সাহেব_বিবি_গোলাম পর্ব-১৬

0
1253

#সাহেব_বিবি_গোলাম
#নুশরাত_জেরিন
#পর্ব:১৬

,
,
রাতে আমাকে ঘুমাতে হলো আপার সাথে।শুভ সেই যে বাড়ি ফিরে ঘর আটকে বসেছে তো আর খোলার নাম গন্ধই নেই।
আমি সকাল সকাল ঘুমিয়ে খুব ভোরে উঠে পরলাম।
নিচে নামতে নামতেই শুনি শুভ এই সাতসকালে অফিসে চলে গেছে।এতো সকালে তার অফিসে কি কাজ?তাছাড়া এখন কোন পাগলেই বা অফিস খুলে বসে থাকে?বেটা নির্ঘাত আমার উপর রাগ করে অফিসের নাম করে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে।যাতে আমার সামনে পরতে না হয়।
আমিও ভেঙে পরার মেয়ে না।যতোই ও আমায় এভয়েড করুক না কেনো,আমি তো তার রাগ ভাঙাবোই ভাঙাবো।
আগে যখন মেসেন্জারে কথা বলতাম তখন ও বলতো,

—আমাদের দুজনার বিয়ে হলে খুব মুশকিলে পরবো আমি জানো মায়াবতী!

আমি কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করতাম,

—মুশকিলে পরবে?কেনো?

—তুমি কোন ভুল করলে তোমার উপর রাগ করে থাকতে যে পারবোনা।মায়াবতীর উপর কি রেগে থাকা যায়?রাগ আসে নাকি?আর যদিও কোন কারনে রাগ এসে যায়,তাহলে তুমি তো আছোই।শাড়ি পরে কপালে কালো টিপ একে আমার সামনে এসে দাড়াবা,নিমিষেই আমার রাগ গায়েব!

আমি হেসে কুটিকুটি হতাম তখন।তবে বুদ্ধিটা মন্দ না।
শুভর রাগ ভাঙানোর এর চেয়ে ভালো উপায় আর কি হতে পারে?
তবে যেহেতু শুভ বাড়ি নেই তাহলে ওর বাড়ি ফেরার অপেক্ষাই করা যাক।
আমি ফটাফট আপার কাছে গিয়ে দাড়ালাম।
আপা কিচেনে নাস্তা বানাচ্ছিলো।
তার হাতের রান্না খুবই ভালো।তাই সে কাজের লোক দিয়ে রান্না করায় না।
আমি পেছনে দাড়িয়ে মিনমিন করে বললাম,

—আপা!

আমার স্বর শুনেই আপা যা বোঝার বুঝে নিলেন।সামনে কাজ করতে করতেই বললেন,

—কি হয়েছে?শুভ চলে গেছে?
তোকে যে কাল বুদ্ধি দিলাম,সে বুদ্ধি খাটালি না কেনো?

—কিভাবে খাটাবো আপা,উনি তো দরজায় খোলেননি!

আপা কথার মর্মার্থ বুঝে মাথা নাড়লেন।হয়তো বুঝলেন,সত্যিইতো দরজা না খুললে আমি ভেতরে যাবো কিভাবে?আর তাকে জাপটে ধরে রাগ ভাঙাবোই বা কিভাবে?

—তো এখন কি করবি?কিছু ভেবেছিস?

আমি উচ্ছাসিত হয়ে সামনে এগোলাম।

—ভেবেছি তো।সেকথাই তো তোমায় বলতে এলাম!

—তাই?তো কি ভাবলি?
ওর পছন্দের রান্না করবি?আর কি?ওর মনের মতো সাজবি?

আমি অবাক হলাম খুব!আমার মনের কথা আপা কিভাবে বুঝে গেলেন?

—তুমি কিভাবে জানলে আপা?তুমি কি জাদু জানো নাকি?

—আরে নাহ,জাদু জানবো কিভাবে?আসলে আমার বিয়ের পর আমিও আমার স্বামীর রাগ এভাবেই ভাঙাতাম।

—সত্যি?দারুণ তো!দুলাভাই এখন কোথায় থাকে আপা?আমি এতোদিনেও দেখলাম নাতো?

হঠাৎ আপার মুখটা কঠোর হতে শুরু করলো।মুখ জুরে রাগের আভাস দেখা গেলো।অথচ চোখে তার টলমলে জল।
এমন অদ্ভুত রুপে কেউ কখনো কাউকে দেখেছে বুঝি?
আমি আপার হাত ঝাঁকালাম।

—কি হয়েছে আপা?কোন সমস্যা?

আপা হাত ছাড়িয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।যেতে যেতে গম্ভীর গলায় বললেন,

—পরোটা টা উল্টিয়ে দিস পিহু!

আমি হতবাক হয়ে দাড়িয়ে রইলাম।হঠাৎ হলোটা কি আপার?এমন অদ্ভুত ব্যবহারই বা কেনো করলেন?
,

,দুপুর গড়িয়ে রাত হয়ে এলো।আপাকে বলে কয়ে রুমে পাঠিয়েছি আমি।তাছাড়া আজ আপার মনটাও ভাল নেই।সেই সকাল থেকে কেমন অদ্ভুত ব্যবহার করছেন তিনি।
আমি এখন শুভর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।
পরনে নীল সুতি শাড়ি।আপা কিনে দিয়েছে আমাকে।নীল শাড়িতে নাকি আমায় দারুণ লাগে।যদিও এটা আমার কথা না,আপার কথা।
সাতে কপালো ছোট কালো টিপ আর চোখে কাজল।ব্যাস, আমার সাজ শপষ।
এর চেয়ে বেশি আমি কখনোই সাজতে পারিনা। কেমন অস্বস্তি হয়।
মনে হয় মানুষের নির্মল সৌন্দর্যকে ঢাকা দেওয়ার কি দরকার?ভারী ভারী মেকআপ করে অতিরিক্ত সুন্দরী সেজে কি লাভ?মেকআপের নিচে যে আসল আমি টাই চাপা পরে যায়!

খাবার টেবিলে আরেকবার উঁকি দিলাম আমি।সব খাবার ঠিকঠাক আছে।আপার কাছ থেকে শুনে যত্ন করে নিজের হাতে সব খাবার রান্না করেছি আমি।
আমার হাতের রান্না খুব ভালো না হলেও একেবারে খারাপ ও না।
বাড়িতে প্রায়ই আমায় রান্না করতে হতো।একটু লবন বা ঝাল কম বেশি হলেই মামির প্রহার তো আছেই।
ভাবতেই দীর্ঘশ্বাস বের হলো বুক চিরে।
না জানি মা ওখানে কেমন আছে?
মামা মামি নিশ্চয়ই তার সাথে ভালো ব্যবহার করছেনা।
কিছুদিন আগেই আপার ফোন থেকে কল করে মায়ের সাথে কথা বলেছিলাম।
মা মুখে হাসি ফুটিয়ে আমার সাথে কথা বলেছিলো।
কিন্তু আমি তো জানি,মায়ের হাসিটা নকল ছিলো।
ও বাড়িতে থাকলে আর যাই হোক মুখে হাসি অন্তত থাকে না।
আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম,মাকে মামার বাড়ি থেকে আলাদা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে।
কিন্তু তারজন্য আমার একটা চাকরী দরকার।শুভর সাহায্যে তো আর আমি মায়ের জন্য কিছু করতে পারবোনা।
নিজের আত্মসম্মানে লাগবে আমার।

ভাবনা চিন্তার মাঝেই কলিং বেল বেজে উঠলো।আমি শাড়িটা আরেকবার চেক করে দরজা খুলে দিলাম।
তবে ওপাশের দৃশ্য দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুুত ছিলাম না।
শুভকে কোন অন্যমেয়ে জাপটে ধরে আছে।শুভর মাথা এলিয়ে আছে তার কাধে।
মুখচোখ তার শুকনো।কেমন অসুস্থ অসুস্থ লাগছে তাকে!আমার বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠলো।
সেটা অন্যকোন মেয়ের বাহুতে শুভকে দেখার জন্য নাকি শুভর শুকনো মুখ দেখার জন্য সেটা বুঝতে পারলাম না।
আমি এগিয়ে গিয়ে উদ্দিগ্ন হয়ে বললাম,

—কি হয়েছে ওর?

মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষন করলো।বললো,

—ক্লাবে ছিলো,অতিরিক্ত নেশা করায় একা বাড়ি আসার মতো অবস্থা ছিলোনা,তাই আমি নিয়ে এলাম।

আমার খুব বলতে ইচ্ছে হলো,

–কেনো নিয়ে এলেন আপনি?কেনো আনতে গেলেন?বাড়িতে কি ফোন করে বলা যেতো না?আমি কি ওকে আনতে পারতাম না?

তবে মনের কথা মুখ অবদি এলোনা আমার।
চোখমুখ কুচকে মুখে হাসি টানার চেষ্টা করে বলে উঠলাম,

–আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।শুধু শুধু এতো কষ্ট করতে হলো আপনাকে।
ঠিক আছে এখন আমিই নিয়ে যেতে পারবো ওনাকে।

শুভকে ধরতে যেতেই সে সরে দাড়ালো।
অস্পষ্ট ভাবে বলে উঠলো,

—আমাকে তুই ঘরে দিয়ে আয় রুবি।

রুবি নামক মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।যেনো শুভর কথায় সে বিশ্বজয় করে ফেলেছে।
আমি কাঠ কাঠ গলায় বললাম,

—আসুন, ঘর ঐদিকে।

,
,
চলবে…..