“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ৫০
(নূর নাফিসা)
.
.
আলোর ঘ্রাণ যেন আহমদ আলীর নাকে ভেসে এলো হঠাৎ। বিদায়কালে ছোট্ট ঘরে প্রবেশ করে আলো পেলো তার শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির দেখা। মধ্যরাতের ছুটে আসার ফলাফলটা সুন্দর সার্থক হলো। আহমদ আলীও দেখলো তাকে। চোখ দুটো জুড়িয়ে গেলো। ঝাপসা হয়ে এলো ওই মুখখানা দেখে। শয়নকালে মনে হলো, ভারি অন্যায় করেছে। আগেও হতো ক্ষণিকের জন্য। মান এবং সম্মানের আভিজাত্যকে ভেবে আবার অন্যায় ভুলে যেতো। মনে হতো, মরিচার পিছু ফিরে তাকানোর প্রয়োজন নেই। আজ যেন তার প্রয়োজন খুব আছে। ঝাপসা চোখ মুছে স্বচ্ছ করে দিতে নিজের হাতদুটো পর্যন্ত উঠে আসছে না সম্মুখে। তারাও যেন বড্ড স্বার্থপর হয়ে উঠেছে আজ তারই উপর। এই স্বার্থপরতার সঙ্গীত শিখেছে তো তারই নিকট। হঠাৎ গড়িয়ে পড়লো দুচোখের ধারা। নূর আলম এগিয়ে এলো। মোয়াজ্জেম আলী বিস্ময় জাগিয়ে উঠে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিলে তিনি বসলেন শ্বশুরের সম্মুখে। বিস্ময় কাটে না কারো চোখের। এতোগুলো চোখের আগে প্রাধান্য দিলেন প্রবীণের চোখজোড়াকে। শরীরটা স্পর্শ করে বললেন,
“ভাবিনি, সেদিনের পর আবার এই অবস্থায় দেখতে হবে আপনাকে। পারলাম না আর থাকতে। ফিরতে হলো আরেকবার দেখা পাওয়া লোভে।”
দুচোখে জমা অশ্রু গড়ালে আবারও তাকে দেখলেন আহমদ আলী, আবারও ঝাপসা হয়ে এলো ওই দুচোখ। পুবাকাশের লালিমা কেটেও উদিত হচ্ছে সোনা রোদ। এই ঘরখানায়ও হাজির হয়েছে তার আলো। বেলা শুরু ও শেষের সোনালী আলো। অশ্রু গড়িয়ে চোখ স্বচ্ছ হলে ওই চোখে অপরাধের উত্তরণ ঘটতে লাগলো। একটু আর্তনাদ তুলে কাঁদতে চায় ওই চোখ। ক্ষমার ভিক্ষা কুড়াতে চায় ওই হাত। পারছেন না তবুও, পারছেন না তিনি। এই সোনালী আলোর মুখটা দেখা মাত্রই যেন এবার চিরতরে নিভে গেলো চোখদুটো। আলোর ঘ্রাণ নিয়েই নিশ্বাসও বন্ধ হলো। নিভে গেলো বাড়ির প্রবীণ প্রজন্মের স্বার্থপর যোদ্ধার প্রদীপ। যে দেশকে জয় করলো এই স্বার্থপরতার তাগিদে। একই তাগিদে ধ্বংসও করলো কয়েকটি আপন প্রাণকে। মরিয়ম তো নূর আলমকে দেখা মাত্রই অন্যরকম পাথর বেশে জমে উঠেছেন হঠাৎ! পাশে শুয়ে থাকা পিতার শ্বাস নিভে যাওয়ার দিকে লক্ষ্য করা হলো না তার। আমজাদ আলী লক্ষ্য করে ডাকলেন, “আব্বা?”
মোয়াজ্জেম আলীও একটু দূরে দাঁড়ানো থাকা অবস্থায় পিতার পুরো শরীর ঝাকি দেওয়া লক্ষ্য করে হুমড়ি খেয়ে সামনে এসে ডাকলেন,
“আব্বা?”
আমজাদ আলী নাকের সামনে হাত রাখলেন। নিজের হাতে তুলে রাখা হাতটারও স্পন্দন পরীক্ষা করলেন। না নিশ্বাস, না দর্শন, না স্পন্দন! সব শেষ! কম্পিত গলায় বারান্দায় দাঁড়ানো মাহতাবকে ডেকে বলতেই সে-ও এসে পরীক্ষা করে নতমুখে মাথা নাড়লো দু’দিকে। বাড়িতে কিছু আর্তনাদের স্পষ্টতর প্রকাশ ঘটলো তৎক্ষনাৎ! পাড়াপড়শি ছুটতে লাগলো এদিকে। এই ভিটা, এই রাজত্ব সবই তো রইলো পড়ে। ফেরা হবে না আর আপন ঘরে, আপনজনের তরে।
মসজিদে তার নামে এলার্ম হলো, যোহর বাদ জানাজা হলো। শেষ সময়ে এই বৃদ্ধা সবাইকেই পাশে পেলো। সবাই-ই ব্যথিত হলো তার না ফেরার বার্তায়, সবাইকেই কাঁদিয়ে গেলো। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ গোপনে কেঁদে চললো দিনব্যাপী।
সন্ধ্যা হলো। খতমে দোয়া পড়ানোর জন্য মুরব্বিদের আসর বসেছে। নূর আলম ছিলেন পাশে। মানুষজন বিস্ময় গেঁড়েছে তাকে দেখে দেখে। বাইরের মানুষ বিদায় হলে সেই প্রবীণ দেহটা ছাড়া পরিবারের লোকজন রইলেন বাড়িতে। নূর আলমের ঘটনাটাও সামনে এলো সকলের। সে জানাতে চায়নি সবটুকু। তাকে ফেলে রেখে আহমদ আলীর ফিরে আসার ব্যাপারটা হয়তো অপ্রকাশেই রেখে দিতেন। কিন্তু আজমাইন বলে ফেলেছে তার বাবার কাছে আগে আগেই। সেই সূত্রে খুব করে জবাবদিহিতাও দিতে হয়নি তাকে। নিজের ব্যাথাটার সাথে যুক্ত আহমদ আলীর না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার ব্যাথা ভারি লিপ্ত। তাই তেমন কিছু বলতেও ইচ্ছাবোধ করছিলেন না নূর আলম। পরিবারের সম্মুখে এসে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়লেন তাদের সম্মান বিনষ্টের ভয়ে। তবুও তখন ছুটে এসেছিলেন আহমদ আলীর শেষ দর্শন পাওয়ার লোভে। তা খুব পূর্ণ হলো। একটা আফসোস ঘুচে নিলো। কিন্তু ব্যাথা ঘুচে যায়নি যে! ছেলে কোনো কথা বললো না, স্ত্রী কিছু বললো না। সবাই শোকের উপর শোক পেয়ে গভীর শোকাহত। মরিয়ম সারাদিন কেঁদে অস্থির হয়ে উঠেছেন। গলার স্বর আর জাগে না যেন। সন্ধ্যা হতেই আহমদ আলীর ঘরে আগরবাতি জ্বালাতে গেছেন হালিমা খাতুন। বিছানার চাদর সহ যে তখন আহমদ আলীকে শেষবারের মতো ঘরের বাইরে নেওয়া হয়েছিলো, সপ্তাহ খানেক আগের লেখা সেই চিঠিটা মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলো। সারাদিন খাটের পায়ার কাছেই পড়ে ছিলো। আগরবাতি রাখতে গিয়ে কাগজটা চোখে পড়তেই হালিমা খাতুন হাতে তুললেন, অপ্রয়োজনীয় হলে বাইরে ফেলে দিবেন। তার ধারণা ছিলো ওষুধের কাগজপত্র হবে। সেগুলোর তো আর এখন প্রয়োজন হবে না৷ কিন্তু আহমদ আলীর লেখা দেখতেই তিনি গুরুত্বের সাথে নিয়ে বের হলেন। তিনি পড়বেন না। উনার ছেলের হাতে দেওয়ার ইচ্ছেটাই অগ্রাধিকার পেলো মনে। হতে পারে কোনো গোপন কথা, যা জানার অধিকার তার ছেলেমেয়ে আগে পায়। এইটুকু বোধ নিজের মধ্যে রাখলেন। আসর ভেঙে আমজাদ আলী অবসর হতেই তার হাতে দিলেন হালিমা খাতুন।
“আব্বার ঘরে পড়ে ছিলো কাগজটা। আব্বার লেখা দেখা যায়। আগের চিঠি?”
আমজাদ আলী পড়লেন৷ চিঠিটা মাহতাবের জন্য লিখে রেখে গেছেন বৃদ্ধ। নূর আলম সম্পর্কে লিখেছেন। তারিখটা গত সপ্তাহের। সেদিন আব্বা ভালোই ছিলো আবার সেদিনই অসুস্থতায় লিপ্ত হলো। শারীরিক ক্ষমতা হারানোর আগেই লিখেছেন তিনি, বুঝতে পারলেন আমজাদ আলী। আজমাইনের কাছে যেই ঘটনা শুনেছে তার শতভাগ প্রামাণ্য দলিল এই চিঠির মর্মার্থ। তাছাড়া নূর আলম এক টুকরোও মিথ্যে বলার লোক নয়, তাদের সর্বকালের বিশ্বাস। আব্বা যে মাঝে মাঝে শহরে যেতেন, সেটা জানা আছে ছেলেদের। কোন কাজে যেতেন, সেটুকুই খুঁটিয়ে দেখার ইচ্ছে জাগেনি কখনো। আব্বার প্রয়োজনে আব্বা যেতেন, সেখানে খুঁটিনাটিরই কি আছে? এমন আদর্শ পিতা কারো হয়? ধীর নিশ্বাস ফেলে আমজাদ আলী হালিমা খাতুনের জবাবটা দিলেন,
“মাহতাবের জন্য লিখেছেন আব্বা। মাহতাব কোথায়?”
“আজমাইনের ঘরে বসে থাকতে দেখছিলাম।”
আমজাদ আলী গেলেন ওই ঘরে। গভীর ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছে ছেলেটা। পাকাপোক্ত মনের অধিকারী যুবক আজ নিস্তেজ, নিবিড়। মামাকে দেখেই তার ধ্যানভঙ্গ হলো, উঠে দাঁড়ালো বসা হতে। আমজাদ আলী এগিয়ে গেলেন। কাঁধে হাত রেখে আদুরে বাক্যে বললেন,
“কথা হইছে তোমার আব্বার সাথে?”
মাহতাব দৃষ্টি নত রেখে মাথা নাড়লো দু’দিকে। আমজাদ আলী অনুভব করতে পারছেন, এই ছেলেটার উপর প্রবাহিত ব্যথাকে। কাঁধ চেপে তিনি আশ্বাসের ইঙ্গিতে বললেন,
“অভিমান আছে?”
“উহুম।”
“কথা বলে নিয়ো। তিনি এসেও যেন দ্বিধায় পড়ে আছেন। তোমরা না চাইলে কার কাছে এসেছেন, কার কাছে থাকবেন?”
“চলে যাবেন, বলেছেন?”
“নাহ। একা অসহায়ত্ব নিয়ে বসে আছেন।”
চিঠিটা মাহতাবের হাতে দিয়ে পরপরই বললেন,
“আব্বা তোমাকে এটা দিয়ে গেছেন। আফরোজার মা পেলো ওই ঘরে।”
আমজাদ আলী ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলেন। তার একটা মানুষের অনুপস্থিতই বাড়িটাকে নিবিড় করে তুলেছে। একটা মানুষের জন্যই আবার এই বাড়ির বাতাসে দ্বিগুণ শোকের ব্যাথা বয়ে যাচ্ছে। আমজাদ আলী ধীর পা চালিয়ে নিশ্বাসে সেই বাতাস নিচ্ছেন, বাড়িটায় চোখ বুলিয়ে ব্যাথায় ব্যথিত হচ্ছেন। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর মাহতাব চিঠির ভাজ খুললো। প্রথমেই যেন তারিখটা চোখে পড়লো। এরপর লেখাগুলোও মনে মনে পড়ে গেলো।
“নানাভাই,
জানিস? একটা সংসার আমি তছনছ করে দিয়েছি আত্মগর্বে! আমার আপন সংসার। আমার আদরের আলোকে আঁধারে ঠেলে দিয়েছি এই দু’হাতে। তোর বাবার মুখের সেই হাসিটা, চোখের জ্বলজ্বল ভাবটা আমার চোখে আজও লেগে আছে। তোরা হয়তো ভুলে ভুলে হালকা করে দিন পাড় করে দিয়েছিস তাকে মৃত ভেবে। আমি কখনো তাকে হালকা করে নিতে পারিনি। যখন গভীরে যাওয়ার সময় হতো, আমি খুব ভাবতাম তোর বাবাকে নিয়ে। চোখের সামনে দেখতাম, কানের কাছে শুনতে পেতাম আলো আমায় বলছিলো, আমি যেন উচ্চ পদের কর্মকর্তাদের কাছে আবেদন করে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসি। আমি যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার চেহারা করুণ ছিলো। আমার দেখা পেতেই প্রাণ ফিরে পেলো যেন। আমি ভুলতে পারি না সেই দিন। ভারি অন্যায় করেছিলাম নানা ভাই। তোর সাথে বড় অন্যায় হয়েছে আমার। আমার মেয়ের চেয়েও বিশাল আকৃতির ক্ষতিটা আমি তোর করেছি। জীবনের বড় শাস্তিটা তোকে এই পাপী বুড়ো দিয়ে গেলো রে নানা ভাই। আমি সেদিন সম্মানের কথা না ভেবে আবেদন করতে পারলে হয়তো তোর জীবনটা বেঁচে যেতো। একটা ছায়ার তলে হাসিখুশি বেড়ে উঠা হতো। যে আমি আমার সন্তানদের দিনের পর দিন ছায়া দিয়ে গেছি, সেই আমি তোর ছায়াটা কেড়ে নিয়ে গেছি। জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা আমি এইখানে করে গেলাম। সময় থাকতে সাধন হলো না। একটা সম্মান বাঁচাতে কিছু প্রাণের ঘাতক হয়ে গেলাম। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জিতে গিয়েও প্রকৃত জীবন যুদ্ধে হেরে গেলাম। হেরে যাওয়ার ব্যর্থতা বুঝলাম সময় ফুরিয়ে আসার পরে। মরিতেও পারি না আযাবের ভয়ে। আলোর কাছে ক্ষমা চেয়েছিলাম দ্বিতীয়বার দেখার পর থেকে প্রতিবারের দেখাতেই। কিন্তু আবেদন পত্র জমা করার ইচ্ছা জাগালাম না মনে। একটা কলঙ্ক নিয়ে বাঁচার চাইতে তোদের এমনিতেই ভালো বাঁচতে দেখে সন্তুষ্ট থাকতাম চোখের সামনে। যেদিন তুই সত্য জানবি, সেদিন ঠিক ভেঙে পড়বি। আফরোজা সেদিন আমায় জেরা করলো, তাতে বুঝলাম আলোর মুক্তি হয়ে গেছে তবে। জীবনের শেষটা তাকে কারাবন্দীতে করতে হবে না এবার। শীঘ্রই সত্যটা তোর সামনে ঝড় হয়ে ছুটে এসে ভেঙে দিবে তোকে। চরম ঘৃণা করবি এই বুড়োকে। তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার মুখ আমি পেলাম না, নানাভাই। পারলে করিস দোয়া আমার ওই সাড়ে তিন হাত গোরের শিয়রে।”
চোখদুটো ঝাপসা হতে যাচ্ছিলো। উপর দিকে তাকিয়ে সেটুকু শুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় মত্ত হলো মাহতাব। প্রেম আর ঘৃণা একত্রে কিভাবে মিশিয়ে তোলা যায়, সেই সূত্র তার জানা নেই। এই ভয়াবহ সত্যে নিজেকে শক্ত রাখতে কতটা শক্তির প্রয়োজন হয়, তা-ও জানা নেই। কেবল চুপ থাকতে জানে এই ছেলেটা। উপর থেকে চোখ সরাতেই জানালা দিয়ে দেখতে পেলো তার অসহায় ভঙ্গিতে একা বসে থাকা পিতাকে। পিতার প্রতি তার কোনো অভিযোগের জন্ম হয়নি এখন পর্যন্ত। তবে মুখে কথা ফুটছিলো না এক বাক্যও। দৃষ্টি নত হয়ে গিয়েছিলো তখন পিতার স্পর্শে, বাকশক্তি হারিয়ে বসেছিলো নিজেরও অজান্তে। মামা যেন একটু অনুপ্রেরণা দিয়ে গেলো শক্তি ফিরিয়ে আনার। সে বাইরে বের হলো। ধীর পায়ে উঠুনে নামলো। মাটির দিকে তাকিয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন নূর আলম। মোয়াজ্জেম আলীও ওদিকে মাথায় হাত রেখে বসে আছেন আহমদ আলীর দুয়ারে বারান্দার সিড়িতে। চিঠি হাতেই নূর আলমের পাশে দাঁড়িয়ে ছেলে ডাক দেয়,
“আব্বা…”
শুকনো মুখের ডাক ধ্যান ভেঙে বেদনার জল নাড়িয়ে দেয় এই অসহায় পিতার। এই একটা শব্দ আজ কত বছর ধরে ডাকেনি তার ছেলে। কত বছর শুনেনি এই সম্বোধন তিনি নিজেও। ছেলের মুখে তাকিয়ে সাথে সাথেই দাঁড়িয়ে গেলেন নূর আলম। ভাঙা গলায় নিজের সাফাই করলেন,
“খোকা, আমি অপরাধ করিনি। ভাগ্য আমায় অপরাধী বানিয়েছে রে।”
বলতে বলতে দু’হাতে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। কাঁধে মুখে গুজে কেঁদে উঠলো মাহতাব৷ বাবাও কাঁদে। আমজাদ আলীর ঘরের দরজার সামনে মরিয়ম বসে ছিলো। রোজার চোখে কান্না থাকলেও সে ফুপুর সেবা করছিলো। মাথার এলোমেলো চুলগুলো বেঁধে দিচ্ছে। সেলিনা বেগম পাশেই বসে তাকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন। মাহতাবের এক শব্দ যেন সেই ঘরের মানুষদেরও মনযোগ কেড়ে নিলো। তারা চোখে জুড়িয়ে নিলো। বুকের ভেতরে আবারও কান্না উদয় হলো মরিয়মের। তার ছেলের জন্য এবারের কান্নাটুকু। কত বছর পর ছেলেটা “আব্বা” বলে ডাকলো। জীবিত থাকতেও বুকের ভেতর এক মৃত বাবাকে পুষে রাখলো। তার যোদ্ধা বাবা কিভাবে এমন করে গেলো তার ওই সোনার টুকরো ছেলেটার সাথে! দূর থেকে আমজাদ আলীর বুক থেকেও ধীর নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। অতিরিক্ত শোকের পিঠে একটু শান্তি পেলো এই ছেলেটার জন্য। সকলের শোক দেখে আজ এবাড়ির বাচ্চাগুলোও দুষ্টুমি করে না। বড়দের কান্না দেখলে তাদেরও কান্না পায়। আজমাইনটাও খুব দায়িত্ব নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। যত ছোটাছুটির কাজ সে-ই সম্পন্ন করছে। সহযোগী হয়ে সিয়ামও কাজ এগিয়ে দিচ্ছে তার। দাদাজানের খাটিয়া কাঁধে তোলার সময় আজমাইনের চোখদুটোতেও শ্রাবণ নেমে এসেছিলো। ক্ষণে ক্ষণে সান্ত্বনাও প্রদান করছে পরিজনদের। মৌসুমীটা একটু পরপরই বড্ড কাঁদছে। আজমাইনের পর সবচেয়ে বেশি ঝগড়া করতো ওই বুড়োর সাথে। নালিশ জমা করতো ভুড়ি ভুড়ি। তার বিচারক ও ঝগড়ার মানুষটা হারিয়ে গেলো আজ। মরিয়মের সাথেও নূর আলমের সাক্ষাৎ হলো অনেকটা সময় পরে। একটু ব্যাথা নিংড়ে, একটু ব্যাথা জাগিয়ে, কখনো নিরবে, কখনো জবাবদিহিতার সুবাদে দুয়েক কথার গল্পে কেটে গেলো এই আঁধার প্রহর। বাইরে চাঁদের আলো, অথচ একেকটা মনের পরিবেশ আজ গভীর থেকেও গভীরতর কালো।
প্রকৃতিতে পরবর্তী ভোরের আলো ফুটতে শুরু করলে ফজরের নামাজের পর কবর জিয়ারতে গেলো পরিজন। জিয়ারত শেষে একে একে ফিরে এলেও দাঁড়িয়ে রইলো একজন। নতুন মাটির স্তুপ পড়ে আছে গতকাল বিদায় নেওয়া দেহের উপর। সে দেখছে তাকিয়ে। বসন্ত ফুরিয়ে নতুনত্ব নিয়ে সেজে আছে প্রকৃতি। পিছু ফেলে দিয়েছে ধূলোময়লায় জর্জরিত মলিন রূপকে। সেই সাথে নিয়ে গেছে ওই বাড়ির প্রবীণ প্রাণকে। নিজের রূপের পরিবর্তনে সমতা রেখে একই সূত্রে জানান দিয়েছে নতুনত্বপ্রাপ্তির। কেউ যাবে, কেউ আসবে। এই সূত্র নিয়েই জন্মেছে প্রকৃতি। আহমদ আলীর কবরের সামনে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাহতাব। শ্বাস প্রবাহিত হচ্ছে স্বাভাবিক। কিন্তু মন, চিন্তাশক্তি, মুখমণ্ডল খুবই কোমলতায় ছেয়ে আছে। এক আশ্চর্যজনক স্তব্ধতার মানব, উপস্থিত মাহতাব। আশ্চর্য রকমের স্বাভাবিকতা নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে কিছু অস্বাভাবিক প্রশ্ন নিয়ে। মাথায় টুপি, হাতদুটো ভাজ করে রাখা, ঠোঁট দুটো একত্রে মেলানো। কোনো নড়চড় নেই। স্থির চোখদুটো মনের প্রশ্ন উপচে দিচ্ছে সাড়ে তিন হাত মাটির গভীরের নিথর দেহটার কাছে।
“এভাবে চলে যাওয়ার কি খুব প্রয়োজন ছিলো? কত হিসেবনিকেশ যে বাকি পড়ে রইলো তোমার সাথে। কত জানা যে অজানায় পড়ে রইলো তোমার জন্য। কত আবেগ যে আমার ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো ফেলে আসা মুহুর্তে। কে দেখবে এসব? জবাবদিহিতারও তো ঢের বাকি। চুকালে না কেন সবটা? খুব প্রয়োজন ছিলো, আমার জীবনের এই অধ্যায়টা এতো বিষাদিত করার? তুমি শান্তি পাচ্ছো এই অপূর্ণতা নিয়ে চলে গিয়ে? নাকি শুধু আমিই অনুভব করছি এই অপূর্ণতাকে? তোমার চলে যাওয়ায় তো আমার কিছু পূর্ণতা ছুটে এসেছে, ভাবছে সবাই। আমি যে পূর্ণতার এক টুকরো এখানে রেখে গেলাম, সেটা কি কেউ দেখেছে? দেখবে না। তুমিই দেখো। দেখে দেখে ভালো থেকো। যেটুকু ভালোবাসা পেয়েছি তোমার কাছে, রবের করুণায় সেটুকুর প্রতিদান তুমি হাজার গুণে লাভ করো। এক টুকরো জান্নাতের মালিক হও তুমি। দেখা হবে নাহয় আবার, তোমার ভিটে তথা জান্নাতের মালিকানায়। তোমার পাওয়া জান্নাতের হকদার কিন্তু আমিও হতে চাই, যেমনটা হয়েছি তোমার দুনিয়ার ভিটায়।”
আরও নানান ভাবনা, নানান মনোক্তি শেষে এই ভুবনের বাতাসে একটা ধীর নিশ্বাসের শব্দ ভাসলো। ভাজ করা হাতদুটো বাঁধন ছেড়ে স্বাভাবিক হলো। নিস্তব্ধতার বিষাদে ঘেরা নরম মুখটায় চোখের পলক পড়লো এতোক্ষণে। হালকা ভিজেছে ভেতরটা। কিন্তু এর জানান বাইরে হতে দেয়নি। বাতাসে মিলিয়ে গেছে চোখের ভেতরেই। এক টুকরো অপূর্ণতা এখানে ফেলে ঘুরে দাঁড়িয়ে চলে গেছে বাড়ি পথে। অভিমান রেখে কি লাভ? একদিন তাকেও নিথর শরীরটা নিয়ে এখানে শুয়ে পড়তে হবে। একটু ভালো ফলাফল পাওয়ার প্রত্যাশায় ভালো কিছু করতে হবে। ধন দৌলত কিছুই যাবে না সাথে। শূন্য হাতে একা এসেছে, একা একাই যেতে হবে শূন্যতা নিয়ে। স্বজনপ্রীতিটাই শুধু আবেগে জড়িয়ে যাবে রূহ এর সাথে।
(সমাপ্ত)