সম্রাজ্ঞী পর্ব-১৬+১৭

0
224

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_16

আজ ইদ। বিশ্বব্যাপী উৎযাপিত হবে ইদ-উল-ফিতর। রামান সাম্রাজ্যের অলি-গলিতে উড়ছে কালেমার পতাকা। জনম দুখীনির মাঝেও যেন আনন্দ বয়ে আনে এই দিনটি। সকাল হতেই বাচ্চারা নতুন সাজে সাজবে বলে হৈ-চৈ শুরু করে দিয়েছে। পুরুষরা গোসল সেরে প্রস্তুতি নিচ্ছে নামাজে যাবার। নারীদের সে কতো কাজ। রান্নাবান্না সেরে তবে না গোসল! সেমাই রান্না হচ্ছে ঘরে ঘরে। মহলের রন্ধনশালার ভিড় আজ দেখার মতো। হরেক রকমের পদ রান্না করতে গিয়ে নিঃশ্বাস নেবার সময়টাও বোধহয় পাচ্ছে না রাঁধুনিরা। ফাইজা রাগে কিড়মিড় করছে। কোথায় একটু সেজেগুজে ঘুরবে তা না কাজ করতে হচ্ছে। মহলের মানুষদের চিত্র অবশ্য অন্যদের থেকে ভিন্ন। পুরুষরা গোসলে যেতে না যেতেই নারীরা নতুন পোশাক পড়ে তৈরি হয়ে যায়। তাদের আর কীসের কাজ? শেহজাদি তানহা ও শেহজাদি মাইরা দু’জনেই আজ সফেদ রঙা গাউন পরিধান করেছে। মহলের এদিক-ওদিক ঘুরছে তারা নিজেদের মতো করে।

আজমাইন মাহতাব নিজের পোশাক পড়ে নিয়ে আগেই প্রস্তুত হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে মাথায় পাগড়ি জড়িয়ে ছুটে এসেছে সুলতানের কামরায়। তবে কামরা বন্ধ থাকার কারনে দুয়েকবার কড়া নেড়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল সে। মহলের সেবিকারা ইতিমধ্যে তাকে দেখে ঠোঁট চেপে হাসাহাসি শুরু করে দিয়েছে। ইদের পোশাকের সাথে তলোয়ার! বড্ড বেমানান লাগছে তবুও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই মাহতাবের মাঝে। হাসলে তার কী? সৌন্দর্যের চেয়ে সুরক্ষা আগে। কিয়ৎ ক্ষণ বাদেই খুলে গেল দ্বার। দৃষ্টিগোচর হলো সুলতান শাহজাইনের সুন্দর মুখখানা। তাকে দেখতেই মাথা ঝুকিয়ে নিলো মাহতাব। মৃদুস্বরে হাসলের সুলতান। হাসিটা কেমন যেন লোক দেখানো লাগছে। মাহতাব ভ্রু কুচকে তাকাতেই সরে গেলেন সুলতান। মাথায় নতুন সবুজ রঙা পাগড়িটা পড়তে পড়তে বললেন, “কী ব্যাপার মাহতাব? ইদের দিনেও তলোয়ার? আজকের দিনটাই অন্তত ওকে একটু রেহাই দাও।”

“মাফ করবেন মহামান্য। আপনার এই কথাটা আমি রাখতে পারবো না। যোদ্ধাদের জীবনে প্রতিটা দিন, প্রতিটা স্থানই হয় যুদ্ধক্ষেত্র।”

শুনলেন সুলতান। তবে কিছু বললেন না উত্তরে। দেয়ালের সাথে লাগানো বিশাল দর্পণের সম্মুখে গিয়ে দাঁড়ালেন। সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে নজর বোলাতেই দেখতে পেল দর্পণের ঠিক পাশের বিশাল কাঠের টুলটার উপরে আতর, সুরমা সাজিয়ে রাখা। হতবাক হতে বাধ্য হলো সে। সকাল থেকে সে তো কামরায় কারোর আসার অনুমতি দেয়নি। নিজেও সরেনি কামরা থেকে। শুধুমাত্র গোসল করতে যতটুকু সময়। এতোটুকু সময়ের মধ্যে কার সাহস হলো অনুমতি ছাড়া সুলতানের কামরায় প্রবেশ করার। বিচক্ষণ মাহতাব ঠিকই উপলব্ধি করে নিলো সুলতানের এমন কঠিন মুখভঙ্গির কারন। সুলতানের দৃষ্টি যে এখনো আতর, সুরমার দিকেই সীমাবদ্ধ। মাহতাব রাগান্বিত হয়ে দ্বারের দিকে পা বাড়াতেই ডেকে উঠলেন সুলতান।

“কোথায় চললে?”

“দ্বারের বাইরে। পাহাড়ারত সৈনিকগুলোকে আজই বরখাস্ত করে দেবো। সুলতানের কামরায় অনুমতি ছাড়া যে কেউ চলে আসছে আর ওরা তলোয়ার হাতে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাছি মারছে।”

“ওদের উপর রাগারাগি করে লাভ নেই মাহতাব। কামরায় যে এসেছিল তাকে ওরা আটকাতে পারবে না। ওরা কেন? তুমিও পারবে না। স্বয়ং আমিও নই।”

অবাক হলো মাহতাব। আগ্রহী নয়নে কিছু শুধানোর পূর্বেই সুলতান সুরমা লাগাতে শুরু করলেন। একেবারে তৈরি হয়ে নিয়ে বাইরে যেতে ধরলেন তিনি। অথচ মাহতাব এখনো অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়েই আছে। কে এসেছিল কামরায়? যাকে স্বয়ং সুলতানও আটকাতে পারেন না! আবার সুলতান রাগও করলো না!

কারাগারের সৈনিকদের উপর চোটপাট করছে এলিজা সুলতান। সৈনিকগুলো কাচুমাচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ধমকে উঠলেন তিনি, “চাবি দাও।”

“মাফ করবেন সুলতানা। সুলতান ব্যতীত অন্যকারো হাতে কারাগারের চাবি হস্তান্তর নিষিদ্ধ করা হয়েছে।” মস্তক নুইয়ে জবাব দিলো সৈনিক।

এবার যেন আরো রেগে গেলেন তিনি। কটমট করে তাকিয়ে বললেন, “তারমানে চাবি দেবে না তুমি?”

“সুলতানের অনুমতি ছাড়া চাবি দেওয়া সম্ভব নয়। আপনি যদি সুলতানের থেকে অনুমতি নিয়ে আসতেন…….”

কথা আর সম্পূর্ণ করতে পারলো না সে। পূর্বেই চেঁচিয়ে উঠলেন এলিজা সুলতান। অতিরিক্ত রাগে গর্জে উঠে বলল, “যখন থেকে এসেছি শুধু সুলতান, সুলতান আর সুলতান। শান্তিতে একটু থাকার জো নাই। আশ্চর্য! তোমাদের সুলতানকে পরোয়া করি না কি আমি? চাবি দাও বলছি। নাহলে সকটার মাথা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেবো।”

অসহায় হলো সৈনিকের মুখভঙ্গি। অদূরে দৃষ্টি রেখে আমতা আমতা করে বলল, “কিন্তু সুলতান তো আপনার……..।”

“আবার সুলতানের নাম নিয়েছো। চাবি দিতে বলছি না? শোনো, ওসব সুলতান-টুলতান কাউকে ভয় পাই না আমি। চুপচাপ চাবি দাও আর গিয়ে তোমার সুলতানকে বলে দাও আমি চাবি নিয়েছি।” খানিক ভাব নিয়ে বলল এলিজা। এমন সময় তার পেছন থেকে ভেসে এলো গুরুগম্ভীর কন্ঠস্বর।

“সৈনিক, চাবি দিয়ে দাও ওনাকে।”

চমকে উঠলো এলিজা। সুলতানের কন্ঠ! তারমানে এতোক্ষন সে পেছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে! বেয়াদব সৈনিকটাকে শূলে চড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার। এতোক্ষন বলতে পারেনি যে সুলতান পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে কটকট করে তাকালো সৈনিকের দিকে। আহত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো সৈনিক। সে তো বারবার এটাই বলার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তাকে তো কিছু বলার সুযোগই দিলেন না সুলতানা। এখন আবার তার দিকে রাগী চোখে তাকাচ্ছে। অসহায় ভঙ্গিতে সে চাবি এগিয়ে দিতেই খপ করে নিয়ে নিলো এলিজা। রাগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বিড়বিড়িয়ে বলল, “ফাঁসিয়ে দিলি।”

অতঃপর হাঁটতে শুরু করলো উল্টো দিকে। ভুলক্রমেও তাকালো না সুলতানের দিকে। কখনো দেয়ালের দিকে তাকাচ্ছে তো কখনো মেঝেতে তাকাচ্ছে। বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠছে, “দেয়ালের রং চটে গেছে এগুলো কি চোখে দেখে না কেউ। আবার রং করতে হবে। সব ফাঁকিবাজ হয়েছে।”

তার ছলচাতুরি ঠিকই ধরে নিলেন সুলতান। পাশ কেটে যেতে নিলেই তার হাত চেপে ধরলো সুলতান। ভ্রু কুচকাল এলিজা। আবার হাত ধরছে কেন? কাল তো বড় ভাব ধরলো যেন একটু ছুলেই ঝলসে যাবে সে! সুলতান শক্ত কন্ঠে বলে উঠলেন, “ইদের পোশাক পরোনি কেন? কী সমস্যা?”

“এমনিই পরিনি।”

“আবার ত্যাড়া কথা বলছো?”

“এখন তো আমার কথা সহ্য হবে না। মনোরঞ্জনের জন্য দাসী আসছে যে মহলে। ছাড়ুন তো।”

সুলতান হতবুদ্ধির ন্যায় তাকালো তার কথাতে। অবাক হয়ে শুধাল, “মনোরঞ্জনের জন্য দাসী! সেটা আবার কবে আনা হলো এই মহলে? মিথ্যা কথা বলবে না একদম।”

“আমি মিথ্যা কথা বলছি? খবরদার উল্টো-পাল্টা অপবাদ দিবেন না আমাকে। আপনার আম্মাজান তার আদরের পুত্রের জীবনের দুঃখ ঘোচাতে দাসী আনবে শীঘ্রই। তখন নিজ চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিয়েন।”

“আমি আবার তোমাকে উল্টো-পাল্টা অপবাদ দিলাম কবে? আম্মা কী না কী বলেছে সেটার জন্য কি আমি দায়ী? আমার পিঠ পিছে তুমি এভাবে আমার নামে দূর্নাম করে বেড়াও!”

অসহায় ভঙ্গিতে তাকালো এলিজা। কন্ঠে একরাশ বিস্ময় নিয়ে বলল, “দূর্ণাম! তাও আপনার নামে! ছি ছি! আমি কখনো মুখেও আনতে পারি না।”

“আচ্ছা, তাই না কি? তাহলে একটু আগে সৈনিকদেরকে কী বলছিলে ওগুলো? সুনাম করছিলে বুঝি? আমার মান-সম্মান তুমিই শেষ করে দেবে কবে যেন।”

টেনে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো এলিজা। সৈনিকটাকে এখন কাঁচা চিবিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে তার। আমতা আমতা করে বলল, “ওটা তো এমনিই আর কী।”

হতাশার শ্বাস ফেললেন সুলতান। তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন, “থাক, বলতে হবে না। তোমাকে চিনি আমি। যাও পোশাক বদলে নাও। নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে আমার।”

“নামাজের সময় হচ্ছে আপনার, আমি কেন পোশাক বদলাতে যাবো? তাছাড়া এই পোশাকটা মোটেই খারাপ নয়। দেখি সরুন তো, যেতে দিন আমাকে।”

“এতো কথা বলো না। ইদের দিন নতুন পোশাক পড়তে হয়।” শান্ত কন্ঠ সুলতানের।

“কিন্তু আমার এখন পোশাক বদলাতে ইচ্ছা করছে না। আপনি নামাজে চলে যান মহামান্য সুলতান। আপনি না গেলে তো নামাজ শুরু করতে পারবে না বেচারা ইমাম।”

ধমকে উঠলেন সুলতান, “একদম চুপ। তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে এসো, যাও। আরেকবার বলা লাগলে এমন এক থাপ্পড় লাগাবো যে…….।”

“আবার মারবেন! কালকের মারের দাগ লুকাতে মুখে কত কিছু লাগাতে হয়েছে জানেন? রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়েছে মুখের সাথে। আরেকটু হলে মেয়ের সামনে ইজ্জত চলে যেত। আর আপনার আম্মা তো তৈরিই থাকে কথার তির নিয়ে। যদি বুঝতে পারতো যে আমাকে মেরেছেন তাহলে এতক্ষণে আপনার তৃতীয় বিবাহের ঘোষণা হয়ে যেত।”

“কিন্তু আমি তো এখনো দ্বিতীয় বিবাহ করিনি। তৃতীয় বিবাহের ঘোষণা কীভাবে হতো?”

“দ্বিতীয় বিবাহ করেননি তো কী হয়েছে? ঘোষণা তো দেওয়া হয়েছে। আমি না আসলে করেও নিতেন। জানি না আমি ভেবেছেন? হাজার হলেও পুরুষ মানুষ বলে কথা। এই এলিজা জীবিত থাকতে আপনার সেই স্বপ্ন কোনোদিন পূরণ হবে না বুঝেছেন। আপনার আম্মার মুখের কথার ছুড়ি কেন? ছুড়ির সাথে বিষ মিশিয়ে আমাকে খাইয়ে দিলেও আবার আত্মা হয়ে ফিরে আসবো আমি।”

মৃদুস্বরে হেসে উঠলেন সুলতান। আচমকা এগিয়ে এসে আকড়ে ধরলো তার মুখখানি। গালটাতে আঙুল ছুইয়ে দিয়ে আদুরে কন্ঠে শুধাল, “বেশি ব্যথা পেয়েছিলে?”

এতোক্ষন যেন এই সুযোগটাই খুঁজছিলেন এলিজা সুলতান। কথাটা বলতেই তেতে উঠলেন তিনি। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল, “নাহ, ব্যথা পাইনি। খুউব মজা লেগেছে। নিজের গালে একটা মেরে দেখুন। মেরে মেরে এখন আবার আদিখ্যেতা দেখানো হচ্ছে।”

হাত ছিটকে সরিয়ে দিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল সে। সেদিকে চেয়ে আনমনে হাসলেন সুলতান। বিড়বিড়িয়ে বললেন, “এর চেয়ে বেশিক্ষণ যে নিজের রাগ আমি ধরে রাখতে পারবো না তা তুমি আগেই জানতে এলি। ছলনা কেন তুমি যদি আমার বুকে আস্ত তলোয়ারটাও ঢুকিয়ে দাও তবুও তোমার সাতখুন মাফ আমার কাছে। তোমাকে দেখতে, তোমার সুঘ্রাণ পেতে দুটো বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে আমাকে আর আজ কি-না তোমাকে কাছে পেয়েও ভালো করে না দেখে নামাজে চলে যাবো! তা তো হবে না।”

সুলতানকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকেই আসছিল মাহতাব। হুট করে দূর থেকে সুলতানকে এভাবে একা একা হাসতে দেখে জানপরাণই অবাক হলো সে। হয়েছে টা কী আজ সুলতানের? তাকে দেখতেই হাসি মিলিয়ে গেল সুলতানের। পুনরায় গম্ভীর হয়ে উঠলো সে। তবে মনে মনে দৃঢ়ভাবে আফসোস করলো, কেন সে সুলতান হলো? চারদিকের এতো এতো পাহাড়া, সৈনিক, সেবক-সেবিকাদের ভিড়ে দু’দন্ড বেগমের সাথে কথাও বলা যায় না। নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতেও সতর্ক থাকতে হয়। সে তো সাধারণ কোনো মানুষও হতে পারতো। সাধারণ প্রজা হতে পারতো সে। ছোট্ট একটা ঘর থাকতো তাদের। হুট করে মনে পড়লো এলিজা তো শেহজাদি ছিলো। তার মতো সাধারণ প্রজার সাথে কিছুতেই বিবাহ দিতো না তাকে। এবার যেন নিজের সুলতান হওয়া নিয়ে সমস্ত আফসোস ঘুচে গেল তার। মাহতাব এসে অবাক কন্ঠে শুধাল, “আপনি এখানে কী করছেন মহামান্য? নামাজের সময় হয়ে যাচ্ছে ।”

হঠাৎ কন্ঠে ধ্যান ভঙ্গ হলো সুলতানের। এখানে কী করছে বলার মতো কোনো কারন না পেয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো, “ব্যক্তিগত কিছু কাজ ছিলো মাহতাব। তুমি যাও। একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি।”

বলেই সে উল্টো দিকে ঘুরে নিজের কামরার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। হতবাক মাহতাব তার ভাবভঙ্গির আগা-মাথা কিছুই ধরতে পারলো না। সে কি বেশি ভাবছে? না কি সুলতান কিছু লুকাচ্ছে তার থেকে?

নিজ কামরায় বেশ কিছুক্ষণ ধরে পায়চারি করছেন সুলতান। তবুও বেগমের আসার কোনো খোঁজ নেই। ওদিকে বারবার সৈনিকরা উচ্চ কন্ঠে সকলকে নামাজে দাড়াতে আহ্বান করছে। মেয়েটা কি তাকে জ্বালাতে চাইছে? না কি প্রতিশোধ নিচ্ছে গতকালের ব্যবহারের জন্য? আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করে সে বিরক্ত হয়ে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এলো। রাগে লাল হয়ে উঠেছে তার মুখশ্রী। ইচ্ছে তো করছে হাতের কাছে পেলে ঠাটিয়ে একটা লাগাতে। মাহতাবকে পেয়ে তাকে সাথে নিয়ে হনহন করে এগিয়ে গেল প্রধান দ্বারের দিকে। এমন সময় পেছন থেকে শুনতে পেল বেগমের কন্ঠস্বর।

“নড়ে না আম্মু। শান্ত হয়ে দাঁড়াও, তাজটা পড়িয়ে দি।”

সমস্ত রাগ ভুলে চকিতে ফিরে তাকালো সে। একই রমক পোশাক পড়েছে তারা মা-মেয়ে। হালকা গোলাপি রঙের গাউন দুটোতে অজস্র মূল্যবান পাথরের কারুকার্য। মাথার সফেদ হিজাবের উপর গোলাপি পাথরের তাজ। এলিজা ঝুঁকে পড়ে তোহফার মাথায় তাজ লাগিয়ে দিচ্ছে। তোহফা ছুটোছুটি করছে আনন্দে। তাকে টেনে ধরে চোখ রাঙাচ্ছে বেগম। মুহুর্তের জন্য যেন থমকে গেলেন সুলতান। সে কী মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! তার হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি পাচ্ছে অত্যধিক মাত্রায়। বুকে হাত চেপে দ্রুত মহল ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। শ্বাস কষ্টের রোগীর ন্যায় জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে দেয়াল ধরে। এতগুলো দিন বাদে আবার সেই রূপ! আবার সেই শ্বাস রুদ্ধকর অনুভূতি! আকস্মাৎ ঘটনায় চমকে উঠলো মাহতাব। হন্তদন্ত হয়ে শুধাল, “কী হয়েছে মহামান্য? হঠাৎ করে কী হলো? কোথায় খারাপ লাগছে আপনার? আমাকে বলুন।”

“আমি নিজের ধ্বংস দেখতে পাচ্ছি মাহতাব। নিজের ভয়ঙ্কর পরাজয় অনুভব করছি।”

বিশাল কৃষ্ণচূড়া আবারো সেজেছে লাল ফুলে। ঝড়ো হাওয়ায় ঝড়ে পড়া তার অজস্র ফুল আর ভেঙে পড়া ডালের শোক যেন এক রাতেই কাটিয়ে উঠেছে সে। আবারো মাথা তুলে ছড়চ্ছে রক্ত রঙা সৌন্দর্য। বারান্দার খুঁটিতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে জারনাব। আনমনে ভাবছে কিছু একট। ইদের কোনো আমেজ নেই তার মধ্যে। সেই কাল থেকেই ধুম ধরে বসে আছে। জোভিয়া নতুন পোশাক পাঠিয়েছে সেগুলোও ছুঁয়ে দেখেনি সে। ইদের দিন পুরো সাম্রাজ্যের মানুষ জড়ো হয় মহলে। প্রতিবারই ইদে সুলতান পুরো সাম্রাজ্যকে দাওয়াত করে খাওয়ায়। ইদের নামাজ শেষ হতে না হতেই মহলের সামনে বিশাল জায়গা জুরে ছাউনি টানানো হয় প্রজাদের জন্য। কিন্তু জারনাবের যেন সেখানে যাবারও কোনো ইচ্ছা নেই। আব্দুর রহমান বেশ কয়েকবার তাকে ডেকে ডেকে হাঁপিয়ে উঠেছে। তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না হুট করে মেয়েটার কী হলো। এর কারন শুধুমাত্র জোভিয়া হলে সে নিশ্চয়ই মহলে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতো। কিন্তু তার বিষাদে ঘেরা চেহারা যেন অন্য কাহিনীই বলছে। আব্দুর রহমান এগিয়ে এলেন মেয়ের কাছে। বসতে চাইলেন জারনাবের পাশে তবে এই পা নিয়ে তা আর সম্ভব হলো না তার পক্ষে। দাঁড়িয়ে থেকেই সামান্য ঝুঁকে হাত রাখলো কাঁধের উপর। সচকিত হয়ে তাকালো জারনাব। ব্যস্ত স্বরে বলল, “কী হয়েছে আব্বা? কিছু লাগবে আপনার?”

“তুমি নতুন পোশাক পরছো না কেন আম্মা। ইদের দিন এভাবে থাকতে নেই। যাও, বোন তোমার জন্য কত কিছু পাঠিয়েছে, ওগুলো পরে নাও।”

“সেবকের হাতে পাঠিয়েছে। সে নিজে তো আসেনি। কেন পরবো আমি সেসব?” অভিমানী কন্ঠ জারনাবের।

আব্দুর রহমান বুঝতে পারলেন মেয়ে তার বোনের উপর অভিমান করেছে। তাকে আশ্বস্ত করে বললেন, “বোনের উপর মান করেছো? সে কতগুলো দিন পরে নিজের স্থানে ফিরেছে, বলো তো। নিজেকে গুছিয়ে নিতেও তো সময় লাগবে। তুমি তো বড়। তোমার কি উচিত নয় বোনের সমস্যা উপলব্ধি করা? যাও আম্মা, নতুন পোশাক পরে নাও।”

তবুও উঠলো না জারনাব। বিষাদ যেন বিন্দুমাত্র কমলো না তার চেহারা থেকে। শূন্য দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে চেয়ে থাকলেন আব্দুর রহমান। হুট করে শোকাহত কন্ঠে বলে উঠলেন, “সাহাদের কথা মনে পড়ছে?”

ডুকরে কেঁদে উঠলো জারনাব। কাতর গলায় বলল, “আমি তো তাকে কোনোদিন ভুলতেই পারলাম না আব্বাজান।”

শ’য়ে শ’য়ে বাণিজ্যিক জাহাজ ভেসে রয়েছে শাহ নদীর বুকে। তবে সবগুলোই তীরে ভেড়ানো। আজ যে ইদ। তাদের কাজ নেই। সওদাগর, নাবিক, বণিক সবার আজ ছুটি। সকলেই ইদ উৎযাপন করছে নিজ নিজ পরিবারের সাথে। তবে জাহাজের কাছেই নদীর তীরে হাঁটছে আবরার জাওয়াদ। তার বাসস্থান এই সাম্রাজ্যে নয়। সে পার্শ্ব সাম্রাজ্যের বাসিন্দা। তবে এই নদীতে বানিজ্যের জাহাজ পরিচালনা করবার অনুমতি আছে তাদের। পার্শ্ব সাম্রাজ্যে তার ছোট্ট একটা দুই কামরার দালান রয়েছে। তবে তার পরিবার-পরিজন বলতে কেউ নেই। সে একা। জন্মের পরেই তার মাতা মারা যায়। তারপর যখন সে যুবক হয়ে উঠলো তখন অসুস্থতার কারনে তার পিতাও মৃত্যুবরণ করেন। তারপর থেকে সে একা। জাহাজে করে এদিক-ওদিক ঘুরে ঘুরে বাণিজ্য করাই রোজকার কর্ম। একার জন্য সে জাহাজেই রাত-দিন কাটিয়ে দেয়। গৃহে ফেরে না বললেই চলে। মাসে-চাঁদে একবার গিয়ে থেকে আসে দুয়েকদিন। তবে যেদিন থেকে জোভিয়াকে দেখেছে সেদিন থেকে নতুন এক পরিবারের স্বপ্ন দেখে সে। মেয়েটাকে ভালোবেসে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে এই সাম্রাজ্যে। আজও সে এখানেই জাহাজ ভিড়িয়েছে। তবে বাজার আজ বন্ধ। তাই সে ঠিক করেছে তাদের গৃহে যাবে আজ। জোভিয়ার জন্য নতুন গাউন কিনে রেখেছিলো সে। তবে মেয়েটার রাগ আর অবিরত উপেক্ষার জন্য দেওয়া হয়ে ওঠেনি। তাই আজ ইদের নাম করে সেটাও দিয়ে আসা যাবে। দ্রুত জাহাজে গিয়ে গাউনটা নিয়ে আসলো সে। নীল রঙা গাউনটা থলে দিয়ে মুড়িয়ে লাল ফিতেই বাঁধা। গাউনটা ছুঁয়ে দিয়ে মুচকি হাসলো সে। জানা নেই মেয়েটা কবে বুঝবে তাকে। ভালোবাসবে তাকে। তবে তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে সে, ছোট্ট একটা সংসারের স্বপ্ন, ভালোবাসায় ঘেরা কিছু মুহুর্তের স্বপ্ন। ঘুরেফিরে বারবারই সে গাউনটার দিকে তাকাচ্ছে। হাসছে মনের অজান্তে। মেয়েটা কি আজও রেগে যাবে? ইদের দিনও তাকে উপেক্ষা করবে? করলে করুক। কিছু সময় মন ভরে তাকে দেখা তো যাবে। এটাই বা কম কীসে?

মনে মনে সে দৃঢ়ভাবে চাচ্ছে জোভিয়া রাজি হয়ে যাক। তার সম্মতি পেলেই সে বিবাহের আয়োজন শুরু করবে। কিন্তু কবে সেই দিন আসবে? আর কত অপেক্ষা? কবে তাদের একটা সুন্দর সংসার হবে? উপরওয়ালা মেয়েটার মন এমন পাথর করে কেন তৈরি করেছে? তাকে কি একটুও ভালোবাসা যায় না? অতঃপর নিজ মনেই হাসলো সে। ভালোবাসবে না কেন? একদিন না একদিন ঠিকই বাসবে। ততদিন নাহয় অপেক্ষা করবে সে। জোভিয়ার তীক্ষ্ম চোখের চাহনির কথা মনে পড়তেই প্রশান্তিতে হৃদয় ছেয়ে গেল তার।
ইদের দিন মেয়েটাকে নিশ্চয়ই আরো সুন্দর লাগবে। সে নিজেক সামলাতে পারবে তো? সেই রূপ তার শ্বাস আটকে দেবে না তো?

চলবে…………

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_17

আজ থেকে ঠিক সাত বছর পূর্বে আব্বাজানের পছন্দের পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল জারনাব। পঁচিশ বছর বয়সি টগবগে যুবক সাহাদের সাথে শুরু করেছিল মধুময় এক সম্পর্ক। সাহাদের পরিবার-পরিজন ছিলো না। ছোট্ট একটা কামরায় শুধু তারা দু’জন থাকতো বেশ সানন্দেই। পারিবারিক বিবাহতেও ভালোবাসা তাদের কম ছিলো না। জারনাবের বয়সই বা কখন কত? আঠারো কী উনিশ। কিন্তু সাহাদ তাকে এতোটাই নিখুঁতভাবে আগলে রেখেছিল যে সে কখনো আক্ষেপ করার সুযোগটাই পায়নি। রোজ রাতে তার চুলে বিনুনি করে দিতে দিতে মিটমিটিয়ে হেসে বলতো, “তুমি এতো নাজুক কেন, বউ? যেন ছুতেই গলে যাবে।”

তার কথায় তাল মিলিয়ে হাসতো জারনাব। চোরা দৃষ্টিতে দেখে যেত পুরুষটার ভূবন ভোলানো হাসি। কিন্তু প্রতিবারই ধরে ফেলতো সাহাদ। তাকে লজ্জা দিতে ঠোঁট চেপে বলে উঠতো, “আমাকে বুঝি খুব সুন্দর লাগছে আজ?”

হুটহাট তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়তো। কিছু বলতে গেলেই চোখ রাঙিয়ে উঠতো সে। কী আগুন সেই দৃষ্টিতে! নিমেষেই ঝলসে দিতো জারনাবের হৃদয়। সাহাদ রাত করে বাড়ি ফিরলে মাঝে মাঝেই ঘুমিয়ে পড়তো জারনাব। যার দরুন দ্বার খুলতে বেশ খানিকটা দেরি হয়ে যেত। তবুও বিন্দু পরিমাণ রাগতো না সাহাদ। দ্বার খুলতেই তার ক্লান্ত মুখটাতে ফুটে উঠতো রাজ্যের খুশি। তড়িৎ বেগে এগিয়ে এসে দু’হাতে আকড়ে ধরতো তার মুখটা। মুচকি হেসে বলতো, “দুঃখিত, ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম। তবে এখন আবার ঘুমিয়ে পড়ো না যেন। অপেক্ষা করো, হাত-মুখ ধুয়ে আসি। একসাথে ঘুমাবো।”

সাহাদ ছিল সুলতানের সৈনিক আর এটাই যেন কাল হয়ে দাঁড়ালো তার বৈবাহিক জীবনে। বিয়ের ঠিক এক সপ্তাহ পরেই শুরু হলো নদী নিয়ে পার্শ্ব সাম্রাজ্যের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। কিছুদিনের মধ্যেই সেই দ্বন্দ্ব যুদ্ধে রূপ নিলো। নতুন বউ ঘরে রেখে সাহাদ বীর সৈনিকের ন্যায় যুদ্ধে ছুটলো। যাবার পূর্বে তার কপালে চুম্বন করে আহত গলায় বলেছিলো, “আমার জন্য দোয়া করো বউ। যেন আবারো তোমার কোলে নিজের মাথাটা রাখতে পারি। বৃদ্ধ বয়সে তোমার সফেদ চুলে বিনুনি করে দেওয়ার সুযোগটা যেন আল্লাহ আমাকে দেয়।”

কেটে গেল কয়েকদিন। কিন্তু সাহাদ আর ফিরে এলো না। ভয়ে-আতঙ্কে জর্জরিত হলো জারনাব। তার দোয়া বুঝি কবুল হলো না! অবশেষে ফিরে এলো তার ক্ষতবিক্ষত লাশ। তলোয়ার দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল সাহাদের চওড়া বুকটাতে। কী গভীর সেই ক্ষত! মানুষটার ফর্সা শরীরটা ফ্যাকাসে হয়ে উঠেছে। নেই কোনো উজ্জ্বলতা। জারনাবকে দেখেও আজ হাসলো না সে। চোখ মেলেও দেখলো না একবার। সহ্য করতে পারেনি জারনাব। জ্ঞান হারিয়েছিল মুহুর্তেই। আর যখন জ্ঞান ফিরল তখন এই দুনিয়ার বুকে সে একা। চারপাশে কোথাও নেই সাহাদ। কী আশ্চর্য! বাতাসে মিশে থাকা তার সুঘ্রাণটাও হারিয়ে গেছে তখন! কান্না করার শক্তিও যেন জোগাতে ব্যর্থ হলো জারনাব। অথচ দিনটা ছিল ইদের দিন। নদী নিয়ে এই দ্বন্দ্ব শেষ করে দিলো তাকে, নিঃশ্ব করে দিলো! এতো অল্প সুখই যদি তার ভাগ্যে ছিলো তবে কেন এই অজস্র মায়া লাগালো সাহাদ? আগলে রাখার স্বপ্ন দেখিয়ে শূন্য করে দিলো তাকে। কত আহাজারি করলো সে তবুও ফিরল না সাহাদ। তার লম্বা লম্বা চুলগুলো যখন মাটিতে পড়ে গড়াগড়ি খেল তখনও ফিরে এলো না সাহাদ। নির্দয়ভাবে একলা করে দিলো জারনাবকে। সদ্য বিবাহিতা জারনাব কিছুদিনের পার্থক্যেই পেয়ে গেল বিধবার তকমা। একলা ঘরে তার আহাজারি দেখার কেউ ছিলো না। ঘরটাতে দম হয়ে আসতো তার। ঘরটার চারদিকে যেন সাহাদের বিচরণ। অথচ কোথাও নেই সে, কোথাও না। সে কি নিষ্ঠুর অনুভূতি!

আর ভাবতে পারলো না জারনাব। দম বন্ধ হয়ে আসছে তার। দূরের কৃষ্ণচূড়ার গাছটা যেন তাচ্ছিল্য করে বলছে। বিধবা তুই! বিধবা! ফিরবে না সাহাদ! তোকে একা ফেলে সে চলে গেছে! আর সহ্য হলো না। দু’হাতে কান চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠলো জারনাব, “মিথ্যা, সব মিথ্যা। সে আমাকে একা ফেলে যায়নি। পরকালে আমার জন্য অপেক্ষা করছে সে। সাতটা বছর ধরে অপেক্ষা করছে সে শুধু আমার জন্য।”

বারান্দা ছেড়ে ছুটে কামরায় চলে গেল সে। শক্ত করে আটকে দিলো দ্বার। দ্বারের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে কেঁদে উঠলো ঝরঝর করে। ইদ কেন তার জীবনে আসে? কেন আসে? প্রতি বছর কেন সাহাদের মৃত্যুর ঘ্রাণ নিয়ে ইদ ফিরে আসে? সুন্দর এই দিনটা কেন এতো ভয়ঙ্করভাবে শোকের পরশ এঁকে দিলো তার জীবনে? উদ্ভ্রান্তের ন্যায় এদিক-ওদিক তাকালো সে। সবকিছু এতো ভয়ঙ্কর লাগছে কেন? তাকে কি মারতে চায় শ্বাসরোধ করে? মাথা থেকে হিজাব টেনে ছুড়ে ফেলল সে। দু’হাতে খামচে ধরলো লম্বা লম্বা চুলগুলো। এই চুলে আর কখনোই বিনুনি করেনি সে। চুলগুলো মুখের সামনে এনে নাকের সাথে চেপে ধরলো শক্ত করে। বড় করে শ্বাস টেনে নিলো নিজের গভীরে। কিন্তু এ কী! সাহাদের হাতের ঘ্রাণ তো নেই চুলগুলোতে। মুহুর্তেই যেন উন্মাদ হয়ে উঠলো সে। দৌড়ে কাঠের বাক্সটার কাছে যেতে গিয়ে গাউনে পা বেঁধে আছড়ে পড়লো মেঝেতে। আশ্চর্য! বিন্দুমাত্র ব্যথা অনুভব হলো না! সে ছ্যাচড়াতে ছ্যাচড়াতে বিছানার পাশে এসে বসলো। ব্যস্ত হাতে বিছানার নিচ থেকে টেনে আনলো কাঠের বাক্সটা। সতর্ক তার দৃষ্টি। সে খুব যত্ন করে খুললো বাক্সটা। এখানেই যেন সাহাদকে লুকিয়ে রেখেছে সে।
হন্তদন্ত হয়ে কয়কেটা কাপড়-চোপড় এলোমেলো করতেই বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা শিশি। আতরের শিশি। ছোট্ট শিশিটার একদম তলানিতে আর অল্প একটুই আতর বেঁচে আছে। চোখ-মুখ প্রজ্জ্বলিত হলো জারনাবের। মহা মূল্যবান কিছু খুঁজে পেয়ে যেমনটা হয় ঠিক তেমন করেই চকচক করে উঠলো তার চোখ। কাঁপা কাঁপা হাতে আতর নিয়ে হাতে, বুকে, গাউনের সব জায়গায় লাগিয়ে নিলো সে। অবশেষে খানিকটা আতর চুলেও লাগিয়ে নিলো। সব শেষে আবার সুন্দর করে শিশিটা রেখে দিলো বাক্সতে। লুকিয়ে রাখলো কাপড়ের নিচে। অতঃপর চুলগুলো সামনে ধরে বিশাল এক শ্বাস টেনে নিলো। এইতো! সাহাদের শরীরের সুঘ্রাণ! তার সাথেই তো মিশে আছে সাহাদ। তার খুব কাছে। হুট করে কী হলো, দৌড়ে গিয়ে জানালার কপাট বন্ধ করে দিলো। যদি জানালা দিয়ে বেরিয়ে যায় এই সুঘ্রাণ! পারলে যেন সে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতো এই ঘ্রাণ। মেঝেতে বসে দু’হাঁটুর আঝে মুখ গুজে অধর প্রসারিত করলো সে। এই ঘ্রাণের মাঝে শক্তপোক্তভাবে অনুভব করলো সাহাদের উপস্থিতি। আতরটা সাহাদের। এটা মেখেই সে ইদের নামাজে যেত। তার মৃত্যুর পর প্রতিটা ইদে জারনাব সাহাদের সুঘ্রাণ খুঁজতে গিয়ে এই আতর মেখে দ্বার আটকে রাখে। এ সম্পর্কে অবগত আব্দুর রহমান। দ্বারের বাইরে থেকেও যেন সব উপলব্ধি করে নিলো সে। মেয়ের কষ্ট অনুভব করে শোক নামলো তার চেহারায়। তার মেয়েটা কি আর কখনোই নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারবে না? ছলছল করে উঠলো তার নয়ন। সে দৃঢ়ভাবে চায় কেউ একজন আসুক, সাহাদের মতোই যত্ন করে আগলে নিক মেয়েটাকে। আবারো প্রাণ খুলে হেসে উঠুক তার জারনাব।

“বাড়িতে কেউ আছেন?”

ফটকের সামনে থেকে ভেসে এলো পুরুষালি কন্ঠস্বর। অবাক হলেন আব্দুর রহমান। এ সময় আবার কে এলো! তাও পুরুষ মানুষ! আবার ভাবলো জোভিয়া হয়তো কাউকে পাঠিয়েছে। দ্রুত চোখ মুখে লাঠি ভর দিয়ে খুরিয়ে খুরিয়ে এগিয়ে গেল সে। ফটকের সামনে যেতেই দৃষ্টিগোচর হলো একটি উচ্ছ্বাসিত মুখ। তবে তাকে হয়তো আশা করেনি সে। উচ্ছ্বাসিত ভাবটা কেমন যেন কমে এলো তাকে দেখে। ভালো করে তার আগা-গোড়া পর্যবেক্ষণ করলেন আব্দুর রহমান। একজন টগবগে যুবক। তার লম্বা লম্বা চুলগুলো উঁকি দিচ্ছে টুপির ভেতর থেকে। তবে তাকে দেখে তো কোনক্রমেই সৈনিক বা সেবক মনে হচ্ছে না। সে অবাক হয়ে শুধাল, “কে তুমি?”

অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো বণিক। সে ভেবেছিলো জোভিয়াই বেরিয়ে আসবে। সে না আসলেও অন্তত তার বুবু আসবে। কিন্তু এ তো তাদের আব্বা চলে এসেছে। এখন কী বলবে? নিজের শব্দভান্ডার হাতরেও বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না সে। আমতা আমতা করে বলে উঠলো, “আমি আবরার জাওয়াদ। শাহ নদীতে জাহাজে করে বানিজ্যের মালামাল আনা-নেওয়া করি।”

ভ্রু কুচকাল আব্দুর রহমান। এমন কারোর নাম পর্যন্ত সে কোনোদিন শুনেছে বলে ঠাহর করতে পারলো না। সে খানিক চিন্তিত স্বরেই বলল, “তোমাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না বাবা।”

“না মানে, পানি।”

“পানি?”

“হ্যাঁ, পানি। খুব তেষ্টা পেয়েছে। আশেপাশে আর কোনো বাড়ি নেই। যদি একটু পানি খাওয়াতেন?”

“ওহ, পানি খাবে? আগে বলবে না? তুমি দাঁড়াও, আমি পানি নিয়ে আসছি।”

বাড়ির ভেতর ঢুকতে লাগলেন আব্দুর রহমান। দু’পা এগোতেই ডেকে উঠলো বণিক, “বলছিলাম, আপনার তো হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। বাড়িতে আর কেউ নেই?”

ঘুরলেন আব্দুর রহমান। স্বাভাবিকভাবেই বললেন, “না সমস্যা নেই। একটু অপেক্ষা করো। আমি পানি এনে দিচ্ছি।”

চলে গেলেন আব্দুর রহমান। না চাইতেও বাধ্য হয়ে বাড়ির ভেতর উঁকিঝুঁকি দিতে থাকলো আবরার। তবে বাড়িতে আর কেউ আছে বলে মনে হলো না। শুকিয়ে এলো তার মুখভঙ্গি। কোথায় গেছে জোভিয়া? আজ তো বাজারও বন্ধ। আবার সাম্রাজ্যের সবার সাথে মহলে যায়নি তো? আফসোস হলো তার। সে তো এই সাম্রাজ্যের বাসিন্দা নয়। বিনা আমন্ত্রণে মহলে যাওয়াটাও ভালো দেখায় না। তবে কি আজ দেখা হবে না মেয়েটাকে? কিন্তু এই গাউন? গাউনটা আবারো নেড়েচেড়ে দেখলো সে। তখনই পানি নিয়ে হাজির হলো আব্দুর রহমান। জোরপূর্বক হেসে পানিটুকু পান করলো বণিক। অতঃপর পাত্র ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।”

“আর কিছু?” শুধাল আব্দুর রহমান।

“না না, শুধু পানিই প্রয়োজন ছিল। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। এখন আসি।”

অপ্রস্তুত ভঙ্গিমায় হেসে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করলো বণিক। তবে কিছদুর গিয়ে আবারো পেছনে ফিরে তাকালো সে। তার দু’চোখ খুব সন্তর্পণে খুঁজে চলেছে কিছু একটা। সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আব্দুর রহমান। তাকে আবার এভাবে ফিরে তাকাতে দেখে চিন্তিত হলো সে। সত্যিই কি পানি খেতে এসেছিল ছেলেটা?

কারাগারের লোহার শিক ধরে দাঁড়িয়ে আছে জিদান। ঘেমে-নেয়ে একাকার তার শরীর। হুট করে আজ বিকেলে সৈনিকরা তাকে তার গৃহ থেকে ধরে এনেছে। কাল সকালে চাঁদা তোলার দিন আর আজ যদি এখানে বন্দি থাকে কতগুলো অর্থ পানিতে যাবে। বিরক্ত হচ্ছে সে। এ কেমন নিয়ম? বিনা কারণে মানুষকে হয়রান করা। অপরাধ জানতে চাইলে তারা কোনো কিছু বলছেও না, ছাড়ছেও না। সেই বিকালে ধরে এনেছে। আর এখন সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হয়েছে। সে রাগান্বিত কন্ঠে বন্দিশালায় পাহাড়ারত সৈনিকদের উদ্দেশ্য করে বলল, “কোনো অপরাধ ছাড়া আপনারা আমাকে এভাবে আটকে রাখতে পারেন না। এটা অন্যায়।”

এগিয়ে এলো একজন সৈনিক। শক্ত কন্ঠে বলল, “কারন ছাড়া কখনো কাউকে এই বন্দিশালায় আনা হয় না, আজও হয়নি।”

“তাহলে বলছেন না কেন আমার কী অপরাধ?” চেঁচিয়ে উঠলো জিদান।

রাগলো সৈনিকটি। বিরক্ত স্বরে বলল, “গলার স্বর পরিবর্তন করুন। এটা সুলতানের মহল, আপনার পিতার গৃহ নয়। সময় হলেই নিজের অপরাধ জেনে যাবেন। সুলতানা আসছেন, ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন।”

কটমট করে তাকালো জিদান। সৈনিকগুলোর একটু বেশিই ভাব। সুলতানের মহলে থাকে বলে জনসাধারণকে গুনতেই চায় না। আর সুলতানা এসে কী করবে? তার এখানে কী কাজ? আজব! তার অপরাধ ব্যক্ত করতে স্বয়ং সুলতানা চলে আসবে! এ অসম্ভব! সৈনিকগুলোর মাথা গেছে। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো সে। রাত কত হয়েছে ঠাহর করতে পারলো না। চতুর্দিকের সহস্রাধিক কৃত্রিম আলোর ভিড়ে রাতের আঁধার যেন ফিকে পড়ে গেছে। দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছে আগুনের কুণ্ডলি। অবশেষে তার অপেক্ষার অবসান ঘটলো। কারাগারের দ্বার আটকে দাঁড়িয়ে থাকা সৈনিক মাথা নিচু করে উচ্চস্বরে বলে উঠলো, “স্বাগতম সুলতানা।”

আগ্রহী হয়ে চাইল জিদান। ততক্ষণাৎ প্রবেশ করলো শাড়ি পরিহিতা এক নারীমূর্তি। তার শরীরে জড়ানো অলংকারগুলো যেন প্রকাশ করছে তার কঠিন দাম্ভিকতা। মাথা নুইয়ে নিলো সমস্ত সৈনিক। হতবুদ্ধির ন্যায় কেবল চেয়ে থাকলো জিদান। কেমন চেনা চেনা লাগছে তার মুখটা! খুব চেনা লাগছে এই চোখদুটো! তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো জিদান। অতঃপর হুট করে অবাক কন্ঠে বলে উঠলো, “জোভিয়া! কিন্তু এ কী করে হতে পারে? নিশ্চয়ই কোনো ভুল হচ্ছে।”

চোখ কচলে আবারো তাকালো সে। নাহ! ইনি জোভিয়া অন্তত নয়। চোখ এক রকম হতেই পারে। জোভিয়া কী করে হবে? সুলতান তো আর সাধারণ মেয়েকে বিবাহ করবে না। আর সুলতান বিবাহ করলে সাম্রাজ্যের সবাই অবশ্যই জানতো। কারাগারের একদম কাছে এগিয়ে এলো নারীটি। তাকে অবাক করে দিয়ে তাচ্ছিল্য স্বরে হেসে উঠলো সে। বিদ্রুপের স্বরে বলল, “আমায় চিনতে কি কষ্ট হচ্ছে জিদান?”

চমকে উঠলো জিদান। এই কন্ঠ অন্তত চিনতে সে ভুল করবে না। অবিকল সেই কন্ঠ! শ্বাস নিতেও যেন ভুললো সে। কারাগারে বন্দি হয়ে এতোবড় ঝটকা খাবে সে কখনোই ভাবেনি। নিমেষেই যেন মাথার উপর দিয়ে কালবৈশাখী ঝড় বয়ে গেল। চোখদুটো খিচে বন্ধ করে নিলো সে। আবারো তাকালো আতঙ্কিত চোখে। জোভিয়ার মাথার উপর জ্বলজ্বল করতে থাকা তাজটা নিশ্চয়ই মিথ্যা সাক্ষী দেবে না! তার অবস্থা বোধহয় উপলব্ধি করে নিলো এলিজা সুলতান। মুচকি হেসে বলল, “বলেছিলাম না অনেক অসম্পূর্ণ কাজ বাকি রয়েছে আমার? তোমাকে এই কারাগারের মাঝে টেনে আনাটা ছিলো দ্বিতীয় অসম্পূর্ণ কাজ। আজ সেটাও পূরণ হয়ে গেল। প্রথম অসম্পূর্ণ কাজ সুলতানের কাছে ফিরে এসে আগেই সম্পূর্ণ করে ফেলেছি। আরো অনেক অসম্পূর্ণ কাজ আছে। সেগুলোও ধীরে ধীরে পুরণ করে ফেলব। যাও, ঘুমিয়ে পড়ো। অভ্যাস করে নাও কারাগারের মশাদের সাথে রাত কাটানোর। অপরাধটা বোধহয় আর নতুন করে বলে দেওয়া লাগবে না?”

হাঁ করে চেয়ে শুধু শুনে গেল জিদান। তখনই কারাগারের ভেতর দৌড়ে এলো সেবকদের প্রধান আবু হানিফ। বয়স হয়েছে লোকটার। এতোটুকু দৌড়ে এসে হাঁপাচ্ছে সে। জিদান তারই পুত্র। সম্মুখে এসে সে মাথা নুইয়ে কিছু বলার পূর্বেই এলিজা গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে, “এমন আবদার করবেন না যেটা আমি রাখতে পারবো না। তার শাস্তির সময় অতিক্রম হলে তবেই তাকে মুক্ত করা হবে। জমিন চিরে যাক অথবা আসমান ধসে পড়ুক আমার সিদ্ধান্ত অনড় থাকবে। একমাত্র ছেলে বলেই যে তাকে বনে-বাজারে ছেড়ে রাখতে হবে এমনটা নয়। বেশি মায়া না দেখিয়ে যদি সময় মতো ছেলেকে শাসন করতেন তবে আজ আর এই দিনটা দেখতে হতো না। পিতার উচিত ছেলেকে সঠিক পথ দেখানো অপরাধের খোরাক জোগানো নয়। তার জন্য কঠোর হওয়ার প্রয়োজন পড়লে হতে হবে।”

কথা সম্পূর্ণ করেই চলে গেলেন তিনি। সৈনিকরা নিজ নিজ স্থানে সটান দাঁড়িয়ে রইল। আবু হানিফ ছেলের দিকে একবার রাগান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন। হতাশার শ্বাস ফেলে কারাগারের মেঝেতে বসে পড়লো জিদান। আব্বাকে আসতে দেখেও সে ছাড়া পাবার আশা করেনি। এলিজা সুলতানকে না চিনুক জোভিয়াকে তো চিনতো সে। জানা নেই কবে মুক্তি পাবে। সেটা এখন চিন্তাও করছে না সে। সে তো এখনো আকাশসম বিস্ময় কাটিয়ে উঠতেই পারেনি।

সারাদিন লাফালাফি করে ক্লান্ত হয়ে তোহফা আজ সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই কোনো চিন্তাও নেই এলিজা সুলতানের মাথায়। সে পুরো মহল চক্কর দিচ্ছে। কোথায় কী হচ্ছে তীক্ষ্ম চোখে তা পর্যবেক্ষণ করছে। কোনো কারন ছাড়াই সেবক-সেবিকাদের এটা-ওটা জিজ্ঞাসা করছে। উদ্দেশ্য হয়তো আছে কিছু। তবে সেটা প্রকাশ করছে না সে। সকলের দিকে কেমন সন্দেহের নজরে তাকাচ্ছে। মুহুর্তেই আবার হেসে দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে। রন্ধনশালার সামনে এসে হুট করে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। দ্বারের দিকে সামান্য এগিয়ে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো বিশাল রন্ধনশালা। কাজকর্ম সেরে ঘুমিয়ে পড়েছে কিছু রাঁধুনি। হাফসা বসে বসে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে ফাইজার মাথায়। পাশেই চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে মাজেদা বানু। যখন থেকে এলিজা সুলতান ফিরেছেন তখন থেকে যেন ঘুম হারাম হয়ে গেছে তার। রাত-দিন গালে হাত দিয়ে পাথরের মতো শুধু বসে থাকে। এসব দেখে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে ফাইজা। হাফসা কোনোমতে ধমকে ধামকে তাকে আটকায়।
হঠাৎ দ্বারের দিকে নজর যেতেই চমকে গেল তারা। হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালো সকলে। মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান প্রদর্শন করলো। তবে ফাইজা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকলো সুলতানার দিকে। এতো সুন্দর মানুষ হয়! তাকে এভাবে চেয়ে থাকতে দেখে হাসলো সুলতানা। শুধাল, “নাম কী তোমার?”

“জি?” অসহায় চোখে শুধাল ফাইজা।

হাফসা বুঝতে পারলো তার কথার তার কেটে যাচ্ছে। এতো অমনোযোগী এই মেয়েটা! কথা মন দিয়ে না শুনে হাঁ করে এতোক্ষন কী দেখছিলো কে জানে? সে নিজেই বলে দিলো, “ওর নাম ফাইজা। ও নতুন এসেছে সুলতানা। তাই সবকিছু বুঝে উঠতে একটু সময় লাগছে।”

“সমস্যা নেই। ধীরে ধীরে বুঝে যাবে।”

খুশি হলো ফাইজা। লাফিয়ে উঠতে চাইলেই টেনে ধরে থামিয়ে দিলো হাফসা। মৃদুস্বরে হেসে উঠলেন বেগম। অতঃপর ঘাড় কাত করে তাকালেন মাজেদা বানুর দিকে। মাজেদা বানু ইতিমধ্যে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে দিয়েছে। ভীত-আতঙ্কিত তার দৃষ্টি। আশ্চর্য! কিছুই বললেন না সুলতানা। এগিয়ে যেতে লাগলেন দ্বারের দিকে। কিন্তু মাজেদা বানু সস্তির শ্বাস ফেলার পূর্বেই সে পুনরায় ঘুরে তাকালো। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলল, “ইচ্ছেতো করছে……. যাকগে, পরে দেখে নেব তোমাকে। এখন খুব ঘুম পাচ্ছে।”

হাই তুলতে তুলতে হনহনিয়ে রন্ধনশালা ছেড়ে বেরিয়ে এলো সে। কাল ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি। আজ না ঘুমালে আর চলছে না। গোলাকার ফাঁকা স্থান পেরিয়ে তোহফার কামরার দিকে চলে গেল সে। অথচ সেখানে বসে থাকা দুটো প্রাণী যেন চোখেই বাঁধলো না তার। অবাক চোখে তার যাওয়ার পানে চেয়ে আছে সুলতান ও আজমাইন মাহতাব। মাহতাব কিছু না বললেও কটমট করে তাকালেন সুলতান। রাগান্বিত স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলল, “চোখে পট্টি বেঁধে রেখেছে। ইচ্ছে করে আমার দিকে তাকাচ্ছে না।”

মাহতাব হতবাক স্বরে কিছু বলার পূর্বেই আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। মাহতাবকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আগামীকাল সকালেই যেন শাহ নদীর সমস্ত বণিক আর সওদাগর মহলে হাজির হয়ে যায়। নতুন করে চুক্তি করতে হবে। আর তাদের সাথে যে চুক্তি হয়েছিল সেসব নথিপত্র প্রস্তুত করে রেখো।”

মাহতাবকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গটগট করে চলে গেল সে। হতবাক হয়ে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না মাহতাবের। সকাল থেকেই সুলতানের এসব আজগুবি কর্মকাণ্ড দেখে যাচ্ছে সে। হতাশার শ্বাস ফেলে নিজের কামরার দিকে ছুটলো সে। নথিপত্রগুলো বের করে রাখা দরকার। মনটাও আজ তার খুব একটা ভালো নেই। কেমন যেন বিষাদের অনুভূতি পাচ্ছে সে। কোনোকিছুতেই ঠিকমতো মনোযোগ দিতে পারছে না। অদূরে কেউ যেন খুব হৃদয়বিদারক কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলছে আমি ভালো নেই, তুমি কেন ভালো থাকবে? সে জানে না এই বিষাদের কারন। তবে অকারণেই বিরহের সুর তুলছে তার হৃদয়। কেন এই বিরহ? অকারনে এতো বিষাদ?
ব্যথিত মন নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে সামনে দাঁড়ানো তানহাকে সে উপেক্ষা করে চলে এসেছে নিজেও জানে না। অথচ তার দিকেই ছলছল নয়নে এখনো চেয়ে আছে শেহজাদি তানহা। সৈনিক প্রধান কি তাকে দেখেও দেখলো না? না কি উপেক্ষা করলো কঠিনভাবে?

“তুমি এখানে কী করছো?”

তোহফার পাশে শুয়ে প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিলো বেগম। হুট করে চেনা পুরুষালি কন্ঠ পেয়ে ধরফরিয়ে উঠে বসলো। চোখ কচলে তাকাতেই সুলতানকে দেখে যেন খানিক বিরক্ত হলো সে। রাগে গজগজ করে সে কিছু বলার পূর্বেই ধমকে উঠলেন সুলতান।

“এখানে ঘুমানোর ধান্দা করেছো? ওঠো। কামরায় চলো।”

বিরক্ত হয়ে শুয়ে পড়লেন বেগম। শুধু শুধু ধমক শুনে ঘুম নষ্ট করার কোনো ইচ্ছাই তার নেই। শরীরের উপর চাদরটা টেনে নিতে নিতে চোখ বন্ধ রেখেই বলে উঠলো, “কেন শুধু শুধু বিরক্ত করছেন, সুলতান? এখন কি ঘুমাতেও দিবেন না শান্তি করে?”

বিস্মিত নয়নে হাঁ করে চেয়ে থাকলেন সুলতান। এমন একটা ভাব যেন এর চেয়ে বড় বিস্ময়কর কথা সে তার জীবনে কখনো শোনেনি। বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো, “দু’বছর পর ফিরে এসে তোমার এখন ঘুম বেশি জরুরি! দেখো, এমন করলে এবার কিন্তু সত্যি সত্যি দ্বিতীয় বিবাহ করে নেবো আমি।”

এক ঝটকায় উঠে বসে পড়লেন বেগম। হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে বললেন, “আপনি নিজেই তো কামরা থেকে বের করে দিয়েছেন এখন আবার কী চাই?”

“চলো তো। মেয়ে উঠে পড়বে।” বিরক্ত কন্ঠ সুলতানের।

“যেখান থেকে একবার আমাকে বের করে দেওয়া হয় সেখানে আর দ্বিতীয়বার ফিরে যাই না আমি। আমার একটা আত্মসম্মান আছে।” খানিকটা ভাব নিয়েই বলল বেগম।

“আচ্ছা? তাহলে সকালে কে ঢুকেছিল আমার কামরায়? তোমার আত্মা? তাছাড়া আজ নতুন না কি? এর আগেও বহুবার তোমাকে কামরা থেকে….।”

দৌড়ে এসে তার মুখ চেপে ধরলো বেগম। চোখ বড়বড় করে বলল, “থামুন। মান-সম্মান সব শেষ করে দিবেন দেখছি মেয়ের সামনে সবকিছু বলে।”

তার হাত মুখ থেকে না সরিয়েই পালঙ্কের দিকে তাকালেন সুলতান। অতঃপর একহাত দিয়ে তার হাতটা সরিয়ে ভ্রু কুচকে বললেন, “কিন্তু মেয়ে তো ঘুমাচ্ছে।”

উত্তরে বেগম কিছু বলার পূর্বেই দ্বারের সামনে থেকে মেয়েলি কন্ঠস্বর পেয়ে ছিটকে সরে গেল তারা। কামরায় প্রবেশ করলো ওয়াসিফা সুলতান। অবাক হয়ে শুধাল, “তুমি এ কামরায় কী করছো শাহজাইন?”

“এই কামরার রং চটে গেছে। নতুন করে রং করা প্রয়োজন।” দেয়ালের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে ভাবুক স্বরে উত্তর দিলেন সুলতান।

না চাইতেও ফিক হেসে ফেললেন বেগম। মুখে হাত চেপে অপেক্ষা করলো শাশুড়ির উত্তর শোনার জন্য। তাকে নিরাশ করলো না ওয়াসিফা সুলতান। রাগান্বিত স্বরে ধমকে উঠলেন তিনি।

“তোমাকে কি দেয়ালের রং পরিক্ষা করার জন্য সুলতান বানানো হয়েছে?”

এবার আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না বেগম। শব্দ করে হেসে উঠে দ্রুত কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। সুলতানের কামরায় এসেও হাসি থামাতে পারছে না সে। আজ তার শাশুড়ির মনোরঞ্জনের জন্য দাসী আনার শখ মিটে যাবে। কিছুক্ষণ পর দ্বার ঠেলে প্রবেশ করলো সুলতান। তার চোখ-মুখে যেন রাজ্যের আঁধার ঠাঁই পেয়েছে। তাকে হাসতে দেখে রাগে গজগজ করে উঠলো সে। আচমকা দু’হাত বাড়িয়ে ধমকে উঠে বলল, “কাছে এসো।”

বলতে দেরি ছুটে আসতে দেরি নেই বেগমের। তার খুব কাছে এসে মিশে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে খুলে নিলো পাগড়িটা। পালঙ্কের পাশে পাগড়িটা রেখে নিজের তাজটা খুলে পাগড়ির উপর সোজা করে বসিয়ে দিলো। অতঃপর বিজয়ী হাসি হেসে বলল, “সম্রাজ্ঞী সবসময় সুলতানের আগেই থাকে।”

সবুজ পাগড়িটার উপর যেন রাজ করছে সফেদ পাথরের তাজটা। সে কী দাম্ভিকতা তার! মুহুর্তেই রাগ বিলীন হয়ে হাসির রেখা ফুটে উঠলো সুলতানের ঠোঁটে। দু,হাতে তাকে নিজের সাথে আগলে নিয়ে মিটমিটিয়ে হেসে বলল, “অনেক হয়েছে সম্রাজ্ঞীর ভাষণ। এবার বেগমের দায়িত্ব পালন করো, সুলতানের বেগম। ঘুম-টুম ভুলে যাও আজকের জন্য।”

চলবে…….