#সেদিন_মুষুলধারে_বৃষ্টি_ছিল
part–18
Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকার জন্য সেজুতির গা ভিজে যাচ্ছে। বৃষ্টির ফোটা চোখে মুখে এসে ঝাপ্টা মারছে৷ সে এখনো অদ্ভুত দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকানো। এতোগুলা মেয়ের এই বাসায় কাজ কি? আজকে তো কোন অনুষ্ঠান নেই তাহলে ওদের এখানে আসার কারণ কি? সেজুতির কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে গেল। সে ভ্রু কুচকে দাঁড়িয়ে থাকলো। বৃষ্টির ফোটায় হাতে ভাজ করে রাখা চিঠিটাও ভিজে উঠতে লাগে। তাতেই টনক পড়ে তার। সে রুমে ফিরে এলো। ততোক্ষনে তার চুলের প্রায় অনেকখানি ভিজে গেছে৷
রুমের ভেতর অভিক বড্ড আশ্চর্য নিয়ে বৃষ্টি দেখছে।ঝমঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। চারিপাশ ভিজে যাচ্ছে।দৃশ্যটা দেখতে চমৎকার!
সেজুতি চুল ঝাড়তে ঝাড়তে রুমের এপাশ থেকে ওপাশ পায়চারি করলো। এরপর অভিকের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, তোমার মাম্মা দেখতে কেমন?
অভিক উত্তেজিত হয়ে গেল এবং খুশি হয়ে বলে, খুব সুন্দর।
— বর্ণনা দিতে পারবে কেমন দেখতে?
অভিক মাথা ঝাকালো। সেজুতি উৎসাহ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
সে বলতে লাগে, মাম্মার দুইটা চোখ আছে, নাক আছে একটা৷
অভিক যখন নাক আছে বললো তখনি সে নিজেও নিজের নাকে হাত দিলো যা দেখে সেজুতি না হেসে পারলো না। সে হোহো করে হেসে দিলো।
অভিক ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। মাম্মার হাসিও অবিকল এই আন্টির মতো! অভিকের মুখ টা শুকিয়ে আসলো। মাম্মার কথা মনে পড়তেই তার কষ্ট হতে লাগে৷তখন কিচ্ছুটি ভালো লাগে না তার।
সেজুতি হাসি থামিয়ে দিলো। তার চোখ অভিকের দিকে। অভিকের সঙ্গে মুহিবের চেহারায় মিল আছে। বেশ মিল আছে!
সে মিনিট পাঁচ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যেতে গেলে অভিক ক্যাঙ্গারুর মতো লাফিয়ে তার কাছে এসে পড়লো।
সে ইশারায় বলল কি হয়েছে? অভিক ভারাক্রান্ত গলায় বলে, আমার মাম্মা কবে আসবে তুমি জানো?
সেজুতি চুপসে গেল। মুহিবের উচিত বাচ্চাটাকে সব সত্য জানিয়ে দেয়া।
সে আরো একটা ব্যাপার ভাবলো তাহলো মুহিব একবারো বাচ্চাটার খোজ নেই নি।নিজের ছেলের প্রতিও দয়া নেই।আর না মনোয়ারা আক্তার একটা খোজ নিল। এমন কেন এই বাসার মানুষ গুলো?এই বাসার প্রতিটা সদস্য কেন এতো হৃদয় হীন ?
সে ফোস করে একটা দম নিলো। যাইহোক না কেন, সে এই বাসা থেকে এখুনি চলে যাবে। এখানে মুহিবের বউ হয়ে থাকা তার জন্য অসম্ভব! সে মুহিবকে তালাক দিয়ে দিবে। এতে তার মধ্যে কোন জড়তা কাজ করবেনা। বিন্দুমাত্র আফসোস করবেনা৷ যেই ছেলে বিয়ের আগে অন্য কারো সঙ্গে সম্পর্ক করতে পারে, কি গ্যারেন্টি আছে বিয়ের পর সে সাধু হয়ে থাকবে?
রুম থেকে বের হয়ে সেজুতি বুঝতে পারলো, বাসার পরিবেশ থমথমে। একে তো আবহাওয়া ভালো না। বৃষ্টি হচ্ছে, ঝড় ও হবে বোধহয়। তার উপর বাসার পরিবেশ তার কাছে সুবিধার ঠেকছে না। প্রতিটা সাহায্যকর্মীর চোখে মুখে অতিরিক্ত ব্যস্ততা সেই সাথে ভয়ের ছাপ তো আছেই।
তখনই শব্দ করে বজ্রপাত হলো। সেজুতি আনমনেই কেপে উঠে। সে সুমিকে খুজছে। এই বাসায় একমাত্র সুমিই কিছুটা প্রাণবন্ত। তার সঙ্গে স্বেচ্ছায় কথা বলেছে। অভিকের দেখা শুনা করছে। কোথাও ও? নিশ্চয়ই রান্নাঘরে হবে। বাসায় চলে যাওয়ার আগে মেয়েটার সঙ্গে দেখা করে নেয়া যাক। কাল রাতে মেয়েটা তার সেবা-যত্ন করেছে। একটা ধন্যবাদ তার প্রাপ্য।
সে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতে গেলেই একজন সাহায্যকর্মী প্রায় দৌড়ে এসে বলে, ভাবী কিছু লাগলে আমাকে বলেন। তাও রান্নাঘরে যাইয়েন না৷
সে ভ্রু কুচকে বলে, কেন? রান্নাঘরে যাব না কেন?
— ছোট ভাই নিষেধ করছে। আপনি নাকি অসুস্থ এইজন্য রান্নাঘরে যাওয়া মানা। যা খেতে মন চায়, আমাকে বলেন, আমি বানিয়ে দিচ্ছি।
সেজুতি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মনে মনে বলে, আলগা ঢং আর পীড়িতি দেখে বাঁচা যায় না।
এরপর শব্দ করে বলে, আম্মা কোথায়?
— খালাম্মা তো ড্রয়িং রুমে বসে হিসাব মিলাচ্ছে।
— আচ্ছা৷
সেজুতি সোজা ড্রয়িং রুমে পা বাড়ালো। ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করতেই মনোয়ারা আক্তারের দেখা মিললো। এই মহিলাটাকে দেখামাত্রই সেজুতির গা জ্বালা করে।
সে তবুও বিনয়ী গলায় বলে, আম্মা আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে৷
মনোয়ারা আক্তার তখন চোখে চশমা লাগিয়ে হিসাব দেখছিলেন। সেজুতির কথা শুনে সে চশমা খুলে টেবিলে রাখলেন এবং পানের ডিব্বা থেকে পান বের করে মুখে পুড়ে নিয়ে বলে, বল কি বলবা।
সেজুতি বেশ দাপটের সঙ্গে বলে উঠে,আমার পক্ষে এই বিয়ে মানা সম্ভব না।
সব জানার পর আমার মনে ওর জন্য এক ফোটা ভালোবাসা আর নেই৷
— মানে?
— মানেটা খুব সহজ। আমি মুহিবকে তালাক দিব।
— সেকি! বিয়েই তো সেদিন হলো। বৌভাতের জবাই করা গরুর মাংস এখনো ফ্রিজে আছে আর তুমি তালাকের কথা বল! মাথা ঠিক আছে তোমার? এক কাজ করো, একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুম দাও৷
সেজুতি প্রচুন্ড বিরক্ত হলো সেই সাথে অবাক ও বটে। একজন নারী কিভাবে অন্য এক নারীর দুঃখ, কষ্ট বুঝতে পারছে না? সেজুতির জায়গায় একবারও নিজেকে কেন তুলনা করছেন না উনি? সেজুতির বুকে যে রক্তক্ষরণ হচ্ছে সেটা তো কেউ টের পাচ্ছেনা। সে কেন কোন অন্যায় না করেও সব সহ্য করবে৷
সেজুতি জোর গলায় বলে, আমার মাথা ঠিকই আছে৷ আমি আজকেই এ বাসা ছেড়ে চলে যাচ্ছি।
মনোয়ারা আক্তার এবারে সেজুতির দিকে তাকিয়ে বলে, আমার ছেলে তো তোমাকে এখান থেকে যেতে দিবে না। তোমাকে বিয়ে করার জন্য কি পাগলামিই না করেছে ও। সেই ছেলে কোন দিন তোমাকে তালাকা দিবে না৷
— আমার তালাক চাই। (চিৎকার করে)
— আহ বৌমা! তোমাকে তোমার বাবা-মা কোন শিক্ষা দেয়নি? শ্বাশুড়ির সামনে কেউ এভাবে কথা বলে?
— আমাকে সঠিক শিক্ষাই দেয়া হয়েছে বরং আপনি আপনার ছেলেকে কিছু শেখাতে পারেন নি! এইজন্য জানোয়ার হইসে৷ মানুষ হতে পারেনি।
মনোয়ারা আক্তার প্রচুর রেগে যাচ্ছেন। মেয়েটার বড্ড বেশি সাহস বেড়ে গেছে। মনে চাচ্ছে টুঁটি চেপে ধরতে মেয়েটার!
তিনি নিজেকে সংযত করে বলে, মেয়ে মানুষের জন্মই সংসার করার জন্য! আমাকে দেখো আমি সংসার করছি না! সংসার ফেলে যাওয়ার কথা মুখে আনতে নেই। তুমি ছোট মানুষ। জেদ বেশি। যাও মাথা ঠান্ডা করো। ভুলেও এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা মুখে আনবে না। এখন থেকে এটাই তোমার বাসা সারওয়ার বংশে তালাক, দ্বিতীয় বিয়ের প্রথা নেই। কাজেই এইসব রাগের কথা বলে লাভ নেই৷
সেজুতি কিছু বললোনা। সে ফিরে এলো। যত যাই হোক সে কারো কথা শুনবেনা। নিজের প্রয়োজনীয় যা জিনিস আছে সব গুছিয়ে রেখেছে, সেগুলো নিয়ে চলে যাবে৷ এক সেকেন্ড ও অপেক্ষা করা যাবে না৷
সেই উদ্দেশ্য ড্রয়িং রুম ছাড়লো সে। ড্রয়িং রুম পার হতেই সুমির সঙ্গে দেখা।
সে বলে উঠে, সুমি এইদিকে শোন৷
— জি, ভাবী৷
— কালকে রাতের জন্য ধন্যবাদ।
— ভাবী কি যে বলেন না। ধন্যবাদ দিতে হবে কেন? আমার কাজেই আপনাদের সেবা করা। এটা আমার দায়িত্ব ।
— শোন আমি চলে যাচ্ছি। তুমি অভিকের খেয়াল রাখবে৷ ভালো থেকো৷
সুমিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে পেছনে ঘুরলো। সঙ্গে সঙ্গে তার আত্মা কেপে উঠে।
তার মুখের সামনে মুহিব দাঁড়ানো। মুহিবকে এই মূহুর্তে ভয়ংকর লাগছে৷ রাগে ঠোঁট জোড়া কাপছে তার।
মুহিব দাতে দাত চেপে বলে, কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?
মুহিবের কন্ঠস্বর শুনে সেজুতি কেপে উঠে। তাও সাহস নিয়ে বলে, আমি আমার বাসায় যাচ্ছি।
সঙ্গে সঙ্গে মুহিব সেজুতির গালে একটা থাপ্পড় মারলো।
সেজুতি অবাক , রাগ,দুঃখে চোখ বড় করে ফেলে। মুখের ভাষা লোপ পেয়েছে তার। সুমির সামনে তাকে এ ভাবে অপমান করলো এটা হজম হচ্ছেনা তার। চোখ বেয়ে মূহুর্তে পানি পড়তে লাগে।
মুহিব রাগে ফুসতে ফুসতে বলে, খবরদার আরেকবার যদি এই বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা মুখে আনিস তাহলে এইখানে মেরে পুতে দিব৷
মুহিবের মুখে তুই-তুরাকি শুনে সেজুতি থম মেরে যায়।
মুহিব আরো একটু সামনে এসে সেজুতির হাত শক্ত করে চেপে ধরলো এবং প্রায় জোর করে তাকে টানতে টানতে রুমে নিয়ে যেতে লাগলো
এর মাঝে সেজুতি চিৎকার চেচামেচি করছিলো। আশেপাশে সাহায্য কর্মীর ভীড় লেগে গেল। কোন রুম থেকে যেন তিন চারটা মেয়ে বের হয়ে তাদের কে দেখতে লাগলো।
সেজুতি কিছুতেই রুমে যাবে না। মুহিব জোরাজোরি করেও তাকে রুমে নিয়ে যেতে পারছে না৷
উপায় না পেয়ে সে সেজুতিকে সবার সামনে কোলে তুলে নেয় এবং রুমের দিকে পা বাড়ায়৷
সেজুতি জোরে জোরে চেচাতে লাগে। মুহিব বলে উঠে, এখানে চিৎকার করলে তোর বাপের কানে যাবেনা।
সেজুতি চুপ হয়ে যায়। এরপর কিছুটা আস্তে বলে উঠে, মুহিব আমার বাবা কোথায়?
মুহিব ততোক্ষনে তাদের বেডরুমে পৌঁছে গেছে৷ সে রুমে ঢুকে ধপ করে সেজুতি কে ফ্লোরে ফেলে দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো।
ফ্লোরে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেজুতির মনে হচ্ছে কোমড়ের সব হাড় ভেঙে গেল। সে কেদে দেয়।
মুহিব সেজুতির দুই বাহু ধরে উপরে টেনে এনে দাড় করিয়ে বলে, অনেক ভালো ব্যবহার করা হইসে তোর সঙ্গে। ভালো ব্যবহার করি জন্য মাথায় উঠে বসে থাকবি না তো হবে না!
সেজুতি বাঘিনী গলায় বলে, কি করবেন? মেরে ফেলবেন? মারুন দেখি কতো সাহস!
— সেজুতি বাড়াবাড়ি করবে না। আমার রাগ উঠে গেল তোমার কপালে শনি আছে৷
— আমি আগেও বলেছি আপনাকে ভয় পাইনা আমি।
এবারে মুহিব আরো রেগে যায় এবং সেজুতিকে বিছানায় টেনে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দেয়।
তারপর গলা চেপে ধরে ধস্তাধস্তি-জাবরদস্তি শুরু করে। এই মূহুর্তে মুহিবকে যেকেউ দেখলে ভয় পাবে। তাকে সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ লাগছে না। রাগে চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। চুল এলোমেলো। জানোয়ারের চেয়ে কোন অংশে কম লাগছে না।
সেজুতি নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে সরানোর চেষ্টা করছে। এদিকে গলা চেপে ধরায় সেজুতি শ্বাস নিতে পারছেনা।
বাইরে প্রচুন্ড বেগে বৃষ্টি শুরু হলো । জোরে জোরে বজ্রপাত হতে লাগলো। বিছানা থেকে জানালা কাছে হওয়ায় বৃষ্টির ফোটা
তাদের গায়ে এসে লাগছে। দুইজনকেই ভিজিয়ে দিচ্ছে।
অপর দিকে মুহিব উম্মাদের মতো সেজুতির উপর আক্রমণ চালাচ্ছে। যেই না তার শাড়ির আচল উক্ত স্থান থেকে সরাতে যাবে, সেজুতি হাতের কাছে থাকা কাচের ফুলদানি দিয়ে সজোরে মুহিবের হাতে আঘাত করে।
কাঁচের দন্ড তার হাতের কব্জিতে লেগে যাওয়ায় গল গল করে রক্ত পড়া শুরু হয়। মুহিব আচমকা শান্ত হয়ে সেজুতির উপর থেকে উঠে দাড়ালো।
মুহিবকে দেখতে ভয়ংকর লাগছে। সেজুতির বুকে কম্পন বয়ে যায়।
চলবে৷