মা দেরি না করে চলে গেলেন নাস্তার আয়োজন করতে।উনি যাবার পরেই মেধা পা থেকে চাদর সরিয়ে নিলো।স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে রইলো কিছুক্ষণ ।শাওন ওর পাশে বসে পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।কাল রাতে একটা বিশাল ঝড় বয়ে গেছে।
(ঝড়টার ব্যাখ্যা শেষ পর্বে আসবে।)
মেধার চোখ থেকে কাল রাতের ঝড়ের দৃশ্য সরছেনা।থেমে থেমে কেঁপে উঠছে সে।গোটা একটা দিন কেটে গেছে।
খবরে দেখাচ্ছে রেদোয়ানের লাশ পাওয়া গেছে।একমাত্র খুনী রকি।
সে ও নিখোঁজ।আজ থেকে এই কেস বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছে ক্রাইম ব্রাঞ্চ অফিসার শাওন আর মেধা,সাজিদ, মিলন।
শাওন মেধার হাত ধরতেই মেধা হঠাৎ ভয় পেয়ে কেঁপে উঠলো।শাওন বুঝতে পেরেছে ও এখনও কাল রাতের ঘটনা ভুলতে পারেনি।তাই সে একটু এগিয়ে এসে ওর পাশে বসে কাঁধে হাত রেখে চেপে ধরলো ওকে।
দুজনে চুপ হয়ে বসে আছে।সোফার রুম থেকে বারবার টিভিতে দেখানো খবরটা শোনা যাচ্ছে। মেধা শাওনের দিকে ফিরে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কেঁদে ফেললো।শাওন মেধার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,’ভুলে যাও সব।যত জলদি ভুলবে ততই ভালো থাকবে’
-“আমার ভালো লাগছেনা কিছু।সব চোখের সামনে ভাসছে।মনে হয় বাঁচবোনা।’
-‘সঞ্চারিণীদের মুখে এমন কথা মানায়?শুয়ে পড়ো।সারাদিনে তো একবারও ঘুমাওনি।আমি গিয়ে নাস্তা নিয়ে আসি।ওঠার চেষ্টা করোনা।’
শাওন চলে যাবার পর মেধা ফোন হাতে নিলো। সব জায়গায় এক খবর।
রেদোয়ানের লাশ একটা জায়গায় মিলেছে।সেই আগের লাশ।সিঁড়ি থেকে পড়ে মৃত্যু বলে মেনে নেওয়া হয়েছে।
মেধা আয়নার দিকে ফিরে বসলো।কাল ঝড়টা যেন তার উপর এসে আছড়ে পড়েছিল।শাওন না থাকলে কাল কি যে হতো ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।
বলতে গেলে কাল শাওন ওর জীবন বাঁচিয়েছে।কিন্তু এ কেমন বাঁচা???
না জানি কতদিন এই বোঝা ঘাঁড়ে চেপে থাকবে।
শাওন নাস্তা এনে টেবিলে রেখে বললো,’ও হো তুমি তো নামতে পারবেনা’
মেধা বলতে চাইলো খাবার ওর সামনে দিয়ে যেতে।কিন্তু তার আগেই শাওন এসে ওকে কোলে তুলে নিলো হঠাৎ।মেধা আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলো কেন শাওন এমন করছে।শাওন জবাবে বললো, ‘কিছু কিছু আঘাতের একমাত্র ঔষুধ ভালোবাসা।’
এরপর মেধাকে চেয়ারে বসিয়ে হাঁটুগেড়ে বসে ওর হাত জোড় করে ধরে বললো,’তোমাকে বিয়ের পর থেকে হয়ত ভালোবাসাটাই দেওয়া হয়নি।তবে এখন মনে হয় ঐ ভালোবাসাটার বড্ড দরকার।সেটা হলেই তুমি আর আমি বাকি জীবনটা সুন্দর করে কাটাতে পারবো।আমাদের এখন কয়েক শব্দের সেই ভালোবাসাটা বাস্তবিক রুপে চাই।’
মেধা শাওনের শুস্ক চুলে হাত বুলিয়ে মাথা নাড়ালো।শাওন দুষ্টুমি করে বললো,’শুধু আমি ভালোবাসলে হবে?আপনি বুঝি এভাবেই কথা এড়িয়ে যাবেন?’
মেধা বিসকিট নিয়ে শাওনের মুখে পুরে দিয়ে বললো,”আমি তো অনেক আগে থেকেই ভালোবেসে এসেছি।প্রকাশ করলাম কই?’
-“তাই নাকি।আহারে তবে সেই ভালোবাসা আমার গায়ে মাখলোনা কেন?’
-“মাখালেই মাখে’
——
নাস্তা শেষ হবার পর একটু রেস্ট নিতে যাওয়ার সময় হলোনা তাদের।বাকি অফিসাররা সবাই এসে হাজির শাওনের বাসায়।সবাই মেধাকে দেখতে এসেছে।কালকে রাতে পায়ে ব্যাথা পেয়েছিল সে।সেটা সব অফিসার জানে।সবাই হাতে হাতে ফুল নিয়ে হাজির।রুমটাকে ফুল দিয়ে ভরিয়ে আড্ডা,হাসি সব শেষ করে রাতটাকে আরও সুন্দর করে দিয়ে তারা যে যার বাড়িতে চলে গেছে।
রুমটা এখন ফুলে সজ্জিত বাসর হয়ে আছে।মেধা একটা হলুদ গোলাপ উল্টে পাল্টে দেখছিল।সেসময়ে শাওন ঢুকলো রুমে।দাঁত কেলিয়ে দরজা বন্ধ করতে করতে বললো,’আমার পেট ব্যাথা হয়ে গেছে হাসতে হাসতে।নুহাশটা এত হাসাইতে জানে!’
মেধা কিছু বললোনা
শাওন ফুলের তোড়াগুলোকে এক পাশ করে রেখে মেধার পাশে বসে ওর হাত থেকে গোলাপটা টেনে কুচি কুচি করে উপরের দিকে ছুঁড়ে মেরে দাঁত কেলিয়ে তাকালো আবার।
মেধা ব্রু কুঁচকে বললো,’এটা কি হলো?এমন কেউ করে ফুলের সাথে?’
-‘বকছো কেন?আমি তো একটু বাসর সাজালাম।বাসর তো সব গোটা ফুল দিয়ে হয়না।কিছু কিছু ফুলের পাপড়ি ছিঁটানো থাকতে হয়”
-‘কোথাকার পাপড়ি,কিসের বাসর?’
-“ওমা!বাসর চিনোনা?বুঝাই বলতাম?”
মেধা বোকার মতন বললো,’হুম।বুঝান’
শাওন এক ধাপ এগিয়ে আসতেই সমস্ত হুশ আসলো মেধার।সে একটু সরে বসে বললো,’আচ্ছা আচ্ছা বুঝছি।বুঝাইতে হবেনা।সুন্দর করে বললেই পারতেন।যেভাবে মজার ছলে বললেন আমি তো ভাবলাম কি না কি।বুঝছি তো।ওমন করে তাকিয়ে আছেন কেন আজব!’
-‘বুঝছো যখন!!তাকাবো না কি করবো?কচি খুকি?কিছু বোঝোনা?’
মেধা শাওনের গায়ে কিল বসিয়ে দিয়ে পায়ে হাত দিয়ে বললো,’আমার পায়ের অবস্থা দেখছেন?’
-“আমাকে বাহানা দিতে হবেনা।কাল তোমার এই পায়ের তাজা ব্যাথা নিয়ে তুমি এক মাইল দৌড়াইছিলা।আমার বেশ মনে আছে।এখন আমার প্রেমের সময় আসায় বাহানা সপছো??
তা মানছিনা।আন্দোলন করবো বলে দিলাম’
-‘আন্দোলনের স্লোগান কি হবে?’
-“যাকে কেউ ছুঁতে পারেনি,সেই সঞ্চারিণীকে আমি ছুঁতে চাই!!ছুঁতে চাই’
চলবে♥