#সায়র
#অন্তিম_পর্ব
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
কিরণ উত্তরাতে বড় একটা শোরুম ভাড়া নিয়েছে। সেখানে সে ব্যবসা দাঁড় করাবে। তার হাতে বানানো যত শিল্পকর্ম সব শিফ্ট করা হয়েছে সেখানে। এখন খালি ডেকোরেট করা বাকি। উজানের সাহায্যেই তার এতদূর আসা। কিরণের মা আর ভাইকেও ঢাকায় নিয়ে এসেছে।
মহিন চেয়েছিলেন ছেলের নামে কেস করবেন তিনি। জাহানা বাঁধা দেন। যতই হোক, তার একটামাত্র ছেলে, ছেলেকে কষ্ট দিলে তারও বুক পুড়বে। জুভের নামে কোনো কেস করলে তার বিদেশে যেতে পড়ে সমস্যা হবে। তাই স্বামীকে অনেক বলে কয়ে কেস করার ভূত মাথা থেকে নামান। জাওভানকে একেবারের জন্য নিউইয়র্কে পাঠিয়ে দিতে বলেন। সেটাই মহিন করেছে। তবে জাওভান বিডির মাটিতে যাতে পা না মাড়ায় সেই ব্যবস্থাও করছেন সাথে এখান থেকে ব্যবসার শাখা তুলে নিতে বলেছেন।
উগ্র মেজাজী জাওভান কিছুই মেনে নিতে পারছিল না। সে আগ্রাসী হয়ে উঠছিল কিরণকে মারার জন্য। কিন্তু কিরণ উজানকে বিয়ে করেছে জানার পর সে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়েছে। নাওয়া খাওয়া তার বন্ধ করে সারাদিন ফ্লাটে পড়ে থাকে। আগে কিরণকে যখন তখন যেটা ইচ্ছা আদেশ করতে পারত, তার কথা মতো চলতে বাধ্য করত, কিন্তু এখন! এখন সে চাইলেও কিরণকে নিজের হাতের পুতুল বানাতে পারবে না। উজান কিরণের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাওভান খুব ভালো করেই জানে উজানকে ডিঙিয়ে কিরণের দিকে এখন আর হাত দেয়া যাবে না, কারণ এখন যে কিরণ তার স্ত্রী। জাওভান ভাই হয়ে উজানের নিকট যেই সেইফটি পেয়েছে সেখানে কিরণ স্ত্রী হয়ে তার চেয়ে দশগুণ বেশি নিরাপত্তা পাবে। সেটা জেনেই জাওভান নিভে গেছে।
তার আফসোস হচ্ছে এখন। কিরণকে হারিয়ে ফেলল সে, সারাজীবনের জন্য। এটা মানতে খুব কষ্ট হয় তার। অদৃশ্য দাবানলে ভেতরটা জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যায়। তার মনে পড়ে কিরণের সাথে করা বাজে ব্যবহারগুলো। কিরণ যে ধর্ষিতা সেটা জেনে প্রথমে কিরণকে আজেবাজে ভাষায় গালিগালাজ করলেও এখন সে অনুতপ্ত। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম বুঝে না – এখন তার হয়েছে এই অবস্থা। মনে হয় কিরণকে যদি সেদিন ওসব না বলত তাহলে হয়ত কাহিনীটা অন্যদিকে মোড় দিত। আসলে তখন তার যেটা সঠিক মনে হয়েছিল সেটাই করেছে। কিরণকে অন্য কেউ স্পর্শ করেছে, তাকে নষ্ট করেছে, আর সেটা কিরণ তার থেকে লুকিয়েছে এসব ভাবতেই ক্রোধানলে দগ্ধ হয়ে বাজে ব্যবহার করেছে সে। তবে এখন মনে হচ্ছে এসব না করলেই পারত। শুধু শুধু নিজের ভালো থাকার জিনিস নিজ হাতেই নষ্ট করেছে সে। কিরণ তার সম্পত্তি ছিল!!
জাওভান কিছুতেই নিউইয়র্ক ফিরবে না। সে এখানেই থাকবে কিরণের নিকট। জাহানা এসে বুঝিয়েছেন, সে যদি এখানে থাকে তার বাবা কেস না করলেও উজান করতে পারে। তখন তার বাহিরের দেশে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে সাথে ব্যবসাটাও। এখন আর শুধু শুধু কিরণের আশা করে লাভ নেই। এর চেয়ে ভালো নিউইয়র্কে গিয়ে জাহানার আর তার নিজের ব্যবসায় হাত লাগাতে। মরিচীকার পেছনে দৌড়ে তো লাভ নেই। একূল ওকূল দুকূল হারাবে শেষে। জাওভান বুঝতে পারছে, মা যা বলছে তার একটা কথাও যে ফেলনা নয় সেটা সে মানছে।
ভাইয়ের সাথে লড়াই করে এখন আর লাভ নেই। কিরণকে তো পাবেই না বরঞ্চ তার উল্টো ক্ষতি হবে। এই বাস্তবতা তার মানতেও অনেক সময় লেগেছে। সে মায়ের কথা মতোই চলে যাবে বলেছে। তবে যাওয়ার আগে কিরণকে একপলক দেখবে সেই আশাটাও ব্যক্ত করেছিল মায়ের প্রতি। সেটা জানার পর উজান সাফ সাফ জানিয়ে দেয় জাওভানের ছায়া যদি কিরণের আশেপাশে দেখে তাহলে সেদিন হবে তার শেষ দিন। সে জাওভানকে ত্যাগ করেছে। ভাইয়ের এতটা পরিবর্তন জাওভানকে অনেক অবাক করেছে। দুইদিনের পরিচয়ে দেখা হওয়া একটা মেয়ের জন্য শান্ত উজান এতটা অশান্ত কেন হলো? তখন তার মনে পরে, এই দুইদিনের পরিচয়ে দেখা হওয়া মেয়েটার জন্যই সে সবার সাথে কতটা খারাপ আচরণ করেছিল। তখন আফসোস তাকে কুড়ে কুড়ে খায়।
সে চলে যাবে। আর কষ্ট দিবে না কিরণকে। কিরণ সুখে থাকবে তাতে।সেটা ভাবলে মাথায় আবারও রাগ চেপে বসে। কিরণকে ভোলার জন্য নিজ মনেই কিরণের নামে বাজে কথা সৃষ্টি করে। একটু আগের যখন সে উত্তাপের আগুনে পুড়ছিল তা নিমিষেই ছাই হয়ে উড়ে যায়। নিজ মনে বলে, থাকুক ঐ কলঙ্কিনী তার ভাইয়ের কাছে। অমন কয়েকবার ইউজ করা মেয়ে তার লাগবে না। সে আরো ভালো মেয়ে পাবে। কিরণের থেকেও ভালো, সুন্দরী। অন্তত কিরণের মতো নষ্ট হবে না। যা ইচ্ছে করুক কিরণ। যাকে ইচ্ছে তাকে বিয়ে করুক, তার কী?
তার এসব ভাবনার মাঝে অদৃশ্য কেউ বলে উঠে, ‘আঙ্গুর ফল টক।’
.
.
জ্যোৎস্নালোকিত রাত। আকাশে থালার মতো পূর্ণিমার গোল চাঁদ নিজের সবটুকু আলো বিলিয়ে দিচ্ছে ধরাধামে। মোহনীয় স্নিগ্ধ কিরণমালায় সায়রের গাঢ় নীল জল ঝলমল করছে। জলের উপর বেসামাল হয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে কুয়াশা। কুয়াশার ধুম্রজাল ভেদ করে উজান এসে দাঁড়িয়েছে সায়রের পাড়ে। চাঁদের নরম আলোয় দাঁড়িয়ে থাকা সুঠামদেহী উজানকে দূর থেকে দেখলে মনে হয় রূপকথা থেকে উঠে আসা রাজকুমার।
শীত শেষ হয়েছে কয়েকদিন আগেই। কিন্তু আজকের সমুদ্রের দিকে নজর গেলে মনে হয় সেখানে শীতের শুরু মাত্র।
উজান চশমাটা খুলে বুকে ঝুলিয়ে রাখল। দুহাত পকেটে পুরে চোখ বন্ধ করে গভীর শ্বাস ফেলল। তারপর আকাশের পানে চেয়ে রইল ক্ষণকাল। সময় কাকে কখন কোথায় এনে ফেলে তা কেউই ঠাহর করতে পারে না। তীর্যক হাসে উজান। তার হাসির সাথে গালের কাটা দাগ মিলিয়ে যায়। ডান হাত দিয়ে চুল পেছনের দিকে ঠেলে সমুদ্রের ঝিকিমিকি জলে দৃষ্টিপাত করে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উজান ভাবতে থাকে সে কত কত পাগলামী করেছিল কিরণকে পাওয়ার জন্য। এই পাগলামী সে ছাড়া আর কেউই জানে না। জানবেও না কখনো। এগুলো যে তার মনের গহীনে হওয়া পাগলামী।
—-
বর্ষাকালে কিরণকে প্রথম দেখেছিল ছোট্ট একটা রেস্টুরেন্টে ঠিক তার পাশের চেয়ারেই বসা। সে তখন মায়ের আর তার ছবির দিকে নির্নিমেষ চেয়েছিল। মূলত ছবিটা দুটি ছবির মিলিয়ে করা একটি ছবি। সে কখনোই তার মাকে দেখেনি। শুধু ছবিতেই দেখত। তারপর মায়ের পুরোনো একটা ছবি আর নিজের ছোটকালের একটা ছবি মিলিয়ে নিখুঁত ভাবে একটা ছবি বানিয়েছে সে। দেখলে মনে হয় উজানের মা সত্যি সত্যি উজানকে জড়িয়ে ধরে আছে। এই ছবিটা উজানের মনে প্রশান্তি দেয়। ছবিটা দেখলে সে তার মাকে অনুভব করতে পারে। যেই নিঃসঙ্গতা তাকে গ্রাস করে বেড়ায় প্রতিনিয়ত তা কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়।
ঠিক তখন একটা মেয়ে তার পাশে বসে বলেছিল, ‘কাঁদছেন কেন?’
উজান ভেতরে ভেতরে অনেক চমকায়। পাশ ফিরে দেখে মাতাল একটি মেয়ে আধবোজা চোখে তাকে দেখছে। উজানের বুক ধড়ফড় করে উঠে হঠাৎ। সে আসলেই কাঁদছিল। অদৃশ্য কান্না। ভেতরে ভেতরে সে এতটা অসহায়, যে কষ্টে তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। উজান বিরক্তির ভান করে মেয়েটার দিকে তাকালেও তার বুকে উচ্চস্বরে দামামা বাজছিল। সে নিজেকে আজীবন শক্ত খোলস দ্বারা আবৃত করে রেখেছে। এই খোলসের ভেতরের উজানকে কেউ কখনো দেখেনি। নিজের সুখ দুঃখ, অনুভূতি সব চাপা রেখেছিল নিজের ভেতর। জাওভান তার সাথে এতটা বছর কাটানোর পরেও খেয়াল করেনি ভাইয়ের মনে রাখা এক আকাশ সম কষ্ট। কেউই খেয়াল করেনি, করবে কী করে? উজান নিজের সত্তাকে ঢেকে রেখেছিল শক্ত আবরণে। সেই আবরণ ভেদ করে একটা সাধারণ মেয়ে তাকে পড়ে ফেলবে এটা উজানের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকল। মেয়েটাকে আড়চোখে দেখল কয়েকবার। উজান নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিল না। তার কোনোদিন এমন অনুভূত হয়নি। বারবার তার চোখ পড়ছিল মেয়েটার দিকে। তার ভেতরটা দুরুদুরু কাঁপছিল। কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলল।
মেয়েটি যখন ঝড়ো বৃষ্টির রাতে বাহিরে গিয়ে দুহাত মেলে দাঁড়াল তখন উজানের মন আছড়ে পড়ল অজানা ভালোলাগা এক অনুভূতির নিকট। সে কখনো তার আবেগ অনুভূতি সম্পর্কে সন্দেহ নয়। তার চোখ অতর্কিতে খাঁটিটা ধরে ফেলে। এমনটাই হয়েছিল সেদিন। উজানের মনের কুঠুরিতে আবদ্ধ হলো সেই অচেনা রমণী। ফ্লাটে এসেও সে তার মনের অস্থিরতাকে দমাতে পারেনি। এই অস্থিরতা ছিল ভালোলাগার। এতটাই পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিল উজান যে সে সেই রাতেই মাটি দিয়ে সেই অচেনা মেয়েটার ভাস্কর্য তৈরি করার কাজে লেগে পড়ে। এমনও হয়েছে যে তার হাতের কাঁপুনিতে মাটি হাত থেকে পড়ে যায়। একরাতেই উজান পরিচিত হয় ভালোবাসা নামক অসহ্য অনুভূতির সাথে। সঁপে দেয় নিজেকে ভালোবাসার সায়রে। যার কোনো কূল নেই।
উজানের ভালোবাসায় ভাটা পড়ে যখন দেখে মেয়েটির জন্য শুধু সে না, আরেকজনও পতিত হয়েছে। আর সে হচ্ছে তার ভাই জাওভান। কিন্তু উজান যে এবার স্যাক্রিফাইস করবে না। কত ত্যাগ করেছে সে ভাইয়ের জন্য! আর না! কিরণকে তার জন্য চাই। এই মেয়েটার চোখে সে নিজের শান্তি খুঁজে পেয়েছে। বুঝেছে, এই মেয়েটিই তার অশান্ত মনের শান্ত আশ্রয়স্থল। এই শান্তি চিরকালের। উজান তো কিছুতেই কিরণকে হাতছাড়া করবে না। এই চিরকালীন শান্তি তার প্রয়োজন। শুধু তার। এর ভাগ তার প্রাণের ভাইকেও দিবে না। এতে তার যা করা লাগবে সে করবে।
উজান ভাইকে রগে রগে চিনে। জাওভানের কিরণকে চাই মানে চাই-ই। সে সহজে ছাড়বে না। জাওভান থাকতে কিরণকে সহজে পাওয়া যাবে না। উজান মনে মনে ছক কষে। তার জোর জবরদস্তি করে কিছু বাগে আনা একদমই পছন্দ না। শিকার নিজে এসে তার খাঁচায় বন্দী হবে। সে পারত জাওভানকে মেরে কিরণকে নিজের করতে। কিন্তু ভাইকেও সে ভালোবাসতো। চেয়েছিল তার ভাই নিজ থেকেই কিরণকে ছাড়বে। দুজনের মনে থাকবে শুধু ঘৃণা। তারপর পাশ থেকে উজান নিয়ে যাবে কিরণকে। উজান সারা পৃথিবীর নিকট ভালো হতে চায়। কেউ তাকে খারাপ জানুক সে সেটা চায় না।
উজান এমনভাবে ছক কষে যে সাপও মরবে আবার লাঠিও ভাঙবে না। এই প্রথম সে ভাইয়ের বিরুদ্ধে যাবে, ভাইয়ের থেকে ছিনিয়ে নিবে নিজের ভালোবাসাকে। এমনভাবে নিবে যে কিরণ স্বেচ্ছায় আসে তার কাছে। সবাই খেলোয়াড় হয়ে মাঠে নামবে। ইচ্ছেমতো খেলবে। উজান শুধু খেলার মোড়টা পাল্টে উপর থেকে সুতা টানবে।
উজান নিজের করা প্ল্যানে নিজেই দাম্ভিক হাসে। নিজের উপর বিশ্বাস আছে তার। ছোটো থেকে এপর্যন্ত যত প্ল্যান করে এসেছে সব সফল হয়েছে তার। এটাও হবে। তারপর থেকে শুরু হয় তার মাইন্ডগেম খেলা..
কিরণের ফ্রেন্ডের থেকে ঠিকানা নিয়ে উজান চলে যায় ময়মনসিংহে। কিরণের বাসায় পৌঁছালে তখন দেখা হয় কিরণ ও কিরণের বাবা ফারুকের সাথে। কিরণ তখন তার বাবার থাবার হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিল। উজান সেখান থেকে উদ্ধার করে আনে কিরণকে। কিরণের থেকে সবটা শোনার পর উজান থমকে যায়। তার প্রেয়সীর সাথে এতবড় অন্যায় তার মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দেয়। রাতে সে ঘুমাতে পারত না। কিরণের ক্রন্দনরত স্বর তার কানে বাজত। উজানের হৃদয় হাহাকার করত কিরণের জন্য। কাজে মন দিতে পারত না। যতদিন না সে ঐ জানো’য়ারদের শাস্তি দিতে পারবে ততদিন তার আত্মা শান্তি পাবে না।
নতুন প্ল্যান যুক্ত হয়। কিরণের সৎ বাবা আর ঐ লোকটাকে শাস্তি দেয়া। একমাস পর সে আবার ময়মনসিংহ যায়। রাতের অন্ধকারে কিরণের বাড়িতে গেলে দেখে কিরণ ঐ লোকটার যে বর্ণনা দিয়েছিল, সেই লোকটা আর কিরণের বাবা মদ্যপ অবস্থায় পড়ে আছে। উজানের কাজ সহজ হয়ে যায়। দুজনকে একসাথেই শাস্তি দেয়ার জন্য ঘরে আগুন লাগিয়ে দেয়। খবরের কাগজে শিরোনাম হয় গ্যাস সিলিন্ডার ব্লাস্ট হয়ে দুইজনের মৃত্যু। এটাই ছিল উজানের প্রথম মার্ডার করা। কোনো প্রমাণ ছিল না, সহজ সরল একটা খু’ন।
কিরণ খবরের কাগজে ঐ জানোয়া’রদের মৃত্যু শুনে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছিল। সেইদিন কিরণের আনন্দ উজানের হৃদয়ে শীতলতা এনে দিয়েছিল। এই নারীটিকে ভালো রাখার মাঝেই ছিল তার ভালো থাকা…
উজান কিরণকে ফলো করত প্রতিদিন। তাকে একপ্রকার স্টকার বলা চলে। তার সকল কাজে শুধু কিরণ, কিরণ এবং কিরণ। কিরণ কী করত না করত, কোথায় যেত সবটা উজান চোখে চোখে রাখত। আরেকভাবেও সে কিরণের খেয়াল রাখত। সেটা ছিল কিরণের রুমমেট মীরা। মীরাকে সে বলেছিল কিরণের সব খবর যাতে সে উজানকে দেয়। জাওভান প্রথমদিন বাসায় এসে যে কাণ্ড ঘটিয়েছে তারপর থেকে কিরণের রুমমেটরা খুব ভয় পেত তাকে। তাই জাওভানের নাম করে উজান কিরণের সব খবর মীরার থেকে নিতো। মীরা বেচারিও জাওভানের ভয়ে সব সুরসুর করে উজানকে বলে দিতো।
উজানের দ্বিতীয় শিকার ছিল সাদমান। সাদমান কিরণের নিকট হাত বাড়িয়েছে শুনে তাকেও রাস্তা থেকে সরানোর প্ল্যান করল। কার অ্যাক্সিডেন্টের নাম করে তাকেও খু’ন করল। কিরণ ভাবল জাওভান! হাহ! উজান তো চায়ই কিরণ জাওভানকে ঘৃণা করুক। সারাদিন চোখের সামনে কিরণকে নিয়ে জাওভানের মাতামাতি অসহ্য ঠেকত উজানের কাছে। রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে যেত। ক্রোধের আগুনে পুড়ে যেত সে।
অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয় -এই কথাটা স্মরণে রেখে উজান দাঁতে দাঁত চেপে রাগ গিলে ফেলত।
উজান কিরণের কত ছবি এঁকেছে নিজেও জানে না। প্রতিটা দিন কিরণের ভিন্নরূপ দেখে সেটাই ক্যানভাসে তুলে নিত। নিজের কল্পনাতেও ছবি এঁকেছে কিরণের। নদীরে পাড়ে, বারান্দার ধারে, ছাদের কোণায়, কতরকমের ছবি যে আছে! সে যে বাংলোটা কিনল সেটার পুরো ইন্টেরিয়র কিরণের মন মতো সাজালো। সে তো জানত, কিরণের শেষ ঠিকানা যে এটাই হবে।
কিরণের সামনে নিজেকে কঠিন করে রাখাটা ছিল উজানের জন্য বড় একটা চ্যালেঞ্জ। কিরণের দিকে তাকালেই যদি কিরণ তার মনে থাকা অনুভূতিগুলো পড়ে ফেলে সেই ভয়ে সে কিরণের সাথে কঠোর ভাবে কথা বলত। অভিনয় করত সবার সাথে। শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষা করত প্রতিটা ক্ষণ।
কিরণকে নিজের করে পাওয়ার তীব্রতা উজানের ক্রমশ বাড়তেই থাকল। নিভৃতে গড়া ভালোবাসা কিরণের সান্নিধ্যের জন্য অস্থির হয়ে উঠল। ছটফট করত যদি সে একদিন চোখের দেখা না দেখে কিরণকে। কিরণের পিছু পিছু তার দেশের বাড়িতে গিয়ে নজরে রাখল। কিরণের কী পছন্দ অপছন্দ সবকিছুই উজানের ঠোঁটস্থ। কিরণ যেদিন তার বাংলোতে পা রেখেছিল সেদিনও তার পিছু নিয়েছিল উজান।
জাওভান আর কিরণের সম্পর্কে ইতি টানার জন্য কাজে লাগায় ইয়ানাকে। ইয়ানা এমনিতেই উজানের প্রতি দুর্বল ছিল। তাই একদিন উজান নিজ থেকেই ইয়ানাকে প্রস্তাব দেয় সে যদি জাওভান আর কিরণের সম্পর্কে ফাটল ধরাবার জন্য উজানকে সাহায্য করে তাহলে ইয়ানার ডাকে উজান সাড়া দেবে। ইয়ানা খুশিতে পাগল হয়ে গিয়েছিল উজানের প্রস্তাব শুনে। আর ভেবেছিল উজান তো এমনিতেই কিরণকে দেখতে পারে না তাই হয়তো তাদের মাঝে ফাটল ধরাতে চায়। বোকা ইয়ানা এর পেছনের উজানের গভীর ষড়যন্ত্র টেরও পায়নি।
মীরার থেকে উজান জেনেছিল কিরণ বাসা ছেড়ে দেয়ার জন্য জাওভানের ফ্লাটে যাবে কিছু জিনিসপত্র আনার জন্য। সেদিন উজান ইয়ানাকে কাজে লাগায়। উজানের কথা মতো ইয়ানা চলে যায় জুভের ফ্লাটে। সেখানে কিছুক্ষণ থাকার পর জাওভানের কফিতে হালকা ডোজের ঘুমের ঔষধ মিশিয়ে দেয় জুভের অজান্তে। ইয়ানাও শয়তান কম না। জাওভানের ঘুমের সুযোগে ঘেষাঘেষি করতে ভুলল না সে। উজানের কথামতো জাওভানের বেডসাইড টেবিলে কয়েকটা প্রটেকশনের প্যাকেট রেখে আরেকটা টেবিলের উপরে খালি প্যাকেট রেখে দিলো। সাথে নিয়ে আসা গোলাপ ফুল খাটে ছড়িয়ে দিলো। পুরো রুমটাকে এমন অবস্থা করল যেন দেখলে মনে হয় তারা এখানে রাত কাটিয়েছে। আসলে তো তার আর জাওভানের মধ্যে জীবনেও কিছু হয়নি।
পরদিন উজান তার প্ল্যান অনুযায়ী চলে গেল ফ্ল্যাটে। কিরণকে জাওভানের ফ্ল্যাটে যাওয়ার সময় তার হাত ধরে আটকানোর ভান করল। যাতে কিরণের মনে সন্দেহ ঢুকে। ততক্ষণে উজানের মেসেজে ইয়ানা দরজা খুলে দেয়। ব্যস। কিরণ আর জাওভানের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি শুরু হয়। এমনকি উজান যখন ময়মনসিংহে কিরণকে মানানোর জন্য গিয়েছিল তখনো উজানের কথায় ইয়ানা মেসেজ পাঠায়। মোবাইলটা উজান ইচ্ছাকৃতভাবেই কিরণের সামনে রাখে যাতে মেসেজ আসামাত্রই কিরণ পড়তে পারে আর ভাবতে পারে এটা জাওভান দিয়েছে।
তবে তাকে সাহায্য করলেও পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ইয়ানা। যেদিন সে কিরণের অ্যাক্সিডেন্টের খবর পায় সেদিন পাগলের মতো হয়ে যায় উজান। কিরণের অবস্থা বেশি খারাপ না হলেও উজানের কাছে তা ছিল মৃত্যুসম। ঘুমন্ত কিরণের মুখের দিকে চেয়ে তার বুক কেঁপে উঠেছিল। চোখে জল এসে ভীড়ছিল। ক্রোধে তার সারামুখ লাল হয়ে গিয়েছিল। পরে জাওভানের পিছু পিছু নিয়ে জানতে পারে সেটা ইয়ানা ছিল।
সেদিনের ঘটনা। জাওভান সেদিন ইয়ানাকে মারেনি। গলায় পর্দা জড়িয়ে কিছুক্ষণ শ্বাসরোধ করে রেখেই ছেড়ে দিয়েছিল। জাওভান যখন চলে যায় ইয়ানা গলা ধরে কাশতে কাশতে বসে পড়ে। তার সামনে একজোড়া পা দেখে ইয়ানা মাথা তুলে। দেখে উজান তার দিকে শান্ত চোখে ঘাড় কাত করে তাকিয়ে আছে। উজানকে দেখে ইয়ানা গলা ধরে শান্তির শ্বাস ফেলে। ভাঙা গলায় বলল,
‘উজি, জুভের হাত থেকে আমাকে বাঁচা প্লিজ। ও আমাকে মে’রে ফেলতে পারে।’
‘তার আগেই আমি তোকে তোর শান্তির জায়গায় পাঠিয়ে দেব ইয়ানা।’ উজানের হিম শীতল কন্ঠ।
উজানের রক্তলাল চোখের দিকে তাকিয়ে ইয়ানা ভয় পেয়ে যায়। কিছু বলবে তার আগেই গ্লাভস হাতে সেই পর্দা নিয়েই ইয়ানার গলা চেপে ধরে উজান। শক্ত হাতে উত্তপ্ত চোখে তাকিয়ে ইয়ানার শ্বাসরোধ করে মে’রে ফেলে সে। ইয়ানাকে এমনিতেও মারতো। কারণ ইয়ানা যদি কোনোভাবে বলে দিত সে এসব উজানের কথায় করেছে তাহলে উজান ফেঁসে যেত। উজান কোনো প্রমাণ রাখতে চাইত না তার কাজের। তাই ইয়ানাকেও সরানোর ব্যবস্থা করে। তবে এত তাড়াতাড়ি মা’রার প্ল্যান ছিল না তাকে। ম’রতে হলো। উজান আত্মাহীন ইয়ানার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
‘আমার কিরণের দিকে হাত বাড়িয়েছিস নাহয় আর কয়টা দিন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে পারতি। নিজের হাতে নিজেকে শেষ করলি তুই।’
ইয়ানাকে একটা ওড়নার সাথে পেঁচিয়ে তার রুমে ফ্যানে ঝুলিয়ে দেয়। চেয়ার খাটের উপর ফেলে দেয়। তারপর ইয়ানার পড়ার টেবিল থেকে তার খাতাগুলো দেখে নেয় উজান। উজানের আর্ট করার দরুণ ইয়ানার হাতের লেখা কপি করতে সমস্যা হয় না। সে জানতো ইয়ানার পরিবার সম্পর্কে। তাই একটা সুই’সাইড নোট লিখে দেয় আর সবাই ভাবে ইয়ানা আত্ম’হত্যা করেছে। ব্যস, ইয়ানার ব্যাপার এখানেই ক্লোজ। এই ব্যাপার না কোনোদিন কিরণ জানবে আর না অন্য কেউ।
উজান জাওভানকে কখনো ঘৃণা করতে চায়নি। ভাইকেও কখনো দূরে সরাতে চায়নি। সে চেয়েছিল কোনোরূপ সহিংসতা ছাড়াই কিরণকে নিজের করে নেবে। কিন্তু জাওভানের রূপ ধীরে ধীরে প্রকাশ হতে লাগল। উজান একটা ছবি এঁকেছিল উল্টোদিকে ঘুরে থাকা কিরণের। জাওভান সব আর্ট নষ্ট করেছিল যেদিন সেদিন তার জন্য উজানের ঘৃণা শুরু হয়। তারপর তো আরো ঝগড়া গেল, জাওভান বাজে বাজে কত কথা বলল উজানকে, যেগুলো উজানের সহ্য ক্ষমতার বাইরে ছিল। সেই থেকে উজান জাওভানের কথা ভাবা বাদ দিয়েছে। জাওভান যে এতদিন উজানকে প্রয়োজনের প্রিয়জন হিসেবে ব্যবহার করেছে সেটা বুঝতে পারার পর জাওভানকেও শেষ করে দিতে মন চেয়েছিল তার। কিন্তু জাওভানের পরিবারের নিক চির কৃতজ্ঞতা থেকে সে জাওভানকে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। তার কাছে কেন যেন খু’ন করতে অনেক ভালো লাগত। এটাও একটা আর্টে পরিণত হয় তার। যত নিখুঁতভাবে এই আর্ট করবে তত উজানের ধরা পড়ার সম্ভাবনা কম হবে।
প্রতিদিন সে নিজের পরিকল্পনায় একবার করে চোখ বুলাতো। জাওভানের উপর ক্ষুব্ধ হয়ে পরিকল্পনা দ্রুত শেষ করতে চাইছিল সে। উজান এমন সুনিপুণভাবে ছক কষেছিল যে সে দুনিয়ার সবার নিকট সুপাত্র হিসেবে পরিচিত থাকবে। তার আপনজন কেউই টের পাবে না যে সে আসলে সবার সাথে মাইন্ডগেম খেলছে। উল্টো জাওভানকে খারাপ বানিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো পরিবার থেকে। উজানকেই ভালোবাসবে সবাই। সবাই জানবে উজান নিষ্পাপ…
—
‘উজান!’
সুমিষ্ট নারীকণ্ঠের আওয়াজে গভীর ভাবনার জগৎ থেকে বের হয় উজান। অদূরে তার প্রিয়তমা তাকে ডাকতে ডাকতে আসছে। উজান অপলক চেয়ে থাকে কিরণের দিকে। ভালোবাসার কী শক্তি! ভালোবাসা তাকে পাগল প্রেমিকে পরিণত করেছে। উন্মাদ করেছে। মাতাল করেছে। উজান পরিতৃপ্ত। জীবনে কম অবহেলা পায়নি সে। অন্যের কথা চিন্তা করে, অবহেলা পেয়ে পেয়েই তার জীবনের অর্ধেক পার করেছে। আপন মায়ের ভালোবাসা তার কপেলে জুটেনি। তবে সত্যিকারে ভালোবাসা আর পালিত মায়ের ভালোবাসার পার্থক্যও বুঝেছে সে। ভালোবাসার অভাব বয়ে বেড়িয়েই সে এতদূর এসেছে। এবার সে ক্লান্ত। আর বয়ে বেড়াতে পারছে না এই ভালোবাসাহীন জীবন। তার ভালোবাসা চাই। আর তার জন্য স্বার্থপর হওয়া চাই। যতটা পাপ করলে এই ভালোবাসা তার নিকট ধরা দেবে ততটা পাপী হওয়া চাই…
কিরণ সাদা একটা লং ড্রেস পরেছে। চাঁদের কিরণ গায়ে মেখে ধীর পায়ে হাঁটতে থাকা কিরণকে কোনো স্বর্গীয় অপ্সরী লাগছিল উজানের কাছে। নিঃশ্বাস আটকে আসছিল তার।
কিরণ বালুচরেই থেমে যায়। উজান এগিয়ে যায় তার দিকে। কিরণের কাছে মনে হয়েছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ তার দিকে এগিয়ে আসছে। এটা মনে হওয়ার কারণ কী? এত দিনে মনে হয়নি তবে আজ কেন? উজান কিরণের অর্ধাঙ্গ বলে? প্রতিটা নারীর কাছেই কি তার স্বামী পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন? কিরণ কখনো উজানকে অন্য চোখে দেখেনি। উজানকে ততটা ভালোও লাগতো না তার। তবে বিয়ে হওয়ার পর তার মধ্যে আমূল পরিবর্তন এসেছে। তিনটা শব্দ বলার পর উজানকেই তার সবচেয়ে আপন মনে হয়েছে। মন সারাক্ষণ উজানের ভাবনা চিন্তায় বুদ হয়ে থাকে। তবে কি সেও ভালোবাসতে শুরু করেছে? কিরণ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠে। এই ধরনের ভালোলাগা এর আগে কখনোই হয়নি। ভালোবাসা এত মোহনীয় কেন!!
উজান কিরণের সামনে এসে দাঁড়ায়। তার চোখে তৃষ্ণা। কিরণকে দেখার তৃষ্ণা।
উজানের চোখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে কিরণ গলা খাঁকারি দেয়। বলে,
‘এত রাতে এখানে কী?’
‘দেখছিলাম কার কিরণের উজ্জ্বলতা বেশি। আমার কিরণের নাকি চাঁদের।’ আবেশী কণ্ঠ উজানের।
কিরণ আড়ষ্ট হয়ে যায় লজ্জায়। ইদানীং উজান এমন এমন কথা বলে যে কিরণের লজ্জা পাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। উজান যে এত রোমান্টিক তা তাকে বিয়ে না করলে জানতোই না।
‘কিরণ।’
কিরণ ঠোঁট টিপে তাকায়। উজানের চোখে অন্যরকম দৃষ্টি। মোহময় চাহনিতে তাকিয়ে আছে সে। ধীর গলায় উজান বলে,
‘আমি কি তোমাকে একটু স্পর্শ করতে পারি?’
উজানের কণ্ঠ ভেতরটা নাড়িয়ে দেয় কিরণের। বিয়ে হয়েছে বেশিদিন হয়নি। কিরণকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সময় দিয়েছে উজান। এরমধ্যে কখনোই সে অন্যভাবে স্পর্শ করেনি কিরণকে। কিরণ নিজ থেকেই হাত বাড়িয়ে দিলো।
উজান শক্ত করে চেপে ধরল সেই হাত। উজান কিরণকে পেছন থেকে আলতোভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখল। কিরণ শিহরণে কেঁপে উঠল। তার বুক ধুকপুক করতে লাগল। শরীর অসাড় হয়ে পড়ল ভালোলাগার অনুভূতিতে। যেন সে এখুনি ঢলে পড়বে। উজান কিরণকে শক্ত করে নিজের বুকে চেপে ধরল। কিরণের কাঁধে মাথা রেখে আড়চোখে তাকে দেখতে লাগে। কিরণের লাজরাঙা মুখ দেখে উজান মিটিমিটি হাসে। প্রিয়তমার লাজুক মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
কিরণ বুঝতে পারছে উজান তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিরণ এত লজ্জা নিয়ে আর থাকতে পারছিল না। ইচ্ছে করছিল দৌড়ে রিসোর্টে চলে যেতে। নিজেকে স্বাভাবিক দেখানোর উদ্দেশ্যে কথা শুরু করে সে।
‘জানো উজান, আমার মনে হয় কী, জাওভানকে যদি আমি প্রথমেই আমার অতীত বলে দিতাম তাহলে এত কিছু সহ্য করা লাগত না। কেননা ও আমার সাথে আরো আগেই ব্রেকাপ করে ফেলত এসব শুনে।’
উজান মুখে কিছু না বললেও সে জানে এটা আসলে অসম্ভব। যদি জাওভান প্রথমেই এসব জেনে ব্রেকাপ করত তাহলে তো উজানের এত কষ্ট করে এই খেলা শুরু করার কোনো দরকারই ছিল না। সে তো সহজেই পেয়ে যেত কিরণকে। কিন্তু জাওভানকে কিরণ না চিনলেও সে তো চিনে। জাওভান প্রথমদিকে কিরণের জন্য অনেক পাগলামী করত। কিরণকে পাওয়ার জন্য সে সব করতে রাজি ছিল। তখন যদি কিরণের অতীত বলে দিত, সেটা জাওভানের মনে ততটা প্রভাব ফেলত না যা রিলেশনের এক বছর পর পড়েছে। প্রথম দিকে কিরণের জন্য হয়তো জুভ মেনে নিত কিরণের অতীতটা। তখন কিরণকে পাওয়া উজানের জন্য আরো বেশি কঠিন হয়ে পড়ত। তাই তো তাদের এক বছর সময় দিয়েছে উজান। এরমধ্যে জাওভানের মনে কিরণের জন্য আর কিরণের মনে জাওভানের জন্য একটু একটু ঘৃণা তৈরীর দরকার ছিল। মনোমালিন্য হওয়ার দরকার ছিল। জাওভান কিরণকে কখনোই রেসপেক্ট করেনি, কিরণকে কষ্ট দিয়ে নিজে ভালো থাকতে চেয়েছিল এই বোধ কিরণের মনে উদয় হওয়ার দরকার ছিল। জাওভানের যখন মোহ ধীরে ধীরে কাটবে, যখন কিরণকে নিজের ভালোবাসা নয় বরং পুতুল হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করবে তখন জাওভানকে কিরণের অতীত বলা জরুরি ছিল। উজান সফল। প্রতিটা কাজে সে সফল।
চন্দ্রালোকিত আকাশের দিকে তাকিয়ে উজান প্রশান্তির শ্বাস নিলো। তারপর আবার মুখ গুঁজল কিরণের কাঁধে। ছোট্ট একটা চুমুও বসিয়ে দিলো সে। কিরণ যেন কারেন্টের শক খেল। তার কম্পন টের পেয়ে উজান আরো একটা চুমু খেল ইচ্ছা করে।
চাঁদ এখন সমুদ্রের বুকে। এমন স্বর্গীয় দৃশ্য উজান আর কিরণের মন কাড়ল। উজানের ইচ্ছা করল এক্ষুনি সে ক্যানভাস এনে এই চাঁদের সাথে তার একান্ত চাঁদটাকেও ক্যানভাসে তুলে নিতে। কিন্তু এখন প্রিয়তমাকে ছাড়তে ইচ্ছা হলো না তার। বরং প্রিয়তমাকে বুকে নিয়ে এমন দৃশ্য সে হাজারবার দেখার অভিলাষ পোষণ করল। কিরণের মসৃণ চুলে নিজের মুখ ডুবিয়ে সে অস্ফুটসুরে বলল,
‘দ্য মুন ইজ বিউটিফুল, ইজন্ট ইট?’
‘হুম।’ ঘোর লাগানো চোখে চাঁদের আর সমুদ্রের মিলনের দিকে চেয়ে বলল কিরণ।
উজান হালকা হাসে। তার হাসি টের পায় কিরণ। ঘাড় ঘুরিয়ে উজানের দিকে চায়। হাসলে উজানকে প্রাণোচ্ছল লাগে। উজানের উচিত গম্ভীর মুখের বদলে এই হাসিমুখে সারাদিন থাকা। যার দিকে সারাদিন সম্মোহিতের ন্যায় চেয়ে থাকবে কিরণ।
উজানকে হাসতে দেখে সে জিজ্ঞেস করল,
‘এখানে হাসার কী হলো?’
‘তুমি এখনো বুঝোনি কিরণ।’ উজান হাসতেই থাকে।
সেই হাসির দিকে মোহগ্রস্তের ন্যায় তাকিয়ে থেকে কিরণ বলে, ‘কী বুঝবো?’
উজান পকেট থেকে ফোন বের করে কিরণের হাতে দেয়। তারপর বলে, ‘আমি একটু আগে চাঁদ নিয়ে কী বলেছি তা গুগল করো mi amor’ এই বলে আবারো মূখ ডুবায় কিরণের চুলে।
কিরণ দ্রুত গুগল করে। যা দেখে তাতে তার মুখ হা হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ তার মনে পড়ে উজান এই কথাটা আথো একবার বলেছিল নদীর ধারে। তারপর আবার কী মনে করে উজানের শেষ কথাটাও গুগল করে। কিরণ জমে যায়। উজান কি তারমানে তাকে আগে থেকে ভালোবাসতো? সে উজানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উজানের দিকে ঘুরে এবার।
‘তুমি…’
‘আমি?’
‘তুমি আগে থেকেই আমাকে পছন্দ করতে?’
‘কোনো সন্দেহ আছে?’ উজান মুচকি হাসে।
‘তাহলে আমার সাথে এত খারাপ ব্যবহার কেন করতে? মনে হত আমাকে কাঁচা গিলে ফেলবে! এত বাজেভাবে কেন কথা বলতে আমার সাথে?’ কিরণ ভ্রুকুটি করে বলে।
উজান কিরণের হাত ধরে আবার নিজের দিকে টেনে আনে। আগের মতো কিরণের পিঠ নিজের বুকের সাথে লাগিয়ে কাঁধে মাথা রাখে। বলে,
‘যাতে তোমাকে ঘৃণা করতে পারি। আমি তো ভেবেছিলাম তুমি অন্যকারো হয়ে যাবে। তাই তোমাকে ঘৃণা করতে চেয়েছিলাম যাতে ভালোবাসা কমে যায়।’
মিথ্যে বলল সে। আসলে তো সে রাগ দমনের জন্য কিরণের দিকে এভাবে তাকাত। আরেকটা কারণ হচ্ছে কিরণ যাতে তার ভেতরের দুর্ভেদ্য উজানকে পড়তে না পারে সেই জন্য এত অভিনয়।
‘কমেছে কি?’ কিরণের প্রশ্ন।
উজান তার প্রত্যুত্তরে কিরণের গালে টুপ করে চুমু খায়। কিরণ চোখ বন্ধ অন্যদিকে মুখ ঘুরায়। সে কিছুতেই তার লাজুক হাসি লুকাতে পারছে না। তারপর হঠাৎ কিছু মনে পড়ল এমনভাবে সে উজানকে বলে,
‘আচ্ছা, তোমার রুমে একটা পেইন্টিং ছিল, ওটার নাম দিয়েছিল mi amor. তাই না?’
উজান আবারও হাসল।
‘আশ্চর্য! এত হাসছ কেন তুমি?’
‘বোকা কিরণ। তুমি কি খেয়াল করোনি ছবিটা যে তোমার?’
কিরণ আশ্চর্যান্বিত চোখে তাকায়। সে মনে করতে লাগল ছবিটা কেমন ছিল। কিন্তু মনে করতে পারল না। সেইদিন এত অস্থিরতার কারণে সে ভালো করে খেয়াল করেনি।
উজান কিরণকে গ্যালারিতে যেতে বলল। সেখানে কিরণের অসংখ্য ছবি। এগুলো সব উজান কিরণের অজান্তে তুলেছে। কিরণ অবাক দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে। উজান আগে থেকেই ভেতরে ভেতরে তাকে ভালোবাসত অথচ সে ঘুণাক্ষরে টেরও পায়নি!
‘ঐ স্কাল্পচারটাও কিন্তু তোমার ছিল যেটাতে চুমু দিতে দেখে আমাকে পার্ভার্ট বানালে।’
‘কিন্তু আমি চিনতে পারলাম না কেন?’
‘কারণ সেটা বাঁকানো ছিল আর তুমি পাশ থেকে দেখেছ। বেশি মনোযোগ সহকারে দেখোনি যে তাই চিনতে পারোনি।’
কিরণ ঝটকা মেরে উজানকে সরালো। চোখ সরু করে বলল,
‘তুমি আসলেই পার্ভার্ট। আর কী কী বানিয়েছ তুমি?’
‘কী বানানোর কথা বলছ?’
‘তোমাকে তো মাঝেমধ্যে দেখি নেকেড পেইন্টিং আর স্কাল্পচার তৈরি করতে। তেমনভাবে আমারও কোনো খারাপ চিত্র আঁকোনি তো?’
উজান খুব কষ্টে হাসি থামাল। বলল,
‘এতদিন এসব চিন্তা মাথায় আসেনি। তুমি যখন বলেছ তখন একবার ট্রাই করে দেখতে হবে।’
‘খবরদার উজান।’
এই বলে কিরণ চলে যেতে লাগল। উজান হাত ধরে থামাল।
‘চলো আমার সাথে।’
‘কোথায়?’
উজান কিরণকে নিয়ে সমুদ্রের দিকে এগোতে লাগল। রাতের জ্যোৎস্না মাখা সমুদ্রের রূপ দেখে মোহিত হলেও কিরণের মনে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে ক্রমশ। সে উজানকে মিনতি করল। উজান শুনল না। ফেনা তোলা হালকা ঢেউ এসে আছড়ে তীরে পড়ছে। উজান কিরণকে নিজের পায়ের উপর ভর করে দাঁড় করালো। কিরণ চোখ বন্ধ করে আছে ভয়ে। উজান কিরণের চুল সরিয়ে ঘাড়ে ছোট্ট একটা চুমু খেল। তারপর কিরণের কোমর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আশ্বস্ত করল,
‘আমি আছি কিরণ, তোমার সাথে। সারাজীবনের জন্য। ভয় পেয়ো না, আমি আছি তো। তোমার ভয়গুলোকে জয় করার পথ দেখিয়ে দেবো আমি। শুধু সাহস করে এগিয়ে চলো, তোমার পাশে আছি আমি, ঢাল হয়ে। থাকবো..সবসময়…সারাজীবন …মৃত্যু পর্যন্ত।’
কিরণ চোখ খুলল চকিতে। এই কথাগুলো সে স্বপ্নে শুনেছিল। ঠিক এরকম দৃশ্যটাই ছিল। কিরণের সাদা জামা, পায়ের উপর পা দিয়ে হাঁটা, একসাথে সমুদ্রে নামা। কিরণের মনে হলো সে তার স্বপ্নে ফিরে গেছে। তারমানে স্বপ্নে দেখা মানুষটি উজান ছিল! তার অর্ধাঙ্গ!
উজান কিরণকে সাথে নিয়ে ধীরে ধীরে সমুদ্রে নামছে। কিরণ ঘোরে ডুবে ছিল। তার ভয় করছে না একটুও। মন বলছে, উজান তো আছে। ভয় কীসের?
পূর্নিমার চাঁদের উজ্জ্বলতাকে গায়ে মাখিয়ে উজান আর কিরণ সমুদ্রের বুকে ডুবে। চাঁদের নীলাভ আভা, জ্বলজ্বল করা নক্ষত্রলোক, চাকচিক্যময় জল যেন পৃথিবীর বুকে এক টুকরো স্বর্গ এনে দিয়েছে। কিরণ অবলোকন করল তার চারপাশ। সায়রের নৈসর্গিক রূপে বশীভূত হয়ে পড়ল কিরণ। মনে উত্তাল ঢেউ তুলল ভালোলাগারা। গভীর ঘোরে আবদ্ধ হয়ে পড়ল সে। উজানের উষ্ণ ভারী নিঃশ্বাস তার ঠাণ্ডা শরীরকে তপ্ততার আবেশে ভাসিয়ে দিচ্ছে।
কিরণ তার কোমর আগলে রাখা হাতের উপর হাত রাখে। একটু হেলে পড়ে উজানের বুকে মাথা রেখে কোমল গলায় ফিসফিস করে বলে,
‘এখন থেকে তোমাকে আমি সায়র ডাকব। যেই সায়রের প্রেমে আমি ভাসবো, ডুববো, মরবো। তুমি হবে আমার…একান্ত আমার সায়র।’
—
উজান পরিতৃপ্তির শ্বাস নিয়ে সমুদ্রে তাকায়। মনে মনে সমুদ্রের সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যে স্মিত হেসে স্বগতোক্তি করে বলে,
‘কিন্তু আমি তো জানতাম আমার ভাগ্য কোথায় এসে ঠেকবে। প্রহেলিকার বেড়াজালে প্রতিটা সদস্যকে আটকে রেখেই তো আমার খেলা শুরু। যার শুরুটা হয়েছে আমার হাতে আর শেষটা…’
বাঁকা হাসে উজান, ‘শেষটাও যে এখন আমার হাতেই হয়েছে। হতেই হতো তাইনা? কী বলো তুমি সায়র? তোমার নামেই যে আমার নাম। তুমি গায়ে ঐশ্বর্যের চাদর জড়িয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করো, আটকে রাখো নিজের মায়াডোরে, অথচ ঐ রূপমোহে আটকে তারা ভুলে যায় তোমার অতলে কতশত হিংস্র প্রাণীর বসবাস। তেমনটা কি আমি নই?’
সমুদ্রের ঠাণ্ডা বাতাস এসে উজানের কানে ফিসফিস করে বলে, ‘তুমিও যে এক ইন্দ্রজাল। তোমার ভেতরকার উন্মাদনা, প্রেম, ভালোবাসা তোমাকে আজকের সায়রে পরিণত করেছে। তুমি যে সায়রের প্রতিরূপ মনুষ্য সায়র।’
হাসল উজান। সে তৃপ্ত সায়রের জবাবে। সে যা শুনতে চেয়েছে ঠিক সেটাই শুনেছে। মন খুলে হাসল সে। আকাশের চাঁদটাও আজ তার সাথে হাসি বিনিময় করছে। কতবছর পর এই সুখের হাসি তার ঠোঁট ছুঁলো? গুনতে পারবে না উজান, চায়ও না। এই হাসি তার ঠোঁটে লেগে থাকুক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। লেগে থাকুক যতটাদিন কিরণ নামক প্রণয়িনী তার সাথে আছে।
.
.
সমাপ্ত