সম্পর্কের মায়াজাল পর্ব-১৬

0
3516

#সম্পর্কের_মায়াজাল
#ফারজানা_আফরোজ
#পর্ব_১৬

—” সারারাত ঘুমান নি? চোখ ফুলে আছে। এইখানে বালিশ কেনো?”

শুভ্রতার কথায় উত্তর না দিয়ে স্পন্দন রুমের ভিতরে চলে গেলো। সন্ধ্যাকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে ওয়াশ রুমের ভিতর চলে গেলো। শুভ্রতা দরজার নিচ থেকে বালিশ আর কম্বল তুলে রুমের ভিতর নিয়ে গেলো।

সন্ধ্যাকে ঘুম থেকে না তুলে শশুর শাশুড়ির রুমের দিকে চলে গেলো।।

—” মা আসবো?”

মুখে পান দিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বললেন….

—” বাবা মায়ের কাছে আসলে কি অনুমতি নিতে হয়? পাগলী মেয়ে একটা।”

গতকাল শাশুড়ির কথার সাথে আজকের শাশুড়ির কথার কোনো মিল পেলো না শুভ্রতা। গতকাল কত কথাই না বলেছেন তিনি কিন্তু আজ মায়ের মতই কথা বলছেন।

—” মা আপনি এত সকালে কিছু না খেয়ে পান খাচ্ছেন কেনো? শরীর খারাপ করবে তো?”

মিস্টার আজম চোখ থেকে চশমা খুলে রুমাল দিয়ে পরিষ্কার করলেন। চোখে আবারো চশমা পরে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বললেন…..

—” মা আর বলো না। তোমার শাশুড়ি সারাদিন খাবার,পানি ছাড়া থাকতে পারবেন কিন্তু এই অখাদ্য পান ছাড়া থাকতে পারবেন না। কি যে মধু পাইছে এই পানে কি জানি?”

—” তুমি কি হুম ? নিজে তো সারাদিন বই আর বই নিয়ে পরে থাকুন। সংসারের বলে একটা কথা আছে তাতো উনি ভুলেই গেছেন।”

—” তুমি কথায় কথায় আমার বইগুলোকে অপমান করো কেনো? আজব, অসভ্য মহিলা।”

—” তুমিও কেনো আমার পান নিয়ে কথা বলো? অসভ্য বইপোকা পুরুষ।”

—” মা বাবা থামুন আপনারা। এইভাবে ঝগড়া করলে কি পেট ভরবে? পান আর বই দুইটা দিয়েই পেট ভরবে না জাস্ট মন ভরবে। এখন আমি যেটা জানতে এসেছি, বাবা আর মা আপনাদের পছন্দের খাবারের নাম বলুন তো আমি নিজ হাতে রান্না করবো।”

—” আরেহ তোর রান্না করতে হবে না রান্নার মানুষ আছে। একটু পর তো আবার অফিসে যেতে হবে।”

শুভ্রতা শাশুড়ি মায়ের দিকে তাকালো। ছলছল চোখে বলল….

—” মা আপনি কি আমার রান্না খারাপ হবে ভাবছেন? আমি কিন্তু খুব ভালো রান্না পারি।”

—” আমি তোর রান্না খারাপ কেনো ভাবতে যাবো? তোকে বারণ করলাম সারাদিন যে কষ্ট করিস শরীরের তো বিশ্রাম চাই তাই না?”

—” মা প্লিজ আমি রান্না করবো প্লিজ প্লিজ প্লিজ।”

—” ওকে যা তোর পছন্দ অনুযায়ী রান্না কর। আর মনে রাখিস তোর শশুর মসলা,তেল এইসব কম খায়। ওর জন্য কম মসলা দিয়ে আলাদা কিছু রান্না করিস।”

শুভ্রতাকে আর বারণ করলেন না মিসেস সাবিনা। শুভ্রতা এমন একটি মেয়ে যার কথায় যাদু আছে। মুখে মায়া, কথায় যাদু কেউ শুভ্রতার কথা না রেখে পারবে না।

—” থ্যাঙ্কু থ্যাঙ্কু মা।”

খুশিতে শুভ্রতা শাশুড়ি মাকে জড়িয়ে ধরলো। মিস্টার আজম মুখ বাঁকা করে বললেন…..

—” একটা দিনও এই মহিলা আমাকে ভালো কিছু খেতে দিবে না। যা খাবে একাই খাবে আর আমাকে অখাদ্য সব খেতে দিবে। স্বার্থপর মহিলা একটা।”

শুভ্রতা তখন শশুর মশাইকে সান্তনা দিলে বলল…..

—” বাবা চিন্তা করবেন না আপনার জন্যও স্পেশাল কিছু রান্না করবো। এখন আসি পরে দেরি হয়ে যাবে।”

শুভ্রতা বেরিয়ে আসলো শশুর শাশুড়ি রুম থেকে। নিজের রুমে এসে দেখলো সন্ধ্যা নেই। স্পন্দনের দিকে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞাসা করলো…..

—” সন্ধ্যা কোথায়?”

—” ও চলে গেছে।”

—” চলে গেছে মানে?”

—” নিজের রুমে চলে গেছে। আমি আমার কাজ করছিলাম ওর নাকি ঘুমের সমস্যা হচ্ছে তাই চলে গিয়েছে। এত প্রশ্ন করছো কেনো?”

—” ওহ্। আচ্ছা আপনার পছন্দের একটা খাবারের নাম বলুন?”

—” আদেশ দিচ্ছ না-কি?”

—” আজব তো! আদেশ কেনো দিবো। আমি আপনার স্ত্রী এইটুকু জিজ্ঞাসা করতে পারি না?”

—” অনুরোধ করে বলতে শিখো পরে না হয় বলবো।”

—” ভাব দেখে আর বাঁচি না। এই যে মাননীয় উগান্ডার প্রেসিডেন্ট মিস্টার স্পন্দন স্যার,আপনার পছন্দের খাবারের নাম বলে উদ্ধার করবেন আমায় প্লিজ।”

—” তোমাকে তো খাবারের নাম বলবই না। ফাজিল মেয়ে একটা। ভদ্র ভাবে কথা বলতে পারো না। সব সময় তর্ক করেই যাবে আমার সাথে ওহহ সরি তর্ক না ঝগড়া হবে ওইটা।”

—” না বললে নাই। আজ উপবাস থাকুন তাহলে আপনি।”

—” উপবাস থাকবো কেনো? রান্না হবে না!”

–” হবে বাট আমি করবো রান্না।”

—” মুখে দেওয়া যাবে তো?”

—” এক্সকিউজ মি আপনি হয়তো আমার রান্নার ভিডিও দেখেন নি তাই জানেন না আমি কত ভালো রান্না পারি।”

—” রান্নার ভিডিও মানে? তুমি কি ইউ টিউব এ রান্নার ভিডিও আপলোড দেও?”

—” ইয়াহ। জানেন আমার চ্যানেলে কত কত সাবস্ক্রাইবার? মিলিয়ন হয়ে গেছে। হাজারে হাজারে লাইক।”

—” ওকে তাহলে তোমার পছন্দ অনুযায়ী আমার জন্য কিছু রান্না করো।”

—” ওকে। পরে কিন্তু বাজে কথা বলবেন না।”

—” আমি কিন্তু অতটা খারাপ ছেলে না যে, বউয়ের রান্না খারাপ বলবো।”

—” গুড।”

শুভ্রতা যেতে নিলে স্পন্দন পিছন ডাকে…..

—” শুভ্রতা…..!”

শুভ্রতা ঘুরে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল…..

—-” কিছু বলবেন?”

—” মিস্টার ফায়াজের সাথে কি সত্যিই কথা হয়েছে তোমার?”

শুভ্রতা স্পন্দনের কথায় এক গাল হেসে দিয়ে বলল…..

—” আপনি যেহেতু আজ আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলেছেন তাই সত্যি বলছি, উহু উনার সাথে কোনো কথা হয় নাই আমার। মিথ্যা বলেছি আপনার সাথে সরি।”

—” ওকে আজ মিথ্যা বলার জন্য ক্ষমা করলাম। পরের বার কিন্তু ক্ষমা নাই। বাই দা ওয়ে মধুলতা আর চাচা চাচিদের সাথে একটু আগে কথা হয়েছিল আমার। মধু তো খুব খুশি ও নাকি এখন পেট ভরে খেতে পারে। ওর এখন না-কি বেশি শীত করে না। ওর শরীরে এখন না-কি আগুন পোশাক। খুব খুশি মেয়েটি জানো। এলাকার ঘর-বাড়ি, স্কুল,কলেজ,মাদ্রাসা তৈরি হতে সময় লাগবে কিছু। ”

—” সত্যি আপনি কত ভাবছেন ওদের নিয়ে। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ স্যার আমাকে এমন একটি কাজে নেওয়ার জন্য।”

—” জানো মধু না-কি তোমার জন্য খেজুরের রস নিয়ে আসবে এইখানে।”

খেজুরের রসের কথা শুনে শুভ্রতা লজ্জা পেয়ে চলে যায়। ওইদিনের রাতের সব কথা মনে পড়লো তার। ইসসসসসস কি লজ্জা…..

শুভ্রতা সবার জন্য অনেক কিছু রান্না করেছে। সন্ধ্যার জন্য বানিয়েছে স্পেশাল এক রান্না। ডিম,আলু,টমেটো ও আটা দিয়ে রোল।

সবাই যখন খাবার খাচ্ছি-লো সবাই শুভ্রতার রান্নার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। স্পন্দন তো খাবার ছেড়ে উঠার নামেই করছে না। শশুর মশাই তো তৃপ্তি করে খেয়েই যাচ্ছেন। শাশুড়ি মা তখন বললেন…..

—” এত খেও না শরীর খারাপ করবে?”

মিস্টার আজম চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ নিয়ে বললেন…..

—” আমার খাবারের দিকে নজর না দিলে কি তোমার খাবার হজম হবে না? তুমি খাচ্ছ কিছু কি বলেছি আমি? রাক্ষসীর মতো তো সব খাচ্ছ এমন কি প্লেট, হাতের আঙ্গুল সব চেটে চেটে খেয়ে ফেলছো কিছু তো বলছি না আমি তাহলে আমার খাবার নিয়ে এত মাথা ব্যাথা কেনো তোমার? এতদিন তো ছাই পাস খেয়ে যাচ্ছি আজ এত মজার খাবার খাচ্ছি তাই একটু বেশিই খাচ্ছি তবুও সমস্যা তোমার।”

—” বাবা গো বাবা একটা কথা বলেছি আর উনি হাজারটা উত্তর দিয়ে দিলেন। সরি আর বলবো না প্লিজ খাও তুমি।”

শুভ্রতা মুখে হাত দিয়ে হাসছে। ওর খুব ভালোই লাগে শশুর শাশুড়ির এই খুনসুটি দেখতে। সন্ধ্যা রোল খাচ্ছে আর বলছে….

—” ইয়াম্মী ইয়াম্মী হয়েছে ভাবী। খুব মজা কিভাবে বানিয়ে-ছো এই রোল বলবে?”

—“হুম কেনো বলবো না? প্রথমে ডিম ও আলু সিদ্ধ করে আলু কাটার মেশিন দিয়ে কুচি কুচি করে তাতে লবণ,গরম মসলা,জিরা গুঁড়া,লাল মরিচের গুঁড়া,সামান্য হলুদ, ধনেপাতা,টমেটো কুচি, কাচা মরিচ কুচি, পেঁয়াজ কুচি, চাট মসলা দিয়ে হাতে সব মিশিয়ে পুর বানাতে হবে। অন্য একটি পাত্রে আটা নিয়ে তাতে সামান্য লবণ, খাবার তেল দিয়ে মিশাতে হবে পরে অল্প অল্প পানি দিয়ে রুটি বানানোর খামি বানাতে হবে। বিশ মিনিট খামি-টা রেস্টে রেখে পাতলা ও বড় করে রুটি বানাতে হবে। পরে রুটির উপর পুর দিয়ে রোলের মতো ভাঁজ করে চিকন করে লম্বা করতে হবে। অনেক বড় হবে রোল তখন তিন টুকরো করে কেটে নিতে হবে। অন্য একটি পাত্রে আটা, স্বাদ মত লবণ ও মরিচের গুড়ো নিয়ে পেস্ট তৈরি করতে হবে যেনো বেশি পাতলা না হয়। রোল গুলো আটার পেস্টে চুবিয়ে তেলে ভাজতে হবে। সস দিয়ে পরিবেশন করতে হবে এই রোল।”

স্পন্দন শুভ্রতার কথা শুনে সন্ধ্যার কাছ থেকে কেড়ে নিলো একটি রোল। সস দিয়ে রোল খেতে খেতে বলল….

—” আম্মু আজকের পর থেকে রান্নার কাজ শুভ্রতা করুক। ভাবছি শুভ্রতাকে একটা রেস্টুরেন্ট খুলে দিবো। আমরা খেতে পারলাম সাথে অন্যরাও। এতে ইনকামও হবে।”

শুভ্রতা স্পন্দনের দিকে তাকিয়ে বললো…..

—” আমার কত গুণ দেখেছেন। শুনুন, এত প্রশংসা করবেন না পরে হাতে নজর লাগবে। পেটুক মানুষ আপনি তাই খেতে থাকুন। ভেবে চিন্তে খাবেন পরে যেনো বাথরুমে দৌড়াদৌড়ি করতে না হয়।”

শশুর শাশুড়ি সবাই হাসতে লাগলেন শুভ্রতার কথায়। স্পন্দন কিছু না বলে খেয়েই যাচ্ছে।

।।

।।

।।

মুগ্ধ আজ সাধনার জন্য হলুদ শাড়ি কিনে এনেছে। হলুদ শাড়ি,হলুদ চুড়ি, গাজরা সাধনার হাতে দিয়ে বললো….

—” আজ ঘুরতে যাবো। আমি বাহিরে অপেক্ষা করছি।”

মুগ্ধ বাহিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা! শব্দটি কত ছোট কিন্তু যারা বা যে এই অপেক্ষা শব্দের সাথে চির পরিচিত তারা জানে অপেক্ষার প্রহর কতটা জটিল। মাত্র কয়েকটা শব্দের তর সইছে না মুগ্ধর। মুগ্ধকে দেখে মনে হচ্ছে কত বছর ধরে সে অপেক্ষা করছে সাধনার জন্য। সাধনাকে দেখার জন্য সে আর অপেক্ষা করতে পারছে না। নিজেকে সামলিয়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে সে……

—-” শুনছো,”

মুগ্ধ চোখ বন্ধ করে আছে। সাধনাকে দেখার সাহস পাচ্ছে না সে। সাধনা মুগ্ধর সামনে গিয়ে দাঁড়ালো……

—” কি হলো চোখ খুল-ছো না কেনো?”

—” পরী কে দেখার জন্য আরেকটু ওয়েট করছি।”

—” পরী টা কে?”

—” আমার সামনে দাঁড়িয়ে যে কথা বলছে।”

—” হলুদ ড্রেসে তুমি আমায় আরো একবার দেখেছিলে মনে আছে?”

—” সেই জন্যই তো আরেকটু অপেক্ষা করছি। আমার হলুদিয়া পাখিটাকে দেখতে একটু ধৈর্য ধরছি।”

—” আমি এতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবো?”

মুগ্ধ চোখ খুলে সাধনাকে দেখে দু’বার চোখের পাতা ফেলল।

হলুদিয়া পাখি, সোনারই বরণ
পাখিটি ছাড়িল কে
পাখিটি ছাড়িল কে রে আমার
পাখিটি ছাড়িল কে।

মুগ্ধর গান শুনে সাধনা বলল….

—” পাখিটাকে ছেড়েছে বলেই তো পাখিটা তার ভালোবাসার মানুষের সাথে থাকতে পারছে। ধন্যবাদ দেওয়া উচিত না যে পাখিটাকে ছেড়েছে।”

—” হাহাহা ঠিক তো। চলো আমরা কোথায় ঘুরতে যাই। এই সময় একটু আক-টু প্রকৃতির সাথে দেখা করা উচিৎ।”

—-” হুম চলো।”

চলবে……