সম্রাজ্ঞী পর্ব-১৪+১৫

0
81

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_14

শেষ বিকেলে আকাশের বুকে কালচে মেঘের প্রলেপ। পশ্চিমে ঝড়ো হাওয়ার তাণ্ডব। হুটহাট নিকষ কালো মেঘ পেরিয়ে তিব্র আলোর ঝলকানি। ত্রিভুবন কেঁপে উঠল মেঘের ক্রোধান্নিত গর্জনে। ঝড়ের কাছে নুইয়ে পড়ছে প্রকৃতি। ঝড়ের দাপটে ফটক আগলে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল আকারের কৃষ্ণচূড়া গাছটার ডালপালা ভেঙে ঝাঁক ঝাঁক ফুল বুকে নিয়ে আছড়ে পড়ছে মাটিতে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রক্ত রঙা ফুলগুলোর যেন প্রকৃতির উপর ভারী অভিমান। দু’হাতে নিজের হিজাব টেনে ধরে গৃহের দিকে ছুটে এলো সুন্দরী রমনী। ভেঙে পড়া ডালপালা ডিঙিয়ে সতেজ ফুলগুলো মারিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলো সে। প্রবল হাওয়ায় তাল মিলিয়ে উড়তে চাইছে তার হিজাব। ছাড়লো না সে। টেনে ধরে রইল নিজের সাথে। দ্রুত হন্তদন্ত হয়ে বারান্দায় উঠে দাঁড়িয়ে সস্তির শ্বাস ছাড়লো। শরীরে লেগে থাকা বালুর কণা ঝারতে ঝারতে উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো।

“জোভিয়া, তাড়াতাড়ি একটা ভালো হিজাব নিয়ে এসো তো। এটাই বালু দিয়ে মাখামাখি হয়ে গেছে। ঘর নোংরা হবে।”

উত্তর এলো না ঘর থেকে। বিরক্ত হলো জারনাব। জোভিয়াকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে সে গিয়েছিল ওষুধের দোকানে। টাকা পরিশোধ করতে। কিন্তু এই মেয়েটা কি আবার শেষ বেলায় এসে ঘুমিয়ে পড়লো? রোজা হালকা না করে ছাড়বে না দেখছি। সে পুনরায় ডাকলো, “কী হলো? শুনতে পাচ্ছ না আমি কী বলছি? তাড়াতাড়ি আসো। একটা তোয়ালেও ভিজিয়ে এনো। বালুতে মাখামাখি হয়ে গিয়েছি একেবারে।”

আশ্চর্যজনকভাবে এবারো কোনো উত্তর এলো না। ঘরটা আজ কেমন যেন নীরব। গৃহ সুনসান। রেগেমেগে খানিক সময় হাঁকডাক পাড়লো জারনাব। অবশেষে বালু সমেত কামরায় গিয়ে উপস্থিত হলো সে। দ্বার ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই অবাক হতে বাধ্য হলো। ঘর যে একেবারে ফাঁকা! কোথায় জোভিয়া? জানালার কপাটটাও বন্ধ। ঘর অন্ধকার। হুট করেই যেন হৃদয়টা তার ফাঁকা ফাঁকা লাগতে শুরু করলো। চমকে উঠলো সে। এমন বিষাদ কেন অনুভব হচ্ছে! আর ভাবলো না সে। যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই ছুটে গেল আব্বাজানের কামরায়। সেখানে গিয়েও তাকে অবাক হতে হলো। এ কামরায়ও নেই জোভিয়া। তবে আব্বাজান বসে আছেন। থমথমে তার মুখভঙ্গি। জারনাব ঘরে আসাতেও ধ্যান ভঙ্গ হলো না তার। চোখ-কান বন্ধ করে যেন মাটির দিকে চেয়ে আছে সে!
ধীর পায়ে তার নিকট এগিয়ে এলো জারনাব। তার উপস্থিতি টের পেলো না আব্দুর রহমান। একমনে মাটির দিকে চেয়ে তজবি গুনছে সে। কাশে উঠলো জারনাব। গলার স্বর উচিয়ে বলল, “কী ভাবছেন আব্বাজান?”

আকস্মাৎ কন্ঠে চমকে উঠলো আব্দুর রহমান। এতোক্ষন যেন অন্য জগতে ছিলো সে। তবে খুব একটা পরিবর্তন হলো না তার ভঙ্গিমা। এক পলক জারনাবের দিকে চেয়ে পুনরায় মাটিতে নজর দিলো। আব্বাজানের ভাবভঙ্গির আগা-মাথা কিছুই উপলব্ধি করতে সক্ষম হলো না জারনাব। গলা খাকারি দিয়ে শুধাতে চাইল জোভিয়া কোথায়। তবে তার পূর্বেই থমথমে কন্ঠে আব্দুর রহমান বলে উঠলো, “বোনকে খুঁজছ?”

দৃষ্টি এখনো তার মাটির দিকেই। সেদিকে ধ্যান দিতে চাইলো না জারনাব। জিজ্ঞাসু স্বরে বলল, “হ্যাঁ, কোথাও দেখছি না যে।”

কথাখানা বলতে বলতে পুনরায় দ্বারের বাইরে উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলো জোভিয়া বাইরে কোথাও আছে কি-না। তার উঁকি দেওয়া তখন বন্ধ হলো যখন আব্দুর রহমান বলল, “জোভিয়াকে পাবে না তুমি। সে গৃহে নেই।”

“গৃহে নেই মানে! এই ঝড়ের মধ্যে আবার কোথায় গেছে? মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। বাইরে শুধু সবদিকে বালু উড়ছে। চোখে-মুখে এসে পড়বে। তাছাড়া ডালপালা ভেঙে পড়তেছে। এখন বাইরে থাকা খুবই বিপজ্জনক। আপনি ওকে এই সময় কীভাবে বাইরে যেতে দিলেন আব্বাজান?” চিন্তিত স্বরে বলল জারনাব। অতঃপর হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল দ্বারের দিকে। ডেকে উঠলেন আব্দুর রহমান।

“কোথায় ছুটলে আবার?”

ফিরলো জারনাব। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কোথায় আবার? দেখে আসি জোভিয়া কোথায়।”

“তার কোনো প্রয়োজন নেই। তুমি কামরায় গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে এসো। কথা আছে।”

তার বাক্যগুলো যেন আমলেই নিলো না জারনাব। উল্টো মনোক্ষুন্ন হলো সে। আহত গলায় বলল, “কথা পরেও বলা যাবে আব্বাজান। জোভিয়া এই ঝড়ের মধ্যে বাইরে। আমি কামরায় গিয়ে শান্তি পাবো না। চিন্তা হবে। তারচেয়ে বরং খুজে নিয়ে আসি।”

পুনরায় পা বাড়ালো সে। এবার খানিক নড়েচড়ে বসলো আব্দুর রহমান। উচ্চস্বরে বলল, “কে হয় সে তোমার? যার জন্য এই ঝড়ের মধ্যে বাইরে যেতে এতো উতলা হয়ে উঠেছো।”

হতবুদ্ধির ন্যায় ঘুরে তাকালো জারনাব। এসব কেমন প্রশ্ন করছে আব্বা? কী হয় মানে! সে হতভম্বের ন্যায় বলে উঠলো, “হঠাৎ করে কী হয়েছে আপনার আব্বা? জোভিয়া আমার বোন। ছোট বোন ঝড়ের মধ্যে বাইরে থাকলে বড় বোন কীভাবে শান্তিতে ঘরে থাকবে বলুন? তাছাড়া সারাদিন রোজা থেকে দোকানে একনাগাড়ে খেটেছে মেয়েটা। নিশ্চয়ই দূর্বল হয়ে পড়েছে।”

আহত চোখে মেয়ের চিন্তিত মুখের দিকে তাকালেন আব্দুর রহমান। এতক্ষণ আটকে রাখা অশ্রুকণা বাঁধ মানলো না আর। গড়িয়ে পড়লো নেত্র বেয়ে। হকচকিয়ে উঠলো জারনাব। দৌড়ে আসলো তার নিকট। উত্তেজিত কন্ঠে শুধাল, “কাঁদছেন কেন? কোথায় কষ্ট হচ্ছে আব্বাজান? আমাকে বলুন। ক্ষতস্থানে ব্যথা করছে আবার?”

“নেই জোভিয়া, কোথাও নেই। চলে গেছে সে। নিজের স্থানে ফিরে গেছে। এই গৃহে আর কখনোই আসবে না সে। কেন মিছে মায়া লাগাচ্ছ? আমাদের এই গরিবের গৃহে আর কতদিন থাকতো এভাবে কষ্ট করে? যার এক ডাকে হাজার-হাজার সেবক-সেবিকা হাজির হয়ে যায় সে আর কতদিন সামান্য দোকানির মুখোশ পড়ে থাকবে? তার উচ্চ বংশ, চাকচিক্যময় জীবন আমাদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে, আম্মা। তুমি ভুলে যাও তাকে। মুছে ফেলো নিজের হৃদয় থেকে। তাকে আর কখনোই ছুঁয়ে দেখা হবে না তোমার। দূর আকাশের নক্ষত্রের সৌন্দর্য যেমন জমিনে দাঁড়িয়ে দেখেই স্বাদ মেটাতে হয়, সে ঠিক তেমনি এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যার সৌন্দর্য দূর থেকেই অবলোকন করা যায়।”

ছিটকে সরে দাঁড়ালো জারনাব। কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল, “মমমানে? ককোথায় চলে গেছে জোভিয়া? আপনি তো বলেছিলেন তার সাত কুলেও কেউ নেই। সে একা। তাহলে কীসের টানে ফিরলো সে?”

“আমি তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম। সে একা নয়, তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা বিশাল। স্বামী আছে, সন্তান আছে, বাবা-মা, শশুর-শাশুড়ি, বোন-ননদ সবাই আছে।
দু’বছর আগে যখন আহত মেয়েটাকে বাড়িতে এনেছিলাম তখন তার পরিচয় গোপন করাটা খুব জরুরি ছিল। তবে আজ আর সেই বাধ্যবাধকতা নেই।”

এবার বুঝি বিস্মিত হবার কথা ছিলো জারনাবের। কিন্তু আশ্চর্য! সে বিস্মিত হলো না বরং তেজি গলায় বলল, “সেদিন নয় আপনি আজ মিথ্যা বলছেন। কোথাও যায়নি জোভিয়া। আপনারা আমার সাথে মজা করছেন, তাই না? নিশ্চয়ই ঘরে কোথাও লুকিয়ে আছে ও। বজ্জাত মেয়েটা সবসময় আমাকে ভয় দেখাতে চায়। আজ ওর একদিন কী আমার একদিন।”

আর এক মুহুর্ত সেখানে দাঁড়ালো না সে। দৌড়ে গেল নিজেদের কামরায়। আরো কিছু বলতে চেয়েছিল আব্দুর রহমান। মেয়ের ব্যাকুলতা উপলব্ধি করতে পারছে সে। তবে জারনাব চলে যাওয়ায় আর কিছু বলা হয়ে উঠলো না। অনিমেষ চেয়ে থাকলো সে দ্বারের দিকে। হন্তদন্ত হয়ে নিজ কামরায় প্রবেশ করলো জারনাব। এদিক-ওদিক উঁকিঝুকি দিয়ে জোর গলায় বলল, “জোভিয়া, কোথায় তুমি? বেরিয়ে এসো বলছি। দেখো, সমসময় কিন্তু এসব মজা ভালো লাগে না। মাথা থেকে বদ বুদ্ধিগুলোকে বিদায় দাও আর সামনে এসো দ্রুত।”

নিস্তব্ধ এ কামরা যেন গিলে নিলো তার কথা। ফিরতি কোনো উত্তর এলো না। ঝড়ের প্রকপে নড়ে উঠছে জানালার কপাট। বোধহয় খুলে যেতে চাইছে। ঘরের এ পাশ থেকে ওপাশ পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করলো জারনাব। কিন্তু এই ঘরে একটা বিছানা আর মাঝারি আকারের দুটো বাক্স ছাড়া কিছুই নেই। তবুও খোঁজার চেষ্টা করছে সে। তার সাথে সাথে বালু ঝরে ঝরে পড়ছে তার পোশাক থেকে। মেঝে ভরে উঠেছে বালুতে। কিচকিচ করছে পায়ের তালু। তবে সেদিকে কোনো ধ্যান নেই তার। ভাবলো অন্ধকারে বোধহয় সে ঠিকমতো দেখতে পাচ্ছে না। তাই ছুটে গিয়ে খুলে দিলো জানালার কপাট। সঙ্গে সঙ্গে জানালা দিয়ে ময়লা আসতে শুরু করলো ঘরের ভেতরে। তবে ধ্যান নেই জারনাবের। সে স্বস্তি পেল ঘরে সামান্য আলো প্রবেশ করাতে। যে আলোতে চোখে পড়লো জোভিয়ার কাঠের বাক্সটা। যেটা বিছানার কোনায় খোলা পড়ে রয়েছে। তার মধ্যে উড়ে যাওয়ার জন্য ছুটোছুটি করছে একটি কাগজের টুকরো। তবে স্বর্নের মোটা দুটো বালা দিয়ে চাঁপা দেওয়া রয়েছে কাগজটা। যার দরুন উড়তে পারছে না সে। এতো দামী অলংকারও চোখে পড়ছে না যেন জারনাবের। ব্যস্ত হয়ে সে নিখুঁতভাবে বালাদুটোকে অগ্রাহ্য করে সরিয়ে রেখে হাতে তুলে নিলো কাগজের টুকরোটা। এটাই যেন মহা মূল্যবান জিনিস তার নিকট। কাগজের উপরে কিছু লেখা রয়েছে তবে সেগুলো পড়া যাচ্ছে না এই সামান্য আলোতে। সে দ্রুত এগিয়ে গেল জানালার দিকে। বাইরে থেকে বাতাসের সাথে বালু এসে ভরিয়ে দিচ্ছে তার শরীর। সরলো না সে। মাথা ঝুঁকিয়ে পড়তে লাগলো পত্রটা।

“বুবু, শুনতে পাচ্ছো আমার কন্ঠ? পাচ্ছো না বোধহয়। আমায় খুঁজছ বুঝি? চিন্তা করো না বেশি। আমি খুব বেশি দূরে চলে যায়নি তোমার থেকে। মনে আছে তোমার? দু’বছর পূর্বে যখন আব্বাজান আমাকে এনে তোমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিল ‘তোমাকে ছোট একটা বোন উপহার দিলাম, সামলে রেখো’। তুমি কীভাবে সেই এক বাক্যে আমাকে এতটা সামলে রাখলে, বলো তো? কষ্ট হয়নি তোমার, নতুন সদস্য মেনে নিতে? কামরা ভাগাভাগি করে নিতে? আব্বাজানের আদরও বুঝি ভাগ হয়েছিল সেদিন! তবে তুমি হয়ে উঠেছিলে মহীয়সী। ঝিনুক যেমন মুক্তাকে আগলে রাখে ঠিক সেভাবেই আষ্টে-পিষ্টে আগলে নিয়েছিলে আমাকে। সেই দিনটা বদলে দিয়েছিল আমার জীবন। আপনজনদের ধোঁকা, চক্রান্ত, অজানা শত্রুর করা ষড়যন্ত্র, পৃথিবীর চরম নিষ্ঠুরতার সম্মুখীন হয়েছিলাম সেদিন। তবে সেদিনই পেয়েছিলাম নিঃস্বার্থ এক ভালোবাসার মানুষ। আমার পরিচয় কখনো দেওয়া হয়ে ওঠেনি তোমাকে। আজ বলছি, এই রামান সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী আমি। সুলতান শাহজাইন শাহ-এর বেগম এলিজা সুলতান। যাকে দেখার আফসোস তুমি মাঝে মাঝেই করতে। অথচ নিজের অজান্তেই তাকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রেখেছিলে তুমি। আমায় ক্ষমা করে দিয়ো এতটা দিন তোমাকে ধোঁয়াশার মাঝে রাখার জন্য। কিছু যে করার ছিলো না আমার। জানো, ছোট থেকে সে কী বিশাল চাকচিক্যের মাঝে বড় হয়েছি আমি, অথচ মায়ের আদর পায়নি কখনোই। যখন দুঃখ পেয়ে মন খারাপ করতাম তখন এগিয়ে আসতো একদল সেবিকা। ভালোবাসা ছিলাম না আমি তাদের কাছে। কেবলই দায়িত্ব ছিলাম। তারপর এই সাম্রাজ্যে বেগম হয়ে এলাম। সুলতানের অজস্র ভালোবাসা পেয়েছি কিন্তু মায়ের ভালোবাসার ঘাটতি কি আর পূরণ হয়? সেই অভাবও পূরণ করেছো তুমি। তোমার এতো ঋণ কী করে চোকাবো আমি? এভাবে যেতে চাইনি। তবে বাধ্য হলাম। দূরে থেকে শত্রুকে চিনতে গিয়ে অজান্তেই তাকে অনেক সুযোগ দিয়ে ফেলেছি, আর নয়। এবার শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। শত্রু নিধন করতে হবে। ওরা খুব নিষ্ঠুর জানো তো? আমার ছোট্ট মেয়েটাকে পর্যন্ত ছাড়েনি। তাকে রোজ রোজ ওষুধের সাথে জবান না ফেরার জড়িবুটি মিশিয়ে খাইয়েছে। নহলে হয়তোবা আমার তোহফা অনেক আগেই কথা বলতে পারতো। কেন এতো ষড়যন্ত্র, এতো নিষ্ঠুরতা জানা নেই। কারোর তো কোনো ক্ষতি করিনি আমি। তবুও আমার কন্যা এই অল্প বয়সে চক্রান্তের শিকার হলো। যেই স্বামীকে ছাড়া দু’দন্ড দূরে থাকলে শ্বাস নিতে ভুলে যেতাম তাকে ছেড়ে দু-দুটো বছর দূরে থেকেছি। তার চোখের অজস্র পানির কারন হয়েছি। আমার সুলতান বোধহয় কখনোই আমাকে ক্ষমা করবে না কিন্তু তুমি বিশ্বাস করো তাদের আমি খুব ভালোবাসি। আমি সে সময় মহলে ফিরে এলে ওরা আরো হিং’স্র হয়ে উঠতো। ক্ষতি করে দিতো আমার তোহফার। অজানা শত্রুর মোকাবিলা কীভাবে করে বলতে পারো? আপনজনের মুখোশ পড়ে যে পিঠ পিছে বিষ মিশ্রিত তীর নিক্ষেপ করে তাকে কী করে চিনবো আমি? তুমি আমায় ক্ষমা করবে তো বুবু? ওরা আমাকে হত্যা করতে প্রচুর অর্থ দিয়ে লোক ভাড়া………..”

আর পড়তে পারলো না জারনাব। পত্রটা হাত ফসকে উড়ে গেলো জানালা দিয়ে। নিমেষেই ঝড়ের মাঝে বালুর অতলে তলিয়ে গেলো। অসাড় হয়ে এলো তার শরীর। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো সে। চোখ টলমল করলেও শক্ত হলো তার মুখশ্রী। যেন বাইরের এ ঝড়ের চেয়ে প্রবল তার বিষাদ। তার মেঝেতে বসার শব্দ বোধহয় শুনতে পেল আব্দুর রহমান। নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে সে। কী আর করার আছে তার? মেয়েটা যে তার হৃদয়েও মায়া লাগিয়েছে। ভুলবে কী করে? মনে পড়লো সেই দিনের কথা। যেদিন হত্যা করার কথা ছিলো এলিজা সুলতানকে। সেদিন তার পেটে ধারালো ছুরি চালান করতে পারলেও শেষ পর্যন্ত কেন যেন হত্যা করতে পারেনি তাকে। সেদিন যখন দাউদাউ করা আগুন এসে তার শাড়ি ছুঁয়েছিলো ঠিক তখনই তার করুন আকুতিতে ধ্বক করে উঠেছিল তার হৃদয়। স্বামীর জন্য, কন্যার জন্য বাঁচতে চেয়ে ছটফট করা মানুষটাকে মারতে পারেনি সে। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল জারনাবের নিষ্পাপ মুখটা। সেদিনই প্রথম নিজের কর্মে ব্যর্থ হয়েছিল সে। তার হাত টেনে সরিয়ে নিয়েছিলো আগুনের থেকে। অজানা এই শত্রুকে চিনতো না সে নিজেও। সে তো অর্থ পেয়েছিল একজন সেবকের হাতে। শত্রুর থেকে বাঁচাতে আহত সম্রাজ্ঞীকে নিজ গৃহে এনে তুলে দিয়েছিলো কন্যার হাতে। গরীব মানুষ সে, পারেনি রাজবংশের মতো করে উন্নত চিকিৎসা করতে। সাধ্যে যতটা কুলিয়েছে চেষ্টা চালিয়ে গেছে সে। তবে ক্ষত ঠিক হয়ে তার পুরোপুরি সুস্থ হতে লেগে গেছে বহুদিন। যতদিনে সে সুস্থ হয়েছে ততদিনে তার লাশ আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছে ভেবে সকলেই মেনে নিয়েছে তার মৃত্যুকে। চারপাশে রটে গেছে তার মৃত্যু সংবাদ। এতোকিছুর পরেও থামেনি সেই শত্রু। নিজের চক্রান্ত চালিয়ে গেছে। তাইতো নিজের বুকে পাথর চেপে এলিজা সুলতানকে পর্দায় ঢেকে সে হয়ে উঠলো জোভিয়া। সকলে তার মৃত্যুকে মেনে নিয়েছে দেখে সুযোগ পেলো সে। লুকিয়ে লুকিয়ে দুটো বছর অনুসন্ধান চালালো শত্রুর। অথচ আশানুরূপ কোনো ফল পেয়েছে কি-না তার জানা নেই।

বাইরে তীব্র ঝড়ো হাওয়ায় সবকিছু লন্ডভন্ড হলেও থমথমে মহল। উড়ছে জানালায় টাঙানো বিশাল বিশাল পর্দাগুলো। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুলছে ঝাড়বাতিটা। জ্বলে থাকা মোমবাতিগুলো নিভে গিয়েছে বহু পূর্বেই। দ্বারে দাঁড়ানো নারীটির আগুনে পোড়া আঁচলটা উড়ছে নিজের মতোন। উপস্থিত সকলের চোখ যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার জোগাড়! বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে আছে মাহতাব। কঠিন সে নীরবতা ভেঙে হাত থেকে তলোয়ার মেঝেতে পড়ে ঝনঝন শব্দ তুলল। হঠাৎ ফাইজার হাত থেকে ছুটে গেল তোফহা। দৌড়ে গিয়ে আষ্টে-পিষ্টে আঁকড়ে ধরলো নারীমূর্তিটিকে। অধর প্রসারিত করলো নারীটি। হাঁটু গেড়ে বসলো তার সম্মুখে। অতঃপর এক টানে তাকে আগলে নিলো নিজের কোলের মধ্যে। চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলল তার পুরো মুখ। আদুরেভাবে তার বুকে মুখ লুকালো তোহফা। বুকের সাথে নাক ঘষে টেনে নিচ্ছে রজনীগন্ধার কড়া সুঘ্রাণ। শান্তি পেলো বোধহয় নারীটি। আলতো করে তোহফার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো সে। চোখে-মুখে একরাশ আত্মতৃপ্তি। মাতৃত্ব অনুভব করলো বুঝি কঠিনভাবে। সৈনিক আর সেবক-সেবিকাগুলো এখনো থরথর করে কাঁপছে। বিড়বিড়িয়ে বলছে, “আত্মা! আত্মা! ভূত!”

তাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে কামরা ছেড়ে ছুটে এসেছে প্রতিটি প্রাণী। মারজিয়া সুলতান, শেহজাদি মাইরা, ওয়াসিফা সুলতান, সুলতান শাহজিল। বাদ যায়নি অসুস্থ তানহাও। আনাবিয়ার সাহায্যে এসে উপস্থিত হয়েছে গোলাকার ফাঁকা স্থানটাতে। রন্ধনশালা থেকে ছুটে এসেছে হাফসাসহ সকল রাঁধুনি। আসেনি সুলতান। তার নিকট কি তবে পৌঁছালো না এই ধ্বনি? সকলের হতভম্ব চেহারাকে নিখুঁতভাবে অগ্রাহ্য করলো নারীটি। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো সৈনিকদের দিকে। ধমকে বলে উঠলো, “একদম চুপ। কীসের আত্মা? না মরলে সে মানুষ আত্মা হয় না কি? মূর্খের দল।”

মুহুর্তেই থেমে গেল তাদের কাঁপাকাপি। মুখে কুলুপ এঁটে অবাক চোখে চেয়ে থাকলো শুধু। তবে শুরু হলো চাঁপা গুঞ্জন। সম্রাজ্ঞী বেঁচে আছে! মরেনি সে! এতোগুলো দিন কোথায় ছিলো? এতোদিন পর কেন এসেছে? কী উদ্দেশ্যে নিজের মৃত্যু সংবাদ ফেলেছিল সে? মরার নাকট করলো কেন বেগম! এমন হাজার হাজার বাক্য সে অগ্রাহ্য করলো। ক্রুর হেসে সবার দিকে একবার নজর বুলাল সে। তোহফার কপালে চুম্বন করে তাকে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ালো। দ্বার ছেড়ে দু’পা এগিয়ে এলো ভেতরে। ঠোঁট বাঁকিয়ে আফসোসের সহিত বলে উঠলো, “দুঃখিত, একটু দ্রুতই চলে এলাম বোধহয়? বিবাহের তো এখনো দু’দিন বাকি! তা কোনো আয়োজন দেখছি না যে? বাইরের দেয়াল ঘষামাজা করেই সব আয়োজন শেষ?”

তার কন্ঠ মহলের দেয়ালের ফাঁকে হারিয়ে গেল। সকলের স্তব্ধ চাহনি তার দিকেই সীমাবদ্ধ। কারোর মুখে কোনো রা নেই। এবার শুরু হলো নতুন গুঞ্জন। বেগম যখন গিয়েছিল তখন তো তোহফা অনেক ছোট ছিলো তাহলে সে কীভাবে চিনলো নিজের আম্মাকে? তার কোনো ছবি তো টাঙানো নেই মহলে। এমন সময় তোহফা আদুরে হাতে টেনে ধরলো তার মুখ। চুমু বসালো তার দুই গালে। আরো একবার হতবাক হলো উপস্থিত সকলে। আবারো হাসলো নারীটি। তোহফার দিকে চেয়ে বলল, “আম্মু, ওষুধ খাওনি তো আর?”

দ্রুতবেগে ডানে-বামে মাথা নাড়ালো তোহফা। যার অর্থ: সে খায়নি। অতঃপর পুনরায় মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে মাথা এলিয়ে দিলো। তাকে কোলে নিয়েই মাইরার দিকে এগিয়ে গেল সে। হতবাক কন্ঠে বলল, “আরে বিয়ের কনে যে! বিবাহের আগেই রোজা থেকে শুকিয়ে গেলি তো। উঁহু, মোটেই ভালো লক্ষণ নয়। এখন তো আরো বেশি বেশি রূপচর্চা করা উচিত তোর।”

খিচে নিজের চোখদুটো বন্ধ করে নিলো মাইরা। বোন জীবিত ফিরেছে এ আনন্দ যেন মিইয়ে গেল তার। এই কন্ঠের জবাব সে দিতে পারবে না। বোনের রাগ আর ভালোবাসা দুটোর সঙ্গেই গভীরভাবে পরিচিত সে। এ সময় তার মুখে মুখে উত্তর দেওয়া মানে অজগরের মুখে খাবার তুলে দেওয়া। মেয়ের কন্ঠের বিদ্রুপ ঠিকই ধরতে পারলো মারজিয়া সুলতান। গলা শুকিয়ে এলো তার। ঢোক গিলল সকলের আড়ালে। তবে পার পেলো না শেষ পর্যন্ত। মাইরাকে পার করে এবার মায়ের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো সে। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “আমার জন্য তুমি এতদিন খুব কষ্টে ছিলে, তাই না আম্মা? নিশ্চয়ই তোমার অমতেই এই বিবাহের আয়োজন করেছিলো সবাই। ঠিক ধরেছি না, বলো?”

নীরবে মাথা নিচু করে থাকলেন মারজিয়া সুলতান। কিন্তু আকস্মাৎ চেঁচিয়ে উঠলো এলিজা, “কী হলো? বলছো না কেন? বলো, কষ্ট পেয়েছিলে কি-না?”

“হ্যাঁ, মা। কককষ্ট পাবো না কেন? মেয়ের জন্য কককোন মায়ের হৃদয় পোড়ে না?”

কাঁপা কাঁপা স্বরে বললেন মারজিয়া সুলতান। শব্দ করে হেসে উঠলো এলিজা। হুট করে হাসি থামিয়ে কষ্ট পাওয়ার ভান ধরে বলল, “একদম ঠিক বলেছো। আমার মেয়ের জন্যও আমার হৃদয় পোড়ে। তাইতো এতো বিপদ মাথায় নিয়েও লুকিয়ে লুকিয়ে এই মহলে আসতাম শুধু এক পলক মেয়েকে দেখতে। তোহফাও কিন্তু চেনে তার আম্মাকে। আমি যে জীবিত সে কথা সে জানতো তবুও কাউকে বলেনি। কেন জানো? কারন সে তীক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী। এতটুকু বয়সেই সে এতটা বিচক্ষণ তবে কেন আবার উত্তরাধিকার চাইবে এই সাম্রাজ্য? তোমারও খুব হৃদয় পুড়ছিল, না? আর আমার স্বামীর সাথে তোমার ছোট কন্যার বিবাহ। সেটা কেন? তোমার স্বামীর ধন-দৌলত ফুরিয়ে গেছিলো বুঝি? দুই জামাইকে আপ্যায়ন করা কষ্ট তাই দুই কন্যার এক স্বামী বানাতে চাচ্ছিলে।”

দাঁত কিড়মিড় করে তার সমস্ত কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছিলো ওয়াসিফা সুলতান। শাহজিল সুলতান বরাবরের মতোই নীরব ও শান্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।
ভিড় ঠেলে তাদের দিকে এগিয়ে এলো সৈনিক। সতর্ক হয়ে গেলেন ওয়াসিফা সুলতান। সবাকে এক নজর দেখে নিলেন সতর্ক দৃষ্টিতে। অতঃপর দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিসিয়ে বলল, “এখানে কী করছিস? খুঁজে পেয়েছিস তাকে?”

“মাফ করবেন সুলতানা। খবর দেওয়ার ছিলো আপনাকে। কয়েদিকে খুঁজে পেয়েছি। এতোদিন অন্ধকারে থাকার কারনে হুট করে বাইরে এসে এতো আলো সে সহ্য করতে পারেনি। দেয়ালের কাছে মুখ গুঁজে বসে ছিল লুকিয়ে। আমি ধরে নিয়ে আবার কারাগারে বন্ধ করে এসেছি।”

স্বস্তির শ্বাস ছাড়লেন ওয়াসিফা সুলতান। সৈনিকের দিকে ইশারা করতেই সে দ্রুত সেই স্থান ত্যাগ করলো। এতোক্ষন দমিয়ে রাখা ভয়টা যেন নিশ্বাসের সাথে বেরিয়ে এলো বুক চিরে। মুহুর্তেই নিজের স্বরূপ ধারন করলো সে। হনহন করে এগিয়ে এলো এলিজার দিকে। কটমটে চাহনি নিক্ষেপ করে বলল, “তুমি যদি জীবিতই ছিলে তবে মহলে আসোনি কেন এতদিন? নিজের মিথ্যা মৃত্যুর নাটক সাজিয়েছিলে কোন উদ্দেশ্যে? এতদিন কোথায় ছিলে? কেন ছিলে? সেই ব্যাখ্যা করতে হবে তোমাকে। আর শাহজাইনের বিবাহ দেওয়ার উদ্যোগটা একেবারেই স্বাভাবিক। এতে এতো উত্তেজিত হবার কিছু নেই। এসেই নিজের সেই রগরগে ব্যবহার আরম্ভ করে দিয়েছো। ভুলে যেও না তুমি একজন নারী। নারীদের কথাবার্তা শালীন হতে হয়।”

“নারী তো আপনিও আম্মা। নিয়মটা আপনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আমার সাথে কেউ উচ্চ কন্ঠে কথা বললে তার প্রশ্নের উত্তর দেই না আমি। তবে আপনি আমার আম্মার মতোন। মতোন কেন বলছি? আম্মাই তো আপনি। যা হোক, সব প্রশ্নের উত্তর এখন দিতে পারবো না। তবে এতটুকু বলবো। আমাকে হত্যা করবার চেষ্টা করা হয়েছিল। আহত করেছিল বটে কিন্তু প্রাণে মারতে ব্যর্থ হয়েছিল। তারপর দীর্ঘদিন আমার চিকিৎসা চলেছে গোপনে। তারপর যখন সুস্থ হলাম ততদিনে আমার আগুনে পুড়ে মৃত্যুর ঘটনা পুরো সাম্রাজ্যে রটে গেছে। কিন্তু তাতে শত্রুর কী? তার উদ্দেশ্য কী? এতোদিনেও বের করতে পেরেছেন আপনারা? এতো এতো সৈনিক নিযুক্ত করেও কি হত্যাকাণ্ড থামাতে পেরেছেন?”

আকস্মাৎ কমে এলো ঝড়ের প্রবল বেগ। টপ করে মাটিতে পড়লো বোধহয় বৃষ্টির ফোঁটা। ভিড় ফেলে এগিয়ে এলেন সুলতান। বেশ খানিকটা সময় হলো এখানে এসেছে সে। সবকিছু শুনেও দাঁড়িয়ে ছিলো পেছনে। এসব সত্যি না কি মিথ্যা বুঝতে সময় লাগছে তার। সে হতবাক নয়নে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বেগমের দিকে এগোতে গিয়েও আবার কী ভেবে পিছিয়ে গেল কয়েকপা। আবারো বুঝি ধোঁকা দিচ্ছে আর নয়ন! এ যদি তার ভ্রম হয়! তবে তো ছুঁলেই হারিয়ে যাবে সে। কিন্তু সকলের স্তব্ধ চাহনি যেন তাকে মানতে বাধ্য করলো এ কঠিন বাস্তবতা। তবে কি সত্যিই ফিরলো তার এলিজা? তার অসাড় হয়ে আসা দেহটাকে টেনে টেনে খানিক এগিয়ে নিয়ে গেল সে। ঠোঁটের ফাঁক পেয়ে বেরিয়ে এলো আবেগঘন ডাক।

“এলিজা!”

চলবে…………

#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_15

ইদের আমেজ নিয়ে চাঁদ উঠেছে গগনে। আকাশ জুড়ে অজস্র তারকাবিন্দুর উচ্ছ্বাস। শেষ বিকেলেও বৃষ্টি পড়েছে অথচ রাত নামতেই পরিষ্কার সবকিছু। মিটেছে প্রকৃতির গুমট ভাব। শীতল হয়েছে আবহাওয়া। মহলের আনাচে-কানাচে খুশির আমেজ। সম্রাজ্ঞীর আগমন যেন ইদের আনন্দকে করেছে দ্বিগুণ। তার আগমনে প্রজারা যেমন আনন্দিত ঠিক তেমনি গোপনে কেউ প্রচন্ড অসন্তুষ্ট। মহল ঝলমল করছে অগনিত মোমবাতির আলোতে। থেকে থেকে মৃদু হাওয়ায় দুলছে আগুনের শিখা। তানহা এখন কিছুটা সুস্থ তবে পুরোপুরি নয়। মহলের ছাদে চাঁদরাত পালন করতে সে কি বিশাল আয়োজন। ছাদের মেঝেতে বিছানো হয়েছে বিশাল মাদুর। সোনালি আর লাল সুতার মিশ্রিত কারুকার্য রয়েছে তাতে। কোনায় কোনায় জ্বালানো হয়েছে বিশাল বিশাল বাতি। মাথার উপরে শুভ্র চন্দ্র। প্রশান্তির জন্য আর কী লাগে? মাদুরে বসে আমেজে মেতেছে আজমাইন মাহতাব, শেহজাদি মাইরা, শেহজাদি তানহা, তোহফাসহ সেবক-সেবিকাগুলোও। ফাইজা এক কোনে বসে সাজগোজ করছে। তা দেখে হা-হুতাশ করছে হাফসা। ওয়াসিফা সুলতানের এসব কোনোকালেই পছন্দ ছিলো না তাই সে নিজ কামরায় বসে আছে। সুলতান শাহজিল একবার এসে দেখে গেছে সবকিছু। মারজিয়া সুলতান হন্তদন্ত হয়ে নিজ সাম্রাজ্যে ফিরেছে কোনো এক অজ্ঞাত কারনে। তোহফা আজ ভীষণ খুশি। একেতো ইদ তার উপর তার আম্মা ফিরেছে। আনন্দ যেন ধরছে না তার। খুশিতে লাফালাফি করছে সে। নিঃশব্দে হাসছে। কী চমৎকার সেই হাসি!

সুলতানের কামরার দ্বারের সম্মুখে শক্ত পাহাড়া। পুরো মহল ইদ আনন্দে মেতে উঠলেও এই একটি কামরা বোধহয় পায়নি এখনো ইদের খবর। তাইতো এতো বিষাদ তার দেয়ালে দেয়ালে। গালে হাত দিয়ে মাথা নুইয়ে রেখেছে এলিজা সুলতান। গালটা ব্যথায় টনটন করছে। পাঁচ আঙুলের দাগও হয়তো পড়ে গেছে তার ফর্সা মুখটাতে। নয়ন জোড়া অনুভূতি শূন্য। সম্মুখেই সুলতান দাঁড়িয়ে আছে পেছন ফিরে। শক্ত চোখে চেয়ে আছে দেয়ালমুখো হয়ে। সে কি তবে দেখতে চাইছে না তার বেগমকে?

আহত দৃষ্টিতে মুখ তুলে তাকালো এলিজা। ধরা গলায় বলল, “আমার দিকে তাকান না সুলতান? দেখুন না একবার আমাকে?”

“কেন আমার সাথে এমন নিখুঁত ছলনা করলে তুমি এলি? জীবিত হয়েও মৃত্যুর স্বাদ ছড়িয়ে দিলে আমার হৃদয়ে।” ভেসে এলো সুলতানের শক্ত কন্ঠস্বর।

“আমি নিরুপায় ছিলাম। বিশ্বাস করুন, আমি প্রতারণা করতে চাইনি। বাধ্য হয়েছিলাম নিজেকে আড়াল করতে।”

“প্রিয় মানুষের বিশ্বাসঘাতকতা কতটা পোড়ায় জানো?
দু দুটো বছর প্রিয় মানুষটার মৃত্যু বুকে ধারন করার যন্ত্রণা তুমি উপলব্ধি করতে পারো?”

ছলছল করে উঠলো এলিজার নয়ন। দাঁতে দাঁত চেপে ঢোক গিলে আটকাতে চাইলো অশ্রুর ফোয়ারা। সামান্য এগিয়ে সুলতানের হাত ধরতে চাইলে সে ছিটকে সরিয়ে নেয় নিজের হাত। এবারো তাকালো না বেগমের দিকে। অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে কঠিন স্বরে বলল, “আমাকে ছুঁয়ো না। চলে যাও আমার সামনে থেকে। আমি নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছি এলি। আবারো তোমাকে আঘাত করার পূর্বেই চলে যাও তুমি। এসো না আমার সামনে।”

“কেন নিয়ন্ত্রণ করছেন সুলতান? শাস্তি দিন আমাকে। আল্লাহর দোহাই লাগে এভাবে মুখ ঘুরিয়ে থাকবেন না আমার থেকে। আমি সহ্য করতে পারছি না।”

উত্তর দিলো না সুলতান। আজ যেন দুনিয়ার সমস্ত কঠিন পদার্থ নিজের মাঝে ধারন করছে সে। পাথর হয়ে গেছে কি তার হৃদয়? না কি তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে মনের আঙিনায়?

“কেন আমার এ অসীম ভালোবাসা তুমি অনুভব করতে পারলে না এলি?”

চকিতে তাকালো এলিজা। সে কি সত্যিই অনুভব করতে পারেনি? তার সুলতান তো মিথ্যা কথা বলে না। তবে কি সে ব্যর্থ হলো ভালোবাসতে! সুলতান পুনরায় বলল, “চলে যাও তুমি। আমাকে একা থাকতে দাও। আমি শান্তি পাচ্ছি না তোমার সম্মুখে। যে বাতাস তোমার শ্বাস গ্রহণ করছে সে বাতাস আমাকে প্রতারণার ছোবলে দংশন করছে।”

কাতর দৃষ্টিতে তাকালো সে। শ্বাস আটকে রাখার প্রচেষ্টা চালালো। লাল হয়ে উঠলো তার মুখমণ্ডল। সে আহত স্বরে শুধাল, “আপনি কি এখন আর আমাকে ভালোবাসেন না সুলতান?”

“বিশ্বাসঘাতককে ভালোবেসে ধ্বংস বয়ে আনতে বলছো?”

“সেই ধ্বংসলীলাতেও আমি আপনাকেই চাইব।”

আচমকা তেড়ে এলেন সুলতান। চোখের মণির আশেপাশে যেন রক্ত জমাট বেঁধেছে। হিং’স্র তার চাহনি। কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই শক্ত করে চেপে ধরলেন বেগমের হাতের কব্জি। এতোটাই শক্তি প্রয়োগ করেছে যে মুহুর্তেই অশ্রু নেমে এলো তার চোখে। ব্যথায় মৃদুস্বরে আহ করে উঠলো। দয়া হলো না বোধহয় সুলতানের। প্রচন্ড নির্দয়ভাবে তাকে টেনে আনলো কামরার বাইরে। তার ব্যথাতুর দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে তাকে বাইরে রেখে কামরায় গিয়ে দ্বার আটকে দিলো সে। আহত নয়নে বন্ধ দ্বারের দিকে চেয়ে থাকলো এলিজা। এ দ্বার কি সত্যিই খুলবে না তার জন্য? সেখানেই দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো সে। নাহ! দ্বার খুলল না। বরং দ্বারের বাইরে পাহাড়ারত সৈনিকদের মাঝে চাপা গুঞ্জনের ঝড় উঠলো। রাগান্বিত হবার কথা থাকলেও রাগলো না এলিজা। হতাশার তপ্ত শ্বাস ফেলে চলে এলো সেখান থেকে। মহলের গোলাকার স্থানটাতে এসে দাঁড়ালো দেয়াল ধরে। বুকে পাথর চেপে অশ্রুগুলোকে আটকে রাখলো শক্ত আবরনে। হুট করে কোথা থেকে তার দিকে দৌড়ে এলো তোহফা। এসেই তাকে জাপটে ধরলো আষ্টে-পিষ্টে। নিমেষেই তার কষ্টের ভার শূন্যতে এসে ঠেকল। একরাশ প্রশান্তি ছেয়ে গেল হৃদয়ে। সে দ্রুত ঝুঁকে পড়ে তাকে কোলে নিলো। বরাবরের মতোই নিঃশব্দে হাসলো তোহফা। গলা জড়িয়ে ধরে মুখের পানে চাইতেই হাসি মিলিয়ে গেল তার। মলিন হলো তার চঞ্চল দৃষ্টি। মায়ের রক্ত রঙা চোখের পেছনের কষ্টটা বোধহয় উপলব্ধি করতে পারলো সে। ছোট ছোট হাতদুটো বাড়িয়ে আকড়ে ধরলো মুখখানা। চুমু বসালো দুই নয়নে। মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মেয়ের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে গেল এলিজা।

এমন সময় সেখানে এসে উপস্থিত হলেন ওয়াসিফা সুলতান। খেয়াল করেনি এলিজা। সে তো মেয়েকে নিয়ে মত্ত। ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ তাচ্ছিল্য সহকারে হাসলেন ওয়াসিফা সুলতান। এগিয়ে এসে বিদ্রুপ করে বললেন, “কী হলো? রাতের বেলা এখানে কেন? এতোদিন পর আসলে, কোথার স্বামীর কাছাকাছি থাকবে তা না বাইরে বাইরে ঘুরছো! শাহজাইনের কামরায় ঠাঁই মেলেনি বুঝি?”

আকস্মিকতায় চমকে উঠলো এলিজা। তার শাশুড়ি কখন এসে এখানে দাঁড়িয়েছে সে জানেই না। অথচ মানুষটা তাকে কী সাবলীলভাবে খোঁচা মেরে দিলো। তবে তার মন এখন পাল্টা জবাব দেবার জন্য প্রস্তুত নয়। এ বিষন্নতা কাটিয়ে উঠা এতো সহজে হবে না তার দ্বারা। তাকে চুপ থাকতে দেখে বোধহয় জিতে গেলেন ওয়াসিফা সুলতান। চোখে-মুখে অদৃশ্য এক হাসি ফুটে উঠলো তার। সে পুনরায় হেয়ালি স্বরে বললেন, “এবার হয়তো শাহজাইনের মনোরঞ্জনের জন্য সেবিকা নিয়োগের সময় এসে গেল। আর কত একলা কাটাবে সে? একজন সুলতানের জীবনযাপন কখনো এমন রসকসহীন হয় না।”

“মনোরঞ্জনের জন্য সেবিকা নিয়োগ! মানে?” অবাক কন্ঠে শুধাল এলিজা।

“এটাও জানো না? অথচ রাজবংশীয় মেয়ে তুমি। তোমার পিতার সাম্রাজ্যে কি এই প্রথা চালু নেই? না কি জেনেও না জানার ভান ধরছো? আমার জানা মতে রামান সাম্রাজ্য ছাড়া সমস্ত সাম্রাজ্যেই এই প্রথা চালু আছে। এখানে এতোদিন শুধু শাহজাইনের অমতের কারনে এই প্রথা চালু করা হয়নি। তবে এবার হবে। কালই এ ব্যপারে আলোচনা করবো আমি। সুলতানের মনোরঞ্জনের জন্য দাসি নিয়োগ দেওয়া হয়, যারা তার শয়নকক্ষে………..।”

বাক্য সম্পূর্ণ করা হলো না তার। চিৎকার করে উঠলো এলিজা।

“থামুন। আর শুনতে চাই না আমি। আপনি একজন নারী হয়ে এ ধরনের কথা কীভাবে বলতে পারলেন আম্মা?”

“এতো অবাক হবার কিছু নেই। ইতিহাসে এমন সম্রাজ্ঞীও আছে যে কি-না সুলতানের মনোরঞ্জনের জন্য দাসী হিসেবে নিযুক্ত হয়ে পরে তাকে সন্তুষ্ট করতে পেরে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সম্রাজ্ঞীর সম্মান পেয়েছে।”

“দয়া করে থেমে যান। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। বারবার আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিবেন না। আমার সহ্য ক্ষমতা কম।”

তেতে উঠলেন ওয়াসিফা সুলতান। রাগান্বিত স্বরে বললেন, “চেঁচিয়ো না। অতিরিক্ত রাগ আর অযথা চিৎকার করে সবকিছু হাসিল করা যায় না। স্বামীর থেকে এতোগুলো দিন সেচ্ছাই দূরে থাকতে পেরেছো। তাহলে মনোরঞ্জনের জন্য দাসী আসলেও তোমার তেমন কোনো সমস্যা হবার কথা নয়। তুমি নিজের মেয়েকে নিয়েই সুখে থাকো।”

আহত দৃষ্টিতে চেয়ে শুধু শুনে গেল এলিজা। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো নিজের অজান্তেই। অযথা তর্ক করতে মোটেও ইচ্ছা করছে না তার। তাই নীরবে তোহফাকে কোলে নিয়ে ত্যাগ করলো সেই স্থান। সে কিছু না বললেও দাদিজানের দিকে কটমটে চাহনি নিক্ষেপ করলো তোহফা। পারলে যেন এখনি কোল থেকে নেমে তেড়ে যাবে। এতোটুকু মানুষ অথচ দৃষ্টির কী তীক্ষ্মতা! তার চাহনি লক্ষ করলেন ওয়াসিফা সুলতান। ভ্রু কুচকে বিড়বিড়িয়ে বললেন, “এটাও কি নিজের মায়ের মতো হচ্ছে না কি?”

যেতে যেতে এলিজা বলে উঠলো, “আজ আমরা একসাথে ঘুমাবো, ঠিক আছে আম্মা? সারারাত গল্প শুনাবো।”

উচ্ছ্বাসিত ভঙ্গিমায় মাথা দুলালো তোহফা। মায়ের গলা জড়িয়ে রেখে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে তুলতে লাগলো তার সারা মুখ। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে মৃদুস্বরে হাসলো এলিজা নিজেও। ধীরে ধীরে নজরের আড়ালে চলে গেল তারা। হতবুদ্ধির ন্যায় সেদিকে চেয়ে থাকলেন ওয়াসিফা সুলতান। সে এবার তালগোল পাকিয়ে ফেলছে শাহজাইন এলিজাকে কামরা থেকে বের করে দিয়েছে না কি এলিজা সেচ্ছাই কামরা ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে!

চলবে…….