শুধু তুই পর্ব-০১

0
556

শুধু তুই
পর্ব-১
সৈয়দা সিরাজুম মনিরা

১.
পেয়ারা গাছের ডালে বসে পা দোলাতে দোলাতে পেয়ারা খাচ্ছি‌ আর বারবার উঁকি দিয়ে দেখছি গাড়ি আসছে কি না। শাড়ির আঁচল কোমরে গোজা। হাঁটুসমান ছেড়ে দেয়া চুল হাওয়ায় দোল খাচ্ছে।

আজ আমায় দেখতে আসবে। ছেলে কোথায় থাকে, কি করে জানা নেই। আসলে জানার চেষ্টাই করিনি। কারণ আমি জানি বিয়েটা হবে না। আমাকে যদিও প্রথমবার দেখতে আসছে তবুও ছেলে তাড়ানোর অভিজ্ঞতা আমার আছে। বান্ধবীদের জন্য কত তাড়ালাম, আর নিজের জন্য তাড়াতে পারব না? ভাবছি, এমন কিছু করতে হবে যাতে পরবর্তীতে ছেলেটি ক্ষণে ক্ষণে মনে করে, অমুক জায়গায় মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম, ভাগ্যিস বিয়েটা হয়নি!

কোমর ব্যাথা হয়ে গেছে বসে থাকতে থাকতে, তাও ছেলেপক্ষের গাড়ির দেখা নেই। রাগে গা আমার জ্বলে যাচ্ছে।

মা বলেছিল, ছেলে নাকি অনেক সুদর্শন। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ছেলের মা-বাবা অনেক ভালো, আমাকে নিজের মেয়ের মতো রাখবে। এক কথায়, একটি মেয়ে যেমন বর, শশুর শাশুড়ি চায় এরা ঠিক তেমনই। কিন্তু আমার সেসব গুণকীর্তন শুনে ভালো লাগার পরিববর্তে অনেক বিরক্ত লেগেছিল।

ঐ তো একটা গাড়ি আসছে। রাগে শরীরের রোম দাঁড়িয়ে গেল। সন্দেহ নেই এইখানেই আছে আমার সর্বনাশের মূল। দাঁড়াও চান্দু, দেখাচ্ছি মজা, আমায় দেখতে আসা। গাছ থেকে একটা বড় আকারের পেয়ারা ছিড়ে ঢিল মারলাম গাড়ির গ্লাস বরাবর। ঝনঝন করে উঠলো গ্লাস। আমার নিশানা কমই ব্যর্থ হয়। যার কারণে গ্রামের লোকেরা খুব কম সংখ্যক ফলমূল নিজেদের পেটে দিতে পারে। গ্রামে আমার নামে রটনা আছে, দুনিয়ার যত অনন্য দুষ্টু বুদ্ধি আছে তা নাকি আমার মাথাতেই উদয় হয়। মা দুঃখ করে বলে, আমি যখন খুব ছোট, তখন মায়ের মনে হয়েছিল আমি শান্তশিষ্ট হব। তাই রেখেছিল এক মিষ্টি নাম – মোহর। আর এখন সেই মোহরের নামে সকাল-বিকাল দু বেলা নালিশ শুনতে হয় তার।

কারটা ইতোমধ্যে ব্রেক কষেছে। তড়িৎ গতিতে আরেকটা পেয়ারা ছিড়ে ঢিল দেওয়ার জন্য যেই না হাত উঁচু করেছি অমনি ড্রাইভিং সিটে বসা মানুষটিকে দেখতে পেলাম। রীতিমতো হাত থেকে পেয়ারা খসে পড়ে গেল। আশিষ! তারমানে এই গাড়িতে ফুপুরা এসেছে। হায় আমার পোড়া কপাল! আর কোনো গাড়ি পেলাম না, ভুল করে আশিষের গাড়িতেই ঢিল দিতে গেলাম? আমারই বা দোষ কোথায়, এমন ভুল সময়ে এসে পড়বে তা কি আমি জানতাম? তাছাড়া এটা আশিষের নতুন গাড়ি বলে চিনতেও পারিনি। এখন আমার কি হবে? তার প্রিয় গাড়িতে ঢিল ছুড়েছি আমাকে কি ছেড়ে দেবে? সে এরইমধ্যে জানালা দিয়ে মাথা বের করে ঢিলের উৎস খুঁজতে শুরু করেছে। একবার মনে হলো আমাকে দেখার আগেই গাছ থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যাই। কিন্তু তার আর দরকার হলো না। আমাকে দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে সে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেল।

আমাকে যে দেখতে আসছে সে কথা এই ঘটনায় ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে পড়লে আশিষ উপস্থিত থাকতে এমন অঘটন ঘটবে ভেবে মুষড়ে পড়লাম। আমি চাইনি এই খবর তার কানে যাক। আজ যখন বেড়াতে এসেছে তখন অবশ্যই জানে। তবে এ থেকে একটা জিনিস বেশ বুঝতে পারা গেল আমার বিয়ের কথা হচ্ছে শুনে আশিষের মনে কোনো খারাপ লাগা নেই। খারাপ লাগা তো তখন থাকবে যখন সে আমায় ভালোবাসবে, না? আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আজকের দিনেই কেন তোমাকে আসতে হবে আশিষ? আমি জানি তুমি আমায় ভালবাসো না। আমার বিয়ে হলেও তোমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু আমার তোমাকে ছাড়া যে চলবে না। তুমি হয়ত মনে করছো আমার পড়াশোনা করতে ভালো লাগে না বলে আমি বিয়ে করে বাঁচতে চাচ্ছি। ঠিক আছে, কোনো ব্যাপার না, আমি আজকে বিয়েটা ভাঙলেই তোমার ভুল ভাঙবে। আপাতত তোমার ভুল ভাঙানোটাই বেশি জরুরি।

আমার আর এক মুহূর্ত এখানে বসে থাকতে মন চাচ্ছে না। মন বারবার বাড়ির দিকে টানছে। যাই হোক বাড়ি এখন ফেরা যাবে না। মধ্যে অনেকটা সময় কেটে গেছে,‌ যেকোনো সময় উজবুকের দল চলে আসবে। আমি মনে মনে আমার করণীয়গুলো ঠিক করতে লাগলাম। এমন সময় ঘটলো বিপত্তি।‌ আমাকে খুঁজতে খুঁজতে মা চলে আসলো। তাও আবার হাতে লাঠি নিয়ে।
মা নিচ থেকে বলল,”নিচে নেমে এসো তাড়াতাড়ি।”

“দেখো মা নামছি কিন্তু তার আগে লাঠি ফেলে দিতে হবে।”

“দেব। আগে নামো তুমি। তোমার সাহস তো মন্দ নয় আজকের দিনেও তুমি কাউকে না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছো আর বাড়ি ফেরার নাম নিচ্ছ না। অপেক্ষা করতে করতে শেষ পর্যন্ত আমাকেই বের হতে হলো।”

“তোমার কষ্ট করে বের হওয়ার দরকার ছিল না। একটু পরেই আমিই তো চলে যেতাম।”

“ফাজলামো করো না। একটা মারও মাটিতে পড়বে না বলে দিচ্ছি।”

মায়ের ভাবগতিক ভালো ঠেকছে না। বেজায় চটেছে। এখন আর চটানো যাবে না। মাকে বুঝিয়ে আরো কিছুক্ষণ সময় চেয়ে নিতে হবে। কিন্তু আমি নামামাত্রই মা আমাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগলো। এ যে তীরে এসে তরী ডুবে যাওয়ার সামিল। মাকে থামিয়ে বললাম,”মা শোনো আমার কথা।‌ তুমি বাড়ি যাও। আমি দশ মিনিটের মধ্যে বাড়ি চলে যাব প্রমিস।”

“না, আর এক মিনিটও দেরি করা যাবে না। ছেলের বাড়ির লোকেরা কখন থেকে এসে বসে আছে।”

আমি চমকে উঠে বললাম,”কখন থেকে এসে বসে আছে?”

“অনেকক্ষণ হলো। এজন্যই তোমার অপেক্ষা করতে করতে শেষে আমাকেই আসতে হলো। এবার বুঝতে পারছো তুমি কতটা অন্যায় করেছো?”

আমি আতঙ্কিত হয়ে বললাম,”এটা কি করে সম্ভব। আমি এই জায়গা ছাড়া এক মিনিটের জন্যও নড়িনি। কোনো গাড়ি, সিএনজি তো দুর একটা রিকশা পর্যন্ত আসেনি। তাহলে ওরা কিভাবে আসলো? জ্বিন ভূত তো আর না।”

“কেন আশিষের গাড়ি আসতে দেখো নি?”

“হ্যাঁ দেখেছি। এই একটা ছাড়া অন্য কোনো গাড়ি আসতে দেখিনি।”

“আচ্ছা। মেহমান অন্য রাস্তা দিয়েও তো আসতে পারে।”

“আর রাস্তা তো নেই মা তুমি ভুলে গেছো? অবশ্য এই রাস্তা ছাড়া শুধু জঙ্গলের ভেতর দিয়ে আসা যায়। তবে কী আমাদের এত সুন্দর ইট বিছানো রাস্তা থাকতে ওরা গাড়ি উল্টাদিকের রাস্তায় পার্ক করে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসেছে! আশ্চর্য!”

“যেদিক দিয়েই হোক এসেছে। তোমার অত ভাবতে হবে না। তাড়াতাড়ি চলো। আর একটা কথা, কোনোরকম চালাকি করার চেষ্টা করবে না। করলে কপালে দুঃখ আছে বলে দিলাম।”

আমি আজ আর কিছুই করতে পারব না বোঝা হয়ে গেছে। আচ্ছা এমন যদি হয় আজই আমাকে পছন্দ হয়ে গেলে বিয়ে পড়িয়ে রাখে, কী হবে তখন?

মা এক প্রকার টেনেই আমাকে বসার ঘরে নিয়ে গেল। ফুপুর আহ্বানে অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখ তুলে দেখি ঘরে বাবা, ফুপা,ফুপু আর আশিষ ছাড়া যারা আছে তারা আমাদেরই স্বজন। আমার বিস্ময়ভাব কাটার আগেই ফুপু সহাস্যে বলল,”মেয়ে আমাদের বেশ পছন্দ হয়েছে।”
ফুপা বাবাকে বললেন,”ভাইয়া, শুভ কাজে দেরি না করাই ভালো।”
চলবে…