#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_১১
শুভ্রতার এমন প্রশ্নে স্পন্দনের বাবা মা একে অন্যের দিকে তাকালো। তাদের ইশারা জনিত কথা শুভ্রতার চোখ এড়ায় নি। তবুও উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো শ্বশুর মশাইয়ের দিকে……
শুভ্রতার শাশুড়ি তখন কঠোর গলায় বললেন…..
—” তুমি নতুন বউ তোমার এইসব জানার দরকার নেই। অনেকদিন পর এসেছো বিশ্রাম করো।”
শুভ্রতা জোর করতে গিয়েও থেমে গেলো। জোর নামক শব্দটি সে কোনো ভাবেই করতে ইচ্ছা করতে চায় না। জোর তাকেই করা যায় যার এইসব কথা বলতে ইচ্ছা করে কিন্তু কোন একটা সংকোচ থাকার জন্য বলতে পারে না কিন্তু যে লোক নিজ থেকেই সব লুকাতে চায় তাকে জোর করা সম্ভব না।
শুভ্রতা রুমে গিয়ে দেখলো স্পন্দন ঘুমিয়ে আছে। দেখে খুব ক্লান্ত লাগছে স্পন্দনকে। শুভ্রতা স্পন্দনের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। গাড়িতে বসে স্পন্দন যা কিছু বলেছে কিছুই ভুলেনি সে। স্পন্দনের কাগজ পত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। মনের সব আগ্রহ কাগজ পত্রের দিকে আকর্ষন করলো শুভ্রতা। সব কিছু গুছিয়ে হটাৎ তার চোখে পাতলা,পুরাতন,নীল রঙের একটি ডায়েরী দেখতে পেলো। স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে এখনও ঘুমিয়ে আছে। ডায়রী-টা নিয়ে রুমের সাথে থাকা ব্যালকনিতে গিয়ে বেতের সোফায় বসলো। ব্যালকনি-টা খুব অদ্ভুদ। চারপাশটা খুন শুনশান নীরবতা। শুভ্রতা এই প্রথম খেয়াল করলো স্পন্দনের রুমটা বাসার পিছনের দিকটায়। এই পিছনের দিকে মানুষ খুব কম চলাচল করে কিন্তু শুভ্রতার মনে হচ্ছে এই জায়গায় কেউ আসেই না। ব্যালকনিতে বসে ড্রিম লাইটের আলোতে ডায়রী-টা খুলল , ডায়রী-র প্রথম পাতায় কিসব গাছপালা,ঘর বাড়ি আঁকা হয়েছে। তার পরের পৃষ্ঠায় কিসব লেখা বুঝা যাচ্ছে না। শুভ্রতা বুঝল এই ডায়রী স্পন্দনের ছোট বেলার। এইভাবে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা যেতে লাগলো শুভ্রতা। পড়ার মতো কিছু পেলো না কিন্তু হটাৎ শেষের দুই পৃষ্ঠা আগে লেখা…..
ক্লাস সেভেনে উঠলাম। অনেক বছর পর ডায়রী-টা খুঁজে পেলাম। খুব হাঁসি পাচ্ছে ডায়রী-টা দেখে। কিসব উল্টা পাল্টা লেখা। ছোট বেলার ডায়রী-তে আজ একটা জিনিষ লেখতে খুব ইচ্ছা করছে। কিন্তু কি লিখবো? মম…. ইয়াহ পেয়েছি। স্পন্দন নামের অর্থ কি? স্পন্দন নামের অর্থ সক্রিয়, উপযুক্ত, অস্থির, স্বাভাবিক।কিন্তু স্পন্দন অর্থ যতটুকু বিজ্ঞান সমত জেনেছি ক্রমাগত পর্যায়ক্রমে গতি ও বিরাম। এমন অদ্ভুত নাম কেনো রেখেছে আব্বু আম্মু? আচ্ছা আমি মানুষটা কি অদ্ভুদ? কি জানি ছোট বাচ্চা আমি বুঝি না কিছু!ভালো-ই হলো ডায়রী-টা আর অচল হয়ে থাকলো না। লাস্ট পেজ গুলো তো এইভাবে-ই নষ্ট হয়ে যেতো।
এইটুকু লেখার পর আর কিছুই লেখা নেই এই ডায়রী-তে। শুভ্রতা গালে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ডায়রী-টার দিকে তাকিয়ে রইলো। তাকিয়ে তাকিয়ে ভাবছে…..
—-“এত ছোট বয়স থেকেই কতটা অদ্ভুত ধরনের মানুষ ছিলেন উনি। যে বয়সে আমরা নামের অর্থ তো দূরে থাক নাম নিয়ে ভাবিনি আর সেই বয়সে উনি কি কি ভেবে রেখেছেন। ছোট থেকেই কিপটা ছিলেন উনি দেখা যাচ্ছে? বাবা গো বাবা কি হিসাব। সত্যিই অদ্ভুত মানুষ। ”
শুভ্রতার ইচ্ছা হলো না স্পন্দনের সাথে গিয়ে ঘুমাতে। কম্বল এনে বেতের সোফায় শুয়ে পড়লো। বাহির থেকে আসা বাতাস থাকা সত্বেও ঘুমটা খুব ভালো হলো শুভ্রতার। ঘুম থেকে উঠে রুমের দিকে পা বাড়িয়ে দেখলো স্পন্দন এখনও ঘুমিয়ে আছে। স্পন্দনকে না ডেকে বাথরুমে চলে গেলো। ফ্রেশ হয়ে এসে স্পন্দনকে ডাকল…..
—” স্যার, অফিসে যাবেন না?”
স্পন্দনের সাড়া শব্দ না পেয়ে আরো কয়েকবার ডাক দিলো কিন্তু স্পন্দন উঠছে না। ভয় পেয়ে শুভ্রতা মুখে হাত দিলো…..
—” আচ্ছা স্যার কি মারা গেছে? এক বছরের বিয়ে কি এখন এক মাসও যাবে না আমার? মা আর বাবাকে ডেকে নিয়ে আসি।”
শুভ্রতা ভয় পেয়ে চলে যেতে নিলে খপ করে স্পন্দন শুভ্রতার হাত ধরে ফেলে……
—” এখনও মরেনি আমি। ভয় পাওয়ার কিছু হয় নাই।”
শুভ্রতা যেনো মনে সাহস পেলো স্পন্দনের কণ্ঠ শুনে। কিন্তু রাগী গলায় বলল….
—” আপনি আমার সাথে অভিনয় করছিলেন এতক্ষণ? জানেন আমি কত ভয় পেয়ে গেছিলাম?”
—” তুমি যখন করেছো কিছু বলেছি আমি? শোধবোধ হয়ে গেলো এখন ওকে।”
কথাটা বলেই বাথরুম চলে গেলো স্পন্দন। শুভ্রতা ওরনা হাতে পেঁচিয়ে রাগী দৃষ্টিতে স্পন্দনের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো……
খাবার টেবিলে বসে আছে স্পন্দনের বাবা ,মা, স্পন্দন ও শুভ্রতা। স্পন্দন চুপচাপ খাচ্ছে। যেনো মনে হচ্ছে তার আশে পাশে কেউ নেই। স্পন্দনের মা একটু কেশে উঠলেন, আমতা আমতা করে বললেন…..
—” স্পন্দন একটা কথা বলবো?”
—-” হুম বলো।”
—” আচ্ছা শুভ্রতা তো তোর বউ এখন ওকে দিয়ে কেনো অফিসের কাজ করাচ্ছিস?”
—-” ও আমার বউ হওয়ার আগে থেকে আমার অফিসের একজন কর্মচারী। ওর কাজ ও করছে এইখানে সমস্যা কি? ও যদি করতে না চায় বলো রিজাইন লেটার জমা দিতে। আমি অন্য একজন খুঁজে নিবো।”
শুভ্রতা তখন তাড়াতাড়ি করে বললো….
—-” না না আমি চাকরি করতে চাই। এত পড়াশোনা করেছি নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য প্লিজ আপনারা এমন কাজ করবেন না। ”
—” শুনেছ ওর কথা আশা করি এখন আর কিছু বলবে না?”
স্পন্দনের মা মাথা একদিক ওদিক ঘুরিয়ে বুঝাল সে বুঝতে পারছে। স্পন্দন খাবার মুখে দিয়েই বললো…..
—” হটাৎ এমন প্রশ্ন করলে কেনো? তোমার মাথায় এমন প্রশ্ন আসবে ভাবতে পারছি না। প্রশ্নটা কি তোমার পাশে থাকা লোকটির?”
শুভ্রতা তখন ফিসফিস করে বললো…..
—” স্যার এইভাবে বলবেন না বাবা কিন্তু খুব কষ্ট পায়।”
স্পন্দন শুভ্রতার দিকে শীতল চোখে তাকালো। শীতল চোখ দিয়ে বুঝিয়ে দিলো এইখানে যেনো সে কথা না বলে। শুভ্রতা চুপ করে আবারো খেতে লাগলো। স্পন্দনের মা বললেন…..
—” সব সময় নিজের বাবার দোষ ধরিস কেনো? হতে পারে না এই কথা আমি নিজ থেকেই বলেছি?”
—” হুম হতে পারে। বাদ দেও । শুনো আম্মু, আমরা ছেলেদের যেমন নিজের স্বাধীনতা আছে, নিজের ইচ্ছা শক্তি আছে, আত্মসম্মান আছে , আলাদা মতামত আছে তেমনভাবে মেয়েদেরও কিন্তু সেই একই দিক গুলো আছে। নিজের মতামত নিজের নেওয়াই উত্তম। ছেলে মেয়ে বলে আলাদা কিছু হবে না। ছেলে হলে তাকে মাছের মাথা খাওয়াতে হবে , বড় টুকরা তাকে দিবে হবে সেইসব দিনগুলো এখন আর নেই। মীনা কার্টুন দ্বারাই এমন দৃষ্টি ভঙ্গি দুর করানো হয়েছে। এখন তুমি আর মীনার সেই দাদী না যে ছেলেকে বড় মেয়েকে ছোট নজরে দেখবে।”
খাবার খেয়ে উঠে পড়লো স্পন্দন। শুভ্রতা আবারো একরাশ মুগ্ধ হলো স্পন্দনের কথায়। সত্যিই এখন তার কাছে মনে হচ্ছে স্পন্দনের সব কথায় মায়া আছে। এই মায়ায় একবার ভালোবাসা শিখায় আরেকবার রাগ,ঘৃনা শিখায়। স্পন্দন উঠে যাওয়ার পর শুভ্রতার শাশুড়ি তখন বললেন…..
—” কেমন লাগলো আমার ছেলের কথাগুলো তোর কাছে? আমি জানতাম ও এমন ধরনের কথাই বলবে। তোকে ওর মনের কথাগুলো জানানোর জন্য এই ধরনের প্রশ্ন করেছি। কষ্ট পাস না মা আমার। দেখ আমার ছেলে তো না যেনো হীরা মানিক।”
স্পন্দনের বাবা হেঁসে দিয়ে বললেন…..
—” একটা কথা বলি, স্পন্দন কিছু মিসির আলীর সমগ্রের মিসির আলীর মতো রহস্যময়। ওকে যত কাছ থেকে চিনতে পারবে ততই ওর ভিতরের রহস্য গুলো জানতে পারবে। ছেলেটা আমার বড়ই অদ্ভুত ধরনের মানুষ।”
—-” তুমি উপন্যাসে এতটাই মগ্ন হয়ে আছো এখন সব কিছুতেই উপন্যাসের চরিত্র খুঁজে পাও। কিছুদিন পর বলবে হিমুর মতো আমার ছেলে অদ্ভুত প্রকৃতির রহস্যময় মানব।”
স্পন্দনের মার কথাটি শেষ না হতেই মিস্টার আজম বলে উঠলেন…..
—” এতদিনে মনের কথাটা বললে স্পন্দনের মা। হৃদয়টা জুড়িয়ে গেলো।”
মিসেস সাবিনা কটমট করে তাকালো মিস্টার আজমের উপর। শুভ্রতা উনাদের এমন কাণ্ড দেখে হাসলো।
—” মা ,বাবা কিন্তু ভুল কিছু বলেনি। তাছাড়া মিসির আলী ও হিমুকে আমার খুব ভালো লাগে। তারমানে স্যারকেও খুব ভালো লাগবে আমার?”
মিসেস সাবিনা হেঁসে দিয়ে বললেন…..
—-” তোর খাওয়া শেষ হলে চলে যেতে পারিস আমাদের বুড়া বুড়ির জন্য বসে থাকতে হবে না। তোর তো আবার অফিস আছে স্পন্দন কিন্তু সময়ের কাজ সময় মতই করতে পছন্দ করে।”
—” ওকে মা। আসছি।”
শুভ্রতা উঠে পড়লো। মিস্টার আজম মিসেস সাবিনার দিকে তাকিয়ে বললেন…..
—-” আমাদের এই হিটলার ছেলেকে এই মেয়েই একমাত্র সোজা পথে আনতে পারবে দেখে নিও তুমি।”
মিসেস সাবিনা বেগমও স্বামীর সাথে তাল মিলিয়ে বললেন……
—-” হুম। আমারও তাই মনে হয়।”
।।
।।
।।
—-” শুভ্রতা এই শুভ্রতাআআআ….!”
—” কি হয়েছে এইভাবে চেঁচাচ্ছেন কেনো? চোর ডাকাত পড়েছে না-কি ?”
—-” আমার ইম্পর্টেন্ট ফাইল গুলো এইখানে রেখেছিলাম এইগুলো কোথায়?”
—” ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন ফাইল গুলো এখন চোখ মেলে আলমারি তো দেখতে পারেন আজব প্রাণী একটা।”
—” কাগজ পত্রের কবে থেকে হাত পা গজিয়েছে ?”
—” বুদ্ধিহীন প্রাণী তাই বুদ্ধিহীনতার মত কথা বার্তা। সরেন তো বাপু আমি খুঁজে দিচ্ছি।”
শুভ্রতা ফাইল গুলো রেখে চলে যেতে নিলে স্পন্দন হাত ধরে টান দিয়ে উল্টো দিকে ঘুরিয়ে বললো…..
—” সাহস দেখছি দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে।”
—-” হুম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অপরিচিতা’ গল্পের কল্যাণীর মতো হতে চেষ্টা করছি।”
—” আমাকে কি অনুপম মনে হয় তোমার?”
—” ইয়েস।”
—” কোন দিক থেকে মনে হয় বলো?”
—” ওই যে বিয়ে করার শখ কিন্তু বলতে পারে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত গিয়ে কল্যাণীর পিছু পিছু ঘুরে আপনারও ঠিক সেই অবস্থায়ই হবে। ডিভোর্স দিতে ইচ্ছা করবে না কিন্তু মুখ ফোটে বলবেন না। ডিভোর্স ঠিকই দিবেন পরে আমার পিছু পিছু ঘুরবেন। হুহহহহ আমি কিন্তু পাত্তা দিবো না।”
—-” শখ কত। যাও রেডি হয়ে অফিসে যাও। তোমার জন্য মিটিং এখনও শেষ করতে পারলাম না।”
—” ওকে স্যার।”
গাড়িতে বসে যাচ্ছে দুইজন তখন হটাৎ করেই…….
চলবে…..
#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_১২
গাড়িতে বসে যাচ্ছে দুইজন তখন হটাৎ করেই স্পন্দন খুব জোড়ে গাড়ি ব্রেক করলো। শুভ্রতা সামনে ঝুঁকে মাথায় সামান্য আঘাত পায়। হটাৎ এমন কিছু হবে ভাবা তো দূর কল্পনাও করেনি শুভ্রতা।
—” হটাৎ এমন ভাবে গাড়ি ব্রেক মারলেন কেনো?”
শুভ্রতা স্পন্দনের দিকে তাকালো, স্পন্দনের মাথা গাড়ির স্টাডিং এর উপর পরে আছে। শুভ্রতা ভয় পেয়ে স্পন্দনের মাথা উঠিয়ে দেখে কিছুটা কেটে গেছে। গাড়িতে সব সময় ফাস্ট এইড বক্স থাকে। শুভ্রতা স্পন্দনের মাথায় কাটা স্থানে পরিষ্কার করে এরপর কোনো অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দিলো। পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করলে ক্ষত দ্রুত সেরে যেতে পারে সেই কথা ভেবে শুভ্রতা এই কাজ করলো। জীবনে প্রথম ডাক্তারের কাজ করছে ভয়ে হাত পা কাঁপছে তার। একটা পরিষ্কার ব্যান্ডেজ জড়িয়ে রেখে দিলো এর ফলে বাইরের ধুলোবালির হাত থেকে ক্ষতস্থান সুরক্ষিত থাকবে।
—” স্যার,শুনছেন আমার কথা? স্যার, স্যার, চোখ খুলুন প্লিজ এই যে আমি দাঁত বের করে হাসছি কিছু তো বলেন। আপনি না সময়ের কাজ সময়ে করতে ভালোবাসেন তাহলে আজ কেনো দেরি করছেন উঠেন স্যার।”
স্পন্দনের নিঃশ্বাস খুব দ্রুত গতিতে উঠা নামা করছে কিন্তু স্পন্দন কথা বলছে না। স্পন্দনকে দেখে এখন শ্বাস কষ্ট রোগীদের মতো লাগছে। শুভ্রতা কি করবে বুঝতে পারছে না। জীবনে গাড়ি চালায় নি গাড়ির কোন জিনিসের কি নাম কিছুই জানে না। কোন যন্ত্র দিয়ে কি করতে হয় তাও জানে না শুভ্রতা। গাড়ি থেকে নেমে সিএনজি খুঁজতে লাগলো। সিএনজি চালক প্রথম রাজি হয় কিন্তু পরে অসুস্থ মানুষ দেখে চলে যায়। শুভ্রতা এই প্রথম নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে। বিয়ের দিনও এত কষ্ট হয় নি তার আজ যে কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছা করছে চিৎকার করে কান্না করতে কিন্তু পারছে না। চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়ছে।
—” আফা কই যাইবেন?”
—” মামা প্লিজ আমার স্বামীকে বাঁচান উনি খুব অসুস্থ এক্ষুনি ডক্টর না দেখালে উনাকে বাঁচাতে পারবো না। প্লিজ সাহায্য করুন।”
—” টাকা কিন্তু বেশি দিতে হইবো আফা।”
—” ওকে মামা যত টাকাই চান দিবো এখন প্লিজ উনাকে ধরুন।”
সিএনজি চালক ও শুভ্রতা দুইজন মিলে স্পন্দনকে সিএনজি তে উঠা-লো। হসপিটালে আসলো। বিশ মিনিটের রাস্তা এসেছে তবুও সিএনজি চালক দুই হাজার টাকার নিচে নিবে না। শুভ্রতার কাছে এখন এত টাকা নেই। স্পন্দনের ওয়ালেট চেক করে দেখলো টাকা আছে। ওয়ালেট এ অনেক টাকা দেখে সিএনজি চালক বললো,
—” আরো দুই হাজার বেশি দিতে হবে।”
শুভ্রতা কুল কিনারা না পেয়ে পাঁচ হাজার টাকা ধরিয়ে দিলো ড্রাইভারের হাতে। এই রকম লোভী মানুষ গুলো তাদের চাওয়া টাকা না পেলে অনেক কিছু করতে পারে। শুভ্রতা কোনো ঝামেলা চাচ্ছে না তাই বেশিই দিয়ে দিলো।
কিছুক্ষণ পর ডক্টর এসে বললেন….
—” উনি কি খুব ধুমপান করেন?”
—” না । আমি তো দেখেনি কখনও।”
—” আমার মনে হচ্ছে উনি খুব ধুমপান করতেন কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে আর করছেন না যার ফলে আজ নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে এই রকম দুর্ঘটনা করেছেন। চিন্তা করবেন না ঠিক হয়ে যাবে। ”
ডক্টর চলে যাওয়ার পর শুভ্রতার মাথায় বার বার এক কথায় ঘুরাঘুরি করছে। ও যেদিন থেকে স্পন্দনের বাড়িতে এসেছে সিগারেটের ধোঁয়া তো দূর প্যাকেট পর্যন্ত দেখেনি তাহলে ডক্টর কি বললো?
শুভ্রতার চিন্তার অন্ত নেই ঠিক এই মুহূর্তে নাদু ফোন দিলো। আকাশ সমান বিরক্তি নিয়ে ফোন রিসিভ করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো….
—-” এই মুহূর্তে তোকেই খুঁজছিলাম। সবাই তো টেনশন ফ্রী তে দিচ্ছে তুই কেনো বাদ যাবি দে তোর টেনশন আমাকে ফ্রী তে।”
—” বাবুই পাখি রাগ করছিস কেনো? জামাই পেয়ে ভুলে গেছিস তাই না? হয় হয় এমন হয় বিয়ের পর বেস্ট ফ্রেন্ড আর বেস্ট ফ্রেন্ড থাকে না ব্যাড ফ্রেন্ড হয়ে যায়।”
—” ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল না করে বলে ফেল কি বলবি?”
—” বাবু আমার বয়ফ্রেন্ড আমার কথা শুনে না। আমি যা বলি তার উল্টোটা করে। ওকে এখনও ভালো করে চিনতে পারছি না। অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ অ্যাঁ।”
—” আমার নিজের জামাই আমার কথা শুনে না আর ওইটা তো বয়ফ্রেন্ড। আমার জামাইয়ের কখন কি মোড হয় বুঝি না,মানুষ হিসেবে কেমন তার মধ্যেই মায়াজালের শেষ নেই আর এই মাইয়া আছে তার বপ্পেন নিয়া আজব ক্যাটাগরির সদস্য।”
—” কি রে কি বিড়বিড় করে বলছিস জোরে বল শুনতে পাচ্ছি না।”
—” তোর বলপেন কি বলছে?”
—” বলপেন কই পাইলি ওইটা বয়ফ্রেন্ড হবে।”
—” ঘুরে ফিরে এক জায়গায় আসে এখন বল কি হয়েছে?”
—” তুই আমাকে বলেছিস ওকে বলতে যে, তুমি সিগারেট খেলে আমিও খাবো তখন ও কি বললো জানিস?”
—” না বললে জানবো কিভাবে? আমি তোদের দুইজনের কথা কি শুনি আজব পাবলিক রে তুই।”
—” চুল-ডা রেগে যাচ্ছিস কেনো? শুন, ও বললো তাহলে তো ঠিকই হলো দুইজন একসাথে বসে বসে সিগারেট খাবো বাতাসে ধোঁয়া উঠা-বো। আমার সিগারেট শেষ হলে তোমার কাছ থেকে নিবো তোমার শেষ আমার কাছ থেকে নিবে। যেকোনো অনুষ্ঠানে যেমন ধরো তোমার বার্থ ডে তখন তোমাকে গিফট হিসেবে এক বছরের সিগারেট কিনে দিবো। লাইফটা সিগারেট ময় হয়ে যাবে।”
শুভ্রতা ভেবেছিলো এই রকম কথা শুনে ছেলেটি নাদিয়াকে ভালোবাসলে সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিবে আর যদি ভালো না বাসে তাহলে মিস বিহেভ করবে কিন্তু এই ধরনের কথা বলতে পারে ভাবতে পারেনি। বুঝতে পারছে না ছেলেটি ভালোবাসে নাকি গেম খেলছে নাদিয়ার সাথে। নাদিয়াকে এখন এইসব বলতে চাচ্ছে না শুভ্রতা। নাদিয়ার প্রেম তিন দিন তারচে বেশি হলে চারদিন এর পর আর ঠিকে না কিন্তু এই প্রেম সেই রেকর্ড ভেঙ্গে দিছে…..
—-” কি হলো চুপ আছিস কেনো? কিছু তো বল!”
—” শোন, এখন বল তোকে বিয়ে করার জন্য।”
—- ” প্রেমের আগেই বিয়ে? এ কেমন সমাধান বললি শুভ্রু তুই?”
—” কথা শুনবি না-কি ফোন কেটে দিবো?”
—” হুম শুনছি বল?”
—” বিয়ের পর কিস করতে দিবি না বলবি গন্ধ। বিয়ের পর বাচ্চা নিবি পরে একদিন দেখিয়ে দেখিয়ে সিগারেট খাবি। আর বলবি ,দেখো তোমার বাচ্চা জন্মের আগে থেকেই সিগারেট খায় ডিজিটাল বাচ্চা তোমার।”
শুভ্রতার কথা শেষ না হতেই নাদিয়া চেঁচিয়ে উঠলো…..
—-” তুই আমাকে সিগারেট না খাইয়ে ছাড়বি না তাই না?”
—” কচু বুঝো তুমি আবাল মাইয়া। নিজের সন্তানের ভালোর জন্য সামান্য সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিবে তখন তোর সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। সিগারেট খাবি মানে নাটক করবি।”
—” আইচ্ছা। শোন আজ শপিং মলে এসেছি সমুদ্র ভাইয়ার তো……. এই এই মিয়া চোখে দেখেন না আজব সিম্বল লোক।”
—” ওই কি হলো কাকে ধমকাচ্ছিস?”
—” একটা তাল পাতার সেপাইকে। রাখছি আগে এই তাল গাছের তাল বিক্রি করি।”
নাদিয়া ফোন কেটে দিলো। শুভ্রতা এখন আরো চিন্তায় পড়লো।
—” এই মেয়ের মাথার তার গুলো কবে জোড়া লাগবে? এত বড় হয়ে গেছে কিন্তু স্বভাব ঠিক আগের মতোই।”
নাদিয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে এখন আবারো স্পন্দনের চিন্তায় মগ্ন হলো শুভ্রতা……
।।
।।
।।
—” এই যে কি বলছেন এইসব আমাকে?”
—” যা বলেছি একদম ঠিক বলেছি। মেয়ে দেখলেই ধাক্কা দিতে ইচ্ছা করে তাই না? আজ আপনাদের মতো লোকের জন্যই আমাদের মতো মেয়েরা রাস্তায় বেরুতে পারে না।”
—” মুখে যা খুশি আসছে বলে দিচ্ছেন আজব মেয়ে তো আপনি।”
—” ছিঃ ছিঃ মেয়েদের মতো ঝগড়া করতে লজ্জা করে না?”
—” ঝগড়া তো আপনি করছেন। কো-থেকে যে আসে এই পাগল ছাগল মেয়েরা।”
ছেলেটি আরো অনেক কিছু বলে চলে গেলো। নাদিয়া ছেলেটির যাওয়ার দিকে কটমট করে তাকিয়ে রইল……
।।
।।
।।
।।
—” মুগ্ধ দেখো তোমার কথা রেখেছি আমি এখন তুমি তোমার কথা রাখো।”
—” আমার কথা তো আমি রেখেছি তোমাকে বিয়ে করে। এখন আবার কি কথা রাখবো?”
—” তুমি কি আমার সাথে ঠাট্টা করছো মুগ্ধ? বিয়ে করেছ তার জন্য অন্য কারণ আছে। তোমার কথা রেখে আমি স্পন্দনের সাথে প্রেমের অভিনয় করেছি। বিয়ের দিন পালিয়ে এসেছি। মা বাবার সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছি আর এখন তোমার কথা রেখে নিজের বোনের সংসার নষ্ট করছি। আর কি করবো বলো তুমি? তোমাকে ভালোবেসে জীবন আমার শেষ হয়ে গেছে। তোমার কথা গুলো শুনছি এই বাচ্চাটার জন্য শুধু।”
—” আমিও তো ওই বাচ্চার জন্য তোমাকে বিয়ে করেছি। এখন যদি বিয়ে না করতাম এই মুখ কাকে দেখাতে তুমি?”
সাধনা কান্না করছে। বিয়ের আগে আবেগ প্রবণ হয়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছে মুগ্ধর কথা শুনে। সেই ভুলের ফসল এখন সাধনার গর্ভে। মুগ্ধর কথা শুনে স্পন্দনের সাথে মিশেছে সে। এতটাই অন্ধ হয়ে গেছিলো নিজের ভালো বুঝতে পারে নাই সাধনা।
—” তোমার সাথে স্পন্দনের কি শত্রুতা বলবে আমায়?”
—” ওর সাথে শত্রুতা হাহাহাহা। ও নিজেই আমার সাথে এমন সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। সামনে থেকে ওকে যত ভালো দেখা যায় তত ভালো স্পন্দন না। ওর মনের ভিতরের কথা কেউ জানে না। ও যে গেম আমার সাথে খেলেছে তার সাথেও আমি একই গেম খেলবো।”
—” আমার বোনের কিছু করো না তুমি প্লিজ।”
—” তোমার বোনের কিছু হবে না। খারাপ হতে পারি কিন্তু এতটা খারাপ না। নিজের যত্ন নিও আরেকবার পালানোর চেষ্টা করলে আগের বারের মতো বেঁধে রাখবো। রাগ উঠলে আমি সন্তান বউ কিচ্ছু বুঝি না ওকে।”
সাধনা মাথা দিয়ে বুঝাল সে বুঝতে পেরেছে আর পালানোর চেষ্টা করবে না।
।।
।।
।।
স্পন্দন এখন সুস্থ্য আছে। শুভ্রতা স্পন্দনের কাছে গিয়ে বসলো। তিন ঘণ্টায় শুভ্রতার মুখ অনেকটা বিষন্ন লাগছে। কেঁদে কেঁদে চোখ দুটি ফুলিয়ে ফেলেছে……
—” কান্না করে তো মুখ নষ্ট করে ফেলেছ। পেত্নী পেত্নী লাগছে।”
—” আপনি সিগারেট খেতেন?”
—” পার্সোনাল ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছুক না আমি।”
—” আমিও তো এখন পার্সোনাল লোক আপনার। লুকানোর কি দরকার আমার কাছ থেকে। না-কি আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন?”
—” এই স্পন্দন কারো জন্য কিছু করে না যা করে নিজের জন্যই করে। সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর তাই ছেড়ে দিয়েছি এইখানে এত প্রশ্ন করার কি আছে?”
—” শরীর কেমন লাগছে এখন?”
—” হুম ভালোই।”
—” এইগুলো নিন।”
অনেকগুলো চকোলেট স্পন্দনের সামনে রাখলো শুভ্রতা। এত গুলো চকোলেট দেখে স্পন্দন বললো….
—” আমার জানা মতে আমার কোনো বাচ্চা কাচ্চা নেই তাহলে চকোলেট নিয়ে কি করবো আমি?”
শুভ্রতা হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না। স্পন্দনের এমন কথা শুনে তার প্রতিক্রিয়া কি হওয়া উচিত বুঝতে না পেরে নিজের চুল নিজেই টানছে…..
—” এইখানে চুল টানাটানির কি আছে?”
—” বলছি যখন সিগারেটের নেশা ধরবে তখন চকোলেট খাবেন দেখবেন আর অস্বস্তি হবে না। আমার আব্বুও এক সময় প্রচুর সিগারেট খেতো একবার আব্বুর সিগারেট খাওয়া বন্ধ করার জন্য আমিও একটা সিগারেট আব্বুকে দেখিয়ে খেয়ে ছিলাম সেই পর থেকে আব্বু আর সিগারেট খায় না। তখন দেখেছি যখনি আব্বুর নেশা ধর-তো তখন চকোলেট খেতো। এখন আর সিগারেট খায় না আব্বু আর নেশাও ধরে না। সিগারেটের ধোঁয়ায় এখন তার বমি আসে।”
—” হাহাহা কি ব্রিলিয়ান্ট মেয়ে রে বাবা। ওকে দেও দেখি পারি কি-না?”
সেদিন রাতে তারা বাসায় চলে যায়। রাত ভালো ভাবেই চলে যায়। পরের দিন সকালে…….
চলবে…….
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।