স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
||পর্ব-১২||
রাত দশটা কিংবা এগোরটা।আমি ডিনারটা সেড়ে হাতে একটা থ্রিলার বই নিয়ে চেয়ার টেনে বসি।এমতাবস্থায় কেউ দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে।আমি চমকে পেছনে ঘুরে তাকিয়ে তুরাব ভাইয়া এসেছে।উনাকে দেখামাত্রই আমার ভেতরটায় এক দলা লজ্জা,সংকোচ গেড়ে বসে।মাথার অর্ধ আবৃত ওড়নাটা সামনে আরেকটু টেনে নিয়ে আবার তাড়াতাড়ি বইয়ে মুখ গুঁজি।আর কানদুটো পেছনের দিকে মনোনিবেশ করে রাখি।
তিন-চার সেকেন্ড কেঁটে যাওয়ার পর তুরাব ভাইয়া খানিকটা কেঁশে নিয়ে গলাটা একটু পরিষ্কার করেন।খুবই সুশীল এবং সুস্পষ্ট গলায় মাকে বলেন,
“আন্টি?ঘুমাচ্ছেন?
মার এতক্ষণ চোখের পাতা বুঁজা ছিল।ঠিক ঘুমায় নি,সন্ধের বুক ব্যথায় কাতর শরীরটা বিছানায় ছড়িয়ে দিয়েছেন মাত্র।কারো কথার আওয়াজ পেয়ে সেই কাতরতার গোচর কাঁটে।চোখজোড়া মেলে দেখেন তুরাব ভাইয়া।মুহূর্তেই মার ঠোঁটে এক দলা হাসি ঝুঁলে পড়ে।শোয়া থেকে ধীরগতিতে উঠে বসেন। তারপর বলেন,
“নাহ,বাবা।ঘুমাই নি।শরীরটা একটু খারাপ লাগছে ত তাই শুয়ে আছি।তা তুমি দাড়িয়ে কেন!চেয়ারে বসো।এই সানা,তুরাবকে একটা চেয়ার টেনে দে।”
“নাহ,আন্টি লাগবে না।আমি একটুপর চলে যাবো।”
খারাপ দেখাবে ভেবে আমি একগাট্টি লজ্জা, সংকোচ বোধ থাকা সত্ত্বেও মার কথায় চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই।চোখের দৃষ্টি নিচের দিকে রেখেই পাশ থেকে একটা চেয়ার টেনে এনে উনার দিকে এগিয়ে দিই।উনি সেখানে ধপাস করে বসে পড়েন!এ বিষয়টা আমার চোখে একটু বাঁধে।কেমন ম্যানারলেস রে!একজন দিয়ে দিলো,আর সে কেমন বেহায়ার মতো বসে গেল!
“তা আগে কোথাও ডাক্তার দেখিয়েছেন,আন্টি ?”
“হুম,বাবা দেখিয়েছে।কুমিল্লা মডার্নে।”
“কী বললেন ওই ডাক্তার?”
“হার্ট দুর্বলের কারণে নাকি বুকে ব্যথা হচ্ছে।আর আগে শুধু বুকে ব্যথাই ছিল, ইদানীং তারসাথে শ্বাসকষ্ট, বমি,মাথাঘোরা নতুন করে জুড়ে বসেছে।”
“তাহলে ত ব্যাপারটা সিরিয়াস!আচ্ছা, আমি তাহলে একজন ডাক্তারের এড্রেস দিয়ে দিচ্ছি।কাল গিয়েই দেখিয়ে আসুন।”
মার ঠোঁট নঁড়ার আগেই আমি পাশ থেকে ফোঁড়ন কেঁটে বললাম,
“কাল সম্ভব না!”
তুরাব ভাইয়া আমার দিকে অবাক নয়নে তাঁকান।বলেন,
“কেন সম্ভব না?”
মনে মনে কথাগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে উনার সামনে নিজেকে যথেষ্ট সম্ভব প্রদর্শন করে বললাম,
“মা একজন হার্টের রোগী।অনেকটা পথ জার্নি করে এখানে এসেছে।এতে শরীরটা প্রায়ই অসাড়।এখন মার রেস্ট খুবই প্রয়োজন।তাই কালকের দিনটা সম্পূর্ণ রেস্টে কাঁটিয়ে ইনসাল্লাহ পরদিন নিয়ে যাবো ভেবেছি।”
তুরাব ভাইয়া নিঃশব্দে কথাগুলো শোনে নিয়ে দু’পাশে হালকা মাথা ঝাঁকিয়ে বলেন,
“তা বেশ,নো প্রবলেম!এজ ইউর উইশ!”
আমি আর কিছু বলিনি।চেয়ারে এসে বসে পড়ি।উনি উনার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে গন্তব্য ফিরতি মায়ের দিকে ফিরে বলেন,
“তা আন্টি আমি চলে যাচ্ছি ঠিকমতো ওষুধ খেয়ে নিবা।ওষুধ কিছুতেই মিস দিবা না।আর পর্যাপ্ত ঘুম দিবা,ওকে?”
“ঘুম ত বেশি আসে নারে বাবা!”
“না আসলেও চেষ্টা করতে হবে।আর যদি একেবারে না-ই আসে তাহলে ডাক্তারের পরামর্শনুযায়ী মেডিসিন নিও।”
“দেখি..!”
“আচ্ছা, যাচ্ছি তাহলে।”
মা মাথা দুলে “হ্যা” ইঙ্গিত করেন।উনি বেরিয়ে যান।
উনি চলে যাওয়ার মিনিট দশেক পর আমি পুরো বারান্দাময় জুড়ে পায়চারী করতে থাকি !মা কিছুক্ষণ হলো ঘুমিয়ে গেছেন।বাতিও অফ করে দিয়েছি।এখন রুমটা পুরো অন্ধকার!আর বারান্দাটা চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় চকচক করছে।বাইরে দূরের দুই তিনটে কৃষ্ণচূড়া গাছ মৃদু বাতাসে কিছুক্ষণ পরপর দুলে উঠছে।আমি ওখানটায় একপলক তাকিয়ে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ি। আজ ওই লোকটাকে মিথ্যে বলেছি। মার ক্লান্তির কারণে কাল নিয়ে যেতে পারবো না।জানি না লোকটা কি ভেবে নিয়েছে!সন্দেহ করেছে নাকি বিশ্বাস করেছে!যদি বিশ্বাসই করে নিল তবে কাল আমি কী বলে রিপোর্ট নিতে যেতে বেরুব? খালামণিকে কী বাহানা করে বলব যে খালামণি আমি বাইরে যাচ্ছি!
আচ্ছা,যদি সত্যটাই,অর্থাৎ আকাশের চেম্বার থেকে মাকে দেখিয়ে এনেছি,সে আমার কলেজ লাইফের ফ্রেন্ড এসব বলে দিতাম তাহলে উনারা কেমন রিয়াক্ট করতেন?বিষয়টি ভালোভাবে দেখতেন?অবশ্যই না।
তাহলে ভুলটা কী আমারই ছিল যে আমি প্রথমেই আকাশের চেম্বার থেকে মাকে দেখিয়ে এই বাসায় আসলাম?
তখন ত আর ওতকিছু ভেবে দেখি নি।উফস!এতশত ভাবনার মাঝেই হুট করে আমার কল বেঁজে উঠে।রুমে যেয়ে বাতিটা অন করে মোবাইল হাতে নিই।তারপর আমার বাতি অফ করে দিয়ে বারান্দায় চলক আসি।স্ক্রিনে তাকিয়ে আকাশ কল করেছে।কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো,
“খালামণির বাসায় গিয়ে আমাকে ভুলেই গেলি?”
“আরেহ নাহ।একটু ব্যস্ত আর কি আকাশ।তুই জানিস?মার আজকে সন্ধেও বুকব্যথা উঠেছে।”
“কী বলিস!?”
“হুম।”
“ওষুধ খাইয়ে দিয়েছিস?”
“হু।ওষুধ খাওয়ানোর পরই ত স্বাভাবিক হলো মা।”
“আন্টির ভালোমতো খেয়াল রাখিস।আর কাল রিপোর্টগুলো ভালোমতো দেখবো কী কারণে এত রোগ!কাল ত আসছিস,না?”
আমি খানিক চুপ থেকে তারপর বললাম,
“যা-বো, আকাশ!
বলেই ছোট্ট একটা ঢোক গিলি।আকাশ বললো,
“ওকে তাহলে কাল আমাদের দেখা হচ্ছে। কাল কিন্তু আমার এখানে লাঞ্চ করবি বলে দিলাম!”
“সেটা পরে দেখা যাবে।”
“পরে দেখা যাবে মানে কী?এতকিছু বুঝি না কাল এখানেই লাঞ্চ করবিই!লাস্ট এন্ড ফাইনাল ডিসিশন!”
আমি ফিকে হেসে ।বললাম,
“আচ্ছা,বাবা করবো করবো।”
“আন্টি ঘুমিয়ে?”
“হু।”
“ওহহ।একটা কথা বলতাম সানা!”
“কী?”
আকাশ খানিক চুপ থাকে।ওর নিশ্চুপতা বুঝা গেল ও কিছু একটা ভাবছে।পরমুহূর্তে বললো,
“না কিছু না!”
“আচ্ছা।তা ডিনার করেছিস?”
“নাহ।”
“কেন?”
“বুয়ার বাসায় কি প্রবলেম হয়েছিল সেজন্যে আসতে পারে নি।তাই রান্না ও হয়নি।ফ্রিজে ফ্রুটস আছে। ফ্রুটস খেয়ে রাতের খাবারটা কোনমতে কাটিয়ে দিব।
তুই করেছিস?”
“আমি আরো আগে করেছি।আর শুন?যতদিন তোর সাথে কথা হলো ততইদিনই শুনলাম তোর এই সমস্যা,ওই সমস্যাএকটা কাজ করলেই ত পারিস!”
“কী?”
“একটা বিয়ে করে পেল!বউ সারাদিন ওটাসেটা খাওয়াবে।জামা ধুঁয়ে দিবে ইত্যাদি ইত্যাদি।”
আকাশ খিলখিল হেসে দেয়।হাসি থামিয়ে বললো,
“বিয়ে ত আর কখনো করবো না।তাই বউ আসবে কথেকে?”
একথাটি শুনামাত্র একমুহূর্তেই আমার ধমনী শিরা-উপশিরায় হীম স্রোহ বয়ে যায়।চোখদুটো ছলছলিয়ে ওঠে।বুকটা ভার হয়ে আসে!মনের অবচেতনে গুনগুনিয়ে উঠে,আকাশ আমায় এখনো অনেক ভালোবাসে?আচ্ছা কেন এত ভালোবাসে?কেন এত আবেগ মোহ বুকের পাশে জমা রেখে নিজের জীবনটাকে শেষ করে দিচ্ছে?কী লাভ তার?
ভেবেই নিজেকে সংযত করি।তারপর প্রসঙ্গ পাল্টে শান্ত গলায় বললাম,
“রাত অনেক হয়ে গেছে।ডিনার করে নে।আর তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়।রাখলাম।”
“আর শুন শুন?কাল কখন আসবি?”
“বের হওয়ার সময় তোকে কল করে জানাবো।”
“ওকে,বায়।টেক কেয়ার।”
কলটা রেখে বেলকনির দরজা বন্ধ করে বিছানায় এসে শুই। আর ভাবতে থাকি কাল খালামণিকে কি বলে বাসা থেকে বেরুনো যায়!
চলবে….