স্বপ্নময় ভালোবাসা পর্ব-১৭

0
4607

স্বপ্নময় ভালোবাসা
রোকসানা আক্তার
পর্ব-১৭

বিকেলের শেষ প্রহর।রোদের তেজটা এখন অনেকটা কমেছে। চারদিকে নরম মিষ্টি রোদগুলো পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে।সতেজ,মিষ্টি,সবুজাভ একটা পরিবেশ।অথচ সেই পরিবেশের অবস্থানরত মানুষের মুখগুলো এক একটা নিকষ কালো,বিষন্ন,গম্ভীর এবং চিন্তা মাখা !তাদের কারো মুখে কোনো ভাষা নেই। নৈঃশব্দ মুখে পশ্চিমা পথ ধরে মাথায় টুপি আর পড়নে সাদা পান্জাবী এবং লুঙ্গি দিকে দিকে তাদের দল দূর বহুদূর ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে।

আমি জানলার পাশে বসে পাথার চোখে তাদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি।
কিছুক্ষণ হলো মার দাফন কাজ শেষ হয়েছে।তুরাব ভাইয়া এবং খালামণিও এসেছে মিনিট দশেক আগে।উনারা মুখটা ভার করে বাসার সামনের এক চিলতে উঠোনের কোণাটায় দাড়িয়ে আছে।আমি খালামণিকে সঙ্গে না আনায় উনারা এম্বুলেন্সের পেছন পেছন নিজেদের গাড়ি করে নাকি আসেন। কাঁচপুর স্থানে আসার পরই হঠাৎ উনাদের গাড়ির তেল ফুরিয়ে যায়,এই নিয়ে নানান ঝামেলাঝাপটা রয়ে সয়ে আসতে আসতে মার দাফনের সময় উপস্থিত থাকতে পারে নি।

কিন্তু এদের এই মুহূর্তে আমার একদম সহ্য হচ্ছে না।এদের জন্যে আমার সব শেষ!এই উন্মাদ পৃথিবীতে আমার মা ছাড়া কেউ ছিল না!আপন বলতে ওই এক রত্নি সম্বল ছিল।আজ ওদের জন্যে আমার সব শেষ হয়ে গেল!তছনছ করে দিল আমার জীবনটাকে এরা!নাহ এদের আর এখানে এক মুহূর্তেও দাড়িয়ে থাকতে দেওয়া যাবে না তাহলে আমার মার আত্মা কষ্ট পাবে, খুব কষ্ট পাবে!আমাকে অভিশাপ দেবে বেকায়দা দের এখানে দাড়িয়ে থাকতে দিলে…!!
মনের ক্রোধে স্থান থেকে উঠে দাড়াই।টোয়া আমার বাম হাতটা শক্ত করে ধরে।বললো,

“কোথায় যাচ্ছিস?”
আমি জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে ভাঙ্গা গলায় বললাম,
“ওই দুজনকে বল এখান থেকে চলে যেতে!”
“উনারা ত তোর খালামণি এবং কাজিন!উনারা চলে যাবে মানে?”
এবার কিছুটা বল প্রয়োগ করে জোর গলায় চিৎকার করে বলে উঠলাম,,
“নাহ ওরা আমার কেউ না!ওদেরকে আমি চিনি না।ওদের বল এখান থেকে চলে যেতে!বল!!!”

শেষ কথাটা মুহূর্তের জন্যে আশপাশে থাকা সবাইকে থমকে দেয়!সবাই কী হয়েছে কী হয়েছে ভেবে দ্রুতপদে এখানে আসতে থাকে।আকাশও আসে।আকাশ সযত্নে আমার কাছে এসে বললো,

“সব ঠিক হয়ে যাবে,সানা।সব ঠিক হয়ে যাবে!শান্ত হ,প্লিজ?”

আমার চিৎকারের আওয়াজে খালামণি এবং তুরাব ভাইয়াও রুমের দরজার চৌকাছে পা রাখে।আমার বেসামাল মনটা উনাদের দেখামাত্রই মনের ক্রোধানলটা আরো দ্বিগুণ দপ করে জ্বলে উঠে।আকাশকে সরিয়ে দিয়ে উনাদের দিকে এগিয়ে মুখটাকে কষ্টের কুন্ডলীতে লেপে অত্যন্ত ব্যথিত মনে বললাম,

“মা মারা গেছে আর আসবে না!আপনাদের আর জ্বালাতন করবে না!কখনো এটা ওটার আবদার করে বসবে না!কখনো আমার জন্যে আপনাদের কাছে নতজানু হবে না!আমার মা শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। মহা শান্তিতে!কেন আপনারা এসেছেন?কেন?আমার কষ্টটা আরো বাড়িয়ে দিতে !?হু?কি ক্ষতি করেছি আমি আপনাদের? ”

“সানা,শোন….?”
“নাহ আমি কোনো কথা শুনবো না!বেরিয়ে যান আপনারা!”

আকাশ উনাদের হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে আমাকে ওখান থেকে সরিয়ে অন্যরুমে নিয়ে আসে।আমি নিস্তেজতায় বললাম,
“আকাশ বল উনারা চলে যেতে!”
বলতে বলতে টালমাটাল হয়ে নিচে পড়তে নিলেই আকাশ তার বাহুডোরে আমাকে ধরে ফেলে!আমি আবারো জ্ঞান হারাই!

জ্ঞান ফিরলে দেখি অনেকটা রাত হয়ে গেছে!টোয়া শক্ত হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“সানা?তুই ঠিক আছিস ত?”

আমি নৈঃশব্দে স্থির দৃষ্টিতে টোয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি।টোয়া আবার বললো,
“পৃথিবী ছেড়ে একদিন না একদিন সবাইকেই মরতে হবে!আমরাও ত মরে যাবো।এই নশ্বর পৃথিবীতে ক্ষণস্থায়ী আমাদের জীবন!জন্ম-মৃত্যু ধ্রুব সত্য।না মানতে পারলেও এটাকে মেনে নিতেই হবে। শক্ত হ, প্লিজ।তোকে শক্ত হতে হবে।এভাবে কাদিস না আর!তুই এভাবে ভেঙ্গে পড়লে সামনের পথ চলবি কীভাবে,বল?”

চুপ করে থাকি।টোয়াও আর কিছু বলেনি।তারপর ও আমার আলতোভাবে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।আকাশ গলা খাঁকারি দিয়ে ভেতরে আসে।টোয়া জায়গা ছেড়ে উঠে দাড়ায়।আকাশ বললো,

“টোয়া,সানার জন্যে খাবার নিয়ে আস।ও আজ সারাদিন কিছুই খায়নি।”

টোয়া সম্মতি দিয়ে বাইরে চলে যায়।আকাশ টোয়ার জায়গায় বসতেই আমি বললাম,
“আকাশ?উনারা চলে গেছ ত?”

আকাশ খানিক ধাতস্থ বোধ করে বললো,
“যায় নি।শুনলাম কিছুক্ষণ পর চলে যাবে।”
“কোথায় এখন?”
“ডাইনিং এ আছে।”

আকাশের কথা শেষ হতেই আমি ধড়ফড় বিছানা থেকে নেমে যাই।আকাশ অপ্রস্তুত বোধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।আমি আমার রুমে যেয়ে হ্যান্ড ব্যাগটা খুজতে থাকি,কিন্তু কোথাও পাইনি।গলার স্বর উঁচু করে টোয়াকে ডাকি।টোয়া দৌড়ে এসে বললো,

“সানা,কিছু খুঁজছিস?”
“আমার ব্যাগ কই?”
“হ্যান্ড ব্যাগ?”
“হ্যাঁ।”
“ওটাতো আমি আলমারি তে রেখে দিয়েছি।লাগবে?”

উপরে-নিচে হালকা মাথা ঝাঁকাই।টোয়া হর্ণ হাতে আলমারি থেকে ব্যাগটা এনে আমার হাতে দেয়।আমি ব্যাগের চেইন খুলে ডিভোর্স পেপারটা বের করি।ওটা হাতে নিয়ে ডাইনিং এ যেয়ে সোঁজা খালামণির হাতে তুলি দিই।উনি প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতেই বললাম,

“পেপারে আমার সাইন করা আছে!ভালোভাবে চেক করে নিয়ে এই বাসা থেকে চলে যান।”
বলেই ভেতরে চলে আসি।বিছানায় বসে আবারো ঢুকরে ঢুকরে কাঁদতে থাকি।টোয়া এসে আমার হাত ধরে নিয়ে খাবার রুমে নিয়ে যায়।ভাতের প্লেট সামনে রাখতেই বললাম,
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না!”

আকাশও সেখানে উপস্থিত ছিল।সে টোয়ার দিকে একফোঁড় তাকিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে।ধীর স্থির গলায় বললো,
“সানা?এরকম করিস না।দ্যাখ তুই এরকম করলে আন্টির আত্মা ভীষণ কষ্ট পাবে।”

“আকাশ বিশ্বাস কর আমার খেতে একদম ইচ্ছে করছে না!”
“বুঝলাম।এরকম একটুআধটু হবেই।তাই বলে খাবার অফ করে দিবি এটা ঠিক না।খাবারের উপর কখনো রাগ করতে নেই!”
চুপ হয়ে থাকি।আকাশ আবার বললো,
“তুই যদি না খাস তাহলে আমরা কিন্তু চলে যাবো!আর কখনো তোর সাথে দেখা করতে আসবো না।কী টোয়া ঠিক বলছি না?”

টোয়া আকাশের কথায় সম্মতি দিয়ে মাথা নাড়ে।তারপর অনেক কষ্টে কয়েক নালা গলায় ঢুকাই।কিন্তু সম্পূর্ণ শেষ করতে পারিনি তার আগেই ওয়াক ওয়াক শুরু করে দিই।আকাশ প্লেটটা সরিয়ে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়।পানি খাওয়ার পর তারপর একটা টেবলেট এগিয়ে দেয় ওটা খেতে।ওটা খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই মাথায় রাজ্যের ঘুম চেপে বসে।টোয়া বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয়।পরদিন অনেক বেলা করে ঘুম থেকে উঠি।মাথাটা প্রচন্ড ভার ভার অনুভূতি হতেই বুঝতে পারলাম আকাশ কালরাতে একটা ঘুমের টেবলেট খাইয়ে দিয়েছে।

তারপর হাটি হাটি পায়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে বাইরে যেতেই টোয়া আমাকে দেখে হেসে ফেলে।বললো,
“নাস্তা রেডি করতেছি।বস।”

আমি চারপাশ তাকাতে তাকাতে টোয়াকে বললাম,
“আকাশ চলে গেছে?”
“হু,তুই ঘুমানোর পরই ও কাল চলে গেছে।”
“হঠাৎ চলে গেল!বলেও গেলো না।”

টোয়া মৃদু হাসি দিয়ে বললো,
“ও বলেছে আবার আসবে।হাসপাতাল থেকে আর্জেন্ট কল এসেছে তাই চলে গেছে হাতে ত এখানে শর্ট সময় নিয়ে এসেছে।”
“ওহহ।”

তারপর, এভাবে আমার দিন চলতে থাকে।টোয়া সারাক্ষণ পাশে থেকে থেকে মার শোক ভুলাতে এটাওটা বলে আমাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।আমি আস্তে আস্তে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠি।এভাবে চারদিন কেঁটে যায়।এরমাঝে আত্মীয়-স্বজন কেউই আর আমাকে দেখতে আসি নি।তবে প্রতিবেশী দু’একজন এসে এসে আমায় দেখে যেত।মা ছাড়া এই মেয়েকে কে দেখবে?কীভাবে চলবে তার দিন?সে একা থাকতে পারবে? হাজারো কথা মানুষের ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকতো!সবার এই কথাগুলো নিয়ে আমিও খুব চিন্তা করেছি!আসলে সত্যিই ত আমার দিন চলবে কীভাবে?এভাবে দিনগুলো চলতে থাকলে ত আমিটাই শেষ হয়ে যাবো!আমাকে কিছু একটা করতে হবে!চাকরি!ভালো একটা চাকরি করতে হবে।যে টাকার অভাবে আমার মা শেষ হয়ে গেল,যে মানুষ গুলোর স্বার্থপরতা দেখালো সেই মানুষ গুলোকে উচিত জবাব আর মাকে দেওয়া প্রতিটি আঘাতের দাগ ফিরিয়ে দিতে অন্তত মায়ের জন্যে হলেও আমাকে নিজের পায়ে নিজেকে দাড়াতে হবে!তবে আমি পারবো নিজের পায়ে দাঁড়াতে?পারতে আমাকে হবেই।ইনসাল্লাহ,আমি পারবই!!!

চলবে…