সাহেব_বিবি_গোলাম পর্ব-১৩

0
1419

#সাহেব_বিবি_গোলাম
#নুশরাত_জেরিন
#পর্ব:১৩

,
,
দেখতে দেখতে কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন।সেদিনের পর থেকে শুভর প্রতি আমার এক চাপা রাগ তৈরি হয়েছে।তাকে দেখলেই সেই রাগ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।মনে হয় আমার আর প্রিতমের এক না হওয়ার জন্য একমাত্র দায়ী শুভ।সে সব জেনে-বুঝে আমায় জোর করে বিয়ে করেছে,প্রিতমের থেকে আমায় আলাদা করেছে।
যদিও আমার রাগকে কোনরকম পাত্তাই দেয়না শুভ।সে নিজের মতো আমায় জালিয়ে মারে।সারাদিন অফিস করে এসে যখনই সময় পায় তখনই আমার পেছন লাগে।
আজেবাজে কথা বলে আমায় রাগিয়ে দেয়।প্রথম প্রথম এসব বিষয়ে আমি খুব বিরক্ত হলেও ইদানীং কেনো যেনো এসব আমার ভালো লাগে।
বরংচ শুভ আমায় কোনদিন না জ্বালালে সেদিন আমার বোরিং লাগে।মনে হয় কি যেনো মিসিং আজ!
হয়তো শুভর দুষ্টুমি গুলো আমার অভ্যাসে পরিনত হয়েছে।নিজেকে বুঝ দেই আমি,কারনটা অভ্যাসই হবে,আর কিছুই নয়,উহু আর কিচ্ছু ন!
রাতে ঘুমানোর সময় আমরা বিছানার মাঝে কোলবালিশ টেনে দেই।
শুভ প্রথম প্রথম কোলবালিশ সরানোর জন্য খুব তালবাহানা করেছিলো।নানারকম আজেবাজে কথাবলে কোলবালিশ সরানোর উপায় খুজছিলো।
কিন্তু আমি কিছুতেই ওর কথার ফাঁদে পা দেইনি।কোলবালিশ নিয়েই ঘুমিয়েছি।
শুভ উপায় না পেয়ে মুখ গোমড়া করে ঘুমিয়েছিলো।
তবে অদ্ভুত ব্যাপার হলো,প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠলেই দেখি মাঝের কোলবালিশ গায়েব।আর আমি থাকি শুভর বুকে।
ব্যাপারটা নিয়ে আমি শুভকে জিজ্ঞেস ও করেছিলাম একদিন।সে ইনোসেন্ট মুখ বানিয়ে বলেছিলো,

—আমি কি জানি পিহু?তুমি ঘুমের ঘোরে আমার মতো অবলা ছেলের সাথে কি করো,সেটা তো তুমিই ভালো জানো।আমি তো সেই যে রাতে ঘুমাই আর ঘুমে উঠে দেখি সকাল।

শুভর কথা শুনে আমি বাঁকা চোখে তাকালেও চিন্তায় পরে যাই।শুভ কোলবালিশ সরিয়ে আমায় নিজের সাথে না জরালে কে এমন করবে?তাহলে কি আমি?ঘুমের ঘোরে এখন হাত পাও চলা শুরু করেছে নাকি আমার?
,

,

প্রতিদিনকার মতো আজও শুভ খেয়ে দেয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে।আমি আপার সাথে কিছুক্ষণ টিভি দেখলাম।তবে বেশিক্ষণ দেখতে ইচ্ছে করলোনা।টিভি দেখাটা আমার বোরিং লাগে।তারচেয়ে বাইরের প্রকৃতি দেখাটা ভালো।
যেই ভাবা সেই কাজ।আমি ফট করে সোফা ছেড়ে উঠে দাড়ালাম।
এ বাড়ির সামনে বিশাল এক বাগান আছে।
নানারকম গাছে ভরা বাগানটা।একপাশে ছোট্ট ফুলের বাগানও আছে।বাগানটা শুভ বানিয়েছে।বাগানে বেশিরভাগই গোলাপের গাছ।গোলাপি গোলাপ।
আমার খুবই পছন্দের গোলাপ।
কিন্তু শুভ কিভাবে জানলো সে ব্যাপারটাই ভেবে পাইনা আমি।
একদিন বিকেলে যখন শুভ গাছে পানি দিচ্ছিলো তখন আমি ওর পিছে গিয়ে দাড়িয়েছিলাম।ভেবেছিলাম শুভকে ভয় দেখাবো।
কিন্তু নাহ,তা আর পারিনি।
আমি ওকে চমকে দেওয়ার আগেই শুভ আমাকে চমকে দিয়ে বলে উঠেছিলো,

–এখানে কি করো পিহু?

আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম।শুভ তো পেছেন ঘুরে কাজ করছে,তারপরও আমায় চিনলো কিভাবে?পেছনে আরেকটা চোখ আছে নাকি?আমার ভাবনার মাঝেই শুভ আবার বলেছিলো,

—কি হলো বলো?

আমি শুভর কথার উত্তর না দিয়ে বলেছিলাম,

—আপনি কিকরে জানলেন আমি এসেছি?আপনি তো পেছনে তাকাননি?আমিও কোনরকম শব্দ করিনি?

শুভ পেছন ফিরে আমার দিকে তাকিয়ে হেসেছিলো সেদিন।বলেছিলো,

—ভালবাসার মানুষটি আশেপাশে এসে দাড়ালো এমনিতেই বোঝা যায়।

একটু আনমনা হয়ে বলেছিলো,
–তবে তুমি কেনো বোঝোনা?

আমি চমকে তাকিয়েছিলাম।আমি বুঝিনা?আমার ভালবাসার মানুষটা আমার আশেপাশেই আছে বুঝি?প্রিতম কি আছে এখানেই?কোথায়?আমি তো দেখিনি?তাহলে কি বলতে চাইছে শুভ?

আমাকে ভাবতে দেখেই শুভ দুষ্ট হেসে বলেছিলো,

—আবার গোবর মাথায় চাপ দিচ্ছো?

আমি রক্ত চক্ষু করে তাকাতেই শুভ হেসে উঠেছিলো।গা দুলিয়ে হু হা করে হেসেছিলো।

পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে আমি বাগান জুরে হেটে চললাম।ফুলের গাছগুলোর কাছে গিয়ে হাত দিয়ে ফুল গুলো ছুয়ে দিলাম।বেশ মিষ্টি ঘ্রান আসছে ফুলগুলো থেকে।মনটা ফ্রেশ লাগলো আমার।
মনে হলো বাগানটায় একটা দোলনা থাকলে খুব ভালো হতো।তাহলে দোলনায় বসে বসে ফুলের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারতাম।
হঠাৎ মেইন গেইটে শব্দ হওয়ায় আমি সোজা হয়ে দাড়ালাম।
বাড়িতে কেউ এসেছে।কিন্তু কে আসতে পারে?আমি থাকা কালিন কেউ তো আসেনি এখানে? আর শুভ ও তো এতো সকাল সকাল বাড়ি ফেরেনা।
আমি একরাশ কৌতুহল হয়ে বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম।
আপা ততক্ষণে দরজা খুলে দিয়েছে।
ড্রয়িং রুমের সোফায় বসতেও দিয়েছেন।লোকটা সোফার উল্টো দিকে মুখ করে বসে আছে।
আপা চা বানাতে কিচেনে চলে গেলেন।
আমি দ্বীধাদন্দে পরলাম খুব।
অজানা অচেনা কোন ব্যাক্তির সামনে যেতে মনে চাইলো না একটুও।কিন্তু ড্রয়িং রুম পেরিয়েই তো সিড়ি বেয়ে উঠে রুমে যেতে হবে।নয়তো বাইরেই দিন কাটাতে হবে আমায়।
আমি ড্রয়িং রুমের কিনারা দিয়ে নিঃশব্দে হেটে চলে যেতে চাইলাম।
কিন্তু লোকটা পিছু ঘুরে তাকিয়েছে।
আমায় দেখেই উঠে দাড়ালো।সরাসরি আমার দিকেই হেটে আসলো।সামনাসামনি দাড়িয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো হা করে।
আমার বিরক্ত লাগলো খুব।কেউ এমন করে তাকিয়ে থাকলে বিরক্ত লাগাটাই স্বাভাবিক।
আমি গলা খুকখুক করলাম।
এতে কাজ হলো।লোকটা সোজা হয়ে দাড়ালো।
চোখে চোখ রেখে বললো,

—আমায় চিনতে পারছোনা মায়াবতী?

আমি চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিলাম।তবে পা থেমে গেলো আপনাআপনি। প্রচন্ড অবাক হয়ে আমার মুখ হা হয়ে গেলো।ভালো করে তাকিয়ে লোকটার দিকে তাকালাম আমি।
দেখতে মোটামুটি ধরনের হলেও আমার তাতে কিছুই যায় আসেনা।সবচেয়ে বড় কথা লোকটা আমার প্রিতম!যাকে আমি ভালবাসি,খুব ভালবাসি!সেই প্রিতম আমার সামনে দাড়িয়ে?আমার সামনে?

অস্ফুট স্বরে বললাম,

—প্রিতম?

প্রিতম হেসে মাথা নাড়লো।হাত সামনে বাড়িয়ে দিলো।আমরা যখন মেসেন্জারে কথা বলতাম তখন বলেছিলাম,প্রথম দেখা হলেই আমরা দুজন দুজনের বুকে আছড়ে পরবো।এতোদিনের না দেখা তৃষ্ণার্থ বুকে ভালবাসায় পরিপূর্ণ করবো।
তবে কেনো যেনো প্রিতমের বাড়ানো হাতের দিকে আমি তাকিয়ে রইলাম।
কোন এক অদৃশ্য বাধা আমায় আটকে দিলো প্রিতমের কাছে যেতে।
প্রিতম আমার এমন কর্মে হয়তো হতাশ হলো।তার মুখটা খুব করুন দেখালো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,

–আমার খোজ কিভাবে পেলে প্রিতম?তুমি জানো কি কি হয়েছে আমার সাথে?তুমি বিশ্বাস করতে পারবেনা কি হয়েছে?

প্রিতম আমাকে মাঝপথে থামিয়ে বললো,

—আমি সব জানি মায়াবতী!

—তুমি সব জানো?

—হ্যাঁ।

—তাহলে আমায় নিতে আসোনি কেনো?

প্রিতম কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই সদর দরজায় প্রচন্ড শব্দ হলো।দরজাটা খোলাই ছিলো।পাল্লাটা কেউ হয়তো তীব্র ভাবে ধাক্কা দিয়ে খুলেছে তাই এমন বিকট শব্দ।
আমি গভীর আগ্রহে দরজার বাইরের দাড়ানো লোকটার ভেতরে আসার অপেক্ষা করলাম।আমার সাথে সাথে প্রিতমও সেদিকে তাকালো।তবে দরজা,ঠেলে শুভকে আসতে দেখেই প্রিতমের মুখটা শুকিয়ে গেলো।
শুভ আশেপাশে না তাকিয়ে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকেই আমার দিকে তাকালো।পরক্ষনেই প্রিতমের দিকে নজর পরলো তার।
লাল চোখে ভয়ংকর রাগী মুখ নিয়ে সে প্রিতমের কলার চেপে ধরলো।
কি যে ভয়ংকর দেখাচ্ছিলো তাকে!
আমি নিজেও বেশ ঘাবড়ে গেলাম।
মাথায় কিছুতেই ঢুকলো না শুভ এতো রেগে গেলো কেনো?এমন উদভ্রান্তের মতোই বা দেখাচ্ছে কেনো তাকে?
আমি তার হাত ছুটানোর চেষ্টা করলাম।
ছুটলো তো না ই উল্টো এমন ঝটকা দিলো যে আমি ছিটকে পাশের ছোফার হাতলে বাড়ি খেলাম।
শোড়গোল শুনে আপা দৌড়ে বেরিয়ে এলেন কিচেন থেকে।
শুভকে প্রিতমের কলার ধরা অবস্থায়,দেখে সে ছুটানোর চেষ্টা করতে লাগলো।
না পেরে সটান করে থাপ্পড় মেরে বসলো শুভকে।বললো,

—পাগল হয়ে গেছিস তুই?কি করছিসটা কি?মেরে ফেলবি নাকি ছেলেটাকে?

থাপ্পড় খেয়েও শুভর কোন ভাবাবেগ হলো বলে মনে হলোনা।বরং সে চিৎকার করে বললো,

—হ্যাঁ,পাগল হয়ে গেছি আমি!পাগল হয়ে গেছি!মেরে ফেলবো বেইমানটাকে আমি,জানে মেরে ফেলবো ওকে।কেনো ও আবার এ বাড়িতে এলো?কেনো?আবার কি কেড়ে নিতে চায়,আমার থেকে?

বলেই আবার তেড়ে গেলো সে।প্রিতম ভয়ে কয়েক কদম পিছোলো।
আপা এসে শুভকে বাধা দিলেন।শুভ প্রিতমের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করলো,

—এখনো দাঁড়িয়ে আছিস তুই?এখনো দাড়িয়ে আছিস?আমার হাতে খুন হতে না চাইলে এক্ষুনি বেরিয়ে যা,এক্ষুনি!
আর জিবনে আমার চোখের সামনে আসবি না,আমার স্ত্রীর সামনেও না!

প্রিতম দ্রুত পায়ে হাটলো।বাইরে যাওয়ার পথে আমার দিকে একবার করুন নয়নে তাকিয়ে আবারও হাটা ধরলো সে।
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।হঠাৎ কি থেকে কি হয়ে গেলো কিচ্ছু আমার মাথায় ঢুকছে না।শুধু মনে হচ্ছে এমন কিছু তো আছে যা আমি জানিনা।কিন্তু জানাটা দরকার।খুব দরকার!

,
,
চলবে……