#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_৯
মহিলাটি শুভ্রতাকে এক ধরনের পোশাক দিলো। তাতের বুনা শাড়ি আর অদ্ভুদ ধরনের ব্লাউজ। হাতাগুলো গলার কাছ থেকে লাভের মত উপরে কাপড় দিয়ে বেঁধে দেওয়া। শুভ্রতা মাতাল অবস্থায় এই রকম ব্লাউজ দেখে হাসতে থাকে। স্পন্দন মুখ চেপে ধরে রাখে কিন্তু শুভ্রতার হাসি থামছে না এক পর্যায় এসে কামড় দিয়ে দেয় স্পন্দনের হাতে……
—” আহ্……!”
স্পন্দনের চিৎকার শুনে শুভ্রতা হাত তালি দিতে লাগলো……
—” কি মজা কি মজা স্যার ব্যাথা পেয়েছে। আমি স্যারকে কামড় দিয়েছি।।”
স্পন্দন ভদ্র মহিলাটির সামনে কিছু বলতে পারছে না। রাগে তার পুরো শরীর আগুন জ্বলছে। শুভ্রতার বাচ্চামো দেখে ভদ্র মহিলা হাসতে হাসতে বললেন,,,,,,
—” বাজান তোমার বউ দেখতাছি অনেক দুষ্টু। তোমার জীবন ত্যানা ত্যানা করে দিতাছে মনে হয়।”
মহিলাটির কথা শুনে স্পন্দন হাসলো। স্পন্দনের হাসি দেখে মহিলাটি আবারো বললো…..
—” বউরে খুব ভালোবাসো তাই না? জানো বাজান, তোমার চাচাও আমারে খুব ভালোবেসে। আমার পোলাপান হইবো না ডাক্তার স্যার কইছে তবুও তিনি আমারে ছাইরা যায় নাই। মাইনসে কিছু কইলে কইবো, আমার বাচ্চা লাগতো না । ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকলেই হইবো। মরার আগ পর্যন্ত তার হাঁসি মুখটা দেইখ্যা মরতে পারলেই আমি খুশি।”
ভদ্র মহিলার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কিন্তু মুখে আনন্দের হাঁসি। একটা ছোট মেয়ে আসলো বয়স ছয় বা সাত হবে……
—-” নানী এনারা কারা? আমাগো কোনো আত্মীয়?”
—” হো বইন এরা হইলো তোর আম্মা আর আব্বা। তোর না অনেকদিনের শখ আছিন তোর আব্বা আম্মারে দেখবি আজ দেইখ্যা লো বইন।”
ভদ্র মহিলার কথা শুনে স্পন্দন অবাক হলো। স্পন্দনের মনে বার বার প্রশ্ন আসছে……
—” এইখানে এসে কি ভুল করলাম?”
স্পন্দনের ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ভদ্র মহিলা বললেন…..
—” বাজান আমি খুব দুঃখিত। আমার কথায় তুমি অবাক হচ্ছো। আসলে কি হয়েছে জানো বাজান, আমাগো কোনো পোলা মাইয়া না থাকায় অনেকে অনেক কথা কইছে। তোমার চাচা কারো কথায় পাত্তা দিতো না। কয়েক বছর আগে কই থেইক্যা যেনো মধুলতারে আইন্যা কইতাছে,,,, দেহো আমাগো তো পোলা মাইয়া নাই তাই আল্লাহ তায়ালা আমাগো একটা নাতনী পাঠাইছে। আঠারো গ্রামে কাম করতে গেছিলাম তখন দেখি রাস্তায় কান্নাতাছে তাই লইয়া আইলাম। বুঝ হইবার পর থেইখ্যা খালি আব্বা আম্মা করে তাই কইলাম তোমরা ওর আব্বা আম্মা। মাইয়াটার একটা শখ পূরণ করতাছি বুঝছো বাজান?”
ভদ্র মহিলার কথা শুনে স্পন্দন বাচ্চা মেয়েটার দিকে তাকালো। গায়ের রং শ্যামলা। চোখ দুটি বড় বড় কিন্তু মায়াবী। দুই বেনুনি করে রেখেছে চুলে। এই শীতে মেয়েটির গায়ে পাতলা জামা।
—-” মধুলতা তুই শীতে এমন খাড়াইয়া আছস কেন? কাঁথা গায়ে দিয়া আয়।”
—” চাচী ওর শীতের পোশাক নেই?”
—” আমাগো আর শীতের পোশাক! তোমার চাচার শরীর বেশি ভালা থাহে না। একদিন কাম করলে পাঁচদিন বইয়া থাহে। একটা দিন যে টেহা পায় ওই টেহা দিয়েই কোনো রহম খাইয়া বাইচ্চা আছি। শীতের ফিরান কই পামু।”
স্পন্দন সহজে কান্না করে না। কিন্তু ভদ্র মহিলার কথা শুনে তার চোখ দুটি বারবার ভিজে যাচ্ছে। অনেক কষ্ট করে তারা চলে তবুও এই বাচ্চাটির লালন পালন করছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা মানুষকে দিতে চায় না হাত কাপে কিন্তু যাদের নেই তারা তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী দিতে চায়। মানুষ ঠিকই বলে, যার টাকা পয়সা আছে তার বড় মন নেই কিন্তু যার টাকা নাই তার বড় মন আছে। (কথাটা সবার জন্য না যারা এমন করে তাদের বলা হচ্ছে)…..
—-” চাচী আপনি যেহেতু আমাকে ছেলে ভেবেছেন তাই আমিও ছেলের কিছু কর্তব্য করতে চাই। প্লিজ না করবেন না।”
—” কি করতে চাও বাজান?”
—” আজ থেকে আপনার, চাচার ও মধুলতার সব দায়িত্ব আমার। আপনাদের যা যা প্রয়োজন সব কিছু আমি দিবো।”
ভদ্র মহিলার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। চিৎকার করে বলতে লাগলেন……
—-” ওগো শুনছো দেহো বাজান আমার কি কইতাছে। আইজ থিকা নাকি বাজান আমাগো দায়িত্ব নিবো।”
বৃদ্ধ লোকটি লাঠি ভর দিয়ে শীতে কাপতে কাপতে এসে স্পন্দনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। স্পন্দনও ভদ্র লোকটিকে জড়িয়ে ধরলো। শুভ্রতার এইসব দিকে কোনো হুস নাই ও ওর মত শাড়ি আর ব্লাউজ দেখতে ব্যাস্ত। ব্লাউজ দেখে একবার হাসে আবার রাখে।
—-” আব্বা আম্মা এমন করতাছে কেন? কি হইছে আম্মার?”
স্পন্দন মধুলতার কথা শুনে তাকালো শুভ্রতার দিকে। শুভ্রতার হাব ভাব দেখে তারও খুব হাসি পাচ্ছে। নিজের হাসি কন্ট্রোল রেখে সবাইকে বললো……
—-” চাচী আজ যা যা আছে সব রান্না করেন তো সবাই একসাথে খাবো। আগামীকাল থেকে আপনাদের খাবার,বস্ত্র, শখ , মধুর পড়াশোনার সব দায়িত্ব আমার। আজকের পর থেকে আর না খেয়ে থাকবেন না।”
স্পন্দনের কথা শুনে ভদ্র মহিলা মধুকে বললেন…..
—-” আয় তাড়াতাড়ি ওগো লাইগ্গা কিছু রান্না করি। তুমি আসো আগুনের পারে বসলে শরীর গরম হইবো।”
তিনজন বের হওয়ার পর স্পন্দন ঘরের ঝাঁপ দিয়ে শুভ্রতার দিকে ছোট চোখে তাকালো…..
—-” তোমাকে এই শাড়িতে দেখতে খুব ইচ্ছা করছে। তাড়াতাড়ি পরো শাড়ি।”
শুভ্রতা হাসতে হাসতে শাড়ি কোমরে গুজে দিচ্ছে কিন্তু পারছে না। স্পন্দন রাজ্যর বিরক্তি নিয়ে শুভ্রতাকে টেনে আনলো…..
—-” মাতাল হয়ে শাড়ি পড়তে পারবে না দেও পড়িয়ে দেই।”
স্পন্দন শাড়ি পড়াতে নিয়ে আবার ঘাবড়ে গিয়ে শুভ্রতাকে বললো….
—” ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে নাও আমি শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছি।”
মাতাল হয়েও শুভ্রতা স্পন্দনের দিকে তাকালো। শুভ্রতার তাকানো দেখে স্পন্দন বুঝলো……
—-” মাতাল হলে কি আছে তালে একদম ঠিক। জাতে মাতাল তালে ঠিক। যাচ্ছি আমি এইগুলো পরে ডাক দিও।”
স্পন্দনের কথায় মাতাল শুভ্রতা দাঁত বের করে হাসলো। স্পন্দন তখন বললো…..
—” তোমাকে রোজ মাতাল করার দরকার। এই দাঁত কেলিয়ে হাসাটা সত্যিই খুব কিউট ছিল।”
শুভ্রতা মুখ ভেংচি কেটে ঝাঁপ আটকালো……
পাঁচ মিনিট পর ঝাঁপ খুললো। স্পন্দন বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল। ঝাঁপ খুলা দেখে ঘরে ঢুকতেই চমকে গেলো সে। এ কাকে দেখছে সে? শুভ্রতাকে দেখতে একদম মণিপুরী মেয়েদের মতো লাগছে।
—” শাড়ি আর পড়তে হবে না। এইভাবে ভালো লাগছে মাতাল শুভ্রতাকে।”
—” আমি শাড়ির আঁচল পাচ্ছি না কেনো? শাড়ির ডান,বাম, সোজা কিছুই বুঝতে পারছি না। সব উল্টো লাগছে কেনো?”
স্পন্দন নিজের কপালে কয়েকটি থাপ্পড় মেরে একটানে নিজের বুকের কাছে মিশালো শুভ্রতাকে। শুভ্রতার ঘন নিঃশ্বাস স্পন্দনের গলার কাছে এসে পড়ছে।
স্পন্দন খুব ভালোই শাড়ি পড়াতে পারে। ছোট বেলায় সন্ধ্যাকে ও শাড়ি পরিয়ে দিতো। সন্ধ্যা ছোট থেকেই ভাই বলতে অজ্ঞান ছিলো। তার সব বায়না সব ভাইয়ের কাছে।
ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে শাড়ি পড়াতে লাগলো। শাড়ি পড়ানোর পর শুভ্রতার দিকে তাকালো একদম অন্য রকম লাগছে তাকে। স্পন্দন এক প্রকার ঘোরে চলে যাচ্ছে শুভ্রতাকে দেখে। নিজেকে কন্ট্রোল রাখতে না পেরে শুভ্রতার কপালে ঠোঁট ছুয়ে দিয়ে গালের কাছে আসলো। শুভ্রতা তখন ঘোরের মধ্যেই বলল…..
—-” স্যার, আমায় আদর করছেন?”
স্পন্দন বুঝতে পেরে শুভ্রতাকে ছেড়ে দিলো। কোলে নিয়ে চকির উপরে শুয়ে দিলো। পাতলা একটা কাঁথা শুভ্রতার শরীরে দিলো। শুভ্রতা কাপছে দেখে তার গায়ে থাকা জ্যাকেট শুভ্রতাকে পড়িয়ে দিলো……
—” আমি আসি তুমি ঘুমাও।”
স্পন্দন বাহিরে আসতেই ঠান্ডা বাতাস বইয়ে গেলো তার শরীরে। কিছুটা দূরে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলো নেটওয়ার্ক এসেছে। ফোনে তার ম্যানেজারকে ফোন দিয়ে লিস্ট করতে বললো স্পন্দন। একে একে অনেক কিছু বললো…..
—-” আগামীকাল সকালে সব কিছু যেনো দেখতে পাই।”
—” ওকে স্যার।”
কথা বলা শেষে মধুর কাছে গিয়ে বসলো। বনের উপরে বসে আগুনের চারপাশে হাত দিয়ে গরম তাপ নিতে লাগলো…..
—-” আব্বা তোমরা কি এইভাবে শীত কমাও?”
—” নাহ মামুনি। আমরা শীতের পোশাক পড়ি। বাসায় রুম হিটার দিয়ে রুম গরম রাখি।”
—” আব্বা রুম কি? হিটলার কি?”
স্পন্দন মধুর কথা শুনে হাসলো। মধুকে নিজের কাছে এনে সুন্দর ভাবে বললো….
—” রুম মানে ঘর। আর ওইটা হিটলার না হিটার হবে। হিটার একটি ইলেকট্রনিক যন্ত্র। বিদ্যুতের সাহায্য রুম বা ঘর গরম করে। ”
—” কি মজা।”
হাত তালি দিলো মধু। ভদ্র মহিলার রান্না শেষ। আলু ভর্তা, কচু শাক রান্না করেছে। স্টিলের প্লেটে খাবার বেড়ে বললেন….
—” বাজান এই নেও খাও। আর বউমারে নিয়া আইতাছি আমি।”
—” চাচী ওকে আমি খাইয়ে দিবো। আপনারা বরং খেয়ে নিন।”
—” আমরা তো অনেক আগে খাইয়া নিছি বাজান। আইচ্ছা বাজান তাইলে তুমি বৌমারে গিয়া খাওয়াও আমরাও শুইয়া পড়ি রাইত অনেক হইছে।”
—” কোথায় ঘুমাবেন চাচী?”
—” চিন্তা কইরো না বাজান আমাগো আরেকটা ঘর আছে। ওইটায় আমরা ঘুমাইতে পারুম তুমি যাও।”
স্পন্দন লক্ষী ছেলের মত এক প্লেট নিয়ে আসলো। আরেক প্লেট মধুকে দিয়ে আসলো। ছোট বাচ্চাদের ঘন ঘন ক্ষুধা লাগে বড় মানুষের থেকে। খাবার এনে ঘরের ঝাঁপ বন্ধ করে শুভ্রতাকে উঠিয়ে ঘরের কোনায় বসিয়ে লোকমা তোলে খাওয়াতে লাগলো। শুভ্রতা নাক মুখ কুঁচকে খেতে লাগলো…..
—” এইভাবে খাচ্ছো কেনো? ভালো হয় নাই?”
—” অসম্ভব ভালো হয়েছে কিন্তু আমার কেমন যেন লাগছে। ”
—” ওকে আর খেতে হবে না। ঘুমাও।”
শুভ্রতা বাচ্চা মেয়ের মতো হাঁটু ভাঁজ করে শুয়ে পরলো। স্পন্দন খাবার খেয়ে শুভ্রতাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো। জড়িয়ে ধরার প্রধান কারণ শীত নিবারণ করা।
🌄🌄🌄
পরেরদিন সকালে শুভ্রতা চোখ মেলে তাকিয়ে স্পন্দনকে এইভাবে এত কাছে দেখে চমকে যায়। উঠতে নিলে স্পন্দন ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলে…..
—” খবরদার উঠবে না । উঠলেই আমার শীত লাগবে। এইজন্যই বলি সিঙ্গেল ছেলে মেয়েরা কেনো বিয়ে করতে চায় শীতে? শীতে বিয়ে করার প্রধান কারণ শীত নিবারণ করা। এই শীতে এইভাবেই জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো। শুয়ে পড় আমার ঘুম হলে পরে উঠবে।”
বাধ্য মেয়ের মত আবারো চুপ করে শুয়ে রইলো। শুয়ে শুয়ে হাত দিয়ে পাখি বানাতে লাগলো……
—” বাচ্চা ওয়ালা মুরগির মতো নড়া চড়া করছো কেনো? চুপচাপ শুয়ে থাকো।”
এইবার শুভ্রতা স্পন্দনের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে লাগলো…..
—” এক বাটি ধান, এক প্লেট ভাত, তরকারি, পায়েস ,ফল, সবজি সব দিবো।”
—” মাতাল শুভ্রতার তাহলে নেশা কাটেনি এখনও?”
নিজের নামের আগে মাতাল উপাধি পেয়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়লো শুভ্রতা। রাজ্যর বিরক্তি নিয়ে স্পন্দন উঠে বসলো…….
—-” এই হরিণীর সাথে ঘুমানো একদম উচিত হয় নি আমার। সব সময় চটপট করে। মাঝে মাঝে মন চায় চটপটি বানিয়ে খেয়ে ফেলি।”
বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেঁসে বলল স্পন্দন…….
চলবে……
#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_১০
বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে হেঁসে বলল স্পন্দন। শুভ্রতাও ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো…..
—” স্যার, আপনি কিভাবে এত ভালো রেজাল্ট করলেন? মাথায় তো কিছুই নেই গোবর ছাড়া।”
স্পন্দন এই প্রথম শুভ্রতার কথায় লজ্জা বোধ করলো। আজ পর্যন্ত কেউ তার রেজাল্ট নিয়ে বাজে কথা বলেনি কিন্তু আজ শুভ্রতা বললো।
—” মাতাল অবস্থায় তোমাকে সাপ, বাঘ, সিংহের কাছ থেকে রক্ষা করেছি আর তুমি কি-না বাজে কথা বলছো। মানুষ ঠিকই বলে পরের উপকার করতে নেই। আর তোমার মতো মেয়ের তো কোনো ভাবেই উপকার করতে নেই।”
শুভ্রতা মাথা নিচু করে ছোট ছোট চোখে তাকালো স্পন্দনের উপর।
—-” ছিঃ স্যার ছিঃ আপনি কি মিথ্যাবাদী। আপনি কি ভেবেছিলেন আমি খেঁজুরের রস খেয়ে মাতাল হয়ে গেছি। স্যার আপনি জানেন না খেঁজুরের রস খেয়ে কেউ মাতাল হয় না। মাতাল হয় তালের রস খেয়ে।”
স্পন্দন এইবার বড় ধরনের শক খেলো। নিজেকে সামলিয়ে বললো…..
—-” তারমানে তুমি গতরাত নাটক করছিলে মাতাল হওয়ার?”
শুভ্রতা কোমরে হাত দিয়ে ভাব নিয়ে বললো…..
—” অফকোর্স। আপনি গতরাত যা যা করেছেন বা বলেছেন সব মনে আছে আমার। আপনার কুকীর্তি গুলো সব সহ্য করেছি তবুও বুঝতে দেইনি আমি যে নাটক করছি। ভাবছি ডিভোর্সের পর অভিনয় করবো। সবাই তখন আমায় হিরোইন হিসেবে চিনবে আহা।”
—” তারমানে গতরাতের সব কথাই শুনেছ তুমি?”
—” শুধু শুনিনি গতরাত কিস করেছেন,শাড়ি পরে দিয়েছেন সব জানি আমি। চাচা,চাচী ও মধুলতার কথা সব জানি।”
—” তাহলে তো আর কিছু বলার নাই। শুধু শুধু তোমার জন্য বাড়ি যেতে পারলাম না।”
স্পন্দন রাগ দেখিয়ে বলল শুভ্রতা হেঁসে হেঁসে বলল….
—” স্যার, দাঁত বের করে হাসি?”
স্পন্দন শুভ্রতার মুখ দেখে হেঁসে দিলো। সত্যিই মেয়েটা একটা বাচ্চা। কেউ বলবে এই মেয়ের বয়স ২৪। কেউ দেখলে বলবে ক্লাস টেনের ছাত্রী।
—” চলো চাচা,চাচী উঠার আগে আমরা কুয়াশায় পা ভিজিয়ে হাঁটি।”
—” বাহ কত্ত পরিবর্তন। হুম চলেন।”
গ্রাম এলাকায় কুয়াশা হয়তো বেশিই পড়ে। শহরে মানুষের কোলাহল, বিভিন্ন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি থাকায় সবুজ মাঠ, গাছ, নিরিবিলি জায়গা খুব কম সেই জন্যই হয়তো প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায় না। চারপাশে নিরবতা, সবুজ ঘাসের উপর শিশির বিন্দু জমে আছে। স্পন্দন ও শুভ্রতা শীত থাকা সত্বেও বিন্দুতে পা দিয়ে পা ভিজাচ্ছে। মোরগ ডাকছে, সকাল হয়েছে গ্রামের মানুষের বুঝানোর জন্য এই মোরগ ডাকার দৃশ্যটা একদম দেখার মতো। শহরের মানুষ ঘড়ি থেকে ঘুম থেকে উঠে। কিন্তু গ্রামের মানুষ মোরগ ডাকাত শব্দে ঘুম থেকে উঠে।
—-” আব্বা তোমরা এত সকালে উঠে পড়ছো?”
মধুর ডাক শুনে স্পন্দন ও শুভ্রতা মধুর দিকে তাকালো। পরনে পাতলা জামায় মেয়েটা শীতে থরথর করে কাঁপছে। শুভ্রতা তার গায়ে স্পন্দনের দেওয়া জ্যাকেট পড়িয়ে দিলো মধুকে। মধু আরাম পেয়ে শুভ্রতার দিকে তাকালো…….
—” আম্মা তোমার তো শীত করবো। আমার অভ্যাস আছে এমন থাকার তোমার তো অভ্যাস নাই। ধরো নেও এই আগুন ফিরান।”
—-” তোকে দিয়েছি তুই পড় এইটা। আর এত সকালে উঠলি কেনো?”
—-” আর কইয়ো না গরুর লগে ঘুমাইতে গিয়া রাইতে কেউ ঘুমাইতে পারলাম না। সারা রাইত তো খাড়াইয়া রইছি।”
স্পন্দন মধুর কথা শুনে বললো….
—” চাচী তো বললো উনাদের আরেকটি ঘর আছে? তাহলে গরুর সাথে ছিলে কেনো?”
—” আমাগো তো একটাই থাকার ঘর। আরেকটা ঘরে গরু, ছাগল, হাঁস,মুরগি থাকে। ছোট্ট ঘর ওই ঘরেই আছিলাম আমরা রাইতে।”
মধুর কথা শুনে স্পন্দন চোখ বন্ধ করে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেললো। চোখ খুলে দেখলো শুভ্রতা তার দিকে তাকিয়ে আছে।
—” ধন্যবাদ শুভ্রতা। আজ তোমার জন্য আমি বুঝতে পারলাম গরীব মানুষের কষ্ট। চিন্তা করো না এই গ্রামে আমি বাচ্চাদের জন্য স্কুল, মাদ্রাসা তৈরি করে দিবো। গরীবদের থাকার জায়গা করে দিবো। বিভিন্ন জমি কিনে সবাইকে চাষাবাদ করার জন্য দিবো। জমি থেকে যা ফসল পাবে নিজেদের অন্ন সেখান থেকেই জোগাড় করতে পারবে।”
স্পন্দনের কথায় শুভ্রতার মুখে আনন্দের হাঁসি ফুটলো। মনে মনে ভাবলো…..
—” এই মানুষটা কিভাবে ঠক, খারাপ মানুষ হবে। যার চিন্তা ভাবনা এত পবিত্র সে কিভাবে অন্য কারো ক্ষতি চাইবে? আচ্ছা সাধনা কি আমার সাথে খেলতে চাচ্ছে? কিন্তু সাধনা তো ওমন মেয়েই না। খুব ভালোবাসে ও আমাকে। তাহলে চোখের সামনে যা দেখি তা ভুল? সব ধোঁয়াশা লাগছে আমার কাছে।”
—” এই ম্যাম কি ভাবছেন চলুন।”
—” হুম চলেন।”
স্পন্দনের বলা জিনিস গুলো সব এসে পড়ছে। ঘরে জায়গা না থাকায় অন্যন্য লোকদেরও জিনিস ভাগাভাগি করে দেওয়া হলো। সারাদিন স্পন্দন ও শুভ্রতা গ্রামের মানুষদের খুঁজ খবর নিলো। মোট তারা ১৫০ টি দরিদ্র পরিবারের কথা জানলো। ১৫০ টি পরিবারের জন্য ভাগে ভাগে জমি, বড় টিনের ঘর তিন রুম করে, কল, বাথরুম ব্যাবস্থা করে দিলো। গ্রামের সব ছাত্র ছাত্রীর জন্য স্কুল, মাদ্রাসা ও কলেজ তৈরি করার ব্যাবস্থা করলো। স্পন্দনের কথা অনুযায়ী দু-একদিনের ভিতর মানুষজন কাজকর্মে লেগে যাবে যাবতীয় সব কাজ করার জন্য। স্পন্দন যেহেতু আগে থেকেই মানুষের পাশে থেকে এসেছে তাই তার এত সময় বা দলিল পত্রের দরকার হয় নাই। এলাকার মেম্বার, চেয়ারম্যান সবার সাথে দেখা করে ঠিক করে ফেললো। কল,বাথরুম,স্কুল,মাদ্রাসা, কলেজ, ঘর-বাড়ি, এই গুলো তৈরি করতে সময় লাগবে ততদিন একটু কষ্ট করে থাকার কথা বললো। খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে স্পন্দন।সবার সব সমস্যার সমাধান করে আরো সপ্তাহ খানেক থেকে শুভ্রতাকে নিয়ে বের হলো স্পন্দন……
—” আপনাকে খুব স্যালুট করতে ইচ্ছা করছে স্যার।”
শুভ্রতার কথা শুনে মাথা ঝাঁকিয়ে হাসলো স্পন্দন। এতদিন পর্যন্ত তাদের গাড়ি রাস্তায় থাকায় ওইখানকার পুলিশ থানায় রেখে দিয়েছে গাড়ি। স্পন্দনের কথা শুনে গাড়ি আবার ঠিক জায়গায় রেখে দিয়ে এসেছে। স্পন্দন গাড়িতে বসলো শুভ্রতা তার পাশের সিটে…..
—-” স্যার আপনি কি সত্যিই আমাকে ডিভোর্স দিবেন?”
—” এক বছর হলে বলতে পারবো। কেনো?”
—” নাহ আপনার কান্ড দেখে বা আমার সাথে যেভাবে বিহেভ করছেন তাতে মনে হচ্ছে আপনি আমাকে ভালোবাসেন।”
শুভ্রতার এমন কথায় হাড় কাঁপানো হাঁসি হাসলো স্পন্দন। শুভ্রতা ভয়ে চুপসে গিয়ে কাঁপা গলায় বলল……
—” হাসছেন কেনো স্যার? ভুল কিছু বলেছি?”
—” এই স্পন্দনের ভালোবাসা এতটা সস্তা না যে যাকে খুশি তাকেই দিয়ে দিবো। হ্যাঁ ঠিক আমি আপনার সাথে ভালো ব্যবহার করি। সম্মান দিয়ে কথা বলি, যখন যা চাচ্ছেন দেওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু এই বলে যে আপনাকে আমার ভালোবাসতে হবে তা কিন্তু নয়। আমি রাস্তার কুকুরটাও যদি অসুস্থ্য থাকে তাকে সেবা দেওয়ার জন্য আমি বিচলিত হয়ে যাই তাই বলে কি এখন আমি কুকুরকে ভালোবাসবো? আপনি আমার অফিসের ভালো একজন কর্মচারী আবার আপনার ছোট বোনের সাথে আমার বিয়ের কথা ছিল তার জন্য আপনাকে আমি সম্মানের চোখে দেখি হ্যাঁ এইটা ঠিক মাঝে মাঝে আমি নিজের প্রতি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলি আর স্বামীর অধিকার ফলিয়ে ফেলি। ”
স্পন্দন দম ছেড়ে আবার বললো…..
—-” সময়ের অপেক্ষা করুন। জানেনই তো সময় ও স্রোত কাহারো জন্য অপেক্ষা করে না। আমাদের জন্যও অপেক্ষা করবে না। এক বছর অতি অল্প সময় চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই হয়ে যাবে। এক বছর পর কি হয় তা আগে জেনে কি দরকার?”
স্পন্দনের কথায় শুভ্রতা আর কিছু বলল না। স্পন্দনের এই মানুষের প্রতি ভালোবাসা দেখে শুভ্রতার মনে স্পন্দনের জন্য আলাদা এক অনুভুতি সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু আজ স্পন্দনের কথায় সব অনুভুতি ভেঙ্গে গেছে। এখন মনে হচ্ছে মানুষের কাছে দাম,সম্মান, নাম,সুনাম পাওয়ার জন্যই স্পন্দন এমন করে……
🌿🌿🌿
—-” সন্ধ্যা তুই এখন আর আমাকে পছন্দ করিস না। ভালোও বাসিস না।”
—” তোমাকে তো খুব ভালোবাসি আমি আলভী ভাইয়া। তুমি তো আমার একটা মাত্র মামাতো ভাই জানো না? আমার তো আর কোনো মামাতো ভাই নাই।”
সন্ধ্যা বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। ছোট বেলায় এক দুর্ঘটনায় ওর মাথায় সমস্যা হয়। নিজের মতামত নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না সে। সহজেই যে কাউকে বিশ্বাস করে ফেলে। যে যা বলবে তাই করবে। মন থেকে যাকে একবার নিজের কেউ ভাববে তার কথা রাখার জন্য সব করতে পারে।
—-” তাহলে তোকে কিছুদিন আগে বলেছি আমায় এক লক্ষ টাকা দে কিন্তু আজও দিলি না।”
—” তোমাকে টাকা দেয় নি?”
—” নাহ।”
—” ওকে আব্বুকে বলে তোমাকে দিচ্ছি ।”
—” ওয়াও লাভ ইউ উম্মাহ।”
আলভী খুশি মনে চলে গেলো। আলভী সন্ধ্যার মামাতো ভাই ,লোভী টাইপের ও, এক লক্ষ্য টাকা কিছুদিন আগে সন্ধ্যার কাছ থেকে চাইছিলো সাথে সাথে পেয়েও গেছে। কিন্তু কম বুদ্ধি থাকায় সন্ধ্যার এইসব আর মনে থাকে না। যতবার টাকা চায় ততবার দিয়ে দেয়। সন্ধ্যা তার বাবাকে ফোন দিয়ে টাকা এনে দিয়ে দিলো আলভীকে। মেয়েকে কোনো কিছুতেই না করতে পারে না সন্ধ্যার বাবা। তাই কিছু জিজ্ঞাসা না করেই দিয়ে দিলো। সন্ধ্যা ফোনে গেম খেলছিল তখন তার ফোনে কল আসলো…..
—” সন্ধ্যাতারা তুই সব ভুলে গেছিস ?”
—” কি ভুলবো?”
—” বিয়ে বাড়ীতে সবার সামনে চড় মেরে তোকে অপমান করেছে তোর ভাই। তুই বারণ করা সত্বেও অফিসের কর্মচারীকে বিয়ে করেছে তোর ভাই আর তুই কি-না চুপ করে বসে আছিস। ছিঃ লজ্জা থাকা দরকার তোর।”
—” কি করবো আমি এখন?”
—” শুন যতো বেশি পারিস তোর ভাই আর ওই মেয়েকে আলাদা রাখতে। দেখ ওই মেয়ে তোর ভাইয়ের জীবনে আসার পর থেকে তোর খুঁজ নেয় না তোর ভাই। তুই তো তোর ভাইয়াকে খুব ভালোবাসিস তাই না?”
—” হুম খুব ভালোবাসি ভাইয়াকে।”
—” তাহলে আর বসে আছিস কেনো লেগে পর কাজে।”
—” কি করবো আমি?”
—” যা যা বলছি শোন।”
—” হুম।”
।।
।।
।।
স্পন্দন ও শুভ্রতা বাসায় যাওয়া মাত্রই স্পন্দন বিছানায় শুয়ে পড়লো। শুভ্রতা ফ্রেশ হয়ে শ্বশুড় শাশুড়ির কাছে গিয়ে বসলো। শাশুড়ি তার পান চিবুচ্ছে আর শ্বশুড় মশাই এখন ‘হুমায়ূন আহমেদ’ স্যারের ‘মৃন্ময়ী ‘ পড়তে ব্যাস্ত। সালাম দিয়ে তাদের পাশে বসলো শুভ্রতা।
—” মৃন্ময়ী চরিত্র আমার খুব ভালো লেগেছে। কিন্তু রহস্য শেষে উন্মোচন হলো না।”
শ্বশুড় মশাই হাসলেন। হেঁসে হেঁসে বললেন…..
—-” উপন্যাসের শেষে রহস্য থাকায় উপন্যাসটি পড়তে আরো মনোযোগ সৃষ্টি করে। তখন উপন্যাস নিয়ে ভাবতে শিখায়।”
—” হুম বাবা। আচ্ছা বাবা একটা প্রশ্ন করবো?”
—” হুম বলো?”
—” আপনার ছেলে আপনার কথা কেনো শুনতে পারে না? মনে হয় খুব রেগে আছে উনি আপনার প্রতি।”
শুভ্রতার এমন প্রশ্নে স্পন্দনের বাবা মা একে অন্যের দিকে তাকালো। তাদের ইশারা জনিত কথা শুভ্রতার চোখ এড়ায় নি। তবুও উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলো শ্বশুড় মশাইয়ের দিকে……
চলবে……
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।